প্রিয় ভুল পর্ব-৪১+৪২+৪৩+৪৪

0
189

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

পাভেল বনানীর একটা রিনাউন্ড কফি শপে বসে অপেক্ষা করছে মীরা আর টুম্পার জন্য। পয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় ওরা যোগ হলো পরপর । টুম্পাও কারখানা থেকে এসে যোগ দেয় মীরার একটু পরে । একসাথে বের হলে সন্দেহ হতে পারে তাই। মীরা এসে কোনমতে বসেই ওর দেরির কারন ব্যাখ্যা করলো। থানায় যা যা হয়েছে তার একটা বিবরণ দিলো সংক্ষিপ্ত আকারে। মীরা যে সেখানে পাভেল আর মকবুলের আটকের কথা ভেবে ওর কি পরিমাণ উদ্বেগে ছিল তা-ও বললো। মীরা বললো-
: ” আমি তো ভাবছি তোমরা এ্যারেস্ট, এখন গিয়ে দেখি বাইক আর বাইকের মালিক”
কথাটা বলে ওড়না দিয়ে ঘাম মুছলো ও। যেন ঐ সময়ের উদ্বেগের কিছুটা আঁচ ওর চোখেমুখে পরলো । কফির অর্ডার দিয়ে মীরা আবারো বললো-
: “তোমার ভাই তো মাশাল্লাহ তোমার চেয়েও সুন্দর। তাকে তো আমি কখনো দেখি নি এর আগে, তা কিভাবে ম্যানেজ করলে তাকে ?”
পাভেল হেসে বলে-
: ” আমাদের পরিবারের আমিই একটু কম সুন্দর, বাকী সবাই মাশাল্লাহ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আফগানি। তাই পরিবারের সবার চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং গড়পড়তা লোকেদের চেয়ে একটু ভিন্ন, শুধু এ পরিবারের বৌ গুলো.. ”
টুম্পা ওদের কথা কিছুই বুঝে না, মীরার দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করে –

: ” মানে কি? থানার ঐ লোকটা আমাদের নিজেদের লোক? আই মিন পাভেল ভাইয়ার বড় ভাই?”
ততক্ষনে মীরার পছন্দের কফি এসে গেছে। মীরা কফির মগে চুমুক দেওয়ার অপেক্ষা করলো না। ছোট্ট একটা সিপ দিয়ে বললো-
: ” হুম, বাইকের মালিক পাভেলের বড় ভাই সোহেল”
টুম্পাকে যেন কেও জোরে একটা ধাক্কা দিলো, এমনি ‘থ’ মেরে গেলো। ওকে স্বাভাবিক করতে পাভেল বললো-
: ” একটুতেই এত অবাক!”
মীরা টুম্পার পক্ষে বললো-
: ” আরেহ্ বাসায় এখন কথা বলাই মুশকিল, যখন বাইরে থাকি তখন টুম্পা থাকে কারখানায়, আর বাসায় যখন ফিরি তখন রাজিবের জন্য এ ব্যাপারে কোন কথা বলা হয় না। এমনিতেই গতরাতে ধরা পরি পরি করেও বেঁচে গিয়েছি। তোমার সাথে কথা শেষ করে দেখি রাজিব পিছনে দাঁড়ানো”
: ” ও এজন্যই তুমি শেষের দিকে আবোলতাবোল বকছিলে, লিপির খেয়াল রেখো, ওর যত্ন নিও, আর হ্যা কোন হসপিটালে যাবে বলে ঠিক করেছো? ”
হাত কানে রেখে ফোনে কথা বলার ভঙ্গিতে কথাগুলো ব্যাঙ্গের সুরে বললো পাভেল। মীরা ওর এমন অভিনয় দেখে কফির মগ নামিয়ে হাসতে লাগলো। হাসির দমকে একটু কফি ছিটকে পরলো ওর ওড়নায়। কফির মগটা টেবিলে রেখে মীরা সেটা পরিষ্কার করতে করতে বললো-
: ” আমাদের বারান্দাটা বেশ বড়। টিএসসি থেকে গাছ, ল্যাম্প, বাবুই পাখির বাসা এগুলো সংগ্রহ করে অনেক যত্ন করে গুছিয়েছি। বারান্দার পাশের দেয়ালে হাত পাখার ডিজাইনের একটা আয়না আছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পরলো আয়নায়। দেখলাম রাজিব আমাকে এদিক-সেদিক খুঁজছে। পরে বারান্দায় তাকিয়ে আমাকে দেখে এগিয়ে এলো, তাই ওসব আবোলতাবোল বকছি। তারাহুরো করে ফোনটা কেটে দিলে ওর সন্দেহ হতো। তবে আমি যে বার ফোন দিয়ে কথা বলেছি সেটা নিয়ে ভীত ছিলাম। এ বুঝি জিজ্ঞেস করে এই ফোন কার, বা কবে নিলে। টাকার শোকে বেচারা এতটাই কাতর যে ব্যাপারটা হয়তো খেয়ালই করে নি”
টুম্পা সবাধন করে দিয়ে বলে-
: ” তবুও আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে”
পাভেল টুম্পার কথায় সায় দিয়ে বলে-
: ” হুম, তা ঠিক”
টুম্পা এবার পাভেলকে জিজ্ঞেস করে –
: ” বললেন না, সোহেল ভাইয়াকে কিভাবে ম্যানেজ করলেন?”
: ” ভাইয়া মীরাকে চিনে, চিনে বলতে ও যে আমাকে ব্যাবসা গুছিয়ে দিয়েছে তা আমাদের পরিবারের সবাই-ই জানে। আমি তো বোহেমিয়ান ছিলাম, পড়াশোনা, ক্লাব আর সংগঠন নিয়ে ছিলাম। আমার পরিবারের কেও-ই আমাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলো না। শেষ কষ্টটা দিলাম একা বিয়ে করে। আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে আমাদের পরিবারে এটাই প্রথম। সবার অমত ছিলো এ বিয়েতে। লিপির পরিবার কি আমার কেও-ই মানতে পারে নি এ বিয়েটা। সে থেকে আমি একপ্রকার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। গত বছর বাবার মেজর একটা অপারেশন হয়, আমি তার পুরো খরচটা দিয়েছিলাম। ভাইয়ার চাকরী ছিলো না তখন। বাবার ঐ অসুস্থতাই ছিলো পরিবারে আমার ফিরে যাওয়ার টিকিট। নতুন করে ভাইয়াকেও এখন আমার মতো ব্যাবসা গুছিয়ে দিলাম। মোটের উপর মীরার কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। ওর কোন উপকার করতে পারলে ভাইয়া কেন আমাদের পরিবারের কেও-ই না করবে না ” এবার মীরা বলে-
: ” হয়েছে থামো এবার, তোমরা আমার জন্য যা করেছো সে দিক থেকে এটা আর তেমন কি? টাকা না পয়সা না জাস্ট পথ চিনিয়ে দিয়েছি আমি”
: ” মাঝে মাঝে একটা ভালো পরামর্শ কোটি টাকার চেয়েও উপকারী হয়, তুমি মাছ না দিয়ে আমাকে মাছ ধরা শিখিয়েছো, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ” – বলে পাভেল।
: ” কৃতজ্ঞতা পর্ব শেষ হলে বলুন প্ল্যান কার ছিলো?” – বলে টুম্পা।
: ” প্ল্যান আর কি, টাকাগুলো ছিনিয়ে নিতে দরকার ছিলো বাইক, ভয় দেখানোর জন্য ছুড়ি, আর মানকি ক্যাপ। এগুলো সব জোগাড় হলেও বাইক নিয়ে ঝামেলায় ছিলাম। কারটা নিবো, আবার ধরা পরে যাবো কি না। শেষে কোন ব্যাবস্থা না করতে পেরে ভাইয়ার কাছে গেলাম। সবকিছু খুলে বললাম, ভাইয়া সব শুনে চলে গেলো থানায় জিডি করতে, আর আমি চলে এলাম তার খয়েরী রঙের হিরো স্প্লেন্ডার ১০০ সিসির বাইক খানা নিয়ে”
: ” মাই গড, আপনি তো সেই খেলা খেললেন” – বললো টুম্পা।
: ” এ ব্যাপারটায় একটা জিনিস রিয়েলাইজ হলো, তা হচ্ছে জীবণে প্ল্যান করে কখনো কিছু হয় না, প্ল্যান করলাম কি আর হলো কি” – বলে হাসে পাভেল।
: ” টাকাগুলো কি করেছো?”- বললো মীরা
: ” ব্যাংকে রাখি নি সন্দেহ হতে পারে কারো, সামনে ইদ তুমি চাইলে টাকাটা গোল্ডে ইনভেস্ট করতে পারো, বেশী দামে বিক্রি করতে পারবে। টাকা বাড়ানোর এরচেয়ে সর্ট কার্ট ওয়ে আপাততঃ আমি দেখছি না” – বলে পাভেল।
: ” টাকাটা পরে থাক, বাড়ার দরকার নেই, কি করতে কি হয়, এটা একটা বাড়তি টেনশন। তার উপর ইন্ডিয়া যাচ্ছি আমি, ভিসা হয়ে গেছে। টিকিট কাটলেই চলে যেতে পারবো যখন তখন” – বলে মীরা।
: ” এ্যাস ইউর উইশ, যখন বলবে তখনই হাজির হয়ে যাবো টাকা নিয়ে”
: ” বিজনেস না স্টর্ট করবেন বললেন” – মীরার উদ্দেশ্যে বললো টুম্পা।
: ” এ মুহূর্তে বিজনেস টা শুরু করার পিক আওয়ার। সামনে সিজন, বিফল হওয়ার কোন চান্স নেই, তবে আমি তাড়াহুরো করে আর কোন ভুল করতে চাই না। তাই সময় নিচ্ছি। তাছাড়া এ মুহূর্তে বিজনেস টা শুরু করলে রাজিব জানতে পারলে সমস্যা করবে। আমি ধাক্কাটা ওকে আকস্মিক ভাবে দিবো। যাতে ওর কোন কিছু বোঝার আগেই সব শেষ হয়ে যায়”
: “তাও আরোকটু ভেবে দেখেন, তার সব সাইড হয়ে গেলে, আপনার দাঁড়ানোর একটা জায়গা, একটা সোর্স অফ ইনকাম দরকার। আর এটা তো রাতারাতি তৈরী হয়ে যাবে না, আগে থেকে এটাকে তৈরী করা দরকার ” – নিজের মতামত যোগ করে টুম্পা।
: ” তোর কি মনে হয় এটা আমি ভাবি নি?” – টুম্পার উদ্দ্যেশে বলে মীরা।
: ” আমি জানি আপু, আপনি অনেক চালাক” বলে টুম্পা।
: ” কথাটা চালাক হবে না টুম্পা, বুদ্ধিমতি হবে, মীরা চালাক না, বুদ্ধিমতি” – পাভেল বললো টুম্পাকে।
মীরা স্মিত হেসে বলে-
: ” শোন তোমরা, আমি চালাক না বুদ্ধিমতি তা জানি না, তবে জীবণে অনেক ভুল করেছি তো তাই সবকিছু অনেক হিসাব করে করি, ভালোর খারাপটা আগে দেখি, ভালো কিছু ভাবার আগে ভেবে নেই বিপরীত হলে কি করবো। পোড় খাওয়া আমার এখন ভুল খুব কম হয়” একটু বিরতি নিয়ে মীরা বলে-
: ” কারখনার অবস্থা এখন শোচনীয়, ভিতরে ভিতরে ভাঙন শুরু হয়ে গেছে বেশ আগেই, ওটাকে বাঁচাবো ভেবেছিলাম। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিজের হাত গুটিয়ে নেওয়ার। যা হচ্ছে হোক, যদিও ব্যাপারটা ভীষণ পেইনফুল। কিন্তু অনেক ভেবে আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ব্যাবসাটায় কম হলেও রাজিবের কন্ট্রিবিউশান রয়েছে, এটা অস্বীকার করা যায় না। তাই এই হাত গুটানো, আমি এখন যা-ই করি বা করবো তাতে আমার একার কনট্রিবিউশন থাকবে। যাতে ভবিষ্যতে কেও না বলতে পারে- রাজিবের কন্ট্রিবিউশান এর কথা, ওর সব কিছু মুছে দিবো আমি আমার জীবন হতে ”
: ” ইউর লাইফ, ইউর চয়েজ, আই অলওয়েজ রেসপেক্ট ইউর ডিসিশন ” – বলে পাভেল।
এরপরও কথা হলো বেশ কিছু সময় পর্যন্ত পরবর্তী করণীয় ব্যাপারে। বিকেল থাকতেই বেরিয়ে গেলো ওরা। সিদ্ধান্ত হলো
কিছু টাকা নিয়ে মীরা ইন্ডিয়া যাবে। সেখান থেকে কিছু সিগনেচার প্রোডাক্ট আনবে। রিস্টার্ট করবে ওর পুরাতন, ঝিমিয়ে পরা পেইজটাকে। মীরা ফিরবার পথে টুম্পাকে বললো-
: ” তোর পাসপোর্টটা করিয়ে ফেল টুম্পা, পরের বার ইনশাআল্লাহ আমরা দুজন একসাথে ইন্ডিয়া যাবো”
: ” কবে যাচ্ছেন আপনি?”
: ” আগামীকাল ”
: ” ভাইয়ার এমন পরিস্থিতিতে আপনি যাবেন, ব্যাপারটা ওভার ডোজ মনে হবে না?”
টুম্পার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকায় মীরা, চোখ ফিরিয়ে টুম্পা বলে-
: ” ম্যানেজ করবেন কিভাবে?”
: ” বলবো পিয়াসা টিকিট কেটে ফেলেছে ”
: ” বাই এয়ার?”
: ” অনেক তো বাঁচালাম টাকা, কি হলো দিন শেষে? আমি এদিকে কষ্ট করে করে টাকা সেইভ করেছি আর ও? ও অন্য দিকে উড়িয়ে এসেছে, টাকার আর মায়া করবো না বাকী জীবনে। কি হবে এত পেরেশানি হয়ে? দেওয়ার মালিক তো ঐ একজন”

টুম্পা কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে দেখে মীরাকে। কষ্ট, শোক মানুষকে বদলে দেয়। হয় ভালো করে দেয়, নয় তো খারাপ। কিন্তু মীরার সবটা দেখে টুম্পা ভাবে কোনটা হয়েছে মীরাপুর? ভালোটা? নাকি খারাপ?”

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

ইদানীং রাজিব খুব পেরেশানিতে আছে। একদিকে কাজের চাপ, সামনে রোজার ইদের সিজন তাই, কয়েকদিন আগে হাত ফসকে বেরিয়ে গেলো কচকচে বিশ লাখ টাকা। এত সুন্দর, রোডসাইড
ফ্ল্যাটটা এত কমে পেয়েও টাকার জন্য বুকিং করা গেলো না, হাতছাড়া হয়ে গেলো। সেটার ধাক্কা সামলে না উঠতেই সাথীর যন্ত্রণা শুরু হলো। মান অভিমান, কান্নাকাটি, ঝগড়া, কথা কাটাকাটি আরো কত কি।

ওর বাবা-মা বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করেছেন। পাত্রের লন্ডনে বিশাল ব্যাবসা। দেখতেও নাকি রাজপুত্রের মতো। গত রাতে রাজিবকে, মীরাকে সাথীর মা ফোন করেছেন। ঢাকা শহরের আত্মীয় বলতে তাদের তো কেবল ওরাই আছে । তিনি সাথীকে ভালো ভাবে বুঝানোর জন্য ওদেরকে অনুরোধ করেছেন। তিনি মীরাকে বললেন-
: ” মোগো কতা তো বেকই জানো, নতুন কইরা আর কি কমু, তোর মামুর খবরও তো তোগো অজানা না। এই ছেমড়িরে রাজিই করান যাইতেয়াছে না। ওরে তোরা বুজাও বাবা। পড়ালেহার বাহানায় ও রাজিই হয় না। দুনিয়ায় কত মাইয়্যারা বিয়ার পর লেহাপড়া করতাছে। তুই ক বাবা এমন পোলা সবসময় পায়া যায়? ”

ফোনটা লাউডস্পিকারে ছিলো। উত্তরে মীরা ওকে ডেকে এনে বুঝাবে বলে তাকে আস্বস্ত করেন। সাথীকে রাজি করানোর, বুঝানোর। রাজিবের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে বেশ কয়েকবার ফোনও করে সাথীকে। কিন্তু সাথী মীরার ফোন রিসিভ করে না।

এদিকে সাথী তো এ খবর শুনার পর থেকেই কান্নাকাাটি শুরু করে দিয়েছে। ওর বাবা-মায়ের এমন পাত্র হাতছাড়া করতে না চাওয়াটা কোন অযৌক্তিক কিছু না। ঘরে এতগুলো বোন ওরা। ওদেরকেও তো বিয়ে দিয়ে দিতে হবে? ওদের অসুস্থ বাবা এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাই তাদের ইচ্ছা এবার সাথী শক্ত-পোক্ত, প্রতিষ্ঠিত কাওকে বিয়ে করে ছোট বোন-গুলের দায়িত্ব নিক।

তিন বছর হতে চললো রাজিবকে বিয়ে করেছে। এখনো কিছুই করতে পারেনি রাজিব। না পেরেছে বিয়ের ব্যাপারে সবাইকে জানাতে, না পেরেছে ওকে কিছু করে দিতে। ওর সাথে থেকে কি লাভ সাথীর? ঐ বৌয়ের নামে তো ঠিকই বাড়ি করে দিয়েছো, আর ও একটা ফ্ল্যাট চাইলো, তাও নিজেদের থাকার জন্য তিনবছরেও তা দিতে পারলো না রজিব । এসব বলেছিলো সাথী কথা কাটাকাটির সময়। অথচ ও একটা বারও বুঝলো না রাজিব এবার ওর সাধ্য মতো চেষ্টা করেছে। এ সময়ে সাথীর কি উচিত ছিলো না রাজিবের পাশে থাকার? রাজিব সবই বুঝে কিন্তু কিছুই যেন করার নেই ওর। রাজিব পড়লো অকুল পাথারে। ও জানে ফ্ল্যাটটা ওর নামে কিনে দিতে পারলে হয়তো বিয়ের এ ধাক্কাটা সামলানো সহজ হতো। কিন্তু তাও তো হলো না। মনে মনে এসবই ভাবছিলো রাজিব।

রাজিব চারদিকে অন্ধকার দেখে। টেনশনে মাথাও ঠিকঠাক কাজ করে না ওর। সাথী রাগ করে বরিশাল চলে গেছে সকালে। বৌ রাগ করে বাপের বাড়ি গেলে তাকে স্বামীরা রাগ ভাঙিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনে। কিন্তু এখন তো এটাও সম্ভব না৷ ফোনটাও রিসিভ করে না সাথী। ইমো, হোয়াটসএপেও ব্লক করে দিয়েছে রাজিবের নম্বর৷ কি যে দমবন্ধ মুহূর্তে আছে রাজিব তা কাওকে বলতেও পারে না। কাজেকর্মে মন নেই। বিকেলে একটা বড় অর্ডার রিসিভ করার কথা ছিলো। সেখানে যাওয়ার কথা ভুলে গেছে ও। বাসায় ফিরেছে জলদি। ঘরে বাইরে কোথাও যেন শান্তি পাচ্ছে না ।

খাওয়া দাওয়া শেষে রাতে মীরা জানায় –
: ” একটা কথা বলবো”
রাজিব কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে। সেখানে যেন নিরব সম্মতি কথাটা শোনার। এরপর মীরা বললো-
: “কি করে যে বলি কথাটা?”
: ” কি কথা?” – কথাটা বলে জিজ্ঞেসু চোখে তাকিয়ে থাকে মীরার দিকে রাজিব। মীরা চুল আঁচড়ানো রেখে ওর দিকে ঘুরে বলে-
: ” আসলে বিশ লাখ টাকার ব্যাপারটা পিয়াসাকে বলিনি, ওর তো আবার সব ব্যাপারেই হাসাহাসির স্বভাব। এ বিষয়ে ও মজা করলে তা নিতে পারতাম না আমি তাই। এদিকে ও আমার ভিসা হয়েছে শুনে
আগামীকাল বিকেলের ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছে । কি যে ঝামেলায় পরলাম”
রাজিব ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে ফোন স্ক্রলিং শুরু করলো। ওর ভাব দেখে মনে হচ্ছে কি যেন খুঁজছে ও। মীরা ওর কাছে বসে জিজ্ঞেস করলো –
: ” জানি এ সময় তোমার আমাকে প্রয়োজন, বলতো কি করি আমি?”
কি যেন ভাবলো রাজিব কিছু সময়। তারপর বললো-
: ” ব্যাগপত্র গোছাও, সমস্যা নেই, কিন্তু এ মুহূর্তে আমার হাত একেবারে ফাঁকা, তুমি খরচ করে আসো আমি পরে দিয়ে দিবো নি টাকা হাতে আসলে”
: ” ছিঃ ছিঃ আমি বুঝি জানি না? তুমি এটা নিয়ে ভেবো না, ইন্ডিয়া ঘুরতে আর কতই বা খরচ। ওটা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মীরা। রাজিব এদিকে ভাবছে- “ও যাক তাহলে, এ মুহূর্তে ওর কাছে ধরা পরাটা ঠিক হবে না। এমনিতেই এতগুলো টাকা লোন এনে দিয়েছে, এখন এসব জানাজানি হলে আর রক্ষা নেই, তারচে ভালো ও ঘুরে আসুক, এদিকে আমিও একটু গুছিয়ে নিই”

বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে মীরা রাজিবকে এড়িয়ে চলে। বিছানায় আসে রাজিব ঘুমানোর পর। সেদিন রাতে রাজিব সব ভুলে কাছে পেতে চেয়েছিলো মীরাকে। কিন্তু মীরা ওর হাত চেপে ধরে কপট ধমক দিয়ে বলে-
: ” কয়েকদিন ধরে টেনশনে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না তোমার , মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমানোর চেষ্টা করো”

অন্য সময় হলে এ পরিস্থিতিতে একটা অসভ্য কথা বলতো রাজিব। কিন্তু এখন তা মনে চাইলো না। বাধ্য ছেলের মতো মীরার বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো ও। মীরা ওদের মাঝখানে নিজের একটা হাত রাখলো দুজনের মধ্যেখানে দেওয়ালের মতো করে। আরেকটা হাত দিয়ে ওর মাথার চুল টেনে দিতে লাগলো। তেল দেওয়ার ভঙ্গিতে আঙুল বুলিয়ে দিলো মাথায়। ম্যাজিকের মতো কাজ হলো তাতে। রাজিব ঘুমিয়ে পরলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।

পরদিন রাজিব কারখানায় যাবার পরই মীরা বেরিয়ে পরে মতিঝিলের উদ্দেশ্য। সেখানে পাভেলের কাছ থেকে নেয়া পাঁচ লক্ষ টাকা ভারতীয় রুপিতে কনভার্ট করে ও। উদ্দেশ্য সেখানে গিয়ে ব্যাবসার উদ্দ্যেশ্যে মালামাল কেনা। নিউমার্কেটে কিছু কেনাকাটা সেরে মীরা বাড়ি ফিরে দু’টোর মধ্যে। বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে মেয়েকে সময় দেয়। কয়েক দিন মেয়ে থেকে দূরে থাকবে ও তাই। ব্যাগপত্র বেশী নিবে না সাথে। ওর জিমে যাওয়ার ছোট্ট ব্যাগটায় দুইটা প্যান্ট, টপস আর লং শার্ট নিয়ে নিলো, স্কার্ফ, আর ওড়না নিলো কয়েকটা। বাকী কাপড় সেখানে কিনে পরার ইচ্ছে আছে ওর। ইন্ডিয়া গেলে ও এমনিতেও কম কাপড় নেয়৷ ওখান থেকে কিনেই পরে বেশীরভাগ সময়। প্রসাধনী হিসেবে ওর সবসময়ের সঙ্গী সানব্লক ক্রিম, ময়েশ্চারাইজার, কাজল আর আপলে রেড শ্যাডের লিপস্টিক নিলো ছোট্ট একটা পাউচে। খালার হাতে কিছু টাকা দিয়ে গেলো যাওয়ার আগে। দরকারে এটা সেটা কিনে দিবে নূহাকে তাই।

বিকেল চারটায় বাসা থেকে বের হলো মীরা। ফ্লাইট রিসিডিউল হয়ে সন্ধ্যা সাতটায় মুভ করেছে। বের হতে হতে মীরা কল করলো রাজিবকে। বললো-
: ” রাজিব আমি মাত্র বের হলাম, তুমি জলদি বাড়ি ফিরে মেয়েকে সময় দিও এই কটা দিন”
রাজিব একটু যেন মনঃক্ষুণ্ন হলো। ও ভেবেছিলো মীরা হয়তো এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে বলবে রাজিবকে। সব কূল হারানো রাজিব মুখিয়ে ছিলো মীরার এমন আহ্বানের অপেক্ষায়। কথা শেষ করে
ফোনটা টেবিলে রেখে অফিস ঘরের রিভলভিং চেয়ারটায় শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে জীবণের নানান হিসাব করছে রাজিব।

বিগত জীবণ, সাথী, গত কয়েকটা দিন, সাথীর এমন স্বার্থান্বেষী আচরন। এসব হিসাব নিকাশের শেষে রাজিব একটু যেন খোঁজ পেয়েছে মীরার বিশাল মনটার। সন্ধ্যা থেকে রাত হয়েছে। বেরিয়ে যাবে এখন। ফোনটা হাতে নেয় রাজিব। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে মীরাকে লিখে – “উইল মিস্ ইউ”
ম্যাসেজটা সেন্ড হয় কিন্তু সীন হয় না….

কেন জানি আজ জলদি বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে রাজিবের। মীরা বলেছে এই কটা দিন জলদি বাড়ি ফিরতে তাই হয়তো। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে মেয়েকে নিয়ে বাইরে বেরুতে চায় রাজিব। কিন্তু মেয়ে দীর্ঘ দিনের অনভ্যস্ততায় বাবার কাছে ভিড়ে না খুব একটা। জোর করে কোলে নিয়ে আদর করতে গেলে কান্না জুড়িয়ে দেয় নূহা। মাজেদা খালা বলেন-
: ” ওয় এহন ঘুমাইবো, তাই এমন করছে”

বিরক্ত রাজিব রেগে গিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে দেন মাজেদা খালার কোলে। তার কোলে গিয়ে নূহা শান্ত হলো। একটু পরেই ঘুমিয়ে পরলো। সবটা সোফায় বসেই লক্ষ করলো রাজিব।

মেয়েকে মাজেদা খালার কাছে ঘুমাতে দেখে নিজের ঘরে ফিরে রাজিব। ফোনটা খুলে দেখে ম্যাসেজটা সীন হয়েছে কিনা। নাহ্ এখনো ম্যাসেজটা খুলে দেখেনি মীরা। ঘড়িতে খেয়াল করে দেখে রাত দশটা বাজে, এতক্ষণে তো ওদের পৌঁছে যাওয়ার কথা। দ্রুত ফেসবুকে সার্চ করে মীরাকে। হঠাৎ ভিতরটা কেমন পাক দিয়ে উঠে। ওর মতো মীরাও কি অন্য কারো সাথে অভিসারে…

ফেসবুকে মীরার সাথে এড নেই রাজিবের। অনেক আগে ঝগড়া করে রাজিবই ব্লক করে দিয়েছিলো মীরাকে। অনেকক্ষণ ঘাটাঘাটি করার পার মীরার আইডি আনব্লক করে রাজিব। নিউজফিডে গিয়ে দেখে মীরার আইডি থেকে আধ ঘন্টা আগে একটা ছবি পোস্ট করা হয়েছে । মীরা চেক-ইন করেছে পার্কস্ট্রিটের একটা অভিজাত হোটেলে তার সামনে দাড়িয়েই দুজনের হাস্যজ্জ্বল ছবি। মীরার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ানো ব্যাক্তিটি আর কেও না, পিয়াসা-ই।

নিজেকে খুব ছোট মনে হলো রাজিবের। নিজে খারাপ তো তাই অন্যকে নিয়ে কোন মন্তব্য করতে বাঁধে না ওর। এমনকি নিজের স্ত্রী সম্পর্কে ও। হঠাৎ
নজরুলের বিখ্যাত একটা পঙ্কক্তির কথা মনে পরলো ওর- ” আমরা সবাই পাপী,
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি”

ম্যাসেন্জাে অফলাইন দেখাচ্ছে ওকে, তারমানে ওরা এখন হোটেলের বাইরে। বহুদিন পর ম্যাসেন্জারে মীরাকে একটা ম্যাসেজ দেয় ও। নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে যায় রাজিব। সেই ম্যাসেজটা ছিলো-
” ঘুমাতে গেলাম বৌ,
হোটেলে ফিরে আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখো ”

আজ বহুদিন পর রাজিব দুটি কাজ করলো। এক মীরাকে ম্যাসেন্জারে ম্যাসেজ দিলো আর
বৌ বলে ডাকলো মীরাকে।

চলবে…

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৩
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

কোলকাতায় এসে মীরা মোটাদাগে চিল করা যাকে বোঝায় তা-ই করছে। পারফেক্ট মি-টাইম। সংসার, স্বামী, মেয়ে, ব্যাবসা এসব শব্দ গুলো প্লেনে উঠার আগে ঝেড়ে ফেলেছে ও মাথা থেকে। এই মীরা যেন অন্য কেও।

প্রতিবার ইন্ডিয়ায় এলেই খরচ বাঁচাতে টাকার হিসেব করে কম দামে হোটেল খুঁজলেও এবার ও উঠেছে পার্ক স্ট্রিটের “দ্যা পার্ক হোটেলে”। হোটেলটি বিশাল বড়, সুন্দর এবং অভিজাত। এমন হোটেলে থাকার এক্সপেরিয়েন্স এটাই প্রথম ওর। টাকাতো কম সেইভ করলো না, দিনশেষে ও শূন। সেইভ করাটা দোষের না, কিন্তু অপাত্রে সেইভ করাটা ভুল হয়েছে ওর, ভুল হয়েছে ভুল মানুষকে বেছে নিয়ে । যার মাশুল দিতে হচ্ছে ওকে সেই শুরুর দিন থেকে। যদিও এসব ভাবনা বাদ দিয়েছে ও বেশ আগেই। এসব ভাবলে কিংবা চিন্তা করলে তো আর পরিস্থিতি বদলে যাবে না। তারচে বরং মীরা মন দিয়েছে সমাধানে, পথ খুঁজেছে এ ভুল থেকে বের হওয়ার।

কোলকাতা পৌঁছানোর পরদিন খুব সকালে বেরিয়ে পরে ওরা। প্রিন্টের লং শার্টের সাথে কালো জিন্স পরিহিত মীরার গলায় ঝুলানো আছে ক্যানোনের ডি-ফিফটি মডেলের ক্যামেরা। ক্যামেরাটা বেশ আগে কেনা হলেও তেমন ব্যাবহার করা হয় নি। প্রতিবারই এসে স্যাম্পল কালেকশন করার জন্য দৌড়ের উপর ছিলো ও আর রাজিব। খাওয়ারই খবর থাকতো না কোন কোন সময়। আবার ছবি তোলা! ছবি তোলার অবকাশ ছিলো না কোন। এবার যেন মীরা অন্য রকম এক কোলকাতাকে এক্সপ্লোর করলো। কোলকাতার এই সৌন্দর্য যেন আগে এতবার এসেও অদেখা ছিলো ওর।

মীরার ছবির হাত ভালো। বেশ কিছু ছবি তুললো ও। শ’পাঁচেক তো হবেই। ছবি তোলা যে মীরার শখ ছিলো তা যেন অনেক দিন পর মনে পরেছে ওর। ক্যামেরাটা সাথে এনেছিলো কি যেন মনে করে। কিন্তু এখন নিজের চোখে কোলকাতা শহরটাকে বন্দি করছে ক্যামেরার লেন্সে। ছবি তুলছে ব্যাস্ত কোলকাতার ট্যাক্সি, বাস, ট্রাম এর, স্ট্টিট ফুড সহ বিভিন্ন বিখ্যাত স্থাপনার যেমন – ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মর্বেল প্যালেস, সেন্ট পল ক্যাথিড্রল, কফি হাউজ, কলেজ স্ট্রিট, কোলকাতা ইউনিভারসিটি, প্রিন্স জেমস এর ঘাটের, যেটি বাবু ঘাট নামে পরিচিত। বিদ্যাসাগর ব্রিজ থেকে শুরু করে হাওড়া ব্রিজ। গাড়ি করে ঘুরবার শহর কোলকাতা না, এখানকার প্রতিটি বাড়িই যেন এক একটি ইতিহাস। হেঁটে দেখলে পা ব্যাথা হয়ে যায় তবুও আঁশ মিটে না।

রোডসাইট একটা দোকানে বেলী ফুল দেখে পিয়াসা কিনতে যায়। ফুল কিনতে গেলে দোকানির পেছনে লাল একটা দালান চোখে পরে মীরার। দোকানিকে জিজ্ঞেস করে আপনার পেছনের এ বাড়িটায় কেও থাকে? লোকটা মুচকি হেসে বললো-
: ” বাংলাদেশ থেকে এসেছেন বুঝি?
মাথা নেড়ে উত্তর দেয় মীরা। লোকটা তখন আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন – “কথা বলার ভঙ্গিতেই বুঝেছি, বাড়িটা বৃটিশ আমলেঅস্ত্রাগার হিসেবে ব্যাবহার হতো, এখন পরিত্যাক্ত”

একটু পথ হাঁটলে সামনেই হাওড়া ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজে এর আগে ও আসে নি। পায়ে হেঁটে অনিন্দ্য সুন্দর এই ব্যাস্ত ব্রিজ পেরিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই হাওড়া রেল স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছে গেলো ওরা। যদিও কোন কাজ নেই, শুধু ঘুরবে বলে যাওয়া। ভারতের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে স্টেশন এটি। ১৬৮ বছরের পুরনো এই স্টেশনটির প্ল্যাটফর্ম সংখ্যা ২৩টি ও রেলপথ ২৬টি। এত কাছে এসে এটা ঘুরে না দেখলে পাপ হবে পাপ। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে ভাবনার জগতে ও যেন চলে গেলো অনেক বছর পেছনে। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহনের দীপার কাছে। যে গল্পে ও প্রথমবারের মতো শুনেছিলো হাওড়া রেল স্টেশন কথা। ব্যাপারটা পিয়াসাকে বললে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে গেলো ওরা দুজনে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হলো হলো।

পায়ে হেঁটে সেখান থেকে ঘাটে গেলো ওরা। সেখান থেকে লঞ্চে করে পার হলো হুগলি নদী। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে কোলকাতার বুকে। দিনের চেয়ে রাতের হাওড়া ব্রিজ যেন শতগুণ বেশি সুন্দর। বাহারী আলো দিয়ে সাজানো পুরো ব্রীজ। সেই আলো হুগলি নদীর বুকে রঙ ছড়াচ্ছে যেন। সেদিন বেশ রাত করে ফিরে ওরা। রাতের স্তব্ধ কোলকাতা যেন আরো বেশী সুন্দর। দিনের বেলা পায়ে পায়ে মানুষ। নিরানব্বই শতাংশই বাংলাদেশী। খুব ক্ষুধা পাওয়ায় ওরা রাতের খাবার খায় বাইরের মুসলিম হোটেলে।

রাতে রুমে ফিরে মীরা একটু হিসাবপত্র নিয়ে বসে পরদিন কি করবে তার এটা ফর্দ তৈরি করে। পরদিন বের হয় কেনাকাটায়। এত টাকা সাথে আনা সত্বেও কেনাকাটার কাজ ২য় দিনেও শুরু করে না। ও একটু মার্কেট স্টাডি করতে চায় ও। বাইরের ঘোরাফেরা শেষে বিকেলে হোটেলের অসম্ভব সুন্দর লাউন্জটাতে বসে ল্যাপটপ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে মীরা। দেশে গুটি কয়েক পেইজ কাজ করে ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট নিয়ে। যারা ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে তারা কি কি প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করে, মার্কেটে কোনটার ডিমান্ড বেশী, কোনটায় লাভ বেশী থাকবে ওর রিসার্চ সেটা নিয়েই। পিয়াসা কিছুটা বিরক্ত হয়। ঘুরতে এসে কেন এমন খুটুরমুটুর?
মীরা কিছুই বলে না, কেবল মৃদু হাসে।

তৃতীয় দিন মীরা পুরোদমে কেনাকাটা শুরু করে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী ডিমান্ড এখানকার হাতের কাজোর জামাগুলোর। বিভিন্ন সাইজ, কাজ, আর রঙের বেশ কিছু জামা, টু-পিস, ব্যাগ, জুতা, শাল, এগুলো নিলো। এতগুলো টাকা আনা সত্বেও ওর মোট কেনাকাটা এক লক্ষ ও ছাড়ালো না। কারন কোন প্রকারের রিস্ক নেয়া যাবে না। প্রথমবার এসব নিলো পেইজে এক্সপেরিমেন্ট এর জন্য। বিক্রি হলে হবে না হলে ও নিজে এগুলো ব্যাবহার করে ফেলবে।

কেনাকাটা যা করার একদিনেই তিনবারে শেষ করলো। পরদিনটা রাখলো ঘুরার জন্য। এখানকার স্ট্রিট ফুড, হলুদ ট্যাক্সি করে কোলকাতা শহরটা ঘুরে দেখা সবচেয়ে বেশী আনন্দের ছিলো। এ তিন দিন রাজিবকে একবারও কল করে নি মীরা। রাজিব কল করলে মীরা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। “তোমার কল করার দরকার নেই, ফ্রী হয়ে আমিই কল করবো তোমাকে “- ম্যাসেজটা দেখে কেমন বুকের ভিতর মুচড়ে উঠে রাজিবের। আঘাতটা বেশী হওয়ার কারন হচ্ছে এই রাজিবই ঠিক একই কথা বলেছিলো মীরাকে মালদ্বীপ ভ্রমণের সময়৷ এখন রাজিব যেন রিয়েলাইজ করতে পারে কথাটা শুনে মীরার মনের অবস্থা কি হয়েছিলো।

এদিকে রাজিবের টাকার শোকে মত্ত থেকে বড় অর্ডারটা কেনসেল হয়ে যায়। গোডাউন ভর্তি তৈরী মালামাল। এ সময়ে এত বড় অর্ডার ক্যানসেল হওয়া মানে বড় রকমের ধাক্কা খাওয়া। টাকার ব্যাপারটা একপ্রকার চাপাই পরে গোছে। রায়সাহেব বাজারে জোড়া খুনের তদন্তে তারা ব্যাস্ত। জোড়া খুনের ব্যাপারটা এখন টক অব দা কান্ট্রিতে পরিনত হয়েছে। উপর মহল থেকে চাপ আসছে খু’নি খুঁজে বের করার জন্য।
তাদের সময় নেই এই ব্যাপারে তদন্ত করার। থানায় গেলে তারা বিরক্ত হন, পরে আসতে বলেন। সেদিক বিবেচনায় টাকা পাওয়ার আশা বাদ। আশার কথা হচ্ছে সাথী ফিরে এসেছে। বিয়ের ব্যাপারটা আপাততঃ ধামাচাপা দেয়া গেছে। সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা। সে পর্যন্ত সময় চেয়েছে ও। এ এক দিকে ও কিছুটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু সাথী প্রকাশ্যে আসার নিয়মিত তাগাদা দিতে ভুলে না। তবে ব্যাবসার ব্যাপারে রাজিব কি করবে বুঝতে পারছে না। মীরাকে এসময় এ ব্যাপারে বলা ঠিক হবে কি না তা ভাবতে থাকে রাজিব। বিয়ে, সংসারের ঘানি টানা, রাজিবের অসুস্থতা, নতুন করে ব্যাবসা দাঁড় করানো, বার দুয়েক মিস ক্যারেজ, প্রেগ্ন্যাসি, একটার পর একটা ঝামেলা যেন অপেক্ষায় ছিলো ওর। ওর দিকে কখনো খেয়ালই করে নি, বেচারী যখন নিজ থেকে রিফ্রেশমেন্ট খুঁজে নিয়েছে ওকে প্যারা দিয়ে লাভ নেই।

চারদিন ঘুরাঘুরি শেষে দেশে ফিরে ওরা, সাথে ব্যাপক শপিং, অনেক ছবি আর একগাদা মধুর স্মৃতি নিয়ে। দেশে ফিরে পুরোদমে ছবি তোলা শুরু করে ওর নতুন প্রোডাক্টের। নিজেই মডেল হয় নিজের ব্র্যান্ডের । ঢাকার বিভিন্ন হ্যারিটেড লোকেশনে হয় এসব শুট৷ ওর মৃতপ্রায় পেইজটাকে আইটি এক্সপার্ট দিয়ে সাজিয়ে নেয়। পুরোদমে কাজ শুরু করে ইদকে টার্গেট করে।

রাজিব যেন ওকে একেবারেই কাছে পাচ্ছে না ব্যাবসার বর্তমান অবস্থা, আর্থিক পরিস্থিতির ব্যাপারে ডিসকাস করতে। ঐ যে একটা অভিযোগ ছিলো না মীরার রাজিবের প্রতি? তুমি আমার কাছেই রয়েছো, কিন্তু আমি তোমাকে ছুঁতে পারছি না ” রাজিবের হয়েছে তেমনি দশা, মীরা বাড়িতেই আছে, গেস্ট রুমটাকে বানিয়েছেন স্টুডিও। সেখানেই এক দেয়াল ডেকোরেশন করেছে, অপর দেয়ালের সেলফে রেখেছে মালামাল। সারাদিন ব্যাস্ত থাকে ও ল্যাপটপ নিয়ে। রাতেও ব্যাস্ত দেখা যায় ওকে। প্রায়ই রাজিব ঐ ঘরটাতে গিয়ে বসে থাকে। তাকিয়ে দেখে ব্যাস্ত মীরাকে। মীরার কোন ভাবান্তর হয় না ওর আসা যাওয়ায়। ও ওর কাজ করে যায় মন দিয়ে। এক রাতে রাজিব মীরাকে বলে-
: ” আল্লাহ তো আমাদের কম দেয় নি, তবুও তোমার কেন এসব করা লাগবে?”
কোন উত্তর দেয় নি মীরা রাজিবের এ প্রশ্নের। ভেবেছিলো সময়-ই এ প্রশ্নের উত্তর দিবে।

দেখতে দেখতে মীরার আনা সব মালামাল বিক্রি হয়ে গেলো রোজার আগেই। একান্ত নিজের জন্য যা কিনেছিলো তাও দিয়ে দিলো ও কাস্টমার স্যাটিসফেকশনের জন্য। দ্বিতীয় বার মাল আনালো হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে। তারা কেজি হিসেব করে কুরিয়ারে মাল পাঠিয়ে দিয়েছে মীরার ঠিকানায়। মীরা ভেবেছিলো ইদের হাইপে হয়তো বিক্রি এত, ইদ শেষে হয়তো এত বিক্রি হবে না। মীরার এ ধারনা ভুল প্রমাণ করে চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলছিলো। ইদের পর মীরা আবারো যায় ইন্ডিয়া। এবার রাজিব গতবারের মতো ওত স্বাচ্ছন্দ্যে পারমিশন দেয় নি। মীরাও পরোয়া করে নি ওর পারমিশনের।

মীরা এত মালামাল সাথে নিতে পারবে না তাই অর্ডার করে কুরিয়ায় পাঠিয়ে দিতে বলে৷ আর প্রথম বারের মতো সঙ্গে করে নিয়ে যায় কসমেটিকস আইটেম। ফেসওয়াস থেকে শুরু করে বডি স্ক্রাব, লিপলাইনার টু মেকআপ রিমুভার। ওর প্রিফারেন্সে ছিলো স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলো। আগের স্ট্র্যাটেজি তো জানাই ছিলো মীরার। অস্ত্র জমা করেছে মীরা ট্রেনিং তো জমা করে নি। রাজিব ওর নিজ হাতে গড়া ব্যাবসা কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু ওর অভিজ্ঞতা তো নিয়ে নেয় নি।

তাইতো মীরা ফেসবুক গ্রুপ, ইন্সট্রাগ্রাম পেইজ সব জায়গায় বিচরন করা শুরু করে ও নতুন করে, নতুন নামে “বিভা” যার অর্থ আলো, কিরণ, সৌন্দর্য। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পেইজ গ্রুপ দুটোই।

কোরবানীর ইদে এক সপ্তাহের মাথায় ফেসবুক গ্রুপে বিক্রি হয় এক হাজার পিস ফুলকড়ি ওড়না। ঐ সময়টাতে ট্রেন্ডি ছিলো এ জিনিসটা। এবার রাজিব একটু নড়েচড়ে বসে। সাফ জানিয়ে দেয় এসব চলবে না ওর বাড়ি তে। “ওর বাড়ি!” চেতনাহীন মীরা যেন জেগে উঠলো ওর এই কথায়। একদিনের মধ্যে ফ্ল্যাট খুঁজে ও। পরদিন সব মালপত্র শিফট করে সেখানে। সাপে যেন বরই হলো। একমাসের মধ্যে কাস্টোমাররা এখানে এসে কেনাকাটা শুরু করলো। বাসা বাড়ি হওয়ায় একটু সমস্যা হলো প্রথমে। সেখান থেকে আইডিয়া এলো আউটলেট এর। অনেকে পরামর্শ দিলো আউটলেট খুলবার। অনেক ভেবে, খুঁজে ছয় মাসের মাথায় মীরা ধানমন্ডিতে খুলে ওর প্রথম আউটলেট। উদ্ভোদন করায় রাজিবকে চিফ গেস্ট করে।

রাজিব যত ওকে দাবিয়ে রাখতে চায় মীরা ততই যে গর্জে উঠে। একদিকে ভঙ্গুর হচ্ছে রাজিবের মীরা ফ্যাশন, অন্য দিকে স্বমহিমায় ছড়িয়ে পরছে মীরার নতুন ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান “বিভা”। রাজিব ততদিনে টের পেয়েছে মীরা ওর হাতের বাইরে চলে গেছে। ব্যাপারটা ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। স্ত্রী স্বাবলম্বি হয়ে যখন স্বামীকে ছাড়িয়ে যায় কত জন পুরুষ তা মানতে পারে, উৎযাপন করতে পারে? রাজিবের মতো ছোটলোকেরা তো তা পারেই না….

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ৪৪
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

মীরার সেই দুটো ঈদই পার হলো যেন আচ্ছন্নের মতো। ও পুরোদমে ব্যাস্ত ছিলো ব্যাবসা নিয়ে। কোরবানির ইদের ছয় মাসের মাথায় আউটলেটের বুদ্ধিটা একটু ঝুকিপূর্ণ হলেও এ যাত্রায় উৎরে গেছে ও। পৃথিবীর সব ক্ষেত্রে মাঠে নামতে চাইলে আপনার ব্যাকাপ থাকা লাগবে৷ রাজিব তো যখন ওর একার ছিলো তখনো ও আপন ছিলো না। এখন তো ও শাখা খুলে বসেছে আরেকটা। ও শুধু নিজের টুকু বুঝে নিতে জানতো, তা হোক টাকা-পয়সা, নিজের শখ পূরণ কিংবা বিছানার অন্তরঙ্গতা। কার কি আসলো গেলো তাতে ওর মাথা ব্যাথা নেই।

কিন্তু কিছু মানুষের মানসিক সাপোর্ট, পাশে থাকা ওকে এ ঝড়ের দিনেও সমলে চলতে সাহায্য করেছে। মাজেদা খালা মীরার অবর্তমানে নূহার মায়ের দায়িত্ব পালন করছে, টুম্পা সবকিছুতে ভালোর মন্দ দিকটা খুঁজে সামনে এনে দিচ্ছে, সাহস দিচ্ছে স্রোতের বিপরীতে ভাবতে। কারখানার পাঠ চুকিয়ে ও যুক্ত হয়েছে মীরার সাথে। এতে আপত্তি ছিল না রাজিবের। ও বরং খুশি টুম্পার বিদায়ে। তাছাড়া রাত-বিরাতে মীরাকে এদিক সেদিক যাওয়া লাগে, তখন টুম্পা হয় ওর সঙ্গী। আর পাভেল? যত কাজই থাকুক ওর, ইন্ডিয়র পার্সেল এলে বুঝে নেওয়ার সময় সাথে যায় ও। কুরিয়ার অফিসে মেয়ে দেখলে পাত্তা দেয় না তারা। ইদানীং অবশ্য ওকে ডাকা বন্ধ করেছে মীরা। এতদিনে শিখে নিয়েছে পাত্তা আদায় করার কৌশল। গলার স্বর উঁচু তারে উঠেছে মীরার, শক্ত হয়েছে পা আর বৃদ্ধি পেয়েছে ভার বহন ক্ষমতা।বিয়ের পর থেকে অদৃশ্য ভার কাঁধে বয়ে বয়ে কাঁধ আর হাত দু’টোই শক্ত হয়েছে ওর৷ ব্যাবসায়ীক কাজ তো আর একদিনের ব্যাপার না, যে শেষ হয়ে যাবে। তাই দুজন ছেলে স্টাফ নিয়েছে ও। দুইজন মেয়ে আগে থেকেই ছিলো অফিসে। মেয়ে দুজনই অফিসে অর্ডার নেয় আর ডেলিভারি রেডি করে। ছেলে দুটি জুতা সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ, যখন যেখানে যেমন দরকার তেমনি কাজ করে। কখনো মালামাল রিসিভ করে আনে, কখনো দেয় ডেলিভারি। অফিসের শেলফ মেরামত থেকে শুরু করে বাথরুমের ট্যাপ। ছেলেমেয়ে চারজন মীর বলতে অজ্ঞান, ওকে ঘিরেই যেন আবর্তিত হয় ওদের দিন। কি মায়ায় বাঁধে মানুষকে মীরা! একবার যে সংস্পর্শে আসে মায়া কাঁটতে পারে না আর। অথচ যাকে বেঁধে রাখাটা জরুরি ছিলো, বাঁধন ছিঁড়ে সেই চলে গেছে অন্যত্র।

হঠাৎ পাওয়া এ সাফল্যের জন্য কিছু জিনিস ছাড় দিতে হয়েছে ওকে। কিছু পেতে হলে কিছুতো ছাড় দিতেই হয়৷ সত্যি বলতে সংসার, স্বামী, সন্তান, এ শব্দগুলো কেমন এড়িয়ে চলা শিখে গেছে মীরা। দুজনের মধ্যে ‘দূরত্ব’ শক্ত করে জায়গা করে নিয়েছে। রাজিব ইদানীং রাতেও ফিরে না, সে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই ওর। আপাততঃ কাজ পায়ের নিচের মাটি শক্ত করা। সে সম্ভাব্য ঝড় সামাল দিতে সেটাতেই মনযোগ দিচ্ছে ও।

টুম্পা কত বলেছে ছেড়েই তো দিয়েছেন সব, স্বামী, নিজের কষ্টে গড়া ব্যাবসা, তাহলে এ সম্পর্কটাকে কেন বয়ে বেড়ানো। উত্তরে মীরা বলেছিলো- “ওকে যে ধাক্কা দিবো, আমার তো সেই শক্তি আগে সঞ্চয় করে নিতে হবে, এমনি ছেড়ে দিলে তো সেই কবেই দিতাম ছেড়ে”

ব্যাবসার ঘূর্ণিবাতে যতই ব্যাস্ত থাকুক এ ব্যাপার গুলো ভুলে না মীরা। রাজিব, সাথী, বিশ্বাসঘাতকতা এ শব্দ গুলো প্রতি রাতে ঝালিয়ে নেয় পুরোনো পড়ার মতো করে। মীরার কাছে ওর ব্যাবসা, ফেইসবুক পেইজ যেন নে’শাদ্রব্য। যতক্ষণ এর সান্যিধ্যে থাকে ততক্ষণ যেন ভুলে যায় এসব। জীবণে মনে করার মতো সুখ কই? ভুলতে চাওয়া যন্তণাই তো দিনেদিনে বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। নতুন একেকটা দিন একটু বেশী জটিল হচ্ছে আগের দিনের চাইতে। তবুও যত্ন করে প্রতি রাতে মীরা খোলে ওর সেই প্যানডোরা বক্স।

দেখতে দেখতে সেই বিশ লক্ষ টাকা শোধের তৃতীয় কিস্তির সময় আসে। আগের দুটো ঠিক সময় মতো শোধ দিয়েছে রাজিব। কিন্তু ওর হাত এখন ফাঁকা। ঈদের সিজনে এত টাকা একসাথে পেয়ে ওর মাথা নষ্ট অবস্থা। সবসময় এমনি বানের মতো টাকা আসবে তাই-ই ভেবেছিলো কি না কে জানে। এ টাকা দিয়ে যে বাকী নয়মাস টুকটুক করে চলতে হবে তা তো রাজিবের অজানা না । তাও এত টাকা হাতে পেয়ে সাথীকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে রাজিব। বৌ তার এখন যায় তখন যায় অবস্থা। তাকে হাতে রাখতে ফ্ল্যাট নামক তাবিজ দিয়ে বশীকরণ করতে চাচ্ছে। তবে কষ্টের ব্যাপার হলো ফ্ল্যাটটা দেরীতে দেওয়ার জরিমানা হিসেবে ওকে গুনতে হয়েছে আগের চেয়ে বেশী অংকের টাকা৷ নগদ টাকায় কেনায় একটু স্বস্তি। মোটা অংকের ছাড় পেয়েছে ওরা। ফ্ল্যাট ওরা বেশ বড়ই নিয়েছে। আগে যেটা কিনবে ঠিক করেছিলো তার চেয়েও বড়। এমনকি মীরার থাকা ফ্ল্যাটের চেয়েও। মীরারা থাকে ১৪০০ স্কয়ার ফিটের বাসায়। যেখানে তিনটা বিশাল বেডরুম, দুইটা বাথরুম, একটা ড্রইং রুম সাথে ডাইনিং স্পেস। রান্নাঘরের সাথে ছোট্ট একটা স্টোর রুমের মতো আছে। সেটাকেও ইচ্ছে হলে ঘরের মতো ব্যাবহার করা যায়। সেখানেই খাট আর আলমারি পেতে থাকেন মাজেদা খালা। সমস্যা হচ্ছে ঐ ঘরটার জানালা একটা। আর সাথীকে কিনে দিয়েছে ১৮০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। ওরা মানুষ মাত্র দুজন, ওদের এত বড় বাসা কি কাজে লাগে তা বুঝে আসে না মীরার। যেন মীরাকে টক্কর দিতেই এ কাজটা করেছে সাথী। মনে মনে বলে মীরা- “এমন টক্কর সারাজীবন যেন দিতে পারিস তুই। এর বেশী ক্ষমতা যেন তোকে খোদা না দেন। যত যাই করিস, এর চেয়ে আগে তো যেতে পারবি না। যারাই অন্যকে টক্কর দেয় তাদেরকে ইশ্বর সবসময় পিছনেই রাখেন।

এ খবরটা পাওয়া দুঃসাধ্য ছিলো মীরার জন্য। ইশ্বর সহায়, এ খবরটা ও পেয়েছিলো কারখানার সুপারভাইজার শিউলি আপার থেকে ! তার বিবেক তাকে মীরা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। রাজিবের নতুন বাসার সমস্ত কাজকর্মের জন্য বিশ্বস্ত কাওকে খুঁজ ছিলো রাজিব। একা এত বড় বাসায় থাকতে ভয় হচ্ছিল সাথীর। যখন তখন, রাতবিরাতে এ বাহানায় আটকে রাখে ও রাজিবকে। এ কাজে শিউলি আপার চেয়ে কাওকে বিশ্বস্ত মনে হয় নি রাজিবের। তাই তার কর্মক্ষেত্র কারখানা থেকে বদলে সাথীর বাসায় স্থানান্তর করেছে রাজিব। বেতন যা তাই থাকবে, খাওয়া থাকাটা উপরি পাওনা। তিনি সারাদিন থাকে ঠিকই কিন্তু রাতে ফিরে আসেন। তখন সাথী আটকে রাখতে চায় রাজিবকে৷ কোন কোন দিন পারে তো কোন কোন দিন পারে না।

শিউলি আপার এদের এসব দেখে কেমন যেন কষ্ট হয়। এত সুন্দরী মেয়ে মীরা, কারখানার মালিকের স্ত্রী, তবুও এতটুকু অহংকার নেই মনে এত্ত ভালো মন। তার স্বামী গোপনে বিয়ে করে সংসার পেতে বসে আছে? দুয়ে দুয়ে চা মিলাতে সময় নেয় যদিও, তবুও বিবেক তাকে মীরার কাছে পৌঁছে দেয়। কথাটা নিজ থেকেই জানিয়েছেন তিনি মীরাকে । দায়িত্ব মনে করেছেন জানানোটাকে। তিনি জানতেন না যে মীরা ইতিমধ্যে জানে ব্যাপারটা। মীরা কিছুই লুকায় নি, সবটা খুলে বলেছে তাকে।

সেই যে বর্ষার তপ্ত দুপুরে বেরিয়েছিল মীরা সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সব। মীরার সংসারের যুদ্ধ, রাজিবের কঠিন অসুখের ব্যায়বহুল চিকিৎসার খরচ জোগাতে নিজেকে বাজি রাখা, ঘুরে দাঁড়ানো, কঠোর পরিশ্রম করে ব্যাবসার উন্নতি, রাজিবের বহুগামিতা, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা, পরপর দুইবারের মি’স’ক্যারেজ, রাজিবের অবর্তমানে নূহার জন্ম, প্রেগ্ন্যাসি পরবর্তী ইনফেকশন, হরমোনাল ইমব্যালেন্স, সাথীর আর ওর বিয়ে, ব্যাবসা থেকে ওকে দূরে রাখা, সবকিছু নিজের নামে করে নেয়া, আর? এত কিছুর বিনিময়ে প্রকৃতির পুরষ্কার হিসেবে বাবাকে শেষ বারের মতো দেখতে না পারার শাস্তি।

শিউলি আপা অঝোরে কেঁদেছেন সবটা শুনে। এত ভালো একটা মানুষ, যে এতটা ত্যাগ স্বীকার করলো তার স্বামীর জন্য, সেই স্বামীই তার বুকে ছুড়ি বসিয়েছে। মীরা শুধু টুম্পার ব্যাপারটা লুকিয়েছে শিউলি আপার কাছে, টুম্পার সম্মান ক্ষুন্ন হোক তা মীরা চায় না। বহুগামিতা শব্দে মুড়ে দিয়েছে ওকে ডহ অনেককে।

শিউলি আপা সাহস দিয়েছেন, কথা দিয়েছেন পাশে থাকার। মীরার দলটা তিনিই ভারী করে দিচ্ছেন। ঐ যে উপরওয়ালা একজন আছেন তিনি । তা না হলে একা মীরার এ যুদ্ধটা চালিয়ে নিতে কষ্ট হতো।

এর মধ্যে হঠাৎ একদিন রাতে রাজিব ইনিয়েবিনিয়ে লোনের কিস্তিটা দিতে বলে মীরাকে। মীরা শুনেও না শোনার ভাব করে বসে থাকে। রাতে বিছানায় এসে রাজিব আবার তোলে কথাটা। মীরা চুল আচড়ানো রেখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, ড্রেসিং টেবিলের থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলে-
: ” ঐ যে ইন্ডিয়া গেলাম আমি, পিয়সার সাথে, বলেছিলে ম্যানেজ করে ঘুরে আসো তারপর হাতে টাকা আসলে দিবো নি , দিয়েছিলে? দাও নি, ধার করে বিদেশ ভ্রমণ করে আসলাম আমি। মালপত্র যা আনলাম তাও ধার করে। ঈদের তাগাদায় কত্তগুলো টাকা পেলে, তবুও আমাকে সাহায্য করার কথা ভাবো নি একবার ও । এমনকি এতগুলো টাকা কোথায় পেলাম আমি তাও জিজ্ঞেস করো নি একটা বার। তারপর ঢুস করে বলে দিলে তোমার বাড়িতে চলবে না এসব। দু’টো মাসও সাপোর্ট করলে না, সোজা হয়ে দাঁড়ানো রেখে এত্তগুলো টাকা এডভান্স করে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হলো। সেখানেও লোন করতে হলো একগাদা টাকা৷ সেসব শোধ করতে আমি দিনরাত এক করে ফেলছি। মেয়েটাকে সময় দিতে পারছিনা, সংসারে মনযোগ নেই, তুমি কই যাও কি করো কোন খবর নাই আমার টাকার টেনশনে। কিসের ভিতরে দিনরাত যাচ্ছে তা কেবল ইশ্বর আর আমি জানি। মনে মনে ভেবেছি তোমার থেকে টাকা নিয়ে বড় লোনটা ক্লিয়ার করবো উল্টো তুমি আমাকে বলছো ব্যাংক লোনের টাকা শোধ করতে?
: না মানে, আসলে ব্যাবসরা অবস্থা বেশী ভালো না, হাতটা ফাঁকা তাই….

: মালেক সাহেবকে বলো এখন, তার কাছ থেকে সাহায্য নাও।

কিছু বলে না রাজিব। কি-ই বা বলবে ও। রাজিব টাকা পয়সার কি করেছে তা জানে না, জানতেও চায় না মীরা করুকগে যা মন চায়। তাতে ওর কি? ও তো কেবল দিন গুনছে রাজিবের নিঃস্ব হওয়ার অপেক্ষায়। যাকে বলে
ধনে আর জনে নিঃস্ব হওয়া।

রাত পেহাতে কত দেরী পান্জেরী?
সেদিন হয়তো আর বেশী দূরে না…..

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে