প্রিয় তুমি পর্ব-১৩

0
1232

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

পূরব, সেহেরের বিয়ের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া শুরু করেছে ওর বাবা ইরফান আহমেদ। একমাত্র ছেলের বিয়েতে তিনি কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। ডেকোরেশনের কাজ, গেস্টদের ইনভাইটেশন পাঠানো সব কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সাথে গরিব-দুঃখীদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। ওটা মূলত পূরবের ইচ্ছে।
পূরবের বিয়ের জন্য কোনো কনভেনশন সেন্টার বুক করেননি ইরফান সাহেব। তাঁদের বাড়ির সামনের জায়গাটাতেই বিয়ের সব আয়োজন চলছে। এসব কাজে ইরফান সাহেবকে হেল্প করছে জিসান। পূরবের বিয়েটা মিটে গেলে মাসখানিক পরে ওর আর শেফার বিয়ের ডেট ঠিক করা হবে। আপাতত এখন এসব কিছু নিয়ে ভাবছেনা ও!

ওদিকে সেহেরের কোনো অভিভাবক না থাকায় ইরফান আহমেদের সাথে কথা বলে ওর চাচাই সব দায়িত্ব নিলেন। সেহের মোটেও তা চায়নি। কিন্তু অনেক জোরাজুরির পর ওকে রাজি করানো গেলো। ওর চাচী ফোন করলেন৷ সবসময় তিনি সেহেরের খারাপ চেয়েছেন, এবার খুব ইচ্ছে অন্তত মেয়েটার বিয়ে তাদের বাড়ি থেকে হোক। নিজের হাতে সেহেরের বিয়ের কাজ করবেন। যদিও খুব অসুস্থ সেহেরের চাচী। ওনার এক কথা, সারাজীবন তো আর কিছু করতে পারেননি সেহেরের জন্য, শুধু অত্যাচারই করেছেন। এখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। সেজন্য বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে নিজের চাচার বাড়িতে উঠেছে সেহের। বিয়ে উপলক্ষে সুমা আর শিলাও ওর সঙ্গে এসেছে। শেফা আর রিমি আসবে একদিন পরে। সন্ধ্যাবেলায় আলমিরাতে বিয়ের জন্য শপিং করে আনা কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখছিলো সেহের। ওকে সাহায্য করছে শিলা। আচমকাই পূরবের ফোন। কাজের মধ্যেও এই লোকের ফোন, দিনের মধ্যে নিয়ম করে তিনবার কথা না হলে পূরবের নাকি শান্তি লাগেনা। শিলাকে হাতের কাপড়টা ভাঁজ করতে দিয়ে সেহের ফোন রিসিভ করলো। পূরব ওর কথা শোনার আগেই কথা বলে উঠলো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কী করছো?’

এটা জানার জন্য ফোন করেছে? কী জ্বালা। ভালোবাসার লোকগুলো কী এভাবেই জ্বালাতে ভালোবাসে নাকি? সময়ে-অসময়ে তাঁদের জানতে ইচ্ছে করে প্রিয় মানুষটি এই মুহূর্তে কী করছে? সেহেরের নাম না জানা এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিলো মুচকি হাসির রেখা। দোলনায় ঠেস দিয়ে বসলো। গাছের পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো, ‘ঠিক এই মুহূর্তে আমি সেহের ভীষণ ইম্পোর্টেন্ট কাজে ব্যস্ত আছি। আমিতো আর আপনার মতো অকর্মা মানুষ নই। সব কাজ একাই সামলাতে হয়।’

‘ওয়েট ওয়েট। আই মিন তুমি বলতে চাইছো আমি কোনো কাজ করিনা? যা করো সব তুমি? মানে পুরো পৃথিবীতে একমাত্র কর্মঠ লোক, আর তোমার কর্মের দ্বারা পুরো পৃথিবীর মানুষ খেয়েপড়ে বেঁচে আছে? ওহ নো সেহের..তোমার এই লজিকটা আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি, তাঁরা মানবোনা।’

‘আপনার মানা না মানায় কিছু যায় আসেনা।।সব কাজ আমি একাই করতে পারি।’

পূরব বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক আছে মানলাম। তুমি অসুস্থ হলে তো নিজের সেবা নিজেই কর‍তে পারো তাইনা? সারারাত জেগে থাকা থেকে শুরু করে হসপিটালে যাওয়াটা তো তুমি একাই করো। আর মাঝেমধ্যে হুটহাট চুমু তো তুমিই দাও তাইনা? এই অসম্ভব কাজগুলো তুমি পারো ভাবতেই আমার প্রাউড ফিল হচ্ছে। তোমার মতো কর্মঠ বউ পেয়ে সত্যিই আমি ধন্য।’

সেহের অভিমানী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপনি কী এমনই বেহায়া? আগেও এমন ছিলেন? আচ্ছা, কতজনের সঙ্গে আপনার আগে রিলেশন ছিল? ক’টা মেয়ে আপনাকে চুমু দিয়েছে?’

পূরব ওর অভিমান স্পষ্ট বুঝতে পেরে মজা করে বলল, ‘তা জেনে তোমার কী হবে? আমি সেলিব্রিটি মানুষ, কত মেয়ের চুমু খেয়েছি তা তো গুণে রাখিনি। তবে এদের মধ্যে বেস্ট ছিল একজনই। ওকে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবোনা।’

সেহেরের চোখে জল টলমল করছে। শুধু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা বাকি। রাগ করে ফোন কেটে দিলো। পূরব একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছে তাহলে সেহেরকে কেন বিয়ে করতে চায়? নাহ, ও যখন ওই মেয়েকে কোনোদিন ভুলতেই পারবেনা তাহলে সেহেরের ওকে বিয়ে করা উচিৎ হবেনা। অন্য কাউকে ভালোবাসবে আর সংসার করবে ওর সাথে তা কি করে হয়! সেহেরের দোলনায় মাথা এলিয়ে বসে রইলো। মৃদু হাওয়ায় ওড়না উড়ছে। ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এবার কেঁদেই ফেললো সে। কান্না শুনে সুমা, শিলা ছুটে এলো ওর কাছে। কারণ জিজ্ঞেস কর‍তেই সেহের কান্নারত কন্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘আমি ওনাকে বিয়ে করবোনা৷ বিয়ে ক্যান্সেল করে দে সুমা।’

ওরা দুজন হতভম্ব। সুমা সেহেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পূরবকে ফোন করে বললো সেহের ওকে বিয়ে করবেনা। যা যা ঘটেছে তার সব বলতেই ও হু হা করে হেসে উঠলো। সুমা অবাক হয়ে বলল, ‘ভাইয়া আপনি হাসছেন? তার মানে আপনিও বিয়ে করতে চাননা?’

পূরব হেসে বললো, ‘তোমার গাধী বান্ধবীকে ফোনটা পাস করো।’

‘ও আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেনা।’

‘ওকে বলো আমার সেই প্রিয় মানুষটা সেহের নিজেই।’

সুমা বুঝতে না পেরে বলল, ‘কীসের মেয়ে?’

‘কিছুনা। সেহেরের কাছে ফোন দিয়ে তোমরা চলে যাও। আমি বুঝিয়ে বলছি।’

অগত্যা সুমা সেহেরের হাতে জোর করে ফোনটা ধরিয়ে শিলাকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। সেহের পূরবের ফোন বারবার কাটতে লাগলো। একসময় বাধ্য হয়ে ধরলো। পূরব সবটা ওকে বুঝিয়ে বলতেই নিজের কাছে নিজেই বোকা প্রমাণিত হলো সে। রেগে বলল, ‘আমার সাথে এধরণের মজা একদম করবেন না চোরমশাই।’

পূরব বলল, ‘আমার প্রিয় বলতে তুমিই আছো। অনেক ভালোবাসি আমার প্রিয় তুমিটাকে।’

সেহের চোখ মুছে গভীর কন্ঠে বলল, ‘কখনো ভুলে যাবেন না তো? সেলিব্রেটিরা নাকি বিয়ের পর সব ভুলে যায়? এমন হলে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাব!’

পূরব বলল, ‘মৃত্যু ছাড়া আর কোনোকিছু তোমাকে ভুলাতে পারবেনা আমার মন থেকে। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।’

সেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওর কথায় সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম।’

সারারাত এভাবে কথা বলতে বলতে কেটে গেলো। সম্পর্ক হওয়ার পরে আজ প্রথম সারারাত কথা হলো দু’জনের মধ্যে। ভোররাতের দিকে ঘুমাতে গেল দুজন। ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠে পড়লো সেহের। চাচা বাজারে যাবেন, সব লিস্ট ওর চাচী নিজের হাতে করে দিলেন। সেহেরের চাচাতো দুই ভাই বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ে খেতে এসেছে। তাছাড়া প্রতিবেশী আর কাছের আত্মীয়রা মিলে পঞ্চাশজনের মতো মেহমান হলো ওদের বাড়িতে।
মেহমানদের মধ্যে কেউ কেউ সেহের খুব প্রশংসা করলো আবার কেউ কেউ কটু কথা শোনাতেও পিছপা হলোনা। এত বড় মাপের একটা ছেলে কী দেখে এই এতিম মেয়েকে পছন্দ করেছে খোদা জানেন। তবে এসব কথা সেহেরের কর্ণগোচর হলোনা, আর হলেও সেহের পাত্তা দিতোনা। বিগত দিনগুলোতে ও একাই যুদ্ধ করে এতদূর এসেছে, আজ তাঁদের কথায় কেন ও পাত্তা দিবে? ওদের কথা শুনলে কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবেনা, তাই সেসব না শোনাই ভালো।

সারা বাড়িতে বিয়ের আমেজ। শেফা, রিমি ওরা এসে হাজির হলো বিকেলের দিকে। সেহের ভীষণ খুশি। এর মধ্যে পূরব দু-বার ফোন করে খোঁজখবর নিলো। ওর গায়ে-হলুদের আয়োজন করা হচ্ছে। সারা বাড়ি গেস্টে ভর্তি। মিনিট খানিক কথা বলে ফোন রেখে দিলো
সেহের। একটু পরে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো। হলুদ দিয়ে গোসল করানো হলো। তারপর সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হলো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মানুষ কম থাকলেও জমকালো আয়োজন বলা চলে। দু-হাত ভরে মেহেদি, কাঁচা ফুলের গয়না আর হলদে-সোনালি শাড়িতে সেহেরকে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো। ওর সাথে কালার কম্বিনেশন করে পূরবের পাঞ্জাবিটা কেনা হয়েছে। সুমা, শিলা, রিমি, শেফা সবাইকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। ওরা সবাই মিলে এক বাটি হলুদ সেহেরের মুখে মেখে দিলো। সেহের রেগে গেল। পুরো ভূত বানিয়ে দিয়েছে ওকে। আচ্ছামত ধমক দিলো ওদেরকে। শেফা ওর চেহারা দেখে হাসতে হাসতে অনেকগুলো ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলো পূরবকে।

পূরব এত এত মানুষের মাঝখানে দম ফেলার জো পাচ্ছেনা। তার নানা বাড়ি, দাদা বাড়ির লোকজন, বাবার বন্ধুরা, ওর বন্ধুরা, তাছাড়া পরিচিত সব ব্যবসায়ী, ডিলারসহ ব্যবসার খাতিরে তৈরি হওয়া সব লোকজন এসেছে। হঠাৎই ফোনে সেহেরের মিষ্টি ছবিটা দেখে ওর খুব ভালো লাগলো। গালে হলুদ ভর্তি। চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা ওর থেকে। আরও একবার নতুন করে ওর মায়ায় ডুবে গেলো পূরব, নতুন করে আবার ভালোবেসে ফেললো প্রিয় তুমিটাকে। আর একটা দিন, তারপর সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ওর জীবনে পদার্পণ করবে এই মেয়েটি। কত ভালোবাসে সেহেরকে, তা যদি সেহেরকে বোঝাতে পারতো! আর কয়েকটা ঘন্টা, তারপর সারা জীবনের জন্য বাঁধা পড়বে একে-অপরের সাথে।

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে