বিবর্ণ ভালোবাসা পর্ব-১৪

0
911

#বিবর্ণ ভালোবাসা
#Tahmina_Akhter

১৪.

— আমাদের মেয়েকে দেখবে না তনুজা?

যান্ত্রিক গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে রুদ্র। এমন প্রশ্ন শুনে তনুজার ভীষণ রাগ করার কথা। কিন্তু, কেন যেন তনুজার রাগ হলো না। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি।

— তনুজা??? এই তনুজা???

তনুজা রুদ্রের ডাকে সাড়া দেয় না। রুদ্র মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে নিজের কোলে থাকা ছোট্ট মনুষ্য পুতুলকে। ছোট্ট চোখ জোড়া, ছোট নাক আর রক্তাভ ঠোঁট, ছোট ছোট হাত-পা গুটিয়ে কি করে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে!

তনুজা এমন দৃশ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে ফোসফাস করছে। কিন্তু, রুদ্রের মুখ থেকে শেষের কথাটি শুনে তনুজা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয় রুদ্রের মুখের দিকে।

— জানো তনুজা আমার কোলে থাকা এই পুতুলটা না পৃথিবীর আলো টুকু দেখতে পায়নি। অন্ধকার জগত থেকে এসেও ফের ওর অস্তিত্ব অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়ে গেছে আমার তনুজাকে মা বানানোর স্বপ্ন। শত আশা আজ ভেঙেচুরে গিয়েছে। আমার তনুজা কোনোদিন মা ডাক শুনতে পাবে না।

তনুজার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। রুদ্র কি বলছে তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না । তাই তো কাঁপা কাঁপা গলায় তনুজা রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি বলছেন আপনি এসব? আমাকে মা বানানোর স্বপ্ন ভেঙেচুরে যাবে কেন? আপনার প্রথম স্ত্রীর সন্তান মারা গেছে তারমানে এই না যে আমিও এই সন্তানের মা।

তনুজার কথা শুনে পাগলের ন্যায় উচ্চস্বরে হাসতে থাকে রুদ্র। রুদ্রের এমন আচরণ দেখে তনুজা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রুদ্র নিজের হাসি বন্ধ করে তনুজার সামনে গিয়ে মৃত বাচ্চাটাকে তনুজার কোলে আলতোভাবে রেখে দেয়। তনুজা বাচ্চাটির গায়ের শীতলতা অনুভব করতে পারছে। মিশ্র এক অনুভূতি তনুজার হৃদয় থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে।

কি শীতল এই ছোট্ট দেহখানা! বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে তনুজার চোখের দৃষ্টি স্থীর হয়ে আছে। রুদ্র পাগলের মতো নিজের চুলগুলো টানছে। কি থেকে কি হয়ে গেল কিছুই মাথায় ঢুকছে না রুদ্রের! রুদ্রের এমন পাগলপ্রায় অবস্থা দেখে তনুজা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মনের মাঝে তখন বিভিন্ন প্রশ্নের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। না জানা অব্দি শান্তি পাবে না হয়তো তনুজা। তাই তো মনের রাগকে এককোনায় রেখে তনুজা শীতল কণ্ঠে রুদ্রকে প্রশ্ন করে,

— আপনি এমন করছেন কেন? বলুন না আমাকে?

তনুজার শীতল কণ্ঠ শুনে রুদ্র স্থীর হয়। হৃদয়কে প্রশান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টাটুকু করে দীর্ঘ শ্বাস চেপে বললো,

— শুধুমাত্র তুমি সন্তান দানে অক্ষম দেখে সেদিন আমার মা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল।

কথাটি বর্জ্যঘাতের ন্যায় তনুজার মাথার ওপর পরলো। রুদ্রের বলা একটা শব্দ বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। তবুও, মন বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে এই ভেবে যে, শুধুমাত্র ওর অক্ষমতার জের ধরে হয়তো ওর বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল। যার দরুন ওর মা এই দুঃখ টুকু সামাল দিতে না পেরে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায় পরকালে। কিন্তু, সেদিন মা কেন বললো না যে, তনুজা তুই মা হতে পারবি না দেখে তোর বিয়েটা ভেঙে গিয়েছে। সেদিন যদি একটিবার ওর মা বলতো তবে তনুজার মনে আজ যতটা আঘাত লেগেছে কথাটি শুনে তখন তার চেয়েও শতগুণ আঘাত কম পেতো সে ।

তনুজার হৃদয়ে আজ অদৃশ্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিন্তু, দেখার মতো কেউ নেই। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেই-বা দেখতে পারে! চোখের জল শুকিয়ে গেছে তাই তো বেরুবার নাম নেই। শক্ত পাথরের ন্যায় বসে আছে মৃত বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে। তনুজাকে দেখে মনে হচ্ছে জগতে ওর চেয়ে দুঃখী, নিঃস্ব বোধহয় আর কেউই নেই।

কিছুটা সময় ব্যয় করে তনুজা নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বললো,

— আমার অক্ষমতা জেনেও তবে কেন আপনি বিবাহিত হবার পরও আমাকে বিয়ে করতে গেলেন? তাও আবার সবটা গোপন রেখে? আজ আমি সবটা জানতে চাই।

তনুজা একপ্রকার চিৎকার দিয়ে কথাটি বলে। তনুজার এমন আচরণ এবং প্রশ্ন শুনে রুদ্র নড়েচড়ে বসে সবটা জানানোর সিদ্ধান্ত নেই। আজ যদি না জানাতে পারে তবে আর কোনোদিনও জানাতে পারবে না।

— মা তোমাকে দেখতে চাওয়ার বাহানায় আমাদের কাউকে না জানিয়ে চলে যায় তোমাদের গ্রামে। গ্রামের মানুষ মাকে চিনতে পারছিল না দেখে পরিচয় জানতে চায়। মা নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে তোমার কথা এবং ফুপির কথা বললে। উনারা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলেছিল, তুমি নাকি কোনোদিনও মা হতে পারবে না কারণ ছোট্ট বেলা তোমার কোন সমস্যা কারণেই নাকি তোমার জরায়ু কেটে ফেলা দেয়া হয়।

এতটুকু অব্দি বলে রুদ্র চুপ হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে কারণ এরপরের ঘটনার জন্য রুদ্র কিংবা তনুজা কেউই দায়ী ছিল না। তবুও দুজনে একই কষ্টে দিনের পর দিন জর্জড়িত হয়েছে। তনুজা নির্বাক শ্রোতা হিসেবে সবটা শুনছে। রুদ্রকে চুপ হয়ে যেতে দেখেই তনুজা এবার বললো,

— সবটা শুনে ছোট মামি আপনার সঙ্গে আমার বিয়েটা ভেঙে দিলেন। কষ্ট পায়নি সেদিন যখন শুনেছিলাম আমি আপনার স্ত্রী হতে পারব না। কষ্ট তখন পেয়েছিলাম যখন আপনার মায়ের বেপরোয়া ব্যবহার দেখে আমার মায়ের দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরেছিল। আমার মা সেই রাতটা কেঁদে কাটিয়েছে একটিবারের জন্যেও আমাকে বুঝতে দেয়নি আমার অক্ষমতার কারণেই এই বিয়েটা ভেঙে গেছে। মা মারা গেল সেই সাথে আমার অক্ষমতার খবরটি হারিয়ে গেছে কালগর্ভে।

তনুজার চোখ দিয়ে এবার জল নেমেছে। এতদিনের মনের মাঝে কষ্ট পুষে রাখার কারণ উদঘাটন হবার পর আজ চোখের জল ফেলে নিজেকে হালকা করার বৃথা চেষ্টা চলছে। রুদ্র তনুজার কান্না দেখে নিজেকে ধাতস্থ করতে না পেরে তনুজার মাথাটা নিজের বুকে মাঝে চেপে ধরলো। ভরসাস্থল জায়গায় মাথা গুঁজতে পেরে যেন তনুজার কান্নার মাত্রা বহুগুণ বেড়ে ওঠে। রুদ্র তনুজাকে বাঁধা দেয় না কারণ আজ দুঃখকে বুকের মাঝ থেকে বের করে আনতে হবে নয়তো তনুজা নামক শক্ত মানবী কখনোই বের করে আনতে চাইবে না, নিজের চোখের জল অন্য কেউ দেখুক তাও চাইবে না।

সময় অতিক্রম হয় একসময় ঘড়ির ঢংঢং শব্দে জানান দেয় সময় তখন সকাল আটটা বাজে। তনুজা রুদ্রের বুকে থেকে মাথা উঁচু করে নিজের কোলে থাকা বাচ্চাটির গালে আলতোভাবে ধরে বললো,

— মেঘলা আপু কেমন আছে?

মেঘলার নামটি শুনে রুদ্রের চেহারায় কালো মেঘের ঘনঘটা ছেয়ে যায়। মুখটা অন্ধকার করে তনুজার হাত ধরে বললো,

— চলো মেঘলার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে নিয়ে আসি।

তনুজা একহাতে বাচ্চাটিকে বুকে চেপে ধরে অন্যহাত তখন রুদ্রের বন্দি। রুদ্রের পেছনে পেছনে তখন তনুজা রওনা হয় মেঘলাকে দেখার উদ্দেশ্য। একটিবার খালি মেঘলার সঙ্গে দেখা হোক তনুজার সবটা জানতে চাইবে। কেন এতকিছু করেছে ওরা দুজনে মিলে? খুব কি প্রয়োজন ছিল রুদ্র আর মেঘলার মাঝে তনুজাকে প্রবেশ করানোর? সুখের সংসারে কে নিজ হাতে আগুন ধরায়?

————————————

হসপিটালের সাদা বেডে অসাড় হয়ে শয়নরত অবস্থায় আছে মেঘলা। দুচোখের পাতায় যেন পুরো রাজ্যের ক্লান্তি ছেয়ে আছে। এসির হিমশীতল হাওয়ার মাঝে থেকেও দরদর করে ঘামছে। জীবনের অন্তিম মূহুর্তের দাঁড়গড়ায় এসে পৌঁছেছে। তবুও, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসি টুকু দেখলে যে কেউ বিভ্রান্ত হতে বাধ্য হবে যে, মেঘলা হয়তো তাদের মাঝেই থাকবে, কোথাও হারিয়ে যাবে না ।

মেঘলার বেডের পাশের ছোট্ট টুলে বসে মেঘলার ডানহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে রুদ্র। অদূরেই মেঘলার সদ্য জন্মানো ছোট্ট ফুটফুটে মৃত মেয়েটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনুজা। তনুজার মনের আসন্ন ঝড় নিমেষে উধাও হয়ে যায় মেঘলার অসহায় মুখখানা দেখে। হাসোচ্ছ্বল মানুষটা হুট করে যেমন গম্ভীর হয়ে গেলে পরিবেশে গুমোট ধারণ করে ঠিক তেমনটাই অনুভব করছে তনুজা।

বহু কষ্টে হাতের ইশারায় তনুজাকে কাছে ডাকলো মেঘলা। তনুজা মেঘলার ডাককে উপেক্ষা করতে পারল না। তড়িঘড়ি করে মেঘলার বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তনুজাকে দেখে রুদ্র টুল ছেড়ে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মেঘলা কোনোমতে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,

— আল্লাহর কাছে এবং রুদ্রের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম আমি। কিন্তু ওয়াদা আর রাখতে পারলাম কই? মেয়েটা পৃথিবীতে এসেও আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে গেছে। তনুজা তোকে মা ডাক শোনাতে আমি ব্যর্থ হলাম রে..

তনুজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় মেঘলার দিকে। মেঘলা কি বলছে তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মেঘলা কেন ওকে বাচ্চা দিতে যাবে? যেখানে রুদ্র এবং মেঘলার সুখের সংসার !

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে