প্রেমকুঞ্জ পর্ব-০১

0
2165

#প্রেমকুঞ্জ 💓
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
#সূচনা_পর্ব

মেইন রাস্তা থেকে বেরিয়ে চৌরাস্তায় ঢুকতেই বুকটা ধক করে উঠল। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। আজও ছেলেটা গাছের কাছে বাইক নিয়ে বসে আছে। খেয়াল করছি তার হাত আর মুখের কাছে ব্যান্ডেজ করা। মনে হচ্ছে পুলিশরা বেধোরে পিটিয়েছে! তা তো মারবেই। মেয়ে ইভটিজিং’র কেসে তো জেলে ঢুকালাম কিন্তু একদিনের মাথায় বের হয়ে এলো কিভাবে। ধারণা বাবা’র হাত অনেক উপর অবদি আছে। তা না হলে আর এসব সম্ভব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছি। অভ্যাসমতো হাতের কলম টা আজ নেই। গতকাল অবদি ছিল কিন্তু আজ নেই। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কলমের অভাবে খোঁপা বাঁধতে পারছি না। এর মানে এটা না যে কলম নেই। কলম তো আছে কিন্তু ওরকম কলম শুধু একটিমাত্র ছিল। জন্মদিনে আমার ছোট ভাই তিতির উপহার দিয়েছিল। ঢাকা কলেজে ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে সে। আমি নিলুফার! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাবা আদর করে ডাকে নিলু। তখন আমি গম্ভীর মুখে বাবার সামনে এসে দাঁড়াই। বাবা পেপার হাতে আমাকে বলেন, চশমা টা দে নিলু, পাচ্ছি না।
আশপাশ চোখ বুলাতে হয় না কারণ চশমা সামনেই থাকে। আমার বাবা আবার কাছের জিনিস দেখতে পায়। এই একটা সমস্যা কিন্তু আমি যে দূর থেকে গম্ভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি এটা তিনি বেশ বুঝেন। তখন মুখ টিপে হাসে। গম্ভীরতা খানিকটা বেড়ে যায়!

বাতাস বয়ে যাওয়াতে চুল গুলো সামনে এসে বিরক্ত করতে লাগলো। আমি তা চুলে গুঁজে শাড়ির আঁচলটা উপরে উঠালাম। প্রতিদিন শাড়ি পড়ি না, গুনে গুনে প্রতি সাপ্তাহের বুধবার করে শাড়ি পড়ে আসি একটা বিশেষ কারণে। কিন্তু আজ মনটা খারাপ, যে কারণে এলাম তা কার্যসীদ্ধি হলো না। আজ আবশ্য খানিকটা সেজেছিলাম। তেমন কিছু না শুধু চোখে গাঢ় করে কাজল টানলাম আর একটা টিপ পড়লাম। এতেই আমার ছোট বোন শ্রেয়া এমন ভাবে তাকাল মনে হলো খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি। আমি একটু আধটু সাজলেই ও এমন করে। তখন হেসে হেসে বলে, তুমি তো এভাবেই সুন্দর আপা, এরপর এতো সাজগোজের কি দরকার বলো তো। কথাটা হয়তো বলে আমার প্রশংসার জন্য কিন্তু কেন জানি ওর কথা শুনলে আমার গা ছ্যাত করে উঠে। মনে মনে আমাকে খোঁচা মেরে বলছে। হ্যাঁ তিন ভাইবোনের চেয়ে হয়ত আমি একটু বেশিই সুন্দর কিন্তু তাই বলে এভাবে আলাদা করবে। তিতিরের অবশ্য এতে কোন দ্বন্দ্ব নেই যা আছে সব ছোটটার। ওর কথা শুনলেই বুঝি আমাকে হিংসে করে কথা গুলো বলে। কিন্তু ও তো কম সুন্দরী না। বেশ ডাগর ডাগর চোখ তার। আর আমার চোখ টানা। শ্রেয়ার চোখের পাতা গুলোও অনেক ক্ষণ শুধু গায়ের রং টা আমার থেকে ময়লা তা বলেই কি অসুন্দর। সারাদিন ঘরে সেজেগুজে বসে থাকে আর আমি এই কি না চুল আঁচড়ালাম ওমনি উঠে পড়ে লাগে!

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেটার দিকে তাকালাম। অনেক কিছু ভেবে ফেলেছি কিন্তু ছেলেটা একটি বারের জন্য এদিকে তাকাল না। হাতে কিসব নিয়ে জানি কি করছে।‌ পা কি আগাবো, ভয় করছে। যদি এসিড ছুঁড়ে মারে। নিশ্চয়তা নেই, গতকাল সে সহ তার আরো চার বন্ধুকে পুলিশের হাতে ধরে দিয়েছি আমি। এতো সহজেই কি রাগ কমে যাবে নাকি। মনে হচ্ছে না। যদি এসিড মেরে আমার মুখ ঝলসে দিতে চায় তখন। কেন জানি মনে হচ্ছে তখন সবচেয়ে বেশি খুশি হবে শ্রেয়া। কারণ সেই তো সুন্দরী খেতাব টা পাবে। যা আছে ভাগ্যে দেখা যাবে। আমি কাঁধের ব্যাগে হাত রেখে পা বাড়ালাম। সব পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখতে জানি। এই গুনটা অবশ্য পেয়েছি বাবা’র কাছ থেকে। ছেলেটার থেকে একটু দূরত্ব রেখেই হাঁটছি।

ছেলেটার পাশ দিয়ে যেতেই ছেলেটা ছোট করে ডাক দিল। ঠিক ডাক দিল তা না, বলতে গেলে একটু শব্দ করে কাশল আর নড়েচড়ে উঠল। আমি থমকে গেলাম। অনুভব করছি ছেলেটা বাইক ছেড়ে আমার পিছু এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে সামনে খুললাম। চোয়াল শক্ত করে ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটা এক নজর আমার চেহারার দিকে তাকাল। অতঃপর মাথা নিচু করে ফেলল। যা ভেবে ছিলাম ঠিক তাই, ছেলেটার হাতে মুখে ব্যান্ডেজ করা। তার মানে বেশ মার খেয়েছে। হয়তো বাপের পৌঁছাতে সময় লেগেছিল। বন্ধু গুলো কি তাহলে হাসপাতালে ভর্তি নাকি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমার সামনে কিছু ধরল‌ মাথা নিচু করে দেখলাম আমার সেই কলম। কলমটা বিশেষ ভাবে পছন্দ হবার কারণ ছিল এতে আমার নাম লেখা ছিল। তিতির কোথা থেকে জানি এমন কলম বাঁধিয়ে এনেছিল। ছেলেটা নিচু স্বরে বলল, কলমটা আপনার!

কথাটা হজম হতে সময় লাগল। বলতে গেলে এই প্রথম তার গলার স্বর শুনলাম আমি। ছেলেটা আমার চেয়ে বয়সে বড় হবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তবুও আমাকে আপনি বলে ডাকছে। ইমপ্রেস করার চেষ্টা নাকি। তাহলে বলছি ছেলেটা ব্যর্থ হলো। এতো সহজে পটে যাবার মেয়ে আমি নই। ছোঁ মেরে কলমটা নিয়ে নিলাম। পা ঘুরাতে সময় নিল না সে। পেছন থেকে বলে উঠলাম, কলমটা কি কাল আপনি নিয়ে গেছিলেন।

ছেলেটা সামনে ফিরল। বোধহয় জানতো আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। সাথে সাথেই উওর দিল, আসলে গতকাল ধাক্কা খেয়ে আপনার হাত থেকে কলমটা পরে গেছিল। আমি হাতে নিয়েছিলাম তবে ফিরে দেবার আগেই পুলিশ নিয়ে গেল…

“মনে হচ্ছে পুলিশ চাচা খুব ভালো ভাবেই খাতির করেছে আপনাদের।

মাথা নিচু করে ফেলল সে। আমি হেসে বললাম, তা আপনার বন্ধুরা কোথায়, আজ দেখছি না যে।

“আমি ওদের আসতে বারণ করে দিয়েছি ‌।

“হাসপাতালে ভর্তি নাকি?

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে আমার মুখের দিকে তাকাল। হয়তো অনেক অপ্রীতিকর কথা বলে ফেলেছি। নিজ থেকেই বলল, তা কেন হবে?

“আপনার হাল দেখে ধারণা করলাম। তবে বলতে হবে আপনার ভাগ্য খুব ভালো তাই এক দিনের মাথায় ছাড়া পেয়ে গেলেন।

“আমি গতকাল রাতেই ছাড়া পেয়েছিলাম। আর পুলিশ কে টাকা দিয়ে বন্ধুদের ছাড়ালাম।

“বাহ তাই নাকি! তাহলে নিজে কেন মার খেলেন। নাকি সব বন্ধুদের মার একাই খেলেন।

“না তা না।‌ তারা যে টাকা দাবি করেছিল তা ছিল না। তবুও আমি অনেক সেধে মাঝ রাস্তায় তাদের ছাড়িয়ে দিলাম। থানায় নেবার পর সেখানকার ওসি আগে থেকেই জানি কার উপর রেখেছিল। এর মাঝে আমার কথা জানতে পেরে কোন কথা ছাড়াই মারতে লাগলো।

“তারপর বাপের নাম নিয়ে বের হয়ে এলেন।

মুখ নিমিয়ে গেল তার। আমি বাঁকা হাসলাম। একদম উচিত জবাব দিয়েছি এবার। ছেলেটা নিজ থেকে বলল, আমি আসলেই দুঃখিত। আমি ওদের এমনটা করতে‌ বলি নি। ওরা নিজ থেকেই গতকাল এমনটা করেছে!

“নাম কি আপনার?

ছেলেটা মুখ তুলে বলল, ফরহাদ!

“ফরহাদ সাহেব! আপনি আমায় মিথ্যে বলেছেন। গতকাল ইচ্ছে করেই কলমটা ফেরত দেন নি যাতে অজুহাত দেখিয়ে এখানে আবারো আসতে পারেন। আমি সাবধান করছি আপনাকে। নাহলে দ্বিতীয় পুলিশি হেফাজতে পাঠাতে দুবার ভাবব না।

“কলমটা অজুহাত ছিল না, আমি এভাবেও আজ এখানে আসতাম।

“তো কি কারণে..

উওর দিল না। পা পিছনে বাড়িয়ে চলে গেল। উওর না পেয়ে মন খারাপ করি নি। তার সৎ সাহস নেই সেটা ধরে নিলাম। নিজের রাস্তায় আমিও পা বাড়ালাম!

——–

ফরহাদ পিছু ফিরল। নিলুফার কে দেখল হাত তুলে চুল গুলো খোঁপা করতে। হাতের কলমটা গেধে দিল সেই চুলের মাঝে। সৎ সাহস যে নেই তা না, শুধু বলতে ইচ্ছে করে নি। কি করে যে বলতো সেটাই বুঝতে পারছে না। ফরহাদ বেশ জানতো নিলুফার আজ শাড়ি পড়ে আসবে। রাস্তায় মোর পেরিয়ে এই পথে ঢুকতেই হাতের কলমটা দিয়ে চুল গুলো বাঁধবে। এই দৃশ্য যে হাত ছাড়া করতে চায় নি সে। ইচ্ছে করে নিলুফার কে বলতে, সবসময় যেন সে শাড়ি পড়ে আসে। আচ্ছা মেয়েটা কি জানে না , পৃথিবীর সবচেয়ে তাকে শাড়ি পড়লে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে বলে মনে হয়। হাজারো মেয়ে হার মানবে তার কাছে। গলা শুকিয়ে আসছে তার।‌ খুব ইচ্ছে করছিল বলতে, তোমাকে একটা নজর দেখার জন্য’ই তো প্রতিদিন এখানে ছুটে আসি নিলু!

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে