বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৩৪+৩৫

0
1792

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৩৪.

অনিমা সম্পূর্ণ একটা ঘোরে আছে। এখনও অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আদ্রিয়ানকে। আর আগের কথা ভাবছে। ওকে টেনে কাজি অফিসে আনার পর ও দেখল সবকিছুই রেডি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এরপরে সবকিছুই যেনো অনিমার মাথার ওপর দিকে গেল। ওকে যখন ‘কবুল’ বলতে বলা হল তখন শুধু বোকার মত কাজীর দিকে তাকিয়ে ছিল। কয়েকবার বলার পরেও কিছু বলছিল না, কিন্তু আদ্রিয়ান ধমক মারার সাথেসাথেই এমনিতেই মুখ দিয়ে ‘কবুল’ শব্দটা বেড়িয়ে গেছে। এরপর সাইন টাইন যা হয়েছে সবটাই অনিমা অবাক হয়েই করেছে। কী থেকে কী হয়ে গেল নিজেই বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওর বোধগম্য হল ও এখন বিবাহিতা। হ্যাঁ ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ও এখন আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের বউ। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অরুমিতা, তীব্র, স্নেহা ওপর পাশে অভ্র, জাবিন, আদিব, আশিস, নাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখে মুখেও একপ্রকার বিষ্ময় ।আদ্রিয়ান অনিমার দিকে একপলক তাকিয়ে ওর হাত ধরে আবার দাঁড় করালো। তারপর হাত ধরেই বাইরে নিয়ে গেল। বাকিরাও এলো পেছন পেছন। বাইরে এসে অনিমা আরেকদফা অবাক হল। অনেক সাংবাদিকরা অপেক্ষা করছে ওখানে। ওরা ওখানে যেতেই সবাই হুরমুরিয়ে ওদের ঘিরে ধরল। আবার নানারকম প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কিন্তু আদ্রিয়ান কোন কথা বলছেনা চুপ করে আছে। একজন বলল,

” মিস্টার জুহায়ের প্লিজ কিছুতো বলুন।”

আদ্রিয়ান এবার সবার উদ্দেশ্যে বলল,

” আপনারা আগে থামবেন তারপর তো আমি বলব তাইনা? সো আমি বলি?”

সবাই এবার চুপ করল এবার। আদ্রিয়ানের কথা শোনার জন্যে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আদ্রিয়ান একপলক অনিমার দিকে তাকিয়ে পরে আবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আপনাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল আমার কোন আত্মীয় না হয়েও কেন ও আমার বাড়িতে থাকে? আচ্ছা, ও আমার কেউ হয়না সেটা আমি আপনাদের বলেছি?”

সবাই চুপ করে আছে। আসলে প্রশ্নটার উত্তরই নেই ওদের কাছে। আদ্রিয়ান হালকা হেসে বলল,

” যা শোনেন সেটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে আসেন? আমার বাড়িতে আমার এসিসটেন্ট অভ্র থাকে, আমার ফ্রেন্ড নাহিদও কিছুদিন হল থাকে। ওরাও আমার অাত্মীয় নয়। তাহলে প্রশ্নটা শুধু এই মেয়েটাকে নিয়েই কেন? মেয়ে বলে? এই লেইম থিংকিং কবে বদলাবেন? এবার উত্তরটা দেই। ও আমার ফিয়ন্সে ছিল। তাই আমার বাড়িতে ছিল। ওর কোন আত্মীয় এই শহরে নেই তাই ও আমার কাছে থাকত! হোয়াটস রং উইথ দ্যাট!”

সবার মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হল। সাথে ক্যামেরায় ফটো তোলার আওয়াজ তো আছেই। আদ্রিয়ান আবার বলল,

” তাছাড়া কাদের কী বলছি? কোন কিছু না জেনে হুটহাট চলে এসে কাউকে হ্যারাস করাইতো আপনাদের প্রধান ডিউটি। কদিন আগে স্মৃতির সাথে আমার নাম জড়িয়ে কীসব লিখে রেখেছিলেন। আরেকটু হলেতো আমার না হওয়া সংসারটা ভেঙ্গে যাচ্ছিল।”

সাংবাদিকরা একে ওপরে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অরুমিতা, নাহিদ ওর সবাই মুখ টিপে হাসছে। অনিমা শুধু আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সবটাই মাথার অনেকটা ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিয়ান সবাইকে থামিয়ে আবার বলল,

” পরের প্রশ্ন ছিল যে, ওর সাথে আমার সম্পর্ক কী? কাল অবধি ও আমার হবু বউ ছিল। কিন্তু আজ এইমুহূর্ত থেকে ও আমার বউ। একটু আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। ভেবেছিলাম ধুমধাম করে বিয়ে করব এরপর আপনাদেরও ইনভাইট করব। নিজেদের দোষে একটা দাওয়াত থেকে বঞ্চিত হলেন। যাই হোক, কাবিননামা আর সাক্ষী সব এখানেই আছে। অভ্র ওনাদের কপি দিয়ে দাও!”

অভ্র দ্রুত কপি এগিয়ে দিল ওনাদের দিকে। সবটা দেখে শুনে ওনারা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেল যে আদ্রিয়ান আর অনিমা বিবাহিত। এখন আবার কী নতুন নিউস হবে সেটা নিয়েই ভাবনায় আছেন ওনারা। সবার মধ্যে চাঁপা গুঞ্জনতো আছেই! আদ্রিয়ান বলল,

” আশা করি আর কোন প্রশ্ন নেই আপনাদের। ওর পরিচয় হল ও আমার বউ। মিসেস আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের। তাই ওর দিকে আঙুল তোলার আগে অবশ্যই ভেবে চিন্তে তুলবেন।”

কথাটা ও অনিমাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রেখেই বলেছে। সবাইকে সব উত্তর দিয়ে ওরা ওখান থেকে চলে এলো। নাহিদ ওরা সবাই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। প্রথমে অনিমা আদ্রিয়ানের হঠাৎ বিয়েতে শকড হলেও এখন ওরা সবাই খুব খুশি। এমনিতেও এতদিন ওরা সবাই অনিমাকে আদ্রিয়ানের বউই মনে করত। তবে অনিমা এখনও শক থেকে বেড় হতে পারছেনা। সবকিছুই একটা স্পষ্ট স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। ও জানে সবটা বাস্তব তবুও। এমন কেন হচ্ছে ও নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা।

____________

রিক নিজের রুমে এসে কোনরকম ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে দেখল টি-টেবিলে গ্লাসে জল রাখা আছে। আসার আগে স্নিগ্ধার কাছে জল চেয়ে এসছিল। স্নিগ্ধাই রেখে গেছে হয়ত। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি চলে গেল যে? এসব ভাবা বাদ দিয়ে ও একঢোকে জলটুকু খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে ওর। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব কাজ আজ ওর ঘাড়েই চাপিয়ে দিয়েছে সবাই। দুপুর থেকে ঠিককরে বসার সুযোগ পায়নি। হঠাৎ আজ একসঙ্গে একদিনে এত জায়গার যাওয়ার প্রয়োজন কেনো হল সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা ও। তবে বাইরে আজ কিছু একটা শুনছিল আদ্রিয়াকে নিয়ে। একটা মেয়েকে নিয়ে কিছু। কাজে ব্যস্ত থাকায় তেমন পাত্তা দেয়নি। ওদের নামে এমনিতেও কত নিউজ বেড় হয়। কদিন আগে স্মৃতিকে নিয়ে কীসব হল। ভাবল রাতে কল করে জেনে নেবে। তাছাড়া কালতো যাচ্ছেই আদ্রিয়ানের বাড়িতে। আদ্রিয়ানকে কল করতে নিয়েও করতে পারলনা রিক। দুচোখে ভীষণ ঘুম এসে ভর করেছে। চোখ প্রচন্ড ভারী হয়ে আসছে। সমস্ত শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে ফোন বুকের ওপর রেখেই ঘুমে তলিয়ে গেল ও।

স্নিগ্ধা ওর রুমে গুটিয়ে বসে আছে। চোখ হালকা লাল হয়ে আছে ওর। বোঝাই যাচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগে কেঁদেছে ও। অনিমার সাথে আদ্রিয়ানের বিয়ের নিউজটা খবরে দেখে ও চমকে গেছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না। সবার আগে মাথায় এই চিন্তাটাই এসছিল যে রিক জানলে কী হবে? রিক যে এই মেয়েটার জন্যে পাগল। এসব চিন্তা করতে করতেই ওর রুমে এসে কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী দুজনেই ঢোকে। দুজনকে এভাবে একসঙ্গে দেখে অবাক হয়েছিল। নিশ্চয়ই আবার কিছু করবে। হয়েছেও তাই স্নিগ্ধা যাতে এই নিউসের কথা রিককে না জানায় সেটা বলতেই এসছেন ওরা। তারসাথে রিকের খাবার জলের সাথে ঘুমের ঔষধ মেশাতে বলেছে। স্নিগ্ধা প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু আবারও ওকে ওর বাবার ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে কাজটা করতে বাধ্য করেছে। সেসব কথা মনে পরতে আবার কান্না পাচ্ছে ওর। ও কখনও অন্যায়কে মেনে নেয়নি। কিন্তু আজ ওর বাবার কথা ভেবে অন্যায় করতেও হচ্ছে। এই লোকগুলোর কী কোনদিন শাস্তি হবেনা। কেউ কী নেই যে এদের ধ্বংস করতে পারে? রিকের সাথে এটা করেছে ভাবলেই প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। তবে অনিমার ব্যাপারটা রিক জানার পর কীরকম তান্ডব করবে সেটা অনুমান করতে পারছে ও। তারওপর ছেলেটা আর কেউ নয় আদ্রিয়ান। দুই ভাইয়ের এতো সুন্দর সম্পর্কে ফাটল ধরবে? এরকম কেন হল? তবে অনিমাযে নিরাপদে আছে সেটা ভেবেই শান্তি লাগছে ওর। অন্তত মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু হয়নি। এখন শুধু বাকি সব একটু ভালো হলেই হয়।

____________

আকাশে আজ পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার রাত। সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছে তাই ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। অনিমা ছাদের দোলনায় বসে সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে ভাবছে। আদ্রিয়ানের বউ ও এখন। এইমুহূর্তে আদ্রিয়ান ব্যস্ত আছে। ঐ নিউসের পর অনেক ফোন কলস্ এসছে। অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে। রাতের দিকে অবশ্য ফ্রি হয়েছে একটু। তখন নাহিদ ওরা সবাই অনেক্ষণ পিঞ্চ করে কথাও বলেছে বিয়েটা নিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ হাসি মজাও হয়েছে। বিশেষ করে নাহিদ বেশ খুঁচিয়েছে আদ্রিয়ানকে। ওরা চেয়েছিল বাসরঘর সাজাতে। কিন্তু কেন জানি আদ্রিয়ান বারণ করে দিল। এটাও বলল যে আপাতত বিয়েটা নিয়ে কিছু না করতে। যা হবার পরে হবে। যদিও এতে অনিমার কোন ভাবান্তর হয়নি বরং স্বস্তিই পেয়েছে। হঠাৎ করেই আদ্রিয়ানের সাথে নরমাল হতে পারতনা ও। তাই ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে। তবে মনে অন্যচিন্তাও ঘুরছে ওর। হঠাৎ দোলনায় ভর অনুভব করে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এল অনিমা। পাশে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান বসে আছে। ওর দৃষ্টিটাও আকাশের দিকে। হালকা বাতাসে আদ্রিয়ানের কপালের চুলগুলো দুলছে। ভীষণ সুন্দর লাগছে ওকে। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান অনিমার হাতে হাত রাখতেই অনিমা ‘আহ’ করে উঠল। আদ্রিয়ান চমকে গেল। অবাক হয়ে অনিমার হাত ধরে দেখল লাল হয়ে গেছে। ও বুঝতে পারল তখন রাগ করে চেপে ধরাতেই এমন হয়েছে। আদ্রিয়ান ওখানে যত্ন করে হাত বুলিয়ে বলল,

” সরি জানপাখি, তখন রেগে গেছিলাম খুব। তাই বুঝতে পারিনি। অনেকটা লেগেছে না? লাল হয়ে আছে তো!”

কথাটা বলে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো ওর হাতে।অনিমা কিছুক্ষণ আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল,

” আচ্ছা আপনি কী অামাকে মন থেকে মেনে বিয়ে করেছেন? না-কি শুধুই সবার মুখ বন্ধ করে আমার সম্মান বাঁচাতে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন?”

#চলবে…

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৩৫.

অনিমার কথা শুনে আদ্রিয়ান অনিমার হাত ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে তাকাল। অনিমা এখনও কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানের চোয়াল খানিকটা শক্ত হয়ে এলো। ও চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলে সামনে তাকাল। আদ্রিয়ান এরকমটা তখনই করে যখন ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অনিমা সেটা জানে। তাই একটু ভয় পেল। না জানি আবার কী ভুলভাল বকে ফেলেছে। কিন্তু ও তো সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছে। রেগে যাওয়ার মতো তো কিছু বলে নি। হ্যাঁ ও জানে আদ্রিয়ান ওকে ভালোবাসে। কিন্তু হঠাৎ করেই বিয়ের মত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা সহজ নয়। বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। অনেক ভাবনা চিন্তা করতে হয়। পরিবারিক ব্যাপারও আছে। ও তো শুধু সেইজন্যেই জিজ্ঞেস করেছিল। আদ্রিয়ান শান্ত গলায় বলল,

” তোমার কী মনে হয়? কেন বিয়ে করেছি আমি তোমাকে?”

আদ্রিয়ানের এমন ঠান্ডা গলার সাথে অনিমা পরিচিত। এটা একপ্রকার বিপদ সংকেত। তাই অনিমা একটু ভয়ে ভয়ে বলল,

” আমি কীকরে বলব? আপনি কেন বিয়ে করেছেন সেটাতো আপনি ভালো বলতে পারবেন তাইনা? ”

আদ্রিয়ান মাথা নাড়িয়ে বলল,

” কান্ড তো তুমি ঘটিয়েছ। কারণটা আমি ভালো কীকরে জানবো?”

আদ্রিয়ানের কথায় অনিমার একটু অভিমান হল। ও মাথা নিচু করে অভিমানী গলায় বলল,

” হুম। দোষটা আমারই। আমারই আপনাকে শুরুতে সবটা বলা উচিত ছিল। তাহলে আপনি প্রথমেই সবটা সামলে নিতে পারতেন। এতোটা সিনক্রিয়েট হত না। আর আপনাকে আমায় বিয়ে করতেও হতোনা।”

কথাটা শেষ করতেই আদ্রিয়ান অনিমার কোমর চেপে ধরে টেনে ওর দিকে টেনে এনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। অনিমা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। আদ্রিয়ান খানিকটা শক্ত কন্ঠে বলল,

” এই মুহূর্তে আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? তোমার ঐ তুলতুলে নরম গাল দুটোতে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে। কিন্তু তোমার ভাগ্য অনেক ভালো আজ আমি সেটা করব না। কারণ প্রথমত আজ এমনিতেই তোমার ওপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে। আর দ্বিতীয়ত আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। সুতরাং আজ কোন মারামারি না শুধু প্রেম হবে।”

অনিমা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। লোকটা আসলেই অদ্ভুত। কখন তার মুড কেমন থাকে সেটা উনি ছাড়া কেউ জানেনা, আন্দাজও করতে পারেনা। যেমন ও ভেবেছিল এই ছেলে এখন ওকে আচ্ছা ধোলাই দেবে। কিন্তু তা হলোনা। সে তো এখন অন্য গান গাইছে। অনিমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিয়ান ভ্রু নাচালো। অর্থাৎ ‘কী দেখছ?’ অনিমা মাথা নেড়ে বোঝালো ‘কিছু না’। তারপর আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

” অনেকটা রাত হয়েছে। ঘুমাবেন না? চলুন!”

আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের সাথে আরও ভালোভাবে মিশিয়ে ধরে বলল,

” উমহুম। আজ কোথায় যাচ্ছিনা। আজ নিচে ঘুমাতে গেলেই দুজনকে আলাদা আলাদা রুমে ঘুমাতে হবে। কারণ বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। তুমি প্রস্তুত ছিলেনা একদমই। আমিও যে খুব বেশি তৈরী ছিলাম তা না। আমি চাই তোমাকে একটু সময় দিতে। আপাতত ব্যাপারটা এই অবধিই রাখতে চাইছি আমি। তাছাড়া বিয়েতো হয়েছেই আমাদের। অপেক্ষা করলে সমস্যা কোথায়। এটা তো সত্যি তুমি আমার বউ। মিসেস আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের।”

অনিমার মন হালকা কেঁপে উঠল শেষের কথাটা শুনে। সত্যিই ও আদ্রিয়ানের বউ এখন। আদ্রিয়ানের নামের সাথে ওর নাম জড়িয়ে গেছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটার বউ হতে পেরেছে। ওর পাশে বসা মানুষটা এখন ওর। শুধুই ওর। এসব ভাবতে ভাবতে নিজেও আদ্রিয়ানের পেটের ওপর হাত রেখে বুকের পাশে মাথা রেখে দিল। আদ্রিয়ান একহাতে অনিমার মুখের পাশের চুলগুলো সরাতে সরাতে বলল,

” তাই আজকের এই বিশেষ রাতটা একসঙ্গে কাটাতে চাই!”

অনিমা কিছু একটা ভেবে বলল,

” আঙ্কেল, আন্টির সাথে কথা বলেছেন?”

” হ্যাঁ। রেগে আছে একটু। তোমাকে বিয়ে করেছি বলে না, ওনাদের দেরীতে ফোন করেছি তাই। তোমাকে নিয়ে ওনাদের সমস্যা নেই। দেখো, কাল পরশুই ফোন করবে তোমার কথা বলার জন্যে। এরপর আমাকে ভুলে তোমাকে নিয়ে নাচবে। আমার মিষ্টি বউ বলে কথা।”

অনিমা আর কিছু বলল না। এখন একটু লজ্জা লজ্জা লাগছে ওর। একজন সার্ভেন্ট দুটো মগে কফি দিতে এল। ওনাকে দেখে অনিমা আদ্রিয়ানকে ছেড়ে দিলেও অাদ্রিয়ান ওভাবেই জড়িয়ে ধরে বসে রইল ওকে। মেয়েটি ওগুলো রেখে দ্রুত মাথা নিচু করে চলে গেল। অনিমা বিরক্তি নিয়ে বলল,

” এরকম করলেন কেন? কী ভাবলো ও?”

” কী ভাববে? কেন ভাববে? আমার বউ আমি ধরেছি তাতে কার কী?”

অনিমা কিছু বলল না। আদ্রিয়ানের মুখে বারবার ‘বউ’ শব্দটা শুনে কেমন একটা ফিল হচ্ছে ওর। আদ্রিয়ান অনিমাকে ছেড়ে একটা কফিমগ অনিমার দিকে এগিয়ে দিলো। অনিমা কফি মগটা নিয়ে দূরে সরতে নিলেই আদ্রিয়ান আবারও একহাতে ওকে বুকে জড়িয়ে নিল। অনিমা আর কিছু বলল না চুপচাপ ওভাবেই কফির মগে চুমুক দিতে লাগল।
বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে। দুজনেই চুপচাপ আছে। কফি শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আদ্রিয়ান এখনও বুকে জড়িয়ে রেখে দিয়েছে অনিমাকে। আদ্রিয়ান অনিমার চুলে আঙ্গুল নাড়তে নাড়তে বলল,

” জানপাখি!”

অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে আদ্রিয়ানের টিশার্টের ওপর নখ ঘষতে ঘষতে বলল,

” হুম।”

” তুমি খুশি তো!”

” আপনি খুশি?”

” আমার জীবনের সেরা দিনগুলোর মধ্যে একটা এটা।”

অনিমা চোখ তুলে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” এতো খুশি হওয়ার কারণ? আপনি যেরকম মানুষ আপনিতো আরও বেটার কাউকে ডিসার্ব করতেন। আরও সুন্দরী, হায়ার ক্লাসের মেয়ে পেতে পারতেন। সেখানে আমার মত একটা মেয়েকেই কেন?”

আদ্রিয়ান এবার একটু রাগী কন্ঠে বলল,

” অনি আই সোয়ার আমি কিন্তু এবার আর কোন ফার্স্ট নাইট টাইট দেখব না। সত্যিই মেরে দেব কিন্তু!”

অনিমা কিছু না বলে সাথেসাথেই আদ্রিয়ানের বুকে গুটিয়ে গেল। ব্যাস! আদ্রিয়ানের রাগটাও সাথেসাথেই জল হয়ে গেল। ও আবার অনিমার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল,

” জানপাখি আজকাল খুব চালাক হয়ে যাচ্ছো তুমি।”

অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে রেখেই হাসল। আদ্রিয়ান বলল,

” কাল আমার ভাই আসছে। কাজিন ব্রাদার।”

” কখন আসবে?”

” এসে দুপুরে খাবে বলেছে।”

অনিমা কিছু বলল না। এভাবে গল্প করতে করতে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেল। আদ্রিয়ান খেয়াল করল যে অনিমা ঘুমিয়ে পরেছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে অনিমাকে বুকে রেখেই দোলনার সাথে হেলান দিয়ে বসল। অনিমা একদম নিশ্চিন্তে আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। ‍যেন এরচেয়ে নিরাপদ জায়গা ওর কাছে কিছুই নেই। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় একটা চুমু দিয়ে ওকে আরও শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রাখল। এই মেয়েটা এখন ওর বউ। ওর নিজের। এরচেয়ে ভালো অনুভূতি ওর জন্যে আর কী হতে পারে! কিন্তু এটা ভেবেও চিন্তা হচ্ছে যে এখন অনিমার কথা সবাই জানে। এখন ওকে আর ওকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এখন ওকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আগলে রাখতে হবে ওর জানপাখিকে। যেন নতুন কোন ঝড় ওকে ছুঁতে না পারে।

______________

রিক খুব দ্রুত রেডি হচ্ছে। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে এমনিতেই। এতক্ষণ কেন ঘুমালো সেটাই বুঝতে পারছেনা। যেতে যেতে এবার প্রায় বিকেল হয়ে যাবে। তাই ঘুম থেকে উঠেই কোনদিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হতে শুরু করেছে। স্নিগ্ধা রুমের কোণে দাঁড়িয়ে হাত কচলে যাচ্ছে। ও জানে আজ রিক যদি আদ্রিয়ানের বাড়িতে যায় তাহলে ভয়ংকর কিছু একটা হয়ে যাবে। কিন্তু রিককে আটকাচ্ছে না কারণ একদিনতো জানবেই। ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো। রেডি হয়ে রিক স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আসছি আমি।”

স্নিগ্ধা শুধু মাথা নাড়ল। রিক বেড়িয়ে ড্রয়িংরুম পাস করতে যাবে তখন ওর রঞ্জিত চৌধুরী বলে উঠল,

“কোথায় যাচ্ছো?”

রিক দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,

” তুমিতো জানো, আজ আদ্রিয়ানের বাড়ি যাচ্ছি।”

রঞ্জিত চৌধুরী গম্ভীর স্বরে বললেন,

” আজ না অন্যদিন যেও। বিকেলে একটা..”

রিক বিরক্তি নিয়ে বলল,

” ড্যাড প্লিজ। এতদিন যখন নিজেরা সব সামলে নিয়েছ। আজকেও পারবে। তোমার রোজ রোজকার এসব আমার আর ভালো লাগছে না। আমিও মানুষ! একটু শান্তি দাও। আমি যাচ্ছি। মামা আমি এলাম। মা কে বলে দিও।”

বলে রিক বেড়িয়ে গেল। রঞ্জিত চৌধুরী কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কবির শেখ আটকে নিয়েছে ওনাকে। রঞ্জিত চৌধুরী রেগে বললেন,

” থামালেনা কেন ওকে?”

কবির শেখ রিকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,

” আজ ও যেতোই। আটকে লাভ হতোনা। খেলার মোর ঘুরেছে। এবার নতুন কিছু ভাবতে হবে।”

” কিন্তু কী ভাবব? আর সারা দুনিয়ায় এতো জায়গা থাকতে তোমার ঐ ভাগ্নের বাড়িতে গিয়েই পরল মেয়েটা? তোমার ভাগ্নে আবার ওকে বিয়েও করে নিল?”

কবির শেখ গভীর ভাবনায় থেকে বলল,

” এটাই তো প্রশ্ন! আদ্রিয়ানই কেন? কিছুতো গন্ডগোল আছেই। কিছু একটা হয়েছে আমাদের অগচরে। ঐ ছেলেটা সুবিধার না। তারওপর সিলেটের ঐখানেও ঐ বুড়িকে পেলাম না। গেলোটা কোথায়!”

বলে টেবিলে ঘুষি মারলেন উনি। রঞ্জিত চৌধুরীর চোখেমুখেও ভীষণ গাম্ভীর্য আর চিন্তা।

____________

এদিকে যাওয়ার পথে রিক কানাঘুষায় শুনতে পেল আদ্রিয়ান কাল বিয়ে করেছে। রিক একটু অবাক হল। গুজব নয়তো? আদ্রিয়ান বিয়ে করলেতো ওকে বলবে তাইনা? এসব ভাবতেই আদ্রিয়ানের ফোন চলে এলো। রিক ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদ্রিয়ান বলে উঠল,

” ঐ তোর না দুপুরে এসে খাওয়ার কথা? কটা বাজে?”

” আমার কথা ছাড়। কী শুনছি? তুই বিয়ে করেছিস? ”

আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইতস্তত করে বলল,

” হ্যাঁ কালকেই করেছি।”

” শালা, দাওয়াত তো দূর জানালিও না? এটা কোন কথা হল নাকি?”

” আরে সব অনেক দ্রুত হয়ে গেছে। নিজেও রেডি ছিলাম না। আয় সব খুলে বলছি। আর নেটে ঢুকলেই আমার বউয়ের ছবি পেয়ে যাবি।”

রিক হেসে বলল,

” ঢোকার ইচ্ছে ছিল কিন্তু এখন আর ঢুকবোনা। একবারে সামনাসামনি ভাবিকে দেখব। ভাবিটা নিশ্চয়ই তোর মায়াবিনী?”

আদ্রিয়ানও হেসে দিয়ে বলল,

” হ্যাঁ ওই আরকি। যাই হোক কখন আসছিস?”

রিক একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,

” পৌছাতে পৌছাতে বিকেল হবে। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেছে।”

” আচ্ছা দ্রুত আয়।”

রিক ফোনটা রেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। যদি ওর নীলপরী আজ ওর কাছে থাকতো তাহলে হয়তো এতোদিনে ওদের বিয়ে হয়ে যেত। কোথায় আছে মেয়েটা কে জানে?

____________

অনিমা আর জাবিন মিলে কিচেনে কয়েকরকম স্নাকস বানাচ্ছে। আসলে রিক বলেছে যে ও দুপুরে বাইরেই খাবে। তাই অনিমা ভাবল যে বিকেলের ভালো কিছু স্নাকস বানিয়ে রাখুক। এসে খেতে পারবে। এতোকিছুর মধ্যে অনিমা জিজ্ঞেস করেনি আদ্রিয়ানের ঐ ভাইয়ের নাম কী? তেমন আগ্রহ নেই ওর। জাবিনও ‘ভাইয়া’ বলে সম্বোধন করছে। আদ্রিয়ানও নাম নেয়নি। এদিকে আদ্রিয়ান, অভ্র আর নাহিদ মিলে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছে। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। নাহিদ বলল,

” রিক এসে গেছে বোধ হয়।”

আদ্রিয়ান উঠে গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে দেখে সত্যিই রিকই দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই হেসে দিয়ে একে ওপরকে জড়িয়ে ধরল। আদ্রিয়ান ছাড়িয়ে বলল,

” আয় ভেতরে আয়!”

রিককে নিয়ে ভেতরে আসার পর রিক অভ্র আর নাহিদ দুজনকেই জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করল। দুজনকেই চেনে ও আগে থেকে। নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল,

” দেশে এলি কবে?”

” এইতো আদিবের বিয়েতেই এসছি।”

রিক উৎসাহি চোখে চারদিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

” ভাবী কোথায়? কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস? তাড়াতাড়ি সামনে আন। দেখি কোন মায়াবিনীকে এভাবে হুট করে বিয়ে করে নিলি!”

আদ্রিয়ান একটু শব্দ করে হেসে দিয়ে বলল,

” আরে আনছি। এতো অধৈর্য হচ্ছিস কেন?”

বলে আদ্রিয়ান রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে জোরে ডাকল,

” অনি!”

‘অনি’ নামটা শুনে রিকের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। বিস্ফোরিত চোখে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। অনি? কোন অনি? ওর নীলপরী নয়তো? না এরকম হতে পারেনা। দুনিয়াতে কী অনি নামের ঐ একটা মেয়েই আছে না-কি? নিশ্চয়ই অন্যকেউ। হ্যাঁ অন্যকেউ। তখনই অনিমা হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বলল,

” জি ডাকছিলেন?”

অতি পরিচিত কন্ঠ শুনে রিক অবাক হয়ে তাকালো সেদিকে। তাকিয়ে সত্যিই সত্যিই অনিমাকে দেখে ও থমকে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। অনিমা এখানে আছে? আর ও এখন আদ্রিয়ানের বউ? মানে ওর নীলপরী এখন ওরই ভাইয়ের বউ? অনিমার দৃষ্টি রিকের ওপর পরতেই ওর পা থেমে গেল। ওও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রিক এখানে কী করছে? এখন কীকরে এলো? গা কাঁপছে ওর। মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। নিজের অজান্তেই দুকদম পিছিয়ে গেল অনিমা।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে