প্রয়োজন পর্ব: ২০

0
813

#গল্প_পোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
প্রয়োজন পর্ব: ২০
লেখায়:তানিয়া তানু

চার বছর শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন করেছিলাম আমাকে কীভাবে চিনেন?
উত্তরে যা বললেন তা শুনে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে গিয়েছিলাম।

একটু শান্তস্বরে বলেছিলেন, “তোমাকে প্রথম দেখি তোমাদের স্কুলে জেএসসি পরীক্ষা ফলাফলের সময়। আমি কাছেই ছিলাম সেদিন। তুমিও এক পলক দেখেছিলে। কিন্তু সেদিন আমাদের পরিচয় হয়নি। তুমি টেনশনে ছিলে তোমার রেজাল্টের জন্য। আমি আর আকাশ বাইরে ছিলাম। তুমি নিলাকে নিয়ে একবার ক্লাসরুমে তো আরেকবার নোটিশবোর্ডের কাছে আসো। তোমার এই টেনশন দেখে মনে মনে অনেক হাসছিলাম। তারপর এলো তোমার বহু কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট। রেজাল্টে তোমার প্লাস এলো। তোমার সেই খুশি আর আনন্দ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মুচকি হাসিতে কিছুক্ষণ মেতে থাকলেও পরক্ষণে শব্দ করা হাসিতে মেতে ছিলে। তোমার সেই হাসির শব্দ আজো মনের মাঝে টুংটাং করে বাজে। যেটায় তোমার জন্য ভালোবাসায় পরিণত করেছিলো। তারপর তুমি আর কোনোদিন আমাকে দেখোনি। কারণ তোমার সামনে আমি আর যাইনি। আকাশ গেলেও আমি ব্যস্ত দেখিয়ে সেখান থেকে চলে এসে আড়ালে সারাক্ষণ তোমাকে দেখতাম। একদিন তুমি স্কুলে না আসায় প্রচন্ড কষ্টবোধ করছিলাম। দম বন্ধের মতো অস্বস্তিজনক অবস্থায় ছিলাম। পরে বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম তোমায় ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। প্রাণভোমরা হয়ে গিয়েছিলে তুমি। প্রতিদিন লুকিয়ে তোমাকে দেখা নেশা হয়ে গিয়েছিলো। তাই তো তুমি স্কুলে না এলে তোমার বাসার পাশে নুরু মিয়ার দোকানে চা খেতে খেতে তোমার বাইরে আসা যাওয়া গণনা করি। একবার দেখলে তৃষ্ণা মেটে না। বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। দোকানে সারাক্ষণ বসে থাকি। অপেক্ষা করি কখন তুমি বাইরে আসবে? টিউশনি করে বাসায় ফিরবে। টিউশনিতে গেলে সেখানে পিছু নেই। তার পূর্বে খোঁজ নেই টিউশনির সদস্য সংখ্যা। তাদের কোনো খারাপ ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কীনা? সেখানে ছেলেরা আছে কীনা? থাকলে তারা বিবাহিত তো? এগুলো না হলে প্রত্যেক টিউশনিতে আমার কনস্টেবল পাঠিয়ে তাদের মানা করে দেই। তোমার বাড়ির খোঁজও আমার এক মহিলা কনস্টেবল দিয়েছিলো। সে যাইহোক, তুমি বলবে তোমার মতো মধ্যবিত্ত মেয়েকে কেন পছন্দ করেছি? তার উত্তরে বলবো,তোমার হাসি, তোমার চাঞ্চল্যতা, তোমার চোখের শাসন এগুলোই ছিলো আমার ভালোবাসার মূল উপাদান। এগুলো থেকে বড় উপাদান ছিলো তুমি খুব সহজে মিশতে পারতে। তুমি সব ভালোবাসাকেই যথেষ্ট মর্যাদা দিতে। ছেলেদের দিকে কোনো আকর্ষণ ছিলো না। তাই পরকীয়া নিয়ে ভয় ছিলো না। কারণ আজকাল অনেক কেস আসে যেগুলোতে স্ত্রী পরকীয়া করে স্বামীকে খুন করেছে বা বাচ্চা রেখে পালিয়ে গেছে অন্য পুরুষের হাত ধরে। এগুলো দেখে মন সারাক্ষণ ব্যথিত হতো। তোমায় দেখে ভরসা করার মতো জায়গা পেয়েছিলাম।তোমার আচরণ দেখে বুঝেছিলাম তুমি ঐরকম মেয়ে হবে না। এই কারণে খুব বেশি করে ভালোবেসেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার একলা দেশের সঙ্গী হিসেবে তুমিই উপযুক্ত। আমি সঙ্গী নির্বাচনে বেশ সতর্ক থেকেছিলাম। কলেজ লাইফে কারোর দিকে তেমন নজরে তাকায়নি। কারণ আমার একলা দেশে যে সঙ্গী হবে সে হবে আমার একমাত্র সুখী থাকার কারণ। তোমায় আমি সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বেছে নেওয়াটা ভুল ছিলো।”

নির্বাক শ্রোতা হিসেবে প্রত্যেক কথাই মনোযোগ সহাকারে শুনছি। এত বছর ধরে উনি আমায় ভালোবাসেন। আমাকে আড়ালে দেখেন। তার সাথে টিউশনিও। তার জন্যই তো বলি, টিউশনি কেন এভাবে হাতছাড়া হচ্ছে। পিছনে যে উনি খেলার দান চালছেন সেটা তো জানা ছিলো না।কিন্তু একটা বিষয়ে ভাবালো, আমাকে এত বছর ধরে এত ভালোবাসেন। তাহলে বললেন না কেন? যেই ভাবা সেই উনাকে বলা। তাই উনাকে বললাম,

“ছেলেরা তো কাউকে ভালোবাসলে ঠাস করে বলে দেয়। যেমনটা আমি ছোট থেকেই দেখে আসছি। আপনি কেন বললেন না?

“ঐ যে তুই বললি না মধ্যবিত্ত মেয়েদের কেউ ভালোবাসে না। এর জন্যই বলি না। তরে প্রস্তাব সেদিন দিলে তো তুই তোর ক্লাসমেট শাওনের সাথে আমাকে তুলনা করতি। তারপর শাওনের মতো আমাকেও আকাশ ভুল বুঝে স্টিক দিয়ে মারতো।”

উনার তুই-তুকারি ভাষায় বেজায় মন খারাপ হলো। ভালোই তো তুমি করে বলছিলেন। তুই তে কেন নামলেন? উনার কী তবে রাগ বেড়েছে আবার? সে যাইহোক, শাওন আমার ক্লাসমেট। ক্লাস নাইনে ও আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলি। যেদিন প্রস্তাব দিয়েছিলো সেদিনের পরদিন আকাশ ভাইয়া কী মারটাই না মারলো! ভাইয়াকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, “তুই বেশ ছোট। তোরে ক্যান প্রস্তাব দিবো। শুন, কেউ তোরে ডিস্টার্ব করলে আমায় বলবি।” সেদিন মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে চলে এসেছিলাম।

শাড়ি থেকে লেগে থাকা বালু ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়ালাম। বিরক্তি না থাকলেও উনার কাছ থেকে আরো কিছু জানার আছে। তাই কৌতূহলী হয়ে অপেক্ষায় আছি কখন প্রশ্ন করার সুযোগ পাবো। কারণ এইবারো উনি মাথায় হাত দিয়ে চুল টান দিচ্ছেন। বুঝা যাচ্ছে বেশ রেগে আছেন।

চুল থেকে হাত সরিয়ে আচমকা আমার কাছে এসে গলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল হারখানা। ব্যথায় আহ করে উঠলেও নিজে সেটাকে পাত্তা দিলাম না। ব্যথা সরিয়ে উনার এহেন কার্যে ভারি অবাক হলাম। হারখানা নিয়ে যেতে যেতে বললেন, “নিকৃষ্ট মনের অযোগ্য মানুষকে উপহার বস্তু মানায় না।”
এতক্ষণ নির্বাক থাকলেও এখন থাকতে না পেরে কিছু বলতে চাইলে দেখলাম তিনি চোখের আড়াল হয়ে গেছেন। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই কাজটা উনি কেন করলেন? এমনভাবে বললেন যেন এটা উনি দিয়েছেন। আচ্ছা উনি সেই শুভাকাঙ্ক্ষী নয় তো?

“দীপ্তি, তুই এখানে?”
আকাশ ভাইয়ার কথা সহুনে হাতের তালু দিয়ে চোখে জল মুছে নিলাম। নিয়িনের ভাইয়ের প্রত্যেক কথাই বুকের মধ্যে তীরের মতো বিঁধছিলো। তাই না চাইতেও জলগুলো উপচে পড়লো গন্ডদেশ বেয়ে।

“ভাইয়া আমাদের দুবোনকে এই মূহুর্তে তোমার কার দিয়ে বাড়িতে পৌছে দিতে পারবে।” এখানে এক মূহুর্তও থাকতে ইচ্ছুক নই। বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছি। খুব কষ্টও হচ্ছে।

“এত রাত্রে তুই কেন যেতে চাচ্ছিস? কোনো সমস্যা হয়েছে কী?”

“আমি খুব অসুস্থবোধ করছি।”

“বাসায় কেন ডাক্তারের কাছে যাবি, চল?”

ভাইয়ার প্রশ্নে বিরক্তি হয়ে বললাম,”প্লিজ বাসায় ড্রপ করে দিবা কী না বলো। না হলে আমরা নিজেরাই যেতে পারবো।”
এই বলে সেখান থেকে চলে আসলে ভাইয়া বলেন সে আমাদের ড্রপ করে দিবে।

বেবলি অনেকবার জিজ্ঞেস করলো কেম চলে যাচ্ছি। বৌভাতে কী আমরা আসবো। উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। তবে এই বাড়িতে আর আসবো না এইটা নিশ্চিত।

গাড়ি থেকে নেমেই ভাইয়াকে টাকা দিলাম। বলে আসলাম আর কোনোদিন যাতে আমাদের টাকা না দেন। আমাদের থেকে আরো গরীব মানুষ আছে। তাদের যাকাত হিসেবে দিলে বেটার হবে। টাকা নিতে চাইলেন না। কিন্তু সিটে রেখে এলাম। অনেক কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার চোখ রাঙানো দেখে মুখে কুলুপ আটলেন।

“দীপ্তি তুই খাবি না?”
দীর্ঘ ভাবনায় হুঁশ এলো মায়ের কথায়। আমাদের রুমের মোমবাতি ফুরিয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে এতক্ষণ অতীতে বিচরণ করছিলাম। মায়ের হাতে মোমবাতি এনে বললাম, “এখন আর খাবো না।”
“খাবি না কেন? আয়।”
“জেদ ধরো না মা। যাও তো।” বিরক্তিকরভাব নিয়ে মাকে এই কথা বললাম।
“আচ্ছা যাচ্ছি। দে বাতি দে।”
“এটা আমার দরকার আছে।” বলেই মাকে তাড়া দিলাম চলে যাওয়ার জন্য। তিনিও চলে গেলেন।

অন্ধকারে ক্ষীণ আলোয় চারপাশে সব কিছুর অবস্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি বস্তু নয় মানুষ দেখছি। তার গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাসি দিলে গালে টুল পড়া দৃশ্য। বার বার দেখায় ভালো লাগলেও বড্ড অস্বস্তিতে পড়ছি। তাই জানালা দিয়ে অন্ধকারে থাকা কালো আকাশটাকে দেখছি। কিন্তু আফসোস! সেখানেও দেখা যাচ্ছে সেই মানুষটিকে। অসহ্যকর ভাব নিয়ে বিছানায় এসে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ দিলে হৃদয়পটে তার হাসিমাখা মুখ, চশমা ঠিক করার দৃশ্য, বার বার চুলে হাত দিয়ে চুল ঠিক করা দৃশ্য ভেসে উঠছে। খুব জ্বালাতন করছে এই বিষয়গুলো। মানুষটাকে মনে করলেই বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হচ্ছে। নদীর মতো উতাল পাতাল ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে মন। কী করে অয়নকে দূরে সরাবো? কয়েদিন না দেখে খুব করে জ্বালাচ্ছে। হৃদয়ে অনুভব করছি শূন্যতার জ্বালা।

এসব থেকে মুক্তি পেতে আলমারি থেকে একটা ব্যাগ বের করলাম। এই ব্যাগে অনেক জিনিস আছে। সবই শুভাকাঙ্ক্ষীর দেওয়া। সাজিয়ে রাখলে মায়ের চোখে পড়তে পারে তাই ভেবে আলামারিতে সযত্নে তুকে রেখেছিলাম। আজ বহুদিন পর ব্যাগ খুললাম। শেষবার শুভাকাঙ্ক্ষীর দেওয়া গিফট ছিলো শুধুমাত্র একটা চিঠি। ঐ চিঠিতে সে উল্লেখ করেছে ওর দেওয়া কোনো গিফটই আমি আজ পর্যন্ত ব্যবহার করিনি। ভেবেছিলো একবার না একবার আমি ব্যবহার করবো। তাই দিনের পর সিন সে কানের দুলের মতো ছোট বস্তু থেকেও শাড়ি পর্যন্ত গিফট করেছে। কিন্তু আমি একটাও ব্যবহার করিনি। এতেই সে ক্ষিপ্ত হয়েছে। চিঠিতে বলে দিয়েছে একদিন পূর্ণ অধিকার নিয়ে চাইবে তার দেওয়া জিনিসগুলো পড়ি। সে সময় নাকি তার কথা ফেরাতে পারবো না।

একটার পর একটা জিনিস খুলে উলটে পালটে দেখলাম। বেশ দামী উপহারই দিয়েছলো।দেখতে দেখতে চোখে ঘুম তলিয়ে এলো। তাই আবারো সযত্নে আলমারিতে তোলে রাখলাম।

চলবে,,,,,,,,,
বিঃদ্রঃ কেমন চলছে এই গল্পটা। জানাবেন প্লিজ। এতে ভীষণ অনুপ্রাণিত হবো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে