ফিরে এসো ভালবাসা পর্ব-১১

0
1113

#ফিরে এসো ভালবাসা❤
#লেখিকাঃ নাবিলা আহমেদ রোজ
#পর্ব- ১১

শুভ্র অতীত থেকে ফিরে এলো। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। শুভ্র গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে এসে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে বললো।”

—-” ক্ষমা করে দিও ভালবাসা। কখনো তোমার মুখের হাসির কারণ হতে পারলাম না। ক্ষমা করে দিও ভালবাসা। সারাটা জীবন তোমাকে কষ্ট দিয়ে গেলাম। ইচ্ছেতে হোক বা অনিচ্ছাতে হোক। কিন্তুু এখনো তোমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি। আর আমি এটাও জানি আমার মৃত্যুর পরও তুমি অনেক কষ্ট পাবে,

শুভ্র আরো কতক্ষণ থেকে চলে গেলো। বাড়ি ফিরতে, ফিরতে সকাল হওয়ার উপক্রম হলো। বাড়ি ফিরে আর কলিং বেল চাপলো না। বাড়ির সামনের বাগানের বেঞ্চে বসে রইলো। সকাল ৮টার দিকে সে কলিং বেল চাপলো। শুভ্রর মা শুভ্রকে দেখে রেগে বললো।”

—-” সারারাত কোথায় ছিলি তুই?”

শুভ্র মাথা নিচু করে বললো,

—-” সরি আম্মু ফোন করতাম বাট চার্জ ছিলো না। আমি নওশাদদের বাড়িতে ছিলাম।”

শুভ্রর মা ভ্রু কুঁচকে বললো,

—-” কিন্তুু রাজ যে বললো তুই ওখানে ছিলি?”

শুভ্র গোল, গোল চোখ করে বললো।”

—-” কিহহহহ?”

শুভ্রর মা ভ্রু কুঁচকে রেখেই বললো,

—-” কোথায় ছিলি বলতো? তোর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাসনি।”

শুভ্র আমতা, আমতা করে বললো,

—-” আসলে আম্মু হয়েছে কি? আমি রিক, আশিক, রাহাত। আমরা নওশাদদের বাড়িতে আড্ডা দিয়েছি। রাজও ছিলো আমাদের সাথে। আর ও মজা করে বলেছিলো যে আমি ওর বাড়িতে।”

শুভ্রর মা সন্দেহর চোখে বললো,

—-” রিক গ্রাম থেকে এলো কবে?”

শুভ্র এবার বিরক্তি নিয়ে বললো।”

—-” তুমি আস্ক করো তোমার ভাতিজাকে,

বলে হনহন করে ভেতরে চলে গেলো। শুভ্রর মা আর ব্যাপারটা ঘাটলো না। উনি কিচেনে গিয়ে নিজের মতো কাজ করছে। শুভ্র রুমে এসে একটা বড় শ্বাস ছেড়ে শাওয়ার নিলো। এরপর রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। শুভ্রকে দেখে শুভ্রর মা বললো।”

—-” আবার কোথায় যাচ্ছিস?”

শুভ্র যেতে, যেতে বললো,

—-” ওয়েডিং কার্ড ছাপাতে।”

বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। শুভ্রর মা অবাক হয়ে দেখছে সব। শুভ্র রাহিকে ফোন করে আসতে বললো। রাহি এসেই একটু চুপ থেকে বললো,

—-” এসব করা কি জরুরি?”

শুভ্র কপাল কুঁচকে বললো।”

—-” কোন সব?”

রাহি তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

—-” এইযে বিয়ে, বিয়ে খেলা। এরপর রোজের সামনে নাটক করা। রোজ তো জানেও না তুমি ওকেই ভালবাসো। আর সেদিন তুমি ওকে দেখে ইচ্ছে করেই আমাকে ওসব বলেছিলে। এরপর আমার ক্লাসরুমের করিডোরেও ইচ্ছে করেই।”

শুভ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

—-” ইচ্ছে করেই ওমনভাবে দাড়িয়েছিলাম। যাতে করে ও আমাকে ভুল বোঝে। আর আমি আই লাভ ইউ ও ওকেই বলেছিলাম। ওর দিকে তাকিয়েই আই লাভ ইউ বলেছিলাম। মনে, মনে রেড রোজ বলেছিলাম। কিন্তুু ও ভেবেছে তোমাকে বলেছি। আমি চাই ও আমাকে ঘৃনা করুক। আমার জীবন থেকে সরে যাক। ও ওর জীবনটা নতুনভাবে সাজাক। আর তাইতো তোমার হেল্প নিতে হলো।”

রাহি ছলছল চোখে বললো,

—-” হুম জানি শুভ্র। তুমি রোজকে অনেক ভালবাসো। কিন্তুু তুমি সবাইকে বলে দিচ্ছো না কেন?”

শুভ্র রাহির দিকে তাকিয়ে বললো।”

—-” এটা শুনলে সবাই ভেঙে পড়বে। যেটা আমি নিজের চোখে দেখতে পারবো না। আমি মরে যাওয়ার পর কি হবে সেটা তো আমি দেখতে পারবো না,

রাহি একটা শ্বাস ছেড়ে বললো।”

—-” হুম সেটাই বরং ভাল,

শুভ্র হালকা হেসে বললো।”

—-” তুমি যাই করো রাহি। থ্যাংকস আমাকে হেল্প করার জন্য। ভালই হয়েছিলো তোমাকে হসপিটালে পেয়েছিলাম,

রাহি হেসে বললো।”

—-” এসব থাক শুভ্র চলো যাই,

__________________

এরপর ওরা ওয়েডিং কার্ড ছাপাতে দিয়ে গেলো। লোকটা জানালো অনেক কার্ড তাই কালকে দেবে। শুভ্র রাহিকে বাড়ি দিয়ে এলো। নিজে চুপিচুপি রোজদের বাড়ির সামনে গেলো। বাড়ি থেকে একটু দুরে গাড়িটা রাখলো। যাতে কারো চোখে না পড়ে। অনেকক্ষণ ওয়েট করার পরও রোজ ব্যালকনিতে এলো না। এসেছিলো এক নজর রোজকে দেখতে। কালকে যখন ওয়েডিং কার্ড দিতে আসবে। তখন রোজ কতটা কষ্ট পাবে ভেবেই শুভ্রর কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। শুভ্র গাড়ি ঘুড়িয়ে চলে গেলো। বাড়ি গিয়ে দেখলো নানুমনি এসেছে। শুভ্র দৌড়ে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো। উনি শুভ্রকে সরিয়ে বললো।”

—-” ভেবো না তোমার বিয়েতে খুশী হয়ে এসেছি। আমি এসেছি শুধুমাএ তোমার মায়ের জন্য,

শুভ্র নানুমনির পাশে বসে বললো।”

—-” নানুমনি তুমি রেগে আছো?”

নানুমনি হালকা হেসে বললো,

—-” কার উপর রাগ করবো? তোমার উপর?”

শুভ্র চুপচাপ বসে রইলো। কতক্ষণ পর বলে উঠলো।”

—-” নানুমনি রাহি অনেক ভাল মেয়ে,

নানুমনি উঠে দাড়িয়ে বললো।”

—-” সেটা আমি শুনতে চাইনি,

বলে উনি চলে গেলো। শুভ্র শুধু উপরের দিকে তাকিয়ে বললো।”

—-” এটাই চেয়েছিলে না?”

পরেরদিন ওয়েডিং কার্ড নিয়ে শুভ্র রোজদের বাড়ি এলো। ড্রয়িংরুমে তনয়া, রোদ, আর রোদের মা বসা ছিলো। শুভ্র আশেপাশে রোজকে খুজতে লাগলো। কিন্তুু কোথাও রোজকে পেলো না। রাহিও এসেছে শুভ্রর সাথে। শুভ্র রাহিকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। সবাই রাহির সাথে কথা বলছে। এরমাঝে উপর থেকে গান ভেসে এলো,

🎶ভোলে না, ভোলে না, ভোলে না, ভোলে না, ভোলে না, ভোলে না🎶
🎶সাথী ভালবাসা মন ভোলে না, সাথী ভালবাসা মন ভোলে না🎶
🎶ওওও কখনো চলার পথে দুটি পথ মিলে যায়🎶
🎶কখনো এভাবে তারা দুটি দিকে চলে যায়🎶

🎶মন তবু সাথে চলে না, সাথী ভালবাসা মন ভোলে না🎶
🎶সাথী ভালবাসা মন ভোলে না🎶

গানটা রোজই গাইছে। ব্যালকনিতে বসে হাতে গিটার। চেহারার কোন হাল নেই। মুখটা কেমন একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত। শুভ্র উপরের দিকে তাকালো। সুযোগ বুঝে উপরে চলে এলো।”

🎶ভালবাসা নয় জানি দুদিনের খেলা ঘর🎶
🎶তবু ঢেউ ভেঙে যায় হৃদয়ের বালুচর🎶২
🎶এত প্রেম নিয়ে বুকে, দুরে আছি কোন সুখে🎶
🎶এত প্রেম নিয়ে বুকে, দুরে আছি কোন সুখে🎶

🎶সেই কথা মন বলে না, সাথী ভালবাসা মন ভোলে না🎶

শুভ্র হাটতে, হাটতে রোজের রুমের সামনে চলে এলো। এক প্রকার উত্তেজিত হয়ে রুমে ঢুকতে গেলেই। শুভ্রর কানে বেজে উঠলো,

—-” আপনার ব্রেইন ক্যান্সার। এখন আপনার মৃত্যু সময়ের অপেক্ষা।”

ওমনি শুভ্রর পা দুটো থেমে গেলো। কিন্তুু শুভ্র নিজেকে আটকাতে পারছে না। ও রোজের রুমে চলে এলো। আস্তে, আস্তে ব্যালকনির সামনে গেলো। নিজেকে শক্ত রেখে গলা খাকারী দিয়ে বললো,

—-” এসব কি গান গাইছো?”

শুভ্রর গলা শুনে রোজ তাকালো। রোজকে দেখে শুভ্র থমকে গেলো। যেন এখনি শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। মনে, মনে করুন ভাবে বললো।”

—-” একি হাল হয়েছে আমার রোজের?”

রোজ শুভ্রকে দেখে বললো,

—-” আপনি এখানে?”

শুভ্র কোনরকম বললো।”

—-” একি হাল করেছো নিজের? এসব করে কি বোঝাতে চাইছো? আমার চিন্তায় এমন হয়েছো তুমি? আর এসব কি গান গাইছো? ইচ্ছে করে এই গান গাইছো না? আসলে বোঝাতে চাইছো আমাকে কত ভালবাসো,

রোজ এবার রেগে বললো।”

—-” ওয়েট মিস্টার শুভ্র। আপনি ভুলে যাচ্ছেন এটা আমার বাড়ি। আর কি বললেন? আমি এই গান গেয়ে বোঝাতে চাইছি আপনাকে ভালবাসি? ফার্স্ট অফ অল আমার বাড়িতে আমি গান গাইছি। আমি কিন্তুু আপনার বাড়িতে গিয়ে গান গাইছি না। এন্ড সেকেন্ড কারো রুমে ঢুকতে গেলে পারমিশন নিতে হয়। এই ম্যানার্সটুকু কি আপনার নেই?”

শুভ্র অবাক হয়ে বললো,

—-” তোমার রুমে ঢুকতে হলে আমার পারমিশন নিতে হবে?”

রোজ চোখমুখ শক্ত করে বললো।”

—-” হ্যা নিতে হবে। কারন আমি আপনার কেউ না,

শুভ্র সামান্য হেসে বললো।”

—-” হ্যা জানি ইনভাইট করতে এসেছি। হাজার হোক কাজিন বলে কথা,

বলেই শুভ্র ঘুরে গেলো। সাথে, সাথে টুপটুপ করে চোখের পানি পড়তে লাগলো। শুভ্র রুম থেকে বের হবে এমন সময় রাহি এলো। আর এসেই বললো।”

—-” বেবি চলো নিচে যাই,

শুভ্র রোজের দিকে না তাকিয়ে বললো।”

—-” ইয়াহ লেটস গো,

রাহি রোজের দিকে তাকিয়ে বললো।”

—-” আসি গো ননদিনী,

বলে হাসলো এরপর চলে গেলো। ওরা যেতেই রোজ কেঁদে দিলো। শুভ্র সবাইকে বলে চলে এলো।”

_________________

দেখতে, দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। ২দিন পরই সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাবে। শুভ্রর একটা বিষয় কেমন অদ্ভুত লাগছে। বিষয়টা ক্লিয়ার করার জন্য হসপিটালে এলো। যেই ডক্টর ওকে দেখেছিলো সে আজকে নেই। উনি আগামীকাল আসবে তাই শুভ্র চলে এলো। গাড়ি স্টার্ট দেবে এমন সময়ে রাহিকে দেখলো। শুভ্র রাহির কাছে গিয়ে বললো,

—-” তুমি এখানে?”

রাহি চমকে বললো।”

—-” তুমি এখানে কি করছো?”

শুভ্র গাড়ির কাছে গিয়ে বললো,

—-” আমি একটা ব্যাপার ক্লিয়ার হতে এসেছি।”

রাহি ভ্রু কুঁচকে বললো,

—-” কি?”

শুভ্র বড় একটা শ্বাস ছেড়ে বললো।”

—-” ব্রেইন ক্যান্সার হলে সাধারণত নাক, মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে জানি। কিন্তুু আমার তো তেমন কিছুই হচ্ছে না,

রাহি মুখের ঘাম মুছে বললো।”

—-” ডক্টর কি বললো?”

শুভ্র বিরক্তি নিয়ে বললো,

—-” ডক্টর আজকে আসেনি কাল আসবে।”

রাহি হালকা হেসে বললো,

—-” ওকে তুমি কাল এসো আমি যাই।”

বলে রাহি তাড়াতাড়ি চলে গেলো। শুভ্র কিছুটা অবাক হলো। তবে ভাবলো হয়তো কোন কাজ আছে। তাই শুভ্র গাড়ি নিয়ে চলে গেলো। এদিকে রোজ বলে দিয়েছে শুভ্রর বিয়েতে ও যাবে না। রোদ আর তনয়া গোল হয়ে রোজের বেডে বসে বললো,

—-” কেন যাবি না?”

রোজ এবার বিরক্তি নিয়ে বললো।”

—-” আমার ইচ্ছে করছে না তাই যাবো না,

রোদ কিছু বলতে গেলেই রোদ বললো।”

—-” ব্যাস আর কিছু বলবি না,

রোদ আর তনয়া গাল ফুলিয়ে চলে গেলো। রোজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসে রইলো।”

শুভ্র পরেরদিন আবার এলো ডক্টরের কাছে। ডক্টর শুভ্রকে দেখে বললো,

—-” আরে আপনি?”

শুভ্র চেয়ারে বসে বললো।”

—-” ডক্টর সত্যিই আমার ক্যান্সার তো?”

ডক্টর একটু ঘাবড়ে বললো,

—-” মানে?”

শুভ্র ডক্টরকে সব বললো। সব শুনে ডক্টর একটু হেসে বললো।”

—-” আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন? আপনি কিন্তুু ঔষুধ খাচ্ছেন। আর তার জন্যই আপনার নাক, মুখ দিয়ে ব্লাড পড়ছে না,

শুভ্র মুখ কালো করে বললো।”

—-” ওহ,

শুভ্র বেরিয়ে চলে গেলো। আর মনে, মনে বললো।”

—-” একটু আশা ছিলো সেটাও শেষ। আমি আর কয়েকদিন বাঁচবো,

শুভ্র হসপিটাল থেকে যেতেই রাহি এলো। রাহি ডক্টরের কেবিনে ঢুকে বললো।”

—-” থ্যাংক ইউ ডক্টর,

ডক্টর একটু চুপ থেকে বললো।”

—-” আপনি ওনাকে সত্যিটা বলছেন না কেন?”

রাহি রেগে বললো,

—-” সেটা আপনাকে বলবো না। আপনি বেশী বাড়াবাড়ি করলে কি হবে জানেন তো?”

ডক্টর ঢোক গিলে বললো।”

—-” জ্বি জানি,

রাহি শয়তানি হেসে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে এসে নিজের মনে বললো।”

—-” সত্যিটা কেউ জানবে না। আর যখন জানবে তখন অনেক দেরী হয়ে যাবো। ততদিনে আমি মিসেস শুভ্র চৌধুরী হয়ে যাবো। আর রোজ নিজের আসল ঠিকানায় পৌছে যাবে,

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে