বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-০৯

0
776

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akther

৯.

রাগে থরথর করে কাঁপছে তনুজার শরীর। মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায় যেন রক্তের প্রদাহ শতগুন বেড়ে গিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে তনুজা। চিৎকার করে জানাতে ইচ্ছে করছে এই শহরের মানুষগুলোকে যে, তার অতি ভরসাস্থল মানুষটার কাছ থেকে জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুঃখটা পেলো। না, না ; তনুজার দুঃখ হচ্ছে না। বরং রুদ্র যে তনুজাকে ধোঁকা দিয়েছে এই ব্যাপারটা সকলের সামনে খোলসা হবার পর থেকে তনুজার পৃথিবী থেকে ভরসা নামক শব্দটা বিলীন হয়ে গিয়েছে।

ড্রইংরুমের সোফায় হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন তাহেরা। তাহেরার কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিচ্ছেন রায়হান আজাদ। ছেলের কান্ড-কর্ম শোনার পর তাহেরা কিছুটা অসুস্থবোধ করছেন। অদূরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। রুদ্রের পাশেই দাঁড়িয়ে মেঘলা। এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনো একদিন হতেই হবে ওরা দু’জন তা খুব ভালো করেই তা জানত। কিন্তু, এত দ্রুত সবার সামনে ব্যাপারটা চলে আসবে রুদ্র কিংবা মেঘলা কেউই ভাবেনি।

তাহেরার পাশে রায়হান। রুদ্রের পাশে মেঘলা। সবার কাছে কেউ তো একজন আছে যে কিনা জীবনের উত্থান-পতনের সময় পাশে থাকবে। কিন্তু, তনুজা? ওর পাশে তো কেউ নেই। ভিটেমাটিহীন মানুষের মতো বসে আছে নীচে। চোখের কোণে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। মাঝে মাঝে কান্নার দমকে হিচকি তুলছে।

রুদ্রের নজর তনুজার মাঝে নিবদ্ধ। কান্নারত তনুজাকে দেখে রুদ্রের হৃদয়ে কে যেন ছুরিকাঘাত করছে। অদৃশ্য রক্তেরা গলগলিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে হৃদয় থেকে।

তনুজা ওঠে দাঁড়ায়। চোখের পানি ওড়নার কোণা দিয়ে মুছে ফেললো। ততক্ষণে সবার দৃষ্টি তনুজার ওপর চলে এসেছে। রুদ্র বোবার মতো তাকিয়ে আছে তনুজার মুখের দিকে। বুক ভেঙে আসছে। তনুজার এমন রুপ আরও একবার রুদ্র দেখেছে। যেদিন রুদ্র তনুজার ওপর থেকে ভালোবাসার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছিল। তনুজার এমন রুপ রুদ্র আর কখনোই দেখতে চায়নি। কিন্তু, বিধাতা যেন অন্য কিছুর পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।

— মামাজান, আমি জানতাম না উনি বিবাহিত। নানীজান কিংবা বড়ো মামীজান আমাকে ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেননি যে উনি বিবাহিত।

কথাটি বলে ফের চোখের জল মুছতে ব্যস্ত হয়ে পর তনুজা। তনুজার কথা শুনে তাহেরা, রায়হান অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুদ্রের পানে। রুদ্র তখন নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে সে? যা সত্য তাই তো বলছে তনুজা।

রায়হান তাহেরার কাছ থেকে সরে এলেন। ধীর পায়ে হেঁটে তনুজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাঁপাকাঁপা হাতে অতি স্নেহ-মমতার সহিত তনুজার মাথায় হাত রাখলেন। পিতৃতুল্য মামার হাত নিজের মাথার ওপর পরার পর তনুজা যেন আপন কারো সংস্পর্শে এসে মনটা আরও ভেঙে পরলো। উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলো। তনুজার কান্না দেখে উপস্থিত সকলেই মাথা নত করে ফেললো লজ্জায়।

তনুজা কাঁদতে কাঁদতে তার মামার হাত ধরে বলছে,

—মামা, আমি কখনো চায়নি অতীত হয়ে যাওয়া সেই মূহুর্ত আমার জীবনে আরও একবার ফিরে আসুক। কিন্তু, আপনার ছেলে হুট করে আমার জীবনে এসে সবটা উলটপালট করে ফেলেছে। কি এমন অপরাধ ছিল আমার? কেউ বলতে পারবে কেন আমার সাথে এমনটা হয়?

ভাগ্নির কান্না সহ্য করতে পারছেন না রায়হান। তাই তো তনুজার ধরে থাকা হাতের ওপর হাত রেখে তনুজাকে শান্ত গলায় বললো,

— যা হবার তা তো হয়ে গেছে। চাইলে বদলানো সম্ভব। তাই আমি বলছিলাম কি আগে তুই শান্ত হ। তারপর, ভেবে দেখব কি করা যায়? আর এমন ঘটনা ঘটানোর মূল কারনটা কি?

শেষের কথাটি রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন রায়হান।

— এই মেয়ে আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না। ওকে এই মূহুর্তে আমার বাড়ি থেকে বের করেন।

তাহেরা পাগলের মতো প্রলেপ গাইতে শুরু করলেন। একসময় রায়হান বিরক্ত হয়ে নিজের স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বললেন,

— তোমার ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রী। চাইলেও তুমি বা আমি ওকে এই বাড়ি থেকে কেন রুদ্রের জীবন থেকেও বের করতে পারব না। অতএব, তুমি তোমার ওই বিষাক্ত কন্ঠে আর কিছু বলো না।

তাহেরা রেগেমেগে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। রুদ্র এবং মেঘলা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। রায়হান রুদ্রের উদ্দেশ্য বিরক্তিসূচক কন্ঠে ছুড়ে দিলেন,

— মেঘলাকে নিয়ে নিজের ঘরে যাও।

— কিন্তু, তনুজা??

এতসময় পর রুদ্রের মুখ দিয়ে কথা বের হলো।

— তনুজার চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। আমি ওর মামাজান এখনো জীবিত আছি।

— কিন্তু, বাবা?

— আমি তোমাদের বলেছি এখান থেকে চলে যেতে। ব্যস, চলে যাবে তোমরা।

রায়হানের রাগান্বিত দৃষ্টি এবং দৃঢ়তা দেখে রুদ্র আর কিছু না বলে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে। যায়। মেঘলা ভারী শরীর নিয়ে রুদ্রের পেছনে ছুটে।

ওদের দুজনের চলে যাওয়ার দৃশ্য ততক্ষণ অব্দি দেখতে থাকে যতক্ষণ অব্দি তনুজার দৃষ্টি সীমানা পর্যন্ত ওদের দেখা মিলেছে। একসময় ওরা আড়াল হয়ে যায় তনুজার দৃষ্টির সীমানা থেকে। বাঁধ ভেঙে চোখেরজল নেমে আসে। নিজেকে এতটা অসহায় আগে কখনো ভাবেনি তনুজা। রুদ্রের জীবনের দ্বিতীয় নারী তনুজা! কথাটি মস্তিষ্কে আসা মাত্র তনুজার মনে হচ্ছে ও পাগল হয়ে যাবে । মেঘলা! সে কি করে এতটা শান্ত হয়ে আছে! নিজের স্বামী অন্য এক নারীকে বিয়ে করেছে জেনেও কেউ এতটা স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে!

ভাগ্য ভালো যে রুদ্রের মা তখন তনুজার সামনে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন ,

— মেঘলাকে বৌ হিসেবে পেয়েছিস এটাই তোর সাতজনমের ভাগ্য। নয়তো, কোন স্বামী তার গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে বারবার বাংলাদেশে ছুটে যায়।

তাহেরা এতটুকু কথা তনুজাকে শুনিয়ে শুনিয়ে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু,কে জানত এই একটি কথার রেষ ধরে তনুজার জীবনে নেমে আসবে কালবৈশাখির ঝড়।

রায়হান তনুজার হাত ধরে নিয়ে গেলেন এই বাড়িতে মেহমানের জ্ন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায়। তনুজাকে খাটের ওপর বসিয়ে নানানভাবে বুঝিয়ে বললেন, তনুজা যা চাইবে তাই করবেন রায়হান। তবু্ও, যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করে।

তনুজা সেই যে বসেছে এখনো সেই একিভাবে বসে আছে। ওকে দেখলে মনে হবে নির্জীব কোনো শরীর। যার দেহে প্রাণ অবশিষ্ট নেই। জীবন নিয়ে তার কোনো আয়োজন নেই।

তনুজাকে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন রায়হান। নিজের মাকে একটিবার কল দিয়ে জানার দরকার কবে, কখন এই বিয়েটা হলো? আর তিনিই বা কেন জানালেন না?

চারপাশে প্রচুর মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ, এখন ফেরি রওনা হবে তিলাফুসি নামক আয়ল্যান্ডের উদ্দেশ্য। ভারুনুলা রালহুগান্ধু ফেরির ওখানে আছে রুদ্র এবং মেঘলা।

দুপুরের তীব্র দাবদাহে চামড়া যেন চামড়া পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তবে রুদ্রের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে রৌদ্রের তাপ এখন ওর কাছে কিছুই নয়। গভীর কোনো চিন্তায় পড়ে আছে সে। মেঘলা নিজেকে অপরাধী ভাবছে। যা কিছু হচ্ছে সবটাই মেঘলার জন্য। রুদ্রের বিষন্নতা, দীর্ঘশ্বাস, একাকিত্ব বোধ, অপরাধবোধ সবটা দেখার পর মেঘলার মনে এখন অপরাধবোধ স্পষ্ট।

— জানিস, মেঘলা আমার বুকটা কেমন যেন করছে? কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পরছে আমার হৃদপিণ্ড। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমি জানতাম যেদিন আমার তনুজা জানতে পারবে সে আমার জীবনের দ্বিতীয়া সেদিন ও জীবনের সবচেয়ে বড়ো ধাক্কাটা পাবে। আজ সে পেয়েছে। এবং আজকের পর থেকে হয়তো ওর হৃদয়ে আমার জন্য যতটুকু ভালোবাসা অবিশিষ্ট ছিল আজ তা হারিয়ে গেছে। আমার তনুজা আজ ফের ভেঙে পরেছে। গতবার ভেঙে পরার পর হয়তো উঠে দাঁড়াতে পেরেছে। কিন্তু, এবার আর দাঁড়াতে পারবে না। কারণ, আমি যে ওর উঠে দাঁড়াবার স্থানটুকু নিজের হাতে ভেঙে ফেলেছি।

রুদ্রের চোখে পানি নেই। কিন্তু, কন্ঠ থেকে নির্গত প্রত্যেকটি শব্দের সঙ্গে রুদ্রের সকল বেদনা বের হয়ে আসছে।

মেঘলা রুদ্রের কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে ফেললো। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে রুদ্রকে বললো,

— কিন্তু, তুমি যা কিছু করছো সবটাই কিন্তু তনুজার ভালোর জন্য। সময় এলে তনুজা আপনাআপনি টের পাবে।

— কিন্তু, সেই সময় আসার আগেই যদি তনুজা হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে? তখন আমার কি হবে, মেঘলা?

মেঘলার উত্তর দেয় না। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রয় রুদ্রের পানে। এই দুচোখে শুধু তনুজার জন্য ভালোবাসা এবং তনুজাকে হারানোর ভয় দুটোই দেখতে পায় মেঘলা। মাঝেমাঝে প্রচুর ঈর্ষা হয়। কেন রুদ্র তনুজাকে এত ভালোবাসে? মেঘলাকে একটু ভালোবাসা ভিক্ষে দিলে কি হতো রুদ্রের?

দু’জনেই নিশ্চুপ। কি বলার আছে? মনে মনে তখন হাজারো প্রশ্ন, উৎকন্ঠা। এমনসময় রুদ্রের ফোন বেজে উঠে। রুদ্রে বিষন্ন মনে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,

—- তনুজা সুইসাইড এটেম্পেড করেছে। আজমী নাঈম মেডিকেল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চলে এসো।

রুদ্রের হাত অবশ হয়ে আসে একসময় মোবাইলটা হাত থেকে পরে চূর্নবিচূর্ণ হয়ে যায়। মেঘলা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে তাকিয়ে আছে রুদ্রের মুখের দিকে উত্তরের আশায়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে