প্রিয় তুমি পর্ব-০৩

0
1260

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

এই লোক ওর বাসার ঠিকানা পেলো কীভাবে? হাউ? সেহের কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো জানালার ধারে। বসে বসে ওদের কর্মকান্ড দেখছে আর দুঃসাহস দেখে অবাক হচ্ছে। কতটা বেয়াদব হলে একটা ছেলে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে নিরীহ একটা মেয়ের সাথে এরকম আচরণ করতে পারে! তাও আবার এতো রাতে? সেহেরের আজ পড়তে ইচ্ছে করছেনা। ঘুমও পাচ্ছেনা। রান্নাঘরে থালাবাসনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর সাথের মেয়ে গুলো কিছু একটা করছে। সেহেরের ভীষণ ইচ্ছে করলো ওদের সাথে গিয়ে কথা বলার, কিন্তু ও যাবার আগেই ওরা নিজেদের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ওর ভীষণ খারাপ লাগলো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের ঘরটাতেই ফিরে এলো।

সাথে থাকা ছেলেগুলোকে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে ওদেরকে বিদায় করে দিলো জিসান। পূরব গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আধঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়েই আছে। কোনো কথা বলছেনা। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? জিসান বেশ বিরক্তবোধ করছে। শেষমেশ না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে আর কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? যা করতে এসেছিলি তা তো করেছিসই, এবার চল।’

পূরব কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানটাতে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘তোর চলে যাবার ইচ্ছে হচ্ছে? ওকে যেতে পারিস তুই!’

‘তোকে একা ফেলে যাবো নাকি? মাথা খারাপ হয়নি আমার।’

‘তাহলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’

‘হুয়াই ম্যান হুয়াই? রাস্তায় দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাওয়ার এতো শখ জাগলো কেন তোর? মেয়েটার বাসার জানালা তো ভেঙ্গে দিলি, আর কী বাকি আছে?’

পূরবের চেহারা থমথমে হয়ে আছে। শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘ওকে স্যরি বলতে হবে। নয়তো আজ এখান থেকে এক পা-ও নড়বোনা।’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে স্যরি বলবে? ও কি এখানে আসবে নাকি?’

‘আসতে হবে।’

‘পাগল হলি তুই? মানুষ দেখলে কী ভাববে?’

‘তোর এতো চিন্তা কর‍তে হবেনা।’

জিসান চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু মেয়েটা জানবে কীভাবে যে তোকে স্যরি বলতে হবে? না জানলে তো এখানে আসবেনা আর স্যরিও বলবেনা।’

পূরব গম্ভীর গলায় কিছু একটা ভেবে বলল, ‘চল।’

জিসান থতমত খেয়ে বলল,’কোথায়?’

‘বাসায়। বড্ড টায়ার্ড লাগছে।’

‘এক্ষুনি না বললি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। যতক্ষণ না মেয়েটি এসে স্যরি বলে ততক্ষণ যাবিনা৷ এখন আবার কী হলো?’

‘কিছুনা। গাড়িতে বস।’

জিসান গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘তোর যে মাঝেমাঝে কি হয়, বুঝিনা বাপু।’

পূরব অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। রহস্যময় সে হাসি। যখন ওর মনে কোনো কুটিল চিন্তাভাবনা আসে তখন এভাবে হাসা ওর স্বভাব। ফেল্টের কাউবয় হ্যাটটা মাথা থেকে খুলে এসির টেম্পারেচার নরমালে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। রাতের জাঁকজমকপূর্ণ ঢাকা শহর। সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক ভুতুড়ে নীরবতায় ছেয়ে আছে। রাস্তার দু’ধারের গাছগুলো শত বছর পার করার সাক্ষী হয়ে কেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পিচঢালা পথে একটা মানুষও নেই। মহানগরী এখন ঘুমন্তপুরীতে রুপান্তর হয়েছে! বাতাস এসে ঝাপটা খাচ্ছে পূরবের চোখেমুখে। লো ভলিউমে গান বেজে চলেছে! জিসান ফোন স্ক্রোল করায় ব্যস্ত, তবু্ও কি ভয়ানক নিস্তব্ধতা চারপাশে ভর করেছে ভাবতেই ওর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো!

রাতের আঁধারে ছুটে চলা গাড়িটির দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সেহের। লোকগুলো চলে গিয়েছে এতেই ওর শান্তি৷ কেউ টের পেলে একটা জঘন্য ব্যাপার হতো৷ এই চিন্তাটা মাথা থেকে উবে যেতেই ওর ভীষণ ঘুম পেলো৷ পেটে ক্ষিধে নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো সেহের!

ভার্সিটির একপাশে ‘ভি’ আকৃতির লেকটার পাড়ে বসে আছে সেহের, রিমি আর শেফা। তারা তিনজনই বেস্ট ফ্রেন্ড এবং একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করে। একে অন্যের সব খবর ওরা জানে, সব কথা শেয়ার করে। ঘাসের উপর বসে তিনজন গল্পে মশগুল। হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত! কথাবার্তার এক পর্যায়ে এসে সেহের শেফাকে একটা ছোটখাটো কাজ যোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ জানালো। শেফা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, ‘টিউশনি করাবি?’

সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘টিউশন? সেতো করছিই! এতে আর কতো পাওয়া যায়, ছোটখাটো জব পেলেও চলে যেতো আমার।’

‘তা ও তো বটে!’

রিমি হঠাৎ বলল, ‘চাকরি করবি? গার্মেন্টসে?’

সেহের চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘গার্মেন্টসে? কীসের চাকরি?’

‘এই সবাই যেমন করে, নরমালি সেলাইয়ের কাজটাজ।’

শেফা আপত্তি জানালো। বলল, ‘ওখানে কাজ করা অনেক টাফ। তাছাড়া ওর পড়াশোনা আছে, গার্মেন্টসে কাজ করতে গেলে সেই সাতসকালে বেরিয়ে বিকেলে বাসায় ফির‍তে হয়, তাও বেতন সামান্য! কয়টা টাকা বেশি পাওয়ার জন্য ওভারটাইম করতে হয়, আর তা করতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে! তখন পড়াশোনার সময় কই পাবে?’

‘এছাড়া তো আর অপশন নাই। আজকাল জব পাওয়া মুখের কথা নয়!’

সেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে বসে ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে ওঠা ছোট ছোট জংলি ফুলগুলোয় হাত বুলালো অনেকক্ষণ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘রেস্টুরেন্টের কাজটা হতে হতেও হয়নি ওই এক সেলিব্রেটির জন্য। এসব বড়লোকেরা নিজেদের যে কী ভাবে আল্লাহ জানে। সামান্য চোর বলায় আমাকে কাজটা দেয়নি! ভাবতে পারিস?’

রিমি ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ করিসনা দোস্ত!’

সেহের কোলের উপর ব্যাগটা রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলো। সামনের দিনগুলোর কথা মনে করে ওর ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। সামান্য টাকায় কীভাবে সব সামাল দিবে? আল্লাহ ভালো জানেন। তাছাড়া সেমিস্টার ফি’ চলে আসছে! শেফা ওর মলিন চেহারা দেখে ওকে হাসানোর জন্য দু’ হাত ওপরে তুলে বলল, ‘ওই সেলিব্রিটির বউ যাতে কড়া আর রাগী হয়, যেন সারাদিন তাঁকে চোর বলে ক্ষেপায়। তখন তো বউকে আর ফেলে দিতে পারবেনা, একে সহ্য করতে হবেই। যা আমি দোয়া করে দিলাম। বেচারা অসহায় সেলিব্রিটি! এই শেফার দোয়া কখনো বিফলে যাবেনা দেখে নিস!’

শেফার কথা শুনে রিমি আর সেহের হেসে ফেললো। শেফাকে জিজ্ঞেস করলো, এটা দোয়া না অভিশাপ ছিল?’

রিমি হাসতে হাসতে শেফার পিঠে কিল মেরে বসলো। ওর এই এক অভ্যাস৷ হাসি আটকাতে পারেনা, সিরিয়াস মোমেন্টে হাসতে হাসতে থাপ্পড় খাওয়ার অনেক রেকর্ড আছে। কিন্তু তাও ওর শিক্ষা হয়না। পিঠে কিলটা একটু জোরেই লাগলো শেফার। চোখমুখ কুঁচকে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে ওঠে রিমির চুল টেনে ধরলো। ক্ষিপ্ত গলায় বলল,

‘কি খাস তুই? দেখতে তো শুটকি আর শক্তি হাতির মতো! অসহ্য, আমার পিঠটাই বাঁকা করে দিলি!’

‘স্যরি রে দোস্ত। তোর কথা শুনে হাসি আর কিল কোনোটাই কন্ট্রোল করতে পারিনি।’

শেফা বিরক্ত গলায় বলল, ‘হাসার মতো কিছু বলিনি যে দাঁত কেলিয়ে হাসবি!’

সেহের পরিস্থিতি সহজ করার জন্য বলে উঠলো, ‘আচ্ছা বাদ দে। ওই সেলিব্রেটির কথা আমার সামনে আর বলবিনা। এ নিশ্চয়ই টিকটক সেলিব্রিটি, নইলে আমরা চিনিনা কেন?’

শেফা আর রিমি ওর কথায় সায় জানিয়ে মাথা দোলালো। বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলল, ‘হতেও পারে!’

‘এই সেলিব্রিটি হ্যাটের কথা বাদ দে। চেহারা দেখলেই গা জ্বলে যায়! কোথাকার পাগলেরা যে এর জন্য এতো পাগল আমি বুঝিনা! শালা আবাল…’

রিমি উৎসাহী কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা চল, ফুচকা খেয়ে আসি! চিল কর সেহের…জাস্ট চিল। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে!’

‘আমি খাবোনা। তোরা যা।’

‘আরে দোস্ত চল..’

রিমি আর শেফা একপ্রকার জোর করেই সেহেরকে নিয়ে ফুচকা খেতে গেলো। ভার্সিটি গেইটের কাছে বিশাল এক হিজল গাছের নিচে ফুচকাওয়ালা চপলের দোকান। কোনো মানুষের নাম আদৌ ‘চপল’ হতে পারে জানা নেই সেহেরের। বেশি করে ঝাল দিয়ে ফুচকা নিলো তিনজনই। খাওয়ার একপর্যায়ে সেহেরের মাথায় ঝাল উঠে গেলো। পানি বোতল নিয়ে কাউন্টার থেকে ফেরার সময় দেখলো হ্যাট পরা লোকটা পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। ওর দিকে চেয়ে আছে। যেন চিবিয়ে খেতে পারলে তাঁর শান্তি! সেহের ভয় পেয়ে ঢোক গিললো। এই লোক কি ওকে ফলো করছে নাকি? কাল রাতের ঘটনা মনে করতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। কোনোক্রমে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই লোকটা তার পা বাড়িয়ে দিলো সেহেরের যাওয়ার পথে। ফলস্বরূপ সেহের পায়ে পা বেঁধে একদম ফ্লোরে পড়ে গেলো আর ওর হাতে থাকা পানির বোতলের পানি ছিঁটকে পড়লো পূরবের গায়ে! ভীষণ রেগে গেলো পূরব।

‘ড্যাম ইট। এটা কী করলে তুমি?’

‘আমি দেখতে পাইনি। দুঃখিত!’

সেহের পড়ে গিয়ে কোমড়ে বেশ ব্যথা পেয়েছে। তবুও উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আপনার পায়ে বেঁধেই তো আমি পড়েছি। এখানে আমার কিছুই করার নেই।’

‘তাই বলে আমার গায়ের উপর পানি ফেলবে? তুমি জানো আমি কে? কার সাথে কথা বলছো জানক তুমি? ইডিয়ট কোথাকার.. ‘

সেহের বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। এই লোকের বড় বড় কথা ওর আর সহ্য হচ্ছেনা। এমনিতেই মাথার ঠিক নেই হাজারো টেনশনে, আবার ওকে চোখ রাঙানো হচ্ছে! আর এখানে তো ওর দোষ ছিল না, এই হ্যাটওয়ালা নিজেই তো পা বাড়িয়ে দিয়েছিল! আবার ঘাড়ত্যাড়ামি করছে! এবার গলা উঁচু করে বলেই ফেললো, ‘কে আপনি? আর আমার পিছু এভাবে লেগে আছেন কেন? যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আপনি আপনার ভিলেনমার্কা চেহারা নিয়ে হাজির! আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি? যেদিন থেকে দেখা হয়েছে সেদিন থেকেই একটা না একটা কান্ড ঘটিয়েই চলেছেন আপনি! আপনি নাকি মহান মানুষ? তাহলে এসব কী অসভ্য আচরণ আপনার? রাতবিরেতে মেয়েদের বাসায় ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি এসব ছাড়া কি আপনার আর কাজ নেই? নিজের দোষ না দেখে হুদাই আমার উপর চেঁচাচ্ছেন! যত্তসব…’

এটুকু বলে বোতলের বাকি পানিটা ওর মাথায় ঢেলে দিয়ে ক্যান্টিন থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেলো সেহের! রিমি আর শেফা এতোক্ষণ ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে কান্ডকারখানা দেখছিলো! সেহের বেরিয়ে যেতেই ওর পিছু দৌড় লাগালো দুজন। চপল মিয়া ওদের ডাকছে, ফুচকার বিল না দিয়েই ওরা চলে গিয়েছে। এদিকে পূরব স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহুর্তেই কি থেকে কি হয়ে গেলো সেটা বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছে। রাগে কিলবিল করছে শরীর!


শেফা আর রিমি সেহেরকে নিয়ে একটা পার্কে বসে আছে। সেহের কাঁদছে। কেঁদেটেদে অবস্থা ভীষণ করুণ। ওর আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে, কোনো কারণ ছাড়াই ওর চোখের পানিতে গাল ভেসে যাচ্ছে। এতো এতো টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরলে মেজাজ তো তিরিক্ষি হবারই কথা! শেফা ওর পিঠে হাত রাখলো। তারপরে বলল, ‘যাকে এতোগুলো কথা শুনিয়েছিস, তুই চিনিস তাকে? সে কে?’

‘আমার তাকে চেনার কোনো প্রয়োজন নেই। নিশ্চয়ই কোনো বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া সন্তান হবে..’

শেফা অবাক হয়ে বলল, ‘আরে না দোস্ত। এ তো ইরফান আহমেদের বড় পুত্র ইরফাজ পূরব! তুই নেটে ছবি দেখস নাই? হায় আল্লাহ!’

সেহেরের চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেলো এই কথা শুনে। ইরফান আহমেদের পুত্র? এই বেয়াদব লোকটা? ও আল্লাহ! এতো ভালো একটা মানুষের পুত্র এতো নিচু মানসিকতা নিয়ে ঘোরাফেরা করে? ছিঃ…

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে