বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৩

0
2062

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৩

–বাবাআআ,কমলা আন্টিইই!!!

এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বাবার রুমে দৌড়ে চলে আসলাম।আমার চিৎকারে সোফায় বসে আরাম করে যে লোকটা পায়ের উপর পা তুলে স্মোক করছিল তার এক হাতে থাকা মোবাইল ফোন টা ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে। আমার ডাকে বাবাও শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে আসলেন।৷ হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন,,,

–কি হয়েছে জুইঁ?ভয় পেয়েছিস?

আমি বললাম,,,

–বাবা ওই লোকটা!ওই লোকটা!

–কে?(বাবা)

–তুমি ড্রইং রুমে চলো।তাড়াতাড়ি চলো।(আমি)

বাবাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে দেখি টিভি ছেড়ে টি টেবিলের উপর দুই পা তুলে আরাম করে লোকটা টিভি দেখছে।বাবা উচু কন্ঠে বলে উঠলো,,,

–জায়েফ এটা একটা ভদ্রলোক এর বাড়ি। এগুলো কেমন বাচনভঙ্গি তোমার?আর এ বাড়িতে কি তোমার?

জায়েফ তখন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো তার গায়ের জ্যাকেট টা ঠিক করতে করতে বলল,,,

–শশুর বাড়িতে যা থাকে আমারও এ বাড়িতে তা।

বাবা উত্তেজিত হয়ে বললো,,,

— কিসের শশুর বাড়ি?

জায়েফ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ই উত্তর দিলো,,,

–আরে শশুরবাবা কয়দিন পরে নানা হবেন আর আজকে বলছেন শশুর বাড়ি কি জানেন না।

বাবা যে এবার রেগে গেছেন প্রচুর তা আমি ভালোই বুঝতে পারলাম। কিন্তু তাও চুপ করে বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম।বাবা বজ্রকন্ঠে বলে উঠলেন,,,

–ভদ্র ভাবে কথা বলো।আর এখানে কি চাই?

জায়েফ বাবাকে ক্রস করে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। আমার বুকের ভিতর মনে হচ্ছে একটা ধকধক শব্দ বার বার ধাক্কা খাচ্ছে।দ্রুত গতিতে আমরা যখন কোনো কিছুর জন্য দৌড়ে হাঁপিয়ে পরি তখন আমাদের হার্ট যেমন দ্রুত বিট করতে থাকে এখন আমারও ঠিক তেমন ভাবে বিট করছে।জায়েফ আমার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল,,,

–আপাতত একটু দুধ হলেই চলবে।

আমি মাথানত করা অবস্থা থেকে মাথা তুলে অনেকটা বিস্ময়মূলক চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালাম।আমার চাহনি বুঝতে পেরে উনি আবার বললেন,,,

–মিল্ক!মিল্ক!আসলে আমার বাসায় দুধ শেষ হয়ে গেছে তো।তাই কফি খাওয়ার জন্য একটু দুধ নিতে আসলাম।

–ঢাকা থেকে গাজীপুর এসেছেন দুধ নিতে?

জায়েফ আমার দিকে চোখ মেরে বললেন,,,

–জুইঁবাবু এই রহস্য তো একটু পরেই বুঝবে।

তখন কমলা আন্টি দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো।এতক্ষণে উপলব্ধি করলাম কমলা আন্টি বাসায় ছিলনা। আসলে তার আজকে নাইট ডিউটি করতে হবে বলে সকাল সকাল আমাদের বাসায় এসে পরেছেন।তাকে দরজা খুলে দিয়ে আমি আমার রুমে এসে একটু শুয়েছিলাম।কমলা আন্টিকে দেখে বাবা বলল,,,

–কোথায় ছিলে তুমি?

বাবার কথায় আমি আর জায়েফ দুজনেই আন্টির দিকে তাকালাম। আন্টি মুখের ভিতর একটা পান চাবাতে চাবাতে বলল,,

–ভাইজান ময়লাওয়ালা নাকি আজকে আসবো না। ৩দিন এর ছুটি তে গেছে।তাই আমিই নিচে গিয়া ময়লা ফালাইয়া আইছি।খালি খালি জুইঁমনি নিচে যাইবো কেন?

বাবা একটু ধমকের স্বরে বললেন,,,

–দরজা কি বাইরে থেকে লক করে যাওয়া যেতো না?জুইঁ বা আমাকে ডাকলেই তো হতো।

–আমি তো ভাবছি দুই মিনিট এর কাম। তাই দরজাডা হালকা চাপাইয়া থুইয়া গেছিলাম। আরে জুইঁমনি এই ব্যাডা ডা কেডা?(আন্টি)

আমি জায়েফ এর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম,,,

–একজন আগন্তুক।

আন্টি কিছুটা অবাক হওয়ার মতো করে বলল,,,

–আরে এই ব্যাডারে তো আমি নিচে যাওয়ার সময় দেখছিলাম।

জায়েফ গিয়ে আন্টির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,,

–কমলা সুন্দরী!রাইট?

আন্টি কিছুটা লাজুক হেসে বলল,,,

–আরে এহন আর সুন্দরী আছি কই।

এই কথাটা অবশ্য উনি ভুল বলেন নি।কমলা আন্টি আসলেই কমলা সুন্দরী। লাল ফর্সা গায়ের রঙে জোড়া ভ্রুযুগল তার রূপকে অনেকটা বাড়িয়ে তোলে।পান খাওয়ায় তার ঠোঁটে তার নামের মতোই একটা কমলা আর খয়েরী রঙের মিশ্রণে তাকে অন্যরকম লাগে।দেখলে তো মনে হয়না বয়স তার পঞ্চাশউর্ধ্ব।

এরমধ্যেই ঝাঝালো কন্ঠে বাবা বলে উঠলেন,,,

–শুরু হয়ে গেল তোমার। যাকে পাও তার সাথেই গল্প শুরু করে দাও।তুমি কি চেনো এই ছেলেকে?তোমাকেই বা কি বলছি।তোমার তো চেনা অচেনা লাগে না।মানুষ হলেই তোমার শুরু হয়ে যায়।আল্লাহ জানে কবে জেনো পশু পাখির সাথেও গল্প শুরু করে দিবে।

–ইশশশ!!শশুরবাবা কার রাগ কার উপর দেখাচ্ছেন? আমি জানি তো আপনি আমার উপর ক্ষেপে আছেন। তাই বলে কমলা সুন্দরীর সাথে রাগটা দেখাবেন?দিস ইজ নট ফেয়ার।(জায়েফ)

–কমলা আন্টি উনি দুধ নিতে এসেছেন,ওনাকে দুধ দিয়ে বিদায় করো তাড়াতাড়ি।(আমি)

–আরে পরিচয় হওন লাগবো না?(আন্টি)

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।জোড়ে বলে উঠলাম,,,

–আন্টি!!!!!!!!তাকে বিদায় করো।

দেখলাম জায়েফ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো আমার এমন আচরণ দেখে ব্যাপারটা তার হজম হচ্ছে না।তার সাথে থাকাকালীন আমি কখনো তার সাথে জোড়ে শব্দ করে কথাই বলিনি।তখনকার আমি আর আজকের আমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত রয়েছে। তাকে তখন যেমন ভয় পেতাম আজও ভয় পাই।তবে সেই সময় আমার মধ্যে তার জন্য ভয় ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু আজ আমার মধ্যে তার জন্য ক্রোধ,ঘৃণা, ক্ষোভ আর অভিমান ছাড়া কিছু নেই।

কমলা আন্টি তাকে ফ্রীজ থেকে এক প্যাকেট দুধ বের করে দিলেন।জায়েফ যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বললেন,,,

–আই এম ইমপ্রেসড।

সে চলে যেতেই কমলা আন্টি এসে আমার কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আমি আন্টিকে সব খুলে বললাম। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আন্টি তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। তার চাচাত ভাই ইন্তেকাল করেছিলেন। জায়েফ কে না চেনাটাই স্বাভাবিক। কমলা আন্টিকেও জায়েফ সম্পর্কিত তথ্য খুব একটা বেশি বলিনি।তাকেও একই কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছি।আর তা হলো – আমি জায়েফ এর সাথে বেমানান। এখন নিজের কাছেও মনে হয় আসলেই তো আমি বেমানান। কোথায় একজন রকস্টার আর কোথায় আমি!!!

কমলা আন্টি দুপুরের খাবার টা আমাদের এখান থেকেই খেয়ে চলে গেলো তার ডিউটি তে।বিকেল বেলা আসর এর আযান দেবার আগে আগে একটু ঘুমিয়ে থাকি।তবে প্রতিদিন না,মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে থাকি। ঘুম না আসলে আমার বারান্দায় বসে বসে গল্পের বই পড়ি, কোনো দিন কফি খাই, কোনোদিন বসে বসে সামনের বিলের পানে নিশ্চিুপ হয়ে চেয়ে থাকি।আবার অনেক সময় এখানে বসে নাটক বা মুভি দেখি।বারান্দায় বসে হাতে চা পা কফি নিয়ে নাটক – সিনেমা দেখার মজাই আলাদা।

এতো কিছুর মাঝেও নিজেকে বড্ড একা মনে হয়।এখন বাবা থেকেও তার সাথে আগের মতো গল্প করা হয় না।সাদুও বড় হয়েছে ওকে ওর মা আগের মতো হুটহাট বাড়ির বাইরে বের হতে দেয় না।ভাইয়াও হয়তো বা ব্যস্ত থাকে।আগের মতো কথা হয়না।সব মিলিয়ে জীবনটা কেমন জেনো ছন্ন ছাড়া মনে হচ্ছে। একা একা যখন থাকি তখনই কষ্টেরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অন্যের সামনে কখনোই আমি নিজের কষ্ট দেখাতে পারি না।সবসময় হাসি-খুশি থাকি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতো কিছু ভাবতে ভাবতে যখন আমি প্রায় ভাবুক হয়ে যাচ্ছিলাম তখনই আমার প্রাণভোমড়া তথা মোবাইলটা বেজে উঠলো।স্ক্রীনে “রাণু মন্ডলের ২য় ভার্ষণ” লেখাটা একেবারে চকচক করছে।ফোনটা কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সাদু বলতে লাগলো,,,

–দোস্ত ওই পাদমান আমারে প্রপোজ করছে আজকে একটু আগে।

–কতোবার বলবো তোরে মানুষের নাম নিয়া ভেঙ্গাইস না।(আমি)

–আমারে ওই জোকার প্রপোজ করছে আর তুই পইরা আছোস নাম নিয়া?(সাদু)

–শোন তোরে প্রপোজ কইরা যে সাদমান ভাইর কপাল পুরাটাই পুড়ছে তা কি সাদমান ভাই জানে?(আমি)

–ও না জানলেও আমি জানি!(সাদু)

হাহাহাহাহাহাহহা!!!!দুজনেই ফোনের দুপাশে একেবারে হেসে কুটি কুটি হচ্ছি।

আসলে সাদু কিছুটা গুন্ডি টাইপ।একবার ক্লাসের বাইরে মাঠে বসে একটা ছেলে সাদুকে পটানোর চেষ্টায় ছিলো।তখন ছেলেদের ক্লাস ছিলো ১২:৩০ মিনিটে আর আমাদের ছুটির সময় ছিলো ১২ টায়। আমাদের শেষ ক্লাস চলছিলো তখন।আমরা দোতলায় ক্লাস করছিলাম।জানালার পাশে ছিলো সাদু।জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই করিডোরের পরে মাঠ দেখা যায়।সেখানেই একছেলে ওকে ইশারায় প্রেম বিনোদনের চেষ্টায় ছিলো।সাদু হঠাৎ ক্লাস চলাকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে যায়।আর স্যারকে বলে মাঠে দাঁড়িয়ে একজন ওকে ডিস্টার্ব করছে।একটু পরে ছুটির ঘন্টা দিলে স্যারকে নিয়ে সেই ছেলের কাছে গিয়ে একে বারে ধুয়ে রঙ উঠিয়ে এসেছিল।আরেক বার ক্লাস নাইনে কোচিং এর এক বড়ো ভাই ওকে প্রপোজ করেছিল।সাদু আগে থেকেই বুঝতে পেরে কোচিং এর নিচে যেখানে সিসি ক্যামেরা ছিলো সেখানে দাঁড়িয়ে পরে ছেলেটাও বলদের মতো ওকে ওখানে প্রপোজ করে বসে।আর তারপরের দিন কোচিং এ এসে ওই ছেলেরও কেল্লাফতে হয়ে যায়।এবার সাদমান ভাইর কি হয় আল্লাহ ই জানে।

আমাদের হাসাহাসির এক পর্যায়ে হঠাৎ আমার চোখ যায় পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায়।জায়েফ একটা হালকা বাদামী রঙ এর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর মেরুন রঙ এর টিশার্ট পড়ে পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটা ফোন, যা দেখে মনে হচ্ছে ফোনটার ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। কিছুটা ভিডিও করার ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে এভাবে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ফোনটা কেটে তার আরেকটু কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম এটা আসলেই জায়েফ স্ব শরীরে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ করেই বুকের ভিতর মনে হচ্চে আমার শ্বাস – প্রশ্বাসেরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কোনো দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করে এসেছি। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার আগেই উনি বললেন,,,

–আরে জুইঁবাবু এটা আমিই।তোমার ওয়ান পিছ হাসবেন্ড।

–আমি ঢাকায় আসলাম কখন?(আমি)

–What?(জায়েফ)

–না মানে আপনি ঢাকায় আসলেন কবে?(আমি)

আমি যখন অতিরিক্ত মাত্রায় ঘাবড়ে যাই বা ভয় পাই তখনই আমি উল্টো পাল্টা কথা বলি।আসলে মাথায় এক কথা থাকলে মুখে বলে ফেলি আরেক কথা।উপন্যাস বা গল্পের চরিত্রের মতো ভয় পাই ঠিকই কিন্তু তাই বলে যে ভয় পেয়ে বোবা হয়ে যাবে তেমন টাও নই আমি।দেখতে হবে না কার সাথে থাকি। সাদুর স্বভাব একটু হলেও বাতাসে বাতসে উড়ে এসে আমার গায়েও লেগে গেছে। তখনি জায়েফ ওপাশ থেকে বলল,,,

— জুইঁবাবু আমরা এখন গাজীপুরে।

–হ্যাঁ।মানে তাই ই।আপনি এখানে কি করেন।(আমি)

–তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না।(জায়েফ)
কিছুটা সুর তুলেই বললেন।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে