বেলা শেষে পর্ব-০৪

0
1238

#বেলা_শেষে। [০৪]

-আপনি এখানে?? ভূমিকার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্ন শুনে দরজার ওপাশে থাকা লোকটি জবাব দিলো,

-এ্যনি প্রবলেম??

– না, প্রবলেম হবে কেন? আপনার বাড়িতে আপনি আসবেন এটাই তো স্বাভাবিক।

-তাহলে পুলিশের মতো জেরা করছো কেন?? বলেই ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো দিগন্ত। ভূমিকা ভেংচি কেটে দিগন্তকে ব্যঙ্গ করে বলল,

-পুলিশের মতো জেরা করছো কেন?? চোরেরে মতো গভীর রাতে বাড়িতে আসলে তো পুলিশের মতো জেরা করবোই। যত্তসব।

দিগন্তের সাথে এক বিছানায় থাকতে হবে ভাবতেই গা সিউরে উঠছে ভূমিকার। এই তিনটা মাস তো সে তার নিজের ইচ্ছেমত ছিলো। যখন খুশি ঘুমিয়েছে, পড়ছে গান গায়ছে। রুমের অন্যকেও থাকলে নিজের স্বাধীন মতো চলা যায় নাকি। পরাধীনতা মেনে নিতে পারবে না ভূমিকা। তাও আবার দিগন্তের জন্যে তো নয়। যার সাথে তার কোন রকমের সম্পর্ক নেই তার সাথে একই ঘরে একই বিছানায় থাকার প্রশ্নই উঠে। ওদের সম্পর্ক তো শুধু কাগজে কলমে। ফিজিক্যালি ওদের কোন সম্পর্ক নেই। পুরো ঘরে পায়চারি করছে আর ভাবছে।

দিগন্ত ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল দিয়ে মাথার মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বাহিরে আসে। ভূমিকাকে এভাবে পায়চারী করতে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় তার দিকে। ভূমিকা বিরবির করে কিছু বলছে আর পায়চারী করছে। মনে হচ্ছে হাই টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু দিগন্ত ভেবে পায়না ভূমিকার টেনশনের কারন কি? যাই নিয়ে টেনশন করুক তাতে দিগন্তের কি? বিছানার উপর টাওয়াল রেখে ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে চিরুনি দিয়ে মাথার চুল আঁচড়াতে থাকে। তখন ভূমিকা কোমড়ে হাত দিয়ে দিগন্তের পাশে দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে আয়নার দিগন্তের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। আয়নার মধ্যেই দিগন্তের সাথে ভূমিকার চোখাচোখি হয়। তখন ভূমিকা তার দৃষ্টি শক্ত করে ফেলে। দিগন্ত চিরুনি রেখে পিছনে ফিরে তাকায় আর বলে,

-এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার হ্যাঁ।এরকম উদ্ভট আচরণ কেন করছো??

-আপনি কোথায় শুবেন??

ভূমিকার প্রশ্নে তড়িৎগতিতে জবাব দেয় দিগন্ত,
-আমার বিছানায়।

-নাহ। আপনি এ ঘরে থাকতে পারবেন না। আমি কিছুতেই আপনার সাথে এক ঘরে থাকতে পারবো না।

-সেটা তোমার প্রবলেম। বলেই বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দেয় দিগন্ত। আর বলে, তুমি চাইলে ফ্লোরে শুতে পারো। বাট আমার বিছানায় জায়গা পাবে না।

-আরেহ আপনি তো চলে গিয়েছিলেন এখন আবার ফিরে আসলেন কেন? মহা মুশকিলে পরলাম তো। শুনুন?এই যে আপনাকেই বলছি, এমা ঘুমিয়ে পড়ছে। এখন কি করি? বিরক্তি মাখা মুখ করে বসে থাকে ভূমিকা।

সেদিন রাতটা জেগেই কাটিয়েছিল ভূমিকা। ভুলেও একটি বারের জন্যেও দু-চোখের পাতা এক করে নি ভূমিকা। পরের দিন সকালে জানতে পারে ইলেকশনের জন্যে গ্রামে এসেছে দিগন্ত। ইলেকশন শেষ হলে সে আবার চলে যাবে। তারপর থেকে প্রয়োজন ছাড়া কথা হতো না করোরই। দিগন্ত বেশীর ভাগ সময় বাড়ির বাহিরে কাটাতো। সকালে খেয়ে বেড়িয়ে যেত আর অনেক রাতে বাড়ি ফিরতো। রাতে দিগন্ত যখন বাড়ি ফিরতো ততক্ষণে ভূমিকা ঘুমিয়ে যেত।আর সে দিগন্তের রুমেই ফ্লোরে বিছানা পেতে শুতো। এদিকে ভূমিকার এডমিশনের ডেট ও চলে আসছে। ভূমিকা চায় সে ডিগ্রীতে ভর্তি হবে। তারপর ডিগ্রী কম্প্লিট করে এল এল বি করবে। কিন্তুু মাশহুদ তালুকদারের ইচ্ছে ভূমিকা ডিগ্রী নয় অনার্স করুক। তারপর ভালো কোন ইউনিভার্সিটিতে এল এল বি এর জন্যে এডমিশন করিয়ে দিবে। ভূমিকা সেটাই মেনে নেয়।কারন ডিগ্রীর থেকে অনার্স পড়াটা বেশী গুরুত্ব দেয় সবাই। তাই মাশহুদের কথা মতো অনার্সেই এডমিশন নেয় ভূমিকা। সব মিলিয়ে দুই মাস খুবই ব্যস্ততার সাথে কাটে তালুকদার পরিবারের।

এবারও বিপুল ভোটে মাশহুদ তালুকদার গ্রামের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। মাশহুদ তালুকদারের মতো লোককে সবাই পছন্দ করে। একজন নেতা হওয়ার সমস্ত গুনই তার মধ্য বিদ্যমান। নির্বাচন শেষে যেদিন দিগন্ত ঢাকায় চলে আসবে সেইদিন মাশহুদ দিগন্ত আর ভূমিকাকে ডেকে তার ঘরে নিয়ে যায়। খাটের উপর গম্ভীর মুখ করে বসে আছে মাশহুদ। তার সামনেই মাথা নিচুকরে দাড়িয়ে আছে দিগন্ত আর ভূমিকা। দিগন্ত ভাবছে কোন কারনে মাশহুদ তার উপর রেগে আছে। কারন এটা সে ছোট বেলা থেকেই জেনে আসছে। ছোট বেলায় যখন দিগন্ত কোন অন্যায় করতো। তখন তিনি ঠিক এইভাবে গম্ভীর হয়ে বসে থেকে দিগন্তকে শাস্তি দিতেন। মাশহুদ দিগন্তকে খুব কড়া শাসন করতেন। যেটা আজ কালের বাবা মায়েদের মধ্যে নেই। এই জেনারেশনের বাবা মা তাদের সন্তানকে শাসন করার নাম করে তাদের দিগুণ আদরে ভরে দেয়। তাহলে এই সন্তায় বখে গেলে তার দায় তো বাবা মাকেই নিতে হবে তাইনা। মাশহুদ তালুকদারের এক কথা, আমি আমার সন্তানকে ভালবাসি খুব ভালবাসি। তাই আমি চাইনা আমার সন্তান মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে যাক। কারন আমি মানুষ জন্ম দিয়েছি। তাকে মানুষের মতো মানুষকরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বটাও আমাকেই নিতে হবে।

দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা যায়, মাদক ব্যবহারকারীদের মধ্যে দুই- তৃতীয়াংশ হলো তরুণ।পশ্চিমা দেশ গুলোতে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন মাদক ব্যবহারকারী হলো তরুন। আমাদের দেশে মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণীর প্রকৃত সংখ্যা বলা কঠিন। কারণ এ বিষয়ে কোনো জাতীয় পরিসংখ্যান নেই। তবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা যায়, শিশু-কিশোরদের ০.৮ ভাগ মাদকাক্তির সমস্যায় ভুগছে। এটুকু বলা যায়, এ হার বাস্তব অবস্থার খণ্ডচিত্র মাত্র। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী যেকানো বয়সী মাদকাসক্তের এ সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি যাদের শতকারা ৮০ ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরেরে মধ্যে।আর এর প্রধান কারন হলো পারিবারিক শিক্ষা আর সু- শিক্ষার অভাব। যেটা মাশহুদ তালুকদার তার সন্তানকে দিয়েছে।

অপরদিকে ভূমিকা ভয়ে কাঁপছে। মাশহুদ তাদের কি এমন বলবে যে এভাবে আলাদা করে ডেকে আনলো। আচ্ছা বাংলা সিরিয়ালের শ্বশুড় শ্বাশুড়ির মতো তো বলবে না, আমি দাদা দাদু হতে চাই। মুখটা ভেটকালো ভূমিকা। এটা কখনও সম্ভব নয়। সকলের মৌনতা ভেঙে মাশহুদ একটা কাগজ বের করে সেটা ভূমিকার হাতে দিলেন। ভূমিকা কাগজের দিকে লক্ষ না করেই প্রশ্নের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাশহুদের দিকে।

-আমি তোমার কলেজেই ভূমিকাকে ভর্তি করিয়েছি দিগু। এখন থেকে তোমরা এক সাথে থাকবে। মাশহুদের কথা শুনে দুজনেরই চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে মাশহুদের দিকে। ভূমিকা জানতো শহরের নাম করা একটা কলেজে ভর্তি করিয়েছে তাকে। কিন্তু সেখানে দিগন্তও পড়ে এটা জানা ছিলো না ভূমিকার। আর দিগন্ত ভাবছে ভূমিকা ইচ্ছে করেই ওর কলেজে এডমিশন নিয়েছে যাতে ভূমিকা ওর কাছাকাছি থাকতে পারে। শক্ত চোখে ভূমিকার দিকে তাকালো দিগন্ত। ভূমিকা ইনোসেন্ট মুখ করে তাকাতেই দিগন্ত ওর হাত শক্ত করে নিলো।

মাশহুদ দিগন্তের হাতে একটা ফ্ল্যাটের ঠিকানা দিলেন। সেটা ওদের দুজনের থাকার জন্যে কিনেছেন তিনি। তারপর ভূমিকার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-যাও মা, একজন সৎ ও কঠিন উকিল হয়ে গ্রামে ফিরবে।যে মিথ্যের ধমকা হাওয়ায় কখনো ভেঙে পড়বে না। রাবেয়া ভূঁইয়া ছিলেন আমাদের দেশের প্রথম মহিলা আইনজীবী। আর আমাইরা ভূমিকা তালুকদার হবে আমাদের গ্রামের প্রথম আইনজীবী। বলেই অট্ট হাসলেন মাশহুদ। এরপর অনিচ্ছা থাকা সত্বেও ভূমিকাকে নিয়ে ঢাকায় আসতে হয় দিগন্তের।

নিজের ভাবনায় জগৎ থেকে বেড়িয়ে বড় করে শ্বাস ছাড়ে ভূমিকা। ঢাকায় চলে আসছে আজ দুদিন হলো। এখানে এসে দুজনে আলাদা রুম নিয়েছে। দরকার ছাড়া কেও কারো সাথে তেমন কথা বলে না। আজ দিগন্তের বন্ধুরা এসেছিলো তাই ভূমিকা নিজে হাতে ওদের জন্যে রান্না করছিলো। পিছনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে সে। সেখানে দিগন্ত বুকের উপর হাত গুজে শক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

-আ- আপনি কখন এলেন??

-এত কি ভাবছিলে তুমি??

– ক-কই কি- কিছু নাতো।

– কখন থেকে ডাকছি তোমাকে কোন রিসপন্স করছো না। আমি ভাবছি তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছো।

-একদম ফালতু কথা বলবেননা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেও ঘুমায় নাকি।

-কেন ঘোড়া ঘুমায়।

-কিহহহ, আমাকে দেখে কি আপনার ঘোড়া মনে হয়।

-আস্তে এত চেঁচাচ্ছ কেন?? কানে হাত রেখে বলল দিগন্ত। ঘোড়র মত দেখতে না হলেও স্বভাব চরিত্র ঠিক ঘোড়ার মতো। শেষ কথাটা বিরবির করে বললেও সেটা ভূমিকার কান পর্যন্ত পৌছায়।

-আর আপনি, আপনি কি হ্যাঁ। আপনি একটা কুমির কিন্ত আপনার স্বভাব জলহস্তীর মতো। রাগে কটমট করে বলল ভূমিকা

ভূমিকার রাগ দেখে ঠোট চেপে হাসলো দিগন্ত। এই মেয়ে খুবই অদ্ভুত। একটুতেই রেগে যায়। ভূমিকাকে রাগানোর জন্যে দিগন্ত আবার বলল,

-তবে যাই বলো দুটোই কিন্তু পানিতে থাকে। তোমার মতো মানুষ হয়ে ঘোড়ার মতো আচরন করে না

-আপনি, আপনাকে তো আমি, বলেই দিগন্তের পিছনে তাড়া করতে শুরু করলো। আর দিগন্ত ওর সামনে দৌড়াচ্ছে।

চলবে,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে