প্রিয় তুমি পর্ব-০৮

0
1124

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

‘বাহ, খুবই ভালো। তাহলে তো এই ডান্ডার বারি খেয়ে যেতেই হয়৷ নাহয় হাত-পা একটু ভাঙলোই। নো প্রবলেম। প্রেমের স্বাদ বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই তাইনা? সো এলাকাবাসীদের কী তুমিই ডাকবে? নাকি আমি ডাকবো?’

সেহের অবাক হয়ে যাচ্ছে পূরবের কথাবার্তা শুনে। প্রেমের স্বাদ মানে কী? ও তো কারো সাথে প্রেম করছেনা। আর পূরবের বিহেভিয়ারও ভালো ঠেকছেনা। কেমন যেন অদ্ভুত! ওকে যা কিছুই বলছে তাতে কোনো পাত্তা দিচ্ছেনা। এলাকাবাসী ডাকার কথাটা তো ও এমনিই বলেছিলো, কী ঝামেলায় পড়া গেলো! মানুষজন ওকে এই রাতে এখানে দেখলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া পূরবের সাথে আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছেনা, তাই সেহের বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসে।

সুমা আর শিলা জানালা দিয়ে ওদেরকে দেখেছে এতোক্ষণ। তাই সেহের বাসায় ফিরলে ওকে ওরা ঝেঁকে ধরে কি বললো, কেন গিয়েছে, ওর সাথে পূরবের কী সম্পর্ক আছে? আরও নানা হ্যানত্যান করে ওকে জ্বালিয়ে মারলো। সেহের কোন কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। কারণ ও নিজেই পূরবের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত নয়, কেন এরকম করছে সেটা সেহেরের চেয়ে পূরবই ভালো বলতে পারবে। সুমা, শিলা ভীষণ আপসেট হলো।

পূরব কিন্তু সেই রাতে আর বাড়ি যায়নি। সেহের চলে যাওয়ার পরেও সে গাড়িতে বসে ছিলো রাত তিনটে পর্যন্ত। কেন এখানে এসে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও নিজেই বুঝতে পারছেনা, শুধু জানে এখানে এসে সেহেরকে দেখলে ওর খানিকটা ভালো লাগে, অদ্ভুত সুখ অনুভূত হয়। মেয়েটার সম্পর্কে যতোই জানছে ততোই ওকে টানছে। সেহের একটা দারুণ মেয়ে, পূরবের বাবাও বলে। এতেই ও আরও আগ্রহবোধ করছে, কেমন ছেলেমানুষী ব্যাপার! মধ্যরাতে হঠাৎ জিসানের ফোন৷ বোধহয় ঘুমাচ্ছিলো। ওকে ঘুমে রেখেই গত চার-পাঁচদিন ধরে সেহেরের এলাকায় আসে পূরব। ওর বাবা বা জিসান কেউওই সেটা জানেনা। ও ঘুমুঘুমু গলায় বলে উঠে,

‘হ্যালো দোস্ত তুই কোথায়?’

পূরব গম্ভীর গলায় বলল, ‘আছি কোথাও।’

জিসান লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। চোখ থেকে সাথে সাথেই ঘুম পালিয়ে গেলো৷ বলল, ‘মানে কী? তুই বাসায় না?’

পূরবের সহজ সীকারোক্তি, ‘না।’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে কোথায়?’

‘বাইরে ঘুরাঘুরি করছি!’

‘এতো রাতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পাগল হয়ে গেলি নাকি? এতো রাতে কেউ বাইরে ঘুরে?’

‘আমি ঘুরি!’

‘বিপদে পড়বি দোস্ত, বাসায় চলে আয়।’

‘কীসের বিপদ?’

‘আরে এতো রাতে রাস্তায় চোর, ডাকাতের অভাব নাই। ওদের খপ্পরে পড়লে বুঝবি কি বিপদ। তোর কি কোনো কাজ আছে বাইরে? না থাকলে চলে আয়।’

‘শিট ম্যান। তোর ঘুমুঘুমু কন্ঠে শুনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আর এসব চোর-ডাকাতের ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই৷ আমি হচ্ছি রাতের আঁধারে বেড়ে ওঠা মানব।’

জিসান বলল, ‘তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী আত্মা কথা বলছে দোস্ত। আমিতো পানি খেতে উঠছি রাত দেড়টায়, পাশে তাকিয়ে দেখি তোর বেড খালি, ভাবলাম ওয়াশরুমে গিয়েছিস। এখন আবার ঘুম ভাঙলো দেখি তুই নাই৷ সন্দেহ হওয়ায় উঠে সারাবাড়ি খুঁজলাম। আঙ্কেলের ঘরেও চেক করলাম তুই নাই।’

‘আরে ইয়ার। নো টেনশান, জাস্ট চিল। আমি ঠিক আছি। একটু পরই বাসায় ফিরছি।’

‘গাড়ি নিয়েছিস?’

‘হুঁ!’

জিসান হাফ ছেড়ে বলল, ‘ওকে। তাড়াতাড়ি আয়।’

ফোন কাটার আগে পূরব জিসানকে থামালো। বলল, ‘আচ্ছা তোর কাছে প্রেম মানে কী? এটা মানে তুই কী বুঝিস?’

জিসান হঠাৎ এরকম প্রশ্ন শুনে অবাক। বেশকিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘উমম..প্রেম মানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লুতুপুতু করা।’

পূরব রেগে এক ধমক দিলো। তারপর বলল, ‘ফান করবিনা একদম। তোর এসব ফান মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।’

জিসান হেসে বলল, ‘প্রেম আবার স্বাস্থ্যেকর হয় নাকি? প্রেম মানেই অস্বাস্থ্যকর অনুভূতি… ‘

পূরব নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, ‘আমি জানতে চাইছি লাভ আই মিন ভালোবাসা কী?’

‘আমি জানিনা রে। কখনো প্রেম, ভালোবাসায় জড়াইনি তো তাই এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা কম। অবশ্য তুই চাইলে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ইন্টারভিউ নিবো। জানতে চাইবো প্রেম কী, ভালোবাসা কী!! ওরা ওদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে আর আমরা জানতে পারবো ভালোবাসার আসল সংজ্ঞা!’

‘ওফফ জিসান৷ আমি যা বলছি শোন।’

‘যথা আজ্ঞা বাদশাহ!’

‘শোন, একটা অসাধারণ মেয়ে, হুম? যে ছোট থেকেই স্ট্রাগল করে বড় হয়েছে, কারো সাহায্য ছাড়াই নিজের উৎসাহে। মানুষের বিপদেও যে সাহায্য করার চেষ্টা করে অথচ নিজেরই অনেক দুঃখ। তো একটা ছেলে আজকাল ওকে একনজর দেখার জন্য নানা ছেলেমানুষী আচরণ করে, মেয়েটাকে দেখতে, ওর হাঁটাচলা, কথাবার্তা, রাগ সবকিছুই ওর ভালো লাগে। মেয়েটার সামনে ওর বেহায় হতে ইচ্ছে করে, যা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি তা-ই ওর মনে উঁকি দেয় বারবার। মনে হয় সুখের মতো এক ব্যথা..তাহলে কি বলা যায়, ছেলেটা মেয়েটার প্রেমে পড়েছে? আর তারা দুজন স্রোতের বিপরীতে বয়ে চলা পানির মতোন..’

পূরব আর কিছু বলতে পারলোনা। তাঁর আগেই জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘মাথামুন্ডু বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তবুও তোর কথা শুনে যা বুঝলাম ছেলেটা হয়তো মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে ধর, ছেলেটা মেয়েটার সারাজীবনের সব দুঃখকষ্টকে ভাগ করে নিলে, কষ্টগুলোকে নিবারণ করার সাহস করলে, একে অন্যের পাশে থাকার চিন্তা করলে তবেই বোধহয় ভালোবাসাটা হয়ে যাবে। তাইতো… ‘

পূরব আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিলো। তারপর সেহেরের বাসায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কেন যে ছুটে আসে সেটা কিছুটা হলেও পূরব বুঝতে পারছে। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা। সেহেরের ঘরের বাতি নেভানো, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। পূরব গাড়ি স্টার্ট করলো। কিন্তু ও কী জানতো ওই অন্ধকার ঘরে জানালার পাশে বসে কেউ ওকে দেখছিলো? নির্ঘুম রাত পার করেছিলো? আর এর সাক্ষী হয়ে রয়েছিলো নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে একঝলক আলোয় মেতে ওঠা ওই শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদটা!

সেহেরের আজকাল টিউশনের চাপটা বেড়েছে। পাঁচটা টিউশন করে সাথে সাথে সেলাই কাজও শিখেছে। তার উপর পড়াশোনার যথেষ্ট চাপ। সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত দিনকাল যাচ্ছিলো ওর। তবে টাকাপয়সার চিন্তা এখন আর নেই। যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলো, সেই টাকাও শোধ করা হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো ওর চাচা বেলায়েত আলীর সাথে। বাজার সেরে ফিরছিলেন তিনি। সেহেরকে দেখে এগিয়ে এলেন। সেহের কোনোরুপ অবান্তর বাক্যলাপ না করে চাচার সাথে যথেষ্ট মার্জিত ব্যবহার করলো। বেলায়েত আলী জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছিস?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন চাচা? আর চাচীমা? অনু, মিম, ইফতি ভাই ওরা কেমন আছে?’

‘সবাই ভালোই আছে। তোর চাচী তো গত মাসে স্ট্রোক করেছে৷ একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। পারভীনের অবস্থা খারাপই।’

সেহের কথাটা শুনে ঝটকা খেলো। ওই শক্ত-সামর্থ্য, রাগী মহিলাটা যার কথায় পুরো পরিবার উঠবস করতো সে আজ শয্যাশায়ী! হায় নিয়তি, সেহেরের সাথে কতোই না দুর্ব্যবহার করেছে, মারধর করে দিনের পর দিন ঘরে না খাইয়ে আটকে রেখেছে। সেই মানুষটার আজ এই অবস্থা! এটা কী সেহেরের সাথে তার করা পাপের ফল? একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরুলো সেহেরের বুক থেকে। ও আর কিছু ভাবতে চাচ্ছেনা। পারভীন বেগমকে দেখতে সে চাচার সাথে বাড়ি এলো। পারভীন বেগমকে এক কোণের একটা ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঔষধপত্র টেবিলের উপর রাখা। ঘরটার ভেতর কেমন অসুস্থ ভাব। না চাইতেও সেহের চাচীর সাথে কথা বললো। পারভীন বেগম ওকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এই মেয়েটার উপর তিনি কতোই না অত্যাচার করেছেন একসময়। সেই কথা ভেবে সেহেরের হাত জড়িয়ে ধরে মাফ চাইলেন। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বললেন। নিজের সন্তান-সন্ততি এখন ওনাকে দেখতে পারেনা, উঠতে বসতে কথা শোনায়৷ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। অথচ তাদের জন্যই সেহেরকে কতো না অত্যাচার করেছেন! সেহের বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে এলো। তারপর শেফার ফোন। ওর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ঘুম দিলো। সেই ঘুম ভাঙলো রাত দশটায়৷ এরপর হাত-মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলো। বারোটার দিকে রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে রাস্তার দিকে নজর যেতেই দেখলো আজও পূরব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই এতগুলো দিনে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এটা৷ পলকহীন চোখে সেহের শুধু চেয়েই রইলো।

সেহের না জানলেও পূরব এতোদিনে পুরোপুরি শিওর হয়ে গিয়েছে যে সেহেরকে ওর চাই-ই চাই। এই কথাটা সে ইরফান আহমেদের সাথেও শেয়ার করেছে। তিনি তো পুত্রের প্রেমে পড়ার বিষয়টা নিয়ে খুবই উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! এই অপেক্ষাও খুব মিষ্টি লাগে পূরবের৷ আহা, মেয়েটা যদি জানতে পারে পূরবের ওকে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই ওকে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেবে! ও মনে মনে বলল, এই চোরেরই বউ হতে হবে তোমায় সেহের। তুমি যে জানালা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সেলিব্রিটি চোরকে দেখো সেটা খুব ভালো করেই সে জানে৷ বউ বানাতে শুধু সময়ের দরকার! বুঝলে চোরের বউ?’ হাসলো শুধু পূরব।

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে