বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০২

0
2331

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০২

–তুই সত্যিই আমার বোনের বিয়েতে যাচ্ছিস তো?

সাদু কিছুটা সন্দেহ করার মতো ভাব নিয়ে বলল।

–মানে?(আমি)

–তুই যেভাবে নিজেরে প্যাকেট করলি মানে বোরকা, হাত মুজা, পা মুজা পরলি মনে তো হচ্ছে আজকেই হজে চলে যাবি।(সাদু)

–ওই খারাপ লোকটা আবারো আসলে?(আমি)

–আরে ধুর ওই ব্যাডার তো খাইয়া দাইয়া কাম নাই।এতো দিন তোমারে ধরে নাই আর কালকে আইসা একেবারে জড়াইয়া ধরলো তাও আবার কই?ওয়াশরুমে!!!(সাদু)

সাদু আমাকে আবারও বলল,,,

–হয়তো তোর মনের ভুল। আচ্ছা একটা কথা বলবি?

— কী?(আমি)

— k-drama কি বেশি দেখছ ইদানিং? (সাদু)

–না বোইন। তোর মতো আমারে রাণু মন্ডলের ফাগলে গুতা মারে নাই।(আমি)

–ওহহ।তাহলে নিশ্চয়ই C-drama দেখছ।তাই না?(সাদু)

–ধুর কি শুরু করলি? ওই সব খচ্চর মার্কা ড্রামা তুই ই দেখ বইসা বইসা।(আমি)

–বাট তুই আর যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো কিন্তু তোর এক্স জামাই আইসা যে তোরে জরাইয়া ধরছে এই কথা বিশ্বাস করতে পারবো না।আর এই টপিক এখানেই শেষ।(সাদু)

হ্যাঁ।গত কালকে আমি ওনাকে দেখেছিলাম।ওটা জায়েফ ই ছিলো।ওখানে নাকি আমি সেন্স হাড়িয়ে ফেলেছিলাম। ওয়াশরুম এর দরজার কাছে নাকি পড়েছিলাম।আমাকে আমার বাসায় সাদু নিয়ে আসে।আর আজ একপ্রকার ভয় পেয়েই বোরকা পরে বিয়েতে যাচ্ছি।সে কেনো এসেছিলো আমি জানিনা।আর না জানত চাই। শুধু তার থেকে দূরে থাকতে চাই।

যেকোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আমি আবার এক্সাইটেড একটু বেশি ই থাকি।কোনো দাওয়াত ই আমি মিস করতাম না আগে।আমি আর সাদু আগে ঘুরতেও যেতাম এক এক জায়গায়। সাথে রাফিদা আপু থাকতো।মাঝে মাঝে সার্থক ভাইয়াও থাকতো।

আমার ডিভোর্স এর পরে এই প্রথম বার আমি আর সাদু একসাথে কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। বাইরে ও আগের মতো যেতাম না।সাদু প্রায়ই বলতো চল ঘুড়ে আসি এই করি ওই করি কিন্তু আমার ওই সময় বাসায় থাকতেই ভালো লাগতো বেশি।বাসায় কাজ বেশি থাকতো না।আমি আর বাবা।কাজ শেষ করে সময় পেলে বারান্দায় বসে থাকতাম।বাবার সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না।এখনো কথা কম বলি তার সাথে। কেমন যেনো একটা অভিমান কাজ করে।মাঝে মাঝে সাদু বাসায় এসে আমার সাথে গল্প করে যেতো।

হঠাৎ চলন্ত অবস্থা থেকে সব কিছু স্থির হয়ে যাওয়াতে আমার ভাবনার সুতোঁ কাটলো।আমরা বিয়ের সেন্টারে এসে পরেছি।কাল যেটা ছিল আজো সেটাই। শুধু ডেকোরেশনটা আলাদা। ভালোই বুঝতে পারছি যে কালো বোরকা পড়ে আসাতে সবাই এমন ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করছে মনে হচ্ছে আমি চাঁদের দেশ থেকে নেমে এসেছি।

এখানে সাদুর কাজিন সার্কেল এর সাথে ভালোই মিশে গিয়েছি।ওর একটা মামাতো ভাই আছে সাদমান ভাই।সে ঢাকার একটা ভার্সিটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় আছে।লোকটা অনেক হাসাতে পারে।সাদু কে সে পছন্দ করে।তবে তা অপ্রকাশিত এখনো।অনেক খেয়াল রাখে সাদুর।আগে কেবল সাদুর মুখে শুনেছিলাম।কাল নিজ চোখে দেখা হয়ে গেছে।সাদুর কাজিনগুলোর মধ্যে ছেলেমেয়ে সবাই আমরা সমবয়সি, ২-৩বছর এর ছোট বড় হবো।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে রাফিদা আপুকে এখন বিদায় দেয়ার পালা।সবাই কান্না করছে।সাদু তো আপুকে জড়িয়ে ধরে সেইযে কান্না শুরু করেছে থামার নামই নেই।আমারও কিছুটা খারাপ লাগছে।গেট এর কাছে একপ্রকার নিউমার্কেটের ভিড় জমে গেছে।হঠাৎ আমার কানের কাছে এক পরিচিত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,,,

–বাহ জুইঁফুল!কালকের গাল ধরে টেনে ধরা তাহলে কাজে দিয়েছে।কিন্তু তুমি ভাবলে কি করে এমন ভাবে নিজেকে কয় গজ কাপড়ে আবদ্ধ করলেই আমি তোমাকে চিনতে পারবো না।

তড়িৎ গতিতে আমি পিছনে তাকালাম।কালো পাঞ্জাবি পরে মুখে সাদা মাস্ক আর চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে জায়েফ দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কিছুটা ভীতু রূপে বলে উঠলাম,,,

–আপনি?

সাথে সাথে তাকে ভিড়ের মাঝে হাড়িয়ে ফেললাম। তাকে দেখে আমি নিজেই আশ্চর্য হলাম।তার মাথার চুল অনেক বড় বড় হয়েগেছে।এতটা বড় যাতে একটা পনিটেল করা যাবে।মুখে তার চাপ দাঁড়ির ঘনত্ব বেড়েছে।

তাড়াতাড়ি করে আর কিছু না ভেবে বাসায় এসে পড়লাম।মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছি না। বাসায় আসতে আসতে এরমধ্যে সাদু কল করেছে ৭বার।ওর কল ধরি নি ইচ্ছে করে।কেনো যেনো খুব ভয় করছে।এক অজানা আতঙ্ক আমায় চেপে ধরেছে।তাকে দেখার পর একটা চাপা কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্নাটা ছেড়ে দিয়ে বসে বসে ইচ্ছে মতো কান্না করলাম। আজ আমার কান্নার কারণ কী নিজেও জানি না।বিছানায় এসে ফুল স্প্রীডে ফ্যানটা ছেড়ে শুয়ে পড়লাম রাত এখন ১১ টা।যখন চোখে আধো আধো ঘুম এসে পড়েছে আমার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তা টের পেয়েছি।ফ্যান এর স্প্রীডও কমানো বুঝতে পেরেছি। এটা আমার বাবা।আমি জানি সে প্রতিদিন এসে এভাবে আমাকে দেখে যায়।

সকালে ফজর এর নামাজ পরতে পারিনি। ঘুমিয়েছিলাম বলে টের পাই নি।কাল এলার্ম টাও দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।সকালে সব সময়ই এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে।সেটা নামাজ এর জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণে। উপন্যাসের চরিত্রে মতো আমার কোনো কালেই পাখির কিচিরমিচির কিংবা আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে না।

বাবার রুমে চা দিয়ে এসে নিজে এক কাপ চা খেলাম।সকালে শহরে আমার জানা মতে হয়তো খুব কম লোকজন আছে যারা ভাড়ি খাবারে অভ্যস্ত।আমি সকালে চা বিস্কুটে অভ্যস্ত।আমার বাবাও তাই।

একটু পরে কমলা চাচি আসলো।সে আসলে আমি ছোট থাকতেই আমাদের বাসার কাজ করে দেয়।বয়স তার ৫০ – ৫৫ হবে তবে এখনো হাজার কাজ সে এক সাথে করতে পারে।অনেক টা রসিক টাইপের সে।কিন্তু আমাকে সবসময় ভালো উপদেশ দেয়।কীভাবে যেন আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন টাও বুঝেন তিনি।তাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি।ছেলেমেয়ে নেই তার।বলতে গেলে মেয়ের মতো দেখেন আমাকে।আমিও তাকে মায়ের মতোই ভাবি।আমার প্রথম পিরিয়ড এর সময় আমার এই মা টা আমার পাশে ছিলেন। আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।আমার এই কমলা মা নাকি টেন পর্যন্ত পড়া লেখা করেছে।সে বর্তমানে একটা বাচ্চাদের ডে-কেয়ারে হাফবেলা চাকরি করেন।আর কিছুটা সময় আমাদের বাসার আর তার বাসার কাজ করেন।তাকে বলে ছিলাম তোমাকে কাজ করা লাগবে না।আমাকে এসে কেবল দেখে যেও।কিন্তু কে শোনে কার কথা।সে এসে হাতের কাছে যেই কাজ পায় তাই করে দিয়ে যায়।

দুপুরে শাওয়ার নিতে ঢুকেছি এমন সময় মনে হচ্ছিলো কেউ ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে। পানির আওয়াজে শুনতে পাচ্ছি না ঠিক কি বলছে।সব কল বন্ধ করে বুঝতে পারলাম সাদু এসেছে।ওকে বললাম,,,

— কি এই ঠাডা পরা গরমে তোর আবার কি চাই?

ও বললো,,,

— শাওয়ারে বসেও যদি তোর গরম লাগে তাইলে আমার কি হবে?বের হ এখন।

আমি বললাম,,,

–আমি কি এমনেই বের হইতে পারবো নাকি।যা বসে বসে মদ খা আর মানুষ হ।আমি একটু গোসল করি।যা তো!

–তুই বের হবি নাকি আমি এখানেই হিসু করে দিবো।(সাদু)

–ওই তোর বাসায় বাথরুম নাই? তুই চোইদ্দো মাইল হাইট্টা আইছোস আমার বাসায় মুততে।(আমি)

–রাস্তায় আসার সময় হাফ লিটার এর সেভেন আপ খাইছিলাম।(সাদু)

— নিজের টাকায় তো মনে হয় না খাইছোস।(আমি)

সাদু চিৎকার করে বলল।

–তুই বাইর হবি?

আমি বললাম,,,

–বেশি ধরছে বাবু?

–হ।বাইর হ তুই।(সাদু)

–আমার বাপের টায় যা।(আমি)

–না। আঙ্কেল এর টায় যাইতে কেমন জানি লাগতেছে।(সাদু)

–তাইলে আর কি করবি বইসা থাক(আমি)

–জুইঁইইই!!!(সাদু)

–চিল্লাস কে?এক কাজ কর আমার খাটের নীচে আমার নেংটু কালের হিসুর পট আসে।তোর মনে নাই?ওই যে নীল রঙের।যা ওই টায় যাইয়া বইসা পর।(আমি)

–একবার খালি বের হ তুই।তোরে আমি দেখাইয়া ছাড়বো।(সাদু)

–থাক তোর টা দেখবো না।আমি দেখলে তোর জামাই কি দেখবো?৫ মিনিট দাড়া তুই। আমি ১০ মিনিটে বের হইতাছি।(আমি)

আমি বের হতেই তড়িৎ গতিতে সাদু ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেলো।আমি বারান্দায় জামাকাপড় গুলো রোদে দিয়ে এসে রুমে সাদুকে বসে থাকতে দেখে বললাম,,,

–এমন জোড়ে দৌড় দিলি ডায়াবেটিস এর রোগীরাও তো এমনে দৌড় দেয় না।

–চুপ থাক।তোর সাথে কথা নাই।কালকে তুই হুট কইরা আইসা পরলি কেন?কতবার কল দিলাম। মোবাইল কি চান্দের দেশে থুইয়া দেছ?(সাদু)

ওর কথা শুনে কালকের কথা মনে পরতেই চুপচাপ বারান্দায় চলে আসলাম।আমার বারান্দার সাথে পাশের বাসার বারান্দার দূরত্ব এক হাতেরও কম।বারান্দার সামনের দিকে দৃষ্টি রাখলে একটা ছোট বিলের মতো চোখে পড়ে।এটা আসলে পিছনের সাইড।তাই কোনো রাস্তা ঘাট নেই এদিকে।বিলটার পাশ ঘেঁষেই এই ৬ তলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে।আমরা এই ভাড়া বাড়িটির ৩ তলাতে থাকি।

আমার পাশে সাদু এসে দাঁড়ালো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,,,

–কি হয়েছে রে?

আমার মন খারাপের সময় এই মেয়েটার মুখে শুদ্ধ ভাষার বুলি ফোটে।আমি বললাম,,,

–বললে তো বিশ্বাস করবি না। লাভ কি বলে?

–অতীতের কথা মনে করে মন খারাপ করছিস?(সাদু)

–অতীত যদি বার বার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে, মন খারাপ কি হবে না?(আমি)

–তুই কি আবারও কিছু দেখেছিস?(সাদু)

ওকে সব খুলে বললাম। সব শুনে ও বলল,,,

–এখন নবাবজাদা তোকে চিনতে আসছে কে?২বছর আগে কি করছিলো?

–তাকেই যেয়ে জিজ্ঞেস কর।(আমি)

সাদু আমাকে ওর বোনের রিসিপশনের জন্যে নিতে এসেছিল। আমার মনের এমন অবস্থা দেখে আর জোড়াজুড়ি করে নি।

এইভাবেই একসপ্তাহ চলে গেলো।কয়দিন পর আমার এইচএসসি এর রেজাল্ট দিবে।একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম ঘুম তখনো কাটেনি।আমার এই একটা বাজে অভ্যাস।ঘুম থেকে উঠে কোনো দিনই সাথে সাথে ফ্রেশ হতে যাই না।এই রুম ওই রুম হাটা হাটি করে ঘুম টা কাটলে তার পর ফ্রেশ হতে যাই।সোফায় বসে থেকেই পাশে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যতম বস্তু আমার সামনে।

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে