বন্ধন পর্ব-৭

0
1181

#বন্ধন
পর্ব-৭
#tani_tass_ritt

সালমা বেগমের অবস্থা দেখে তিতলি বেশ মজা পেলো।সে উঠতে উঠতে বললো,”আরে খালামনি ভয় পেয়েছো নাকি? আমি তো মজা করছিলাম।কারো কাছ থেকে কিছু চাওয়ার অভ্যেস বরাবরি আমার ছিলো না।”

সালমা বেগমের মুখটা ছোট হয়ে গেলো।তারা মেয়েটাকে ঠিক কতখানি কষ্ট দিয়েছে ভাবতেই তার ভেতরটা হাহাকার করে।

“আমি স্কলারশিপ পেয়েছি।এক মাস বাদে আমার ফ্লাইট।আশা করি তোমাদের কারো আপত্তি নেই।”

সালমা বেগম কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না।কোন মুখ নিয়েই বা আটকাবেন।মেয়েটার জীবন নিয়ে অনেক তো ছেলেখেলা হলো।এবার না হয় সে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নেক।সালমা বেগমের চোখ টা ভরে এলো।

“এমা তুমি আবার কাঁদছো কেনো? আমি কি একবারে চলে যাচ্ছি নাকি।আর তাছাড়া পড়ালেখা শেষ হলে জব পেলে তোমাকেও নিয়ে যাবো কেমন।”
সালমা বেগম এবার নিজেকে সামলাতে পারলেন না।তিতলিকে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলেন।অন্যসময় হলে হয়তো তিতলিও তার খালার সাথে তালে তাল মিলিয়ে কাঁদতো।কিন্তু এখন কেন যেনো তার কান্না আসে না।হয়তোবা তার ভাগের কান্না সে আগেই কেঁদে ফেলেছে।

এইদিকে অভ্র অনেক চেষ্টা করেও মাহাদির সাথে দেখা করতে পারেনি। কিন্তু অভ্র হাল ছাড়ার পাত্র নয়।এর আগেও সে চেষ্ট করেছে। দরকার হলে প্রতিদিনই চেষ্টা করবে।কিছু প্রশ্নের উত্তর যে তার চাই।তাছাড়া তিতলির স্কলারশিপের লেটার দেখে অভ্রের মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।তিতলিকে কোন অধিকারে সে আটকাবে! অভ্রের ইচ্ছে করছে সব ছেড়ে ছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে।অভ্র মনে মনে ঠিক করলো তার শেষ চেষ্টা করতেই হবে।আজ ই সে তিতলির সাথে কথা বলবে।

রাত ১১ টার দিকে অভ্র বাসায় ফিরেছে।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা।তাকিয়ে থাকতে পারছেনা। অল্প কিছু খেয়ে মেডিসিন নিয়েছে।ভেবেছিলো তিতলির সাথে কথা হবে।কিন্তু মন শরীর কিছুই সায় দিচ্ছে না।রাইমা অনেক্ষন ধরে অভ্রের এই অবস্থা দেখছে।অভ্রের কাছে যাওয়ার সাহস ও পাচ্ছেনা। দেখা যাবে চিল্লাফাল্লা শুরু করে দিয়েছে।তাছাড়া মাহাদির সাথে দেখা হয়েছে নাকি এটা নিয়েও তার বেশ চিন্তা লাগছে।
সব চিন্তার অবসান ঘটিয়ে রাইমা ড্র‍য়ের থেকে মুভ নিয়ে অভ্রের সামনে যেয়ে দাড়ালো।অভ্র চোখের উপর এক হাত দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।রাইমার উপস্থিতি টের পেয়েও কিছু বলছে না।

রাইমা অভ্রের পাশে বসে আঙুলে মুভ নিয়ে আলতো করে অভ্রের কপালে দিয়ে হাত বুলাতে লাগলো।অভ্র কিছু বলছে না।বেশ আরাম লাগছে তার।আর কত!ঝগড়া করতে করতে সে নিজেও হাপিয়ে গিয়েছে।

অভ্র চোখ বন্ধ করেই বললো,”মাহাদি আর তোর বিয়ে ভাঙার কারণ টা কি রে?”
অভ্রের প্রশ্নে রাইমার বুক ধক করে উঠলো।সে আমতা আমতা করে বললো,”এগুলো এখন কেনো জিজ্ঞেস করছো?”
“প্রশ্নের পরিবর্তে প্রশ্ন করা আমার পছন্দ নয়।”
রাইমা ভয়ে ভয়ে বললো,”আমি জানিনা। বিয়ের দুদিন আগে ও ফোন দিয়ে বলে বিয়ে করবে না।আমিও কারণ জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাকে বলেনি।আর তুমি তো জানো ও এক কথার মানুষ। যা মনে চায় তাই করে।”
রাইমার কথা যে অভ্রের খুব একটা বিশ্বাস হয়নি তা বোঝাই যাচ্ছে।কিন্তু অভ্র কিছু বললোনা।দুজনই চুপ।
অভ্র কিছুক্ষণ পর আবার বললো,”তুই তো জানতি আমি তিতলিকে ভালোবাসি।বিয়ের দিন তোকে আলাদা করে ডেকেও বলেছিলাম।অনেক মিনতি করেছিলাম তোর কাছে যাতে তুই নিজে থেকেই পিছিয়ে যাস।তারপর ও আমায় বিয়ে কেন করলি?এমন একটা মানুষকে বিয়ে করে কি সুখ পেলি যে তোকে ভালোইবাসে না!আর কোনোদিন ভালো বাসতেও পারবেনা!”

অভ্রের প্রতিটা কথা রাইমার বুকে তীরের মতো বিধেছে।সে মনে মনে ভাবছে”সেদিন তো তার মাথায় ভুত চেপেছিলো। এতো বছরের ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাবো। এই লোভ সামলাতে পারিনি।তবে এখন ঠিক ই বুঝতে পারছি কত বড় ভুল করেছি।”
রাইমা চুপ থাকতে দেখে অভ্র বললো,”কি হলো? কিছু বলছিস না যে?”
“আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলোনা।পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য তোমায় বিয়ে করতে হয়েছে।”
রাইমার এই উত্তরটাও অভ্রের খুব একটা বোধগম্য না হলেও কিছু বললোনা।
রাইমা এখনো অভ্রের মাথায় হাত বুলোচ্ছে।একটা সময় অভ্র ঘুমিয়ে পরলো।অভ্র ঘুমানোর পর রাইমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।আজ না হয় কোনোভাবে অভ্রকে বুঝিয়ে দিয়েছে।শরীর খারাপ ছিলো বলে অভ্র ঘাটায় নাই।কিন্তু আবার যদি জিজ্ঞেস করে।সেদিন রাতে রাইমার আর ঘুম হলোনা।

এর মাঝে কেটে গিয়েছে এক সপ্তাহ। অভ্র এখন আর রাইমার উপর চিল্লায় না। সকালে উঠে অফিস চলে যায় । বেশ রাত করে ফিরে। এভাবেই তার দিন কাটছে।অভ্র যে সব কিছু থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।সে চায় না তিতলির সুখে বাধা দিতে।স্কলারশিপ পাওয়ার পর অভ্র প্রথম এই ছয় মাসে তাকে হাসতে দেখেছে। অভ্র চায় না এই হাসি কেড়ে নিতে।তাছাড়া সে তো ভাগ্যের কাছে হেরে গিয়েছে।
এইদিকে রাইমা সর্বোক্ষন ভয়ে ভয়ে থাকে।এই বুঝি অভ্র সবটা জেনে যাবে।অভ্রকে হারানোর ভয় সর্বোক্ষন তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।

★★★★★★★★★

সকাল থেকেই মুশলধারে বৃষ্ট পরছে।সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো বৃষ্টি থামছেইনা।অভ্র অফিসে বসে বসে তিতলির কথা ভাবছে।এমনি বৃষ্টির দিনে তারা একসাথে কত ভিজেছে।বৃষ্টি হলেই তিতলির মাথা খারাপ হয়ে যেতো ভেজার জন্য। তাও আবার সে একা ভিজবে না।প্রতিবার বায়না ধরতো অভ্রকেও তার সাথে ভিজতে হবে।অভ্র বেচারার বাধ্য হয়েই ভিজতে হতো।তবে আজ বড্ড মিস করছে সে এই বৃষ্টিতে ভেজা।
এইসব ভাবনায় তার ছেদ ঘটলো রফিক সাহেবের ডাকে।রফিক সাহেব অভ্রের কলিগ।
“কি ব্যাপার অভ্র সাহেব! আপনাকে বেশ অন্যমনস্ক লাগছে।”
অভ্র মৃদু হেসে বললো,”তেমন কিছুনা।”
রফিক সাহেব অভ্রের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললো, “কাল আপনার জন্য এই লেটার টা এসেছিলো।দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
অভ্র খাম টা হাতে নিয়ে খামের উপর লিখা নাম টা দেখে চমকে গেলো।

এইদিকে মাহাদির কল পেয়ে রাইমা চমকে উঠলো।সে ভয়ে ভয়ে ফোনটা রিসিভ করলো।
“হ্যালো মিসেস অভ্র, কেমন আছেন?”
মাহাদির কথার টোনটাই অন্যরকম লাগছে রাইমার কাছে।
“অভ্র যে আমাকে খুঁজে অস্থির অবস্থা।কি বলো আমি কি তার সাথে দেখা দিবো?”
রাইমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
“তুমি কি চাও মাহাদি? এমন কেনো করছো?”
মাহাদি হেসে বললো,”আমি যে শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম।কিন্তু তুমি কি খেলাটাইনা খেললে।”
“মানে আমি কি খেলেছি?”
“আর কত মিথ্যে বলবে? কি ভেবেছো আমি কিছু বুঝিনি?তুমি তো জানতে আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি।আর এই ভালোবাসার সুযোগ তুমি নিয়েছো খুব ভালো করেই।”
রাইমা আমতা আমতা করে বললো,”আমি কোনো সুযোগ নেইনি।একদম মিথ্যে বলবে না।আমি তো তোমাকে বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম।কিন্তু তুমি ই তো এই বিয়ে ভেঙে দিয়েছো।”
মাহাদি বললো,”নাটক টা কিন্তু ভালোই সাজিয়েছিলে।নাটক সিনেমাও হার মানিয়েছো তুমি।আচ্ছা তুমি বলো আজ বাদে কাল যেই মেয়ের সাথে বিয়ে।সে যদি বিয়ের দুদিন আগেও মেহেদিতে তার হবু স্বামীর নাম না লিখে তার পুরনো ভালোবাসার নাম লিখে রাখে তাহলে কোন ছেলের মাথা ঠিক থাকে!রাগের মাথায় না হয় কিছু একটা বলেই ফেলেছিলো ছেলেটা।হাজার হোক নিজের ভালোবাসার মানু্ষের হাতে অন্য কারো নাম কি মেনে নেয়া যায়! ওমা মেয়েটা কি করলো এর সদব্যাবহার করলো।তিলে কে তাল বানিয়ে ভিক্টিম কার্ড প্লে করে সেই ছেলেটাকে ঠকিয়ে ফাদে ফেললো মেয়েটির সেই ভালোবাসার মানুষটাকে।”

রাইমা একদম চুপ হয়ে গেলো।কথা কেমন যেনো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
“জানো তো ছেলেটা মেয়েটাকে অনেক বেশি ভালোবাসতো।মেয়েটা যখন তার ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে ছেলেটাকে এসে বলতো তখন ছেলেটার মন ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতো।কিন্তু বুঝতে দিতোনা।ছেলেটার একটাই চাওয়া ছিলো মেয়েটা যাতে সুখে থাকে।একদিন মেয়েটা হার মেনে ছেলেটার ভালোবাসায় সারা দিলো।নিজ থেকে বিয়ে করতে চাইলো। বিশ্বাস করো ঐদিন যে ছেলেটা কত বেশি খুশি হয়েছিলো।কিন্তু এই খুশি বেশিদিন স্থায়ী হলো না।বিশ্বাস করো ছেলেটা ঐদিন প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে বলেছিলো যে সে এই বিয়ে করবেনা।কিন্তু এটা তার মনের কথা ছিলোনা।নিজেকে বোঝানোর সময় নিচ্ছিলো।আর এটা মেয়েটাও খুব ভালো করেই জানতো যে ছেলেটা মেয়েটার উপর কত বেশি দুর্বল
কিন্তু মেয়েটা ছেলেটার উপর বন্দুক রেখে তার সার্থ সিদ্ধি করে নিলো।আর ছেলেটাকে জীবনের চরম শিক্ষা দিয়ে গেলো।”
মাহাদির প্রতিটা কথায় রাইমার ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।তার এখন মনে হচ্ছে হিড়ে রেখে সে এতোদিন মরিচিকার পিছে দৌড়েছে।
“আমি জানি আজ তোমার বলার কিছু নেই।আমি তোমার থেকে কিছু শুনতেই চাইনা।জানোতো সেদিন তোমার বিদায়ের ঠিক ১ ঘন্টা পর আমি তোমার বাসায় গিয়েছিলাম তোমার পছন্দের আইস্ক্রিম নিয়ে।ভেবেছিলাম তোমার রাগ ভাঙাবো।কিন্তু আমি বড্ড বেশি দেড়ি করে ফেলেছিলাম।কেনোনা তখন তুমি অন্য কারো স্ত্রী। অন্য কারো ঘরের বউ হয়ে গিয়েছো।তোমার মা আমাকে থাপ্পড় মেরেছিলো।আমি নাকি তোমাদের ঠকিয়েছি।তখন নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে অসহায় মনে হচ্ছিলো।”
রাইমা কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও।আমি ভুল করেছি।আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ।তুমি আমাকে যে শাস্তি দিবে আমি সবটা মাথা পেতে নিবো।আমাকে নিয়ে যাও।”
মাহাদি হাসতে হাসতে বললো,”তুমি যে একটা #বন্ধনে আবধ্য হয়ে গিয়েছো।তুমি কি পারবে বেড় হতে?”
রাইমা চুপ হয়ে গেলো।মাহাদির বুঝতে আর বাকি রইলোনা। সে ফোনটা কেটে দিলো।রাইমা ফোন হাতে নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।

তিতলির বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০ টা বেজে গিয়েছে।বৃষ্টির জন্য বান্ধুবির বাসায় আটকা পরে গিয়েছিলো।সে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিলো।স্কলারশিপের জন্য বেশ কিছু কাজ বাকি।

তিতলি হাত মুখ মুছতে মুছতে ড্রয়ের খুললো।ড্রয়ের খুলতেই সে চমকে গেলো।কি করে সম্ভব এটা!সে তো এখানেই রেখেছিলো।

চলবে…….

(।আজকের পর্ব পরে আপনাদের মন্তব্য জানাবেন)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে