বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0
1616

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৩৬.

রিক এখনও হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। ওর মন খুব করে বলছে এটা মিথ্যা হোক, স্বপ্ন হোক। কিন্তু না; এটা বাস্তব। আর ও সেটা এতক্ষণে বুঝেও গেছে। অনিমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাথা যন্ত্রণা আবার তীব্রভাবে শুরু হয়ে গেছে। হঠাৎ এরকম ধাক্কা নিতে পারছেনা ও। আচমকা এরকমভাবে রিকের সম্মুখীন হওয়াটা মেনে নিতে পারছেনা । ওর মনে হচ্ছে ও আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা। হলোও ঠিক তাই। আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও। অনিমা পরে যেতে নিলে রিক দ্রুত দৌড়ে ধরতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আদ্রিয়ান ধরে ফেলল। রিক সাথে সাথেই থেমে গেল। আদ্রিয়ান দুই হাতে অনিমাকে জড়িয়ে ধরে গালে হালকা চাপড় মেরে ডাকল। জাবিন এসে এরকম পরিস্থিতি দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। নাহিদ বলল,

” জাবিন, দ্রুত পানি নিয়ে আয় যা।”

জাবিন দৌড়ে কিচেনে গেল জল আনতে। আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বড় সোফায় শুইয়ে দিয়ে আবার ডাকতে শুরু করল। অভ্র আর নাহিদও ওর মাথার কাছে এসে ডাকছে ওকে কিন্তু অনিমার কোন সাড়াশব্দ নেই। রিক শুধু তাকিয়ে আছে অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে। অনেকটা থমকে গেছে ও। তারওপর অনিমার এরকম অবস্থা দেখে কী বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। এরমধ্যেই জাবিন জল নিয়ে চলে এলো। আদ্রিয়ান দ্রুত সেটা হাতে নিল। রিক একটু এগিয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,

” ক্ কী হয়েছে ও্ ওর?”

আদ্রিয়ান অনিমার মুখে পানি ছেটাতে ছেটাতে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

” টেনশন করিস না। ও একটু অসুস্থ। আমি দেখছি।”

কিছুক্ষণ চেষ্টার পর অনিমা চোখ খুলে তাকাল। আদ্রিয়ানের মনে ভয় ঢুকে গেছে। ডক্টর যা বলেছিল তেমন কিছু হয়ে গেলে ও মানতে পারবেনা। ও অনিমাকে নিজের সাথে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে নরম কন্ঠে বলল,

” ঠিক আছো তুমি এখন?”

অনিমা একটা শুকনো ঢোক গিলে আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরল। জোরে জোরে দুটো শ্বাস ফেলে ভয়ে ভয়ে পাশে তাকাতেই রিকের দিকে চোখ পরল। রিকের চোখ লালচে হয়ে গেছে। ঠোঁট সামান্য কাঁপছে। অনিমা ওদের সামনেই আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুজে দিল। রিক সাথেসাথেই নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল। অনিমার মত এমন লাজুক মেয়ের এমন কান্ড দেখে আদ্রিয়ান নিজেও অবাক হয়ে গেল। নাহিদ, অভ্র আর জাবিন ঠোঁট চেপে হাসছে। আদ্রিয়ান খেয়াল করল অনিমা নিঃশব্দে কাঁদছে। ও অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” জানপাখি, কী হয়েছে কাঁদছো কেন?”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনিমা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ানও আর কিছু না বলে চুপচাপ ওকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। নাহিদ হঠাৎ বলে উঠল,

” রিক, তুই ঠিক আছিস? তোর কী হয়েছে?”

নাহিদের কথায় রিকের হুশ এলো। বাকি সবাই তাকাল রিকের দিকে। অনিমাও অনেকটা ভয় নিয়েই তাকাল। রিক যথাসম্ভব নিজেকে সামলে বলল,

” হ্যাঁ, ঠিক আছিতো!”

আদ্রিয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,

” তোর চোখ, নাক এমন লাল হয়ে গেল কেন?”

” আরে একটু ঠান্ডা লেগেছে। তারওপর এখন আবার চোখটা জ্বলছে একটু। একটু ওয়াশরুমে যাবো আমি।”

জাবিন বলল,

” চল আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

জাবিন রিককে নিয়ে চলে গেল। অনিমা রিকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রিক আদ্রিয়ানের ভাই? কাজিন ব্রাদার? ওর জানামতে রঞ্জিত চৌধুরীর কোন ভাই বোন নেই। তাহলে? মায়ের পক্ষের কেউ? কবির শেখতো বিয়েই করেনি। হ্যাঁ শুনেছিল লিমা আন্টির আরেকটা জমজ বোন আছে। নামটা মনে নেই ওর। আদ্রিয়ান কি কবির শেখের ভাগ্নে? আদ্রিয়ানও কী তাহলে ওদের মতই? না কী ভাবছে কী ও? এক পরিবারের হলেই একরকম হবে এরকম কোন মানে নেই। লিমা আন্টিও তো কত ভালো। কিন্তু ভাগ্য ওকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার সেখানেই এনে কেন দাঁড় করালো? যে মানুষটাকে ও সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে ও আজ তারই ভাগ্নের বউ! এটা কেমন নিয়তি? আর কিছু ভাবতে পারছেনা ও। কোনরকমে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” পা-পানি।”

নাহিদ দ্রুত পানি এগিয়ে দিল। আদ্রিয়ান সেটা নিয়ে ওকে খাইয়ে দিয়ে বলল,

” রুমে যাবে? শুয়ে একটু রেস্ট করলে ভালো লাগতো।”

অনিমা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আদ্রিয়ান অনিমাকে ধরে ওপরে নিয়ে গেল। নাহিদ আর অভ্র বসে পরল সোফায়। আর রিকের আসার অপেক্ষা করতে লাগল। সন্ধ্যার দিকে আদিব, আশিস আসবে। তীব্র, অরুমিতা, স্নেহাকেও ইনভাইট করা হয়েছে, ওরাও আসবে।

বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে আয়নার দিকে তাকাল রিক। চোখ, নাক সত্যিই লাল হয়ে আছে। মাথায় একটা কথাই ঘুরছে যে ওর নীলপরী এখন অন্যকারো বউ। অনিমার ওভাবে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরা, ওরকম ঘনিষ্ঠতা সব চোখের সামনে ভেসে উঠতেই সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। প্রচন্ড জোরে চেঁচাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ওর ভেতরের কোন এক সত্তা ওকে বাঁধা দিচ্ছে কোনরকম সিনক্রিয়েট করতে। জোরে জোরে মুখে কিছুক্ষণ পানির ছিটা দিয়েও নিজেকে সামলে রাখতে পারছেনা। আদ্রিয়ানতো ওর ভাই! ও জানতো ও নীলপরীকে ঠিক কতটা চায়, সবটা জেনে শুনে ভাই হয়ে ভাইয়ের সাথে এরকম কীকরে করল? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল যে আদ্রিয়ানতো জানতোনা ওর নীলপরী কে। ও আসল নামটাও কখনও বলেছি আদ্রিয়ানকে। ও কীকরে জানবে? কিন্তু অনিমা এখানে কীকরে এলো? ওর মামা বলেছিল কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। সেই ছেলেটাকে কী আদ্রিয়ান? কিচ্ছু ভাবতে পারছেনা ও। কিন্তু ওর নীলপরীকে অন্যকারো সাথে সহ্য করতে পারবেনা ও, সম্ভব না সহ্য করা। কিন্তু কী করবে এখন? একটাদিন আগে হলেও ও ঠিক অনিমাকে নিজের করে নিতো কিন্তু এখন ও ওর ভাইয়ের বউ। শুধু তাই না। রিক জানে আদ্রিয়ান ওর মায়াবিনীকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। কিন্তু ওও তো ওর নীরপরীকে ভালোবাসে। কীকরে ছেড়ে দেবে? কীকরে? সবকিছুই অসহ্য হয়ে উঠছে। রেগে গিয়ে সামনের আয়নায় জোরে ধাক্কা মারলো। আয়নাটা ভেঙে নিচে পরে গেলো। রিকের হাতও কেটে গেছে খানিকটা। দমবন্ধ লাগছে,কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা ও। কিছুতো করতে হবে। কী করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা।

” ভাইয়া? কী হয়েছে? কী ভাঙল? তুমি ঠিক আছো?”

জাবিনের গলায় আওয়াজ শুনে রিক নিজেকে সামলে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে দরজা খুলল। জাবিন রিকের কাটা হাত দেখে বলল,

” কী হয়েছে? কাটলো কীকরে?”

রিক হাতের দিকে তাকিয়ে এরপর সামনে তাকিয়ে বলল,

” ধাক্কা লেগে আয়নাটা পরে গেছে। আর হাতে লেগেছে তাই___

” ইশ! কতখানি কেটে গেছে! চলো ড্রেসিং করে দিচ্ছি।”

জাবিন রিকের হাত ধরে নিয়ে গেল। রিকও কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান নিচে নেমে দেখে ওরা সবাই বসে আছে সোফাতে। রিকের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে অবাক কন্ঠে বলল,

” হাতে কী হয়েছে?”

রিক হাতের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

” কিছুনা, ওয়াসরুমে আয়না ভেঙ্গে একটু কেটে গেছে।”

” তো ওয়াসরুমে গিয়ে কী যুদ্ধ করছিলি না-কি?”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে দিলো। রিক বলল,

” ন_ ভাবি কেমন আছে এখন?”

” এখন একটু ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যায় বাকিরা চলে এলে ডেকে দেব।”

রিক কিছুই বলল না। মাথাটা ধরে যাচ্ছে এখন।বাতাসটাও অসহনীয় হয়ে উঠছে। ওর এখন কী করা উচিত সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা।

_____________

সন্ধ্যার পর একে একে আদিব, রাইমা, আশিস। পরে অরুমিতা, তীব্র, স্নেহা সবাই চলে এলো অরুমিতা ওরা রিককে দেখে বেশ অবাক হল। অনিমার মুখ কিছুটা শুনেছে ওরা। কিন্তু কিছু বলল না। পরিস্থিতি বিগড়ে দিতে চায়না আপাতত। রিক তেমন কথা বলছেনা চুপচাপ বসে আছে। এতক্ষণে কেবল অনি-আদ্রিয়ানের বিয়ের ঘটনাটা কিভাবে ঘটেছে সেটাই জানতে পেরেছে। অন্যকিছু জানতে চাওয়ার মানসিকতা এখন নেই ওর। আদ্রিয়ান গিয়ে অনিমাকে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে নিচে নিয়ে এলো। অনিমা রিককে দেখে আবার ঘাবড়ে গেল। রিক যদি আদ্রিয়ানকে কিছু বলে? আদ্রিয়ান ভুল বুঝবে না-তো ওকে? শুনবেতো ওর কথা? রাইমা উঠে গিয়ে অনিমাকে জড়িয়ে ধরে বিয়ের জন্যে কনগ্রাচুলেট করল। এরপর অনিমাকে নিয়ে ওদের মাঝে বসাল। অনিমা ওখানে বসতেই রিক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল অনিমার দিকে। অনিমা রিকের দিকে তাকাচ্ছেনা ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে ওর। আদ্রিয়ান বলল,

” অনি, তুমি তো অসুস্থ হয়ে পরলে তাই আলাপ করানো হয়নি। ও আমার খালাতো ভাই, রিক।”

অনিমা একপলক রিকের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে চোখ নামিয়ে নিল। রিক নিজের চোয়াল শক্ত করে রেখেছে। আদ্রিয়ান রিকের কাধে হাত রেখে বলল,

” কীরে? ভাবিকে দেখার জন্যে তো মরে যাচ্ছিলি। এখন চুপ কেন?”

রিক অনিমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই বলল,

” আছিতো এখানেই ঠিক কথা বলে নেব। এখনতো অসুস্থ। চুপচাপ থাকাই ভালো।”

অনিমা শুধু নিচের দিকে হাত কচলে যাচ্ছে। অভ্র জাবিন একে ওপরেই থেকে দশ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করছে। তীব্র স্নেহার সেই বিখ্যাত ঝগড়া মাঝেমাঝেই শুরু হচ্ছে। আদিব আর রাইমা নিজেদের মতো বসে টুকটাক কথা বলছে। আশিস কিছুক্ষণ পরপরই কীরকমভাবে দেখছে অরুমিতাকে। যেটা আর কেউ বুঝতে না পারলেও অরুমিতা বুঝতে পারছে। কিন্তু পাত্তা দিচ্ছেনা। ওর আর এসবে কিছু যায় আসেনা। সারাটা সন্ধ্যা সবার হাসি মজাতেই কেটেছে। শুধু রিক আর অনিমার মধ্যে দুটো আলাদারকম ঝড় বইছিলো। রাতে আদ্রিয়ান নিজের হাতে খাইয়ে দিচ্ছিল অনিমাকে। ও অসুস্থ বলে। রিকের গা জ্বলে যাচ্ছিল এসব দেখে। পারছিল না সহ্য করতে। এবার ওর অনিমার ওপর রাগ হতে শুরু করল। যুক্তি নেই জেনেও সবকিছু জন্যে ওকেই দোষী মনে হচ্ছে এখন রিকের। এমন মনে হচ্ছে অনিমা ইচ্ছে করে ওদের দুজনের জীবন নিয়েই খেলেছে। ঠিক করে আর খেতে পারলোনা রিক। কোনরকম খেয়ে উঠে পরল।

সবাইকে বিদায় দেওয়ার পর সবাই যে যার রুমে শুতে চলে গেল। প্রচন্ড ক্লান্ত এখন সবাই। আদ্রিয়ান অনিমা এখনও আলাদা রুমেই শোয়। স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন এখনই শুরু করছেনা ওরা। সেটাও আদ্রিয়ানের কথাতেই। রুমে যাওয়ার সময় আদ্রিয়ান অনিমাকে একটু ডাকল ওর রুমে। যেটা রিক তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছে।

_____________

অনিমা আদ্রিয়ানের রুম থেকে থেকে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। অন্যমনষ্ক হয়ে কিছু ভেবে চলেছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে রিককে ওর বিছানায় বসে থাকতে দেখে ও চমকে উঠল। রিকের চোখে মুখে ভয়ংকর রাগ। অনিমা ভয় পেল প্রচন্ড। ভীত গলায় বলল,

” আপনি?”

রিক উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল,

” আশা করোনি তাইনা? বিশ্বাস করো, আমিও আশা করিনি। আমি ভাবিও নি তুমি এরকম কিছু করতে পারো। তোমাকে সবার চেয়ে আলাদা মনে হতো। কিন্তু তুমিও তো সেই লোভী মেয়েদের দলে গিয়েই পরলে।”

অনিমা অবাক হয়ে তাকাল। রিকের কথার মানে বুঝে উঠতে পারছেনা। রিক আবার বলল,

” আমার কাছেতো ভালোই ছিলে। কিন্তু আমাকে পরে আর ভালো লাগেনি তাইনা? তাই এখন আমার ভাইয়ের গলায় এসে ঝুলেছো।”

রিকের কথা শুনে অনিমা কেঁদে ফেলল। এরকম কথা কেন বলছে সে? রিক রাগে দুঃখে কী বলছে নিজেও জানেনা। ও চেনে অনিমাকে। তবুও বলছে এসব। রিক অনিমার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলল,

” কাঁদছো কেন? কেন করলে এটা নীলপরী? কী করিনি আমি তোমার জন্যে? তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছি, তোমাকে আশ্রয় দিয়েছি, বাবার আপত্তি সত্ত্বেও তোমাকে আগলে রেখেছি। আর তুমি এভাবে চলে এলে?”

অনিমা কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,

” ছাড়ুন, আমার লাগছে।”

” আমার প্রশ্নের উত্তর দাও! কেন করলে এটা?”

” আমি কারো প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। ছাড়ুন!”

রিক আরও জোরে চেপে ধরে বলল,

” একশবার বাধ্য তুমি! আমার জবাব চাই।”

অনিমা এবার একটু রেগে গেল। অনিমা ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে রিককে থাপ্পড় মেরে দিল। রিক অবাক হয়ে তাকাল অনিমার দিকে। অনিমা হাফানো কন্ঠে বলল,

” আমি কী করেছি, কেন করেছি; সেটা সবচেয়ে ভালো আপনি জানেন। জেনে শুনে ন্যাকামো করছেন? সেটাইতো হয়েছিল না যেটা আপনি চেয়েছেন? না-কি আজ আমি এখনও বেঁচে আছি বলে আপনার রাগ হচ্ছে, আফসোস হচ্ছে।”

রিক হতভম্ব হয়ে গেল। অনিমার কথার মানে বুঝতে পারল না ও। যেখানে ওর অভিযোগ করার কথা সেখানে উল্টে অনিমা অভিযোগ করছে ওকে নিয়ে? কী করেছে ও?

#চলবে…

[ রি-চেইক করিনি। ভুলত্রুটিগুলো একটু নিজ থেকে বুঝে নেবেন। ]

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৩৭.

কথাগুলো বলতে বলতে অনিমার চোখ ভিজে উঠেছে। রিক চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। এরকম অদ্ভুত অভিযোগের মানে কী? অনিমাকে খুঁজে খুঁজে ও পাগল হয়ে যাচ্ছে আর এই মেয়ে উল্টে ওকেই দোষারোপ করছে? রিক অবাক কন্ঠে বলল,

” কী বলছ এসব? কী করেছি আমি? দেখো নীলপরী আ__”

অনিমা রিককে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” একদম নীলপরী বলে ডাকবেন না আমাকে। আপনার মুখে এই ডাকটা অসহ্য লাগছে আমার। আমি ভালো আছি এখন। এতগুলো বছর পর এখন একটু ভালো আছি আমি। আমার জীবনটাকে নতুন করে আর দুর্বিষহ করবেন না। ছেড়ে দিন আমাকে আমার মত। প্লিজ!”

রিকের এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অনিমার ওপর। ছেড়ে দিন মানে কী? ওর এতোদিনের ভালোবাসা এই মেয়ের কাছে কিচ্ছু না? রিক আবার অনিমার বাহু চেপে ধরে বলল,

” এতোটা স্বার্থপর কীকরে হলে তুমি? যা ইচ্ছা করবে? আমাকে বিয়ে করা নিয়ে তো তোমার মধ্যে অনেক কনফিউশন ছিল। তাহলে আমারই ভাইকে হুট করে বিয়ে করে ফেললে কীকরে? বল?”

” কারণ ভালোবাসি ওনাকে আমি। হ্যাঁ আমি আপনার ভাইকে ভালোবাসি।”

রিক সাথেসাথে অনিমার হাত ছেড়ে দিল। শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমার দিকে। প্রায় দুই বছর যাবত ভালোবেসেও না অনিমাকে ভালোবাসি বলতে পেরেছে, আর না অনিমার মুখ থেকে শুনতে পেরেছে। অথচ সেই ভালোবাসার কথাই অনিমা আজ বলছে। কিন্তু সেটা ওকে না ওরই ভাইকে। অনিমার মাথা ভার লাগছে তাই মাথা ধরে বিছানায় বসে পরল। রিকের রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। এখানে থাকলে হয়তো অনিমার সাথে খারাপ কিছু করে ফেলবে। আর অনিমাকে দেখেও অসুস্থ মনে হচ্ছে। তাই রিক আর না দাঁড়িয়ে দরজা খুলে হনহনে পায়ে বেড়িয়ে গেল। অনিমা নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর জীবনে অন্যতম ভালো বন্ধুদের মধ্যে একজন ছিল রিক। কিন্তু রিকও ওর বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়েছে বাকি সবার মতই। সবাই এতো স্বার্থপর কেন হয়?

___________

সকালবেলা আদ্রিয়ান আর নাহিদ সোফায় বসে নিউস দেখছে। আজ আর বেড় হবেনা আদ্রিয়ান। রিক আজকে দিনটা এখানে থাকবে তাই। অনিমাকে কাল রাতেই বলে দিয়েছে আজ ভার্সিটি না যেতে। অনিমা এখন কিচেনে কফি বানাচ্ছে। জাবিন আর রিক নামেনি এখন ও। অভ্র এসে পাশের সিঙ্গেল সোফাতে বসে আদ্রিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,

” গুড মর্নিং স্যার!”

আদ্রিয়ান টিভিতে মনোযোগ রেখেই বলল,

” মর্নিং।”

অভ্র নাহিদকেও সকালের শুভেচ্ছা জানালো। এরমধ্যে রিকও টি-শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে নিচে চলে এলো। অপরপাশের সিঙ্গেল সোফায় বসল। কিন্তু কিছু বলল না। আদ্রিয়ান আর অভ্র সকালের শুভেচ্ছা জানালে সেটারই উত্তর দিল শুধু। আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

” কী ব্যাপার? চোখ আবার লাল হয়ে আছে? রাতে ঘুমাস নি?”

রিক চোখ কচলে কোনরকম হাসার চেষ্টা করে বলল,

” আরে না, সেরকম কিছুই না। বললাম না ঠান্ডা লেগেছিল? সেইজন্যই হয়তো।”

নাহিদ রিকের হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” ব্যান্ডেজে আবার রক্ত এলো কথা থেকে?”

রিক হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

” ঘুমের মধ্যে লেগে গেছে হয়ত। ও কিছুনা সেড়ে যাবে।”

এরমধ্যেই অনিমা ট্রে তে করে সবার জন্যে কফি নিয়ে চলে এলো। প্রথমে অভ্র, নাহিদ পরে আদ্রিয়ানকে দিল। আদ্রিয়ান বলল,

” সব ক্ষত সেড়ে যাবে বললেই সাড়েনা। একটু কেয়ারফুল থাকবি তো।”

ততক্ষণে অনিমা রিকের সামনে চলে গেছে। রিকের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিতেই রিক অনিমার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা নিতে নিতে বলল,

” ঠিকই বলেছিস, সব ক্ষত সাড়েনা। বরং সময়ের সাথে সাথে আরও গভীর হয়।”

অনিমা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে নিলে আদ্রিয়ান বলল,

” কোথায় যাচ্ছো?”

” ব্রেকফাস্ট বানাতে।”

আদ্রিয়ান অনেকটা আদেশের সুরে বলল,

” চুপচাপ এখানে বস। আজ ব্রেকফাস্ট সার্ভেন্টরাই বানাতে পারবে। এই শরীর নিয়ে আর কিচ্ছু করতে হবেনা। জেদ করছিলে তাই কফি করতে দিয়েছি। এখন আর কিচ্ছু না।”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনিমা ভদ্র মেয়ের মত বসে পরল। রিক কফির মগে চুমুক দিতে দিতে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে ওদের। তবে এতোদিন পর অনিমার হাতের কফির স্বাদ পেয়ে মনটা তৃপ্ত হয়েছে। নাহিদ উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,

” একটা জিনিস ভালো হয়েছে। ভাবিকে এতোদিন লাইসেন্স ছাড়া ভাবি ডাকতে হতো। এখন লাইসেন্স পেয়ে গেছি। মন খুলে ভাবি ডাকব।”

নাহিদের কথায় অভ্র আর আদ্রিয়ান দুজনেই হাসল। অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ভয় লাগছে অনেকটা ওর। এরমধ্যেই জাবিনও নেমে এল। অভ্রর দিকে চোখ পরতেই ও মোটামুটি বড়সর একটা ক্রাশ খেলো। এলোমেলো চুল, হাফ হাতা টিশার্ট, থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট সব মিলিয়ে দারুণ লাগছে। অভ্রর সাথে চোখাচোখি হতেই ও দ্রুত চোখ সরিয়ে বসে পরল সোফায়। অনিমা ওর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিল। কফিতে চুমুক দিয়ে জাবিন বলল,

” উম ভাবি, তুমি কফিটা যা বানাও না। আমি কফি তেমন পছন্দ করিনা। কিন্তু তোমার কফি মিস করতে মন চায়না। অসাধারণ।”

হঠাৎ রিক বলে উঠল,

” বরাবরই অসাধারণ হয়।”

রিকের কথা শুনে সবাই রিকের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। অনিমা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিকের দিকে। আদ্রিয়ান চোখ ছোট ছোট করে বলল,

” তুই ওর বানানো কফি এর আগে খেয়েছিস?”

রিক মুচকি হেসে কফির মগটা রেখে বলল,

” কফিটা খেয়ে মনে হল বরাবরই ভালো বানায় সেটাই বললাম।”

সবাই আবার নিজের কাজে মন দিল। অনিমা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। আদ্রিয়ান বলল,

” আজকেই চলে যাবি কেন? আর কয়েকটা দিন থেকে যা এখানে?”

আদ্রিয়ানের কথা শুনে রিক আবারও একটু হাসল। নিজের তীক্ষ্ম দৃষ্টি অনিমার ওপরেই রেখে বলল,

” চাইলেও থাকতে পারব না। জামাকাপড় আনিনি। তবে ভাবছি যে পোশাক নিয়ে আবার চলে আসব এখানে। কয়েকটা দিন থেকে গেলে মন্দ হয়না। ভাবির সাথেও ভালো করে আলাপ হয়ে যাবে।”

অনিমার বুক কেঁপে উঠল। রিক এখনও অনিমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান হেসে বলল,

” একদম! চলে আয়। সবাই মিলে কয়েকটা দিন মজা করা যাবে।”

জাবিনও খুব এক্সাইটেড হয়ে উঠল রিকের থাকার কথা শুনে। ওরা সবাই বেশ খুশি। শুধু অনিমাই খুশি হতে পারছেনা। রিক কেন থাকতে চায় এখানে? কী দরকার এখানে ওনার? আবার কী করতে চায়? এই লোকটার কী ওর শান্তি সহ্য হয়না? কবে ছাড়বে ওকে? ও মরে গেলে?

____________

রুমের ব্যালকনির রেলিং ধরে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে অনিমা। আজ সারাদিন ও রুমেই ছিল। খুব দরকার ছাড়া বেড় হয়নি। রিকের মুখোমুখি হতে চায়না ও। ওর ভয় করছে খুব। আদ্রিয়ান যখন সব জানবে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে? সেটা ভাবলে আরও বেশি ভয় হচ্ছে ওর। খুব বেশি জড়িয়ে গেছে আদ্রিয়ান নামক মানুষটার সাথে। ওই মানুষটাকে ছেড়ে বাঁচতে পারবেনা ও। কখনও না। সম্ভব না আদ্রিয়ানকে ভুলে যাওয়া। হঠাৎ কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই অনিমা কেঁপে উঠল। অনিমা নড়তে গেলেই আরো শক্ত করে ধরে বলল,

” আমি, এতো নড়াচড়া করোনাতো।”

আদ্রিয়ানের গলা পেয়ে অনিমা শান্ত হল। নড়াচড়া থামিয়ে দিল। আদ্রিয়ান অনিমার কাঁধে থুতনি রেখে বলল,

” কী এতো ভাবছ? সারাদিন রুমেই আছো। দুপুরে খেলেনা ঠিক করে। শরীর খারাপ?”

অনিমা কোন জবাব দিলোনা। আদ্রিয়ান ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোমরে হাত রেখে বলল,

” কী হয়েছে?”

অনিমা মাথা নেড়ে ‘কিছুনা’ বোঝালো। আদ্রিয়ান ওর কপালে কপাল লাগিয়ে বলল,

” মন খারাপ?”

” আব্বুর কথা খুব মনে পরছে।”

অত্যন্ত অসহায় গলায় কথাটা বলল অনিমা। চোখ ছলছল করছে ওর। আদ্রিয়ানের বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। ওর মায়াবিনীর এরকম অসহায়ত্ব ওকে তীব্র যন্ত্রণা দেয়। ও আর কিছু না বলে অনিমাকে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” এখন একটু ঘুমিয়ে রেস্ট করো। ভালো লাগবে।”

অনিমা চোখ বন্ধ করে ফেলল। বন্ধ চোখ দিয়েও জল পরছে। আদ্রিয়ান শান্ত কন্ঠে বলল,

” আব্বুর কথা খুব মনে পরে?”

অনিমা চোখ বন্ধ করেই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আদ্রিয়ান আর কিছু বলল না। ওরও চোখ লালচে হয়ে উঠছে। এই মেয়েটার সামান্য কষ্টও ওর সহ্য হয়না। এতোটা ভালো কবে বেসে ফেলল ও নিজেও জানেনা। কিন্তু অনিমার চোখের একেক ফোটা জল ওর হৃদয় থেকে ফোটায় ফোটায় রক্ত ঝড়ায়। অনিমা ঘুমিয়ে পরার পর অনিমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

” যখন থেকে ভালোবেসেছি, তোমার সব কষ্ট থেকে মুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব আমার জানপাখি। আমি থাকতে এভাবে কাঁদতে পারোনা তুমি।”

____________

আদ্রিয়ান আর রিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। চা টা খেয়েই বেড়িয়ে পরবে বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও রিক বলেছে আবার আসবে। এটা নিয়ে আদ্রিয়ানের তেমন মাথাব্যাথা নেই। বরং এবিষয়ে ও আরও উৎসাহি। আদ্রিয়ান বলল,

” তাড়াতাড়ি চলে আসিস কিন্তু। তোর হিটলার বাপ যাই বলুক।”

রিক হাসল খানিকটা। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে রিক বলল,

” তোর বউ কই?”

” ঘুমোচ্ছে একটু। শরীর ভালো নেই।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রিক আবার বলল,

” আচ্ছা নী_ আই মিন ভাবির সাথে কোথায় দেখা হয়েছিল তোর? আই মিন কোথায় পেয়েছিলি ওকে? আর ও এখানে থাকত কেন? ওর ফ্যামিলি সব ___

আদ্রিয়ান কিছক্ষণ চুপ থেকে বলল,

” ওকে একটা নারীপাচার চক্রের লোকেদের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলাম। ওকে বেঁচে দিচ্ছিল ওরা।”

রিক বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। নারীপাচার চক্র? কী বলছে কী এসব আদ্রিয়ান? রিক অনেকটা অবাক হয়েই বলল,

” মানে?”

এরপর আদ্রিয়ান রিককে অনিমাকে কোথায়, কীভাবে পেয়েছে। এরপর থানায় কী কী ঘটেছে। কেন ওকে বাড়ি নিয়ে এসছে সবটা খুলে বলল। সবটা শুনে রিক হতভম্ব হয়ে গেল। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে ওর। ওর মামা বলেছিল যে অনিমা পালিয়ে গেছে। পালিয়ে গেলে এরকম একটা গ্যাং এর হাতে কীকরে পরল ও? ও উল্টে ভেবে বসেছিল অনিমা ওকে ঠকিয়েছে। কিন্তু অনিমার সাথেই তো সবচেয়ে খারাপ কিছু হতে যাচ্ছিল। কী হয়েছিল ও যাওয়ার পর? সেদিন আদ্রিয়ান অনিমাকে না পেলে আজ কোথায় থাকত ওর নীলপরী? কী অবস্থায় থাকত? কল্পনা করলেও গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ওর।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে