প্রেরক: সানজিদা তাসনীম রিতু – আমার সোনালী শৈশব,

0
426

#গল্পপোকা_চিঠি_প্রতিযোগিতা_২০২০
চিঠি নং-৪
প্রেরক: সানজিদা তাসনীম রিতু

আমার সোনালী শৈশব,
এ্যালবামের পাতায় পাতায় বন্দি জীবন কাটছে কেমন তোমার? ভালো না নিশ্চয়? জানো আমিও ভালো নেই। তোমার কথা মনে হলেই কেমন যেন একটা ধূসর গল্পের জগৎ সামনে চলে আসে। নির্ভার, চিন্তাহীন একটা সময় ছিল। কত কীই–না করেছি আমি সে সময়! কত গল্প, কত দুষ্টুমি আর কত খেলা। তুমি যখন আমার সাথে মিশে ছিলে জীবনটা অদ্ভুত রঙীন ছিল। অসাধারণ চঞ্চল আর অদম্য ছিল। তোমাকে খুব মনে পড়ে আমার, মনে পড়ে সেই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুমির কুমির খেলা, মনে পড়ে উঠানের কাঁদার মধ্যে গড়াগড়ি করে বৃষ্টিবিলাস করা, মনে পড়ে তড়তড় করে গাছে উঠে ফল চুরি করে খাওয়া। তোমার হাত ধরে ধানের মাঠের আইল ধরে ঘুড়ি উড়িয়ে দল বেঁধে ছুটে বেড়ানোর সেই দিনগুলো এত দ্রুত কেন চলে গেল বলোতো? চিল্লিয়ে পাড়া মাতানোর সেই উদ্দমতা কোথায় যে হারিয়ে গেল! এক ঝাঁক শৈশবের সাথে আম বাগানের মধ্যে কল-কাকলীতে মেতে উঠে আমাদের চড়ুইভাতি আর উদযাপিত হয় না। জানো, আম বাগানটা এখন আর নেই? ওখানে কারা যেন ইটভাটা বানিয়েছে। ঐযে একপাশে বাঁশ ঝাড় ছিল না? যেখানে আমরা ভয়ে ভয়ে যেতাম না কিন্তু খেলার ফাঁকে ফাঁকে ঝাঁক বেঁধে গিয়ে প্রাকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে আসতাম সেখানেও কতগুলো বাড়ি উঠেছে জানো? আর সেই যে আমাদের প্রিয় নবাব বাড়ির পুকুরটা ওটাও একদম শুকিয়ে গেছে, ওখানে আর কোনো শৈশব দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ে না।

আমার প্রিয় শিশু পার্ক,
সেই কত আগে আব্বুর হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে তোমার কাছে যেতাম। প্রতিবারই বাঘ আর বকের গল্পটা কতটা উত্তেজিত করতো আমাকে। তোমার সবুজ অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে একেকটা কৃত্রিম প্রাণিমূর্তি আনন্দের সাগরে ভাসাতো আমাকে। আব্বু চার টাকা দিয়ে এত্তগুলো বাদাম কিনে দিতো তারপর তোমার খোলা মাঠের সবুজের বুকে শুয়ে আকাশ দেখতাম আর বাদাম চিবুতাম। জানো! কিছুদিন আগে তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম, তোমার সৌন্দর্য ভরা সবুজের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নোংরামী আমাকে থাকতে দেয়নি সেখানে।

আমার পুতুল খেলার দিনগুলো,
আমার মেয়েগুলো ঐযে শ্বশুড় বাড়ি গেল আর তো এলো না! কি সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতাম পুতুল মেয়ে গুলো কে তখন। আমার স্মৃতিবাক্সের হাজারো স্মৃতির নীচে চাপা পড়া একটা পুতুলের বাক্স সেদিন বের করেছিলাম। আলতো আদরে ছুঁয়ে দেখেছিলাম ওদের। কোথায় হারিয়ে গেলে আমার সাজানো দিনগুলো? কেন আর সময় হয় না তোমার সাথে সব ভুলে হারিয়ে যাওয়ার? কেন আর বারবার আসর সাজিয়ে বিয়ে দিতে পারি না আমার পুতুল মেয়েদের? কেন হারিয়ে গেলে প্রিয় দিনগুলো?

আমার প্রিয় ছেলেবেলা,
আচ্ছা তোমারও কী আমার কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে কলাগাছ আর কচুরিপানা দিয়ে বানানো সেই ভেলাটার কথা? আমি স্কুল শেষে ফিরে এসে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলেই ছুটে যেতাম তারপর ভেলায় ভেসে, পুকুরে ডুবে, কাঁদামাটি মেখে বাসায় ফিরেই মায়ের বকা খেতাম। মনে পড়ে, সুপারি গাছের শুকনো ডাল কুড়িয়ে গাড়ি বানিয়ে টেনে নিয়ে বেড়ানোর সেই মন জুড়ানো খেলার কথা? রোজ বিকেলে যখন আইসক্রিম ওয়ালা আসতো মায়ের লুকিয়ে রাখা টাকা চুরি করে এক গাল হাসি নিয়ে দুই টাকা দিয়ে দু’হাতে দুইটা সকাল-সন্ধ্যা আইসক্রিম নিয়ে মেতে থাকতাম। বন্ধুদের সাথে মাঠে গোল হয়ে বসে সেই যে বানিয়ে বানিয়ে বলা ভুতের গল্প গুলোর আতঙ্ক, উফ! আর ভাইয়ার সাথে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়ানোর সেই রক্তিম বিকেল গুলো কতটা ক্লান্তিবিহীন ছিল তাই না? সারাদিনের অদম্য চঞ্চলতা, ছুটোছুটি শেষে সূর্য মামা তার সবটুকু সৌন্দর্য মেলে যখন ঢলে পড়তো পশ্চিমাকাশে আমিও মায়ের আঁচলের তলে ঘুমে ঢলে পড়তাম। কোথায় গেল সেই শান্তির ঘুম? সারাদিন ক্লান্ত হলেও কেন মায়ের আঁচলের তল খুঁজি না আর? সেই ভেলার দুলুনি আর বিকেলের চঞ্চলতা কেন আর খুঁজে পাই না? গোঁধূলীর আলো মেখে ঘুড়ির মতো আর কেন উড়ে বেড়ানো হয় না?

আমার নানা রঙের দিনগুলো,
কেন হারিয়ে গেলে আমার কাছ থেকে? কেন এক দমবন্ধ করা ঘুপচি ঘরের মাঝে আটকে ফেললে নিজেকে? চলো না আবার যাই মেতে উঠি বিহঙ্গের কলতানে, নেচে উঠি কলরবে, গেয়ে উঠি – অনির্বাণ মিত্র চৌধুরীর ‘পুরনো দিনের কথা’ কবিতার সেই আবেশিত পংক্তিগুলো,

ফেলে আসা কিছু স্মৃতি,
কিছু প্রিয় মুখ
ভালোবাসার আবেশ জড়ানো
কিছু চেনা সুখ।
কিছু কিছু সম্ভাবনা,
আর কিছু কল্পনা
বিস্মৃতির অতলে হারানো
কিছু প্রিয় ঠিকানা।
হারিয়ে খুঁজি নতুন করে
উল্টিয়ে স্মৃতির পাতা
আজ বারে বারে শুধু মনে পড়ে
পুরনো দিনের কথা।

আমার ফেলে আসা অতীত,
তোমার সোনালী ডানায় ভর করে কাটিয়ে দেওয়া প্রতিটা মুহূর্ত যদি আরেকবার ফিরে পেতাম! যদি আরেকবার তোমার ভেলায় ভেসে হারাতে পারতাম, আরেকবার… কী হবে আর এসব বলে তাই না? তুমি তো আমার সঙ্গে সঙ্গে ছায়া হয়ে হাঁটো। আমি আজীবন তোমার স্মৃতি মনে রেখে পথ চলতে চাই। মনের এক কোণে সব সময় ঘাপটি মেরে বসে থাকো প্রিয় শৈশবের অতীত তুমি। তোমার বন্ধনটাই এমন। কেমন লাগলো বলো তো স্মৃতির পাতায় পাতায় ঘুরে আসতে? আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। আমি একাই তোমাকে মনে করে করে কষ্ট পাবো না-কী! তুমিও একটু কষ্ট পাও। আমার মতো একটু ছটফট করো। আচ্ছা শোনো, অনেকটা লিখেছি, জানোই তো আমি/আমরা কত ব্যস্ত। তোমার জন্য কি এত সময় আছে বলো? ভালো থেকো আমার রূপকথার দিনগুলো, ভালো থেকো আমার রঙীন ডানামেলা দিনগুলো, ভালো থেকো। আমি আবারও রঙ ছড়াবো কোনো একদিন তোমার স্মৃতিমাখা আমার প্রিয় ক্যানভাসে। আবারও লিখবো তোমার কাছে চিঠি। পাঠিয়ে দিব আমার অতীত স্মৃতির তোমার ঠিকানায়, ততোদিনে আমাকে ভুলে যেও না কিন্তু…

ইতি
তোমার স্মৃতি আকড়ে বেঁচে থাকা
একজন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে