প্রিয় ভুল পর্ব-১০৫ এবং শেষ পর্ব

0
307

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৫
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

বছর কয়েক পরের ঘটনা….

একদিন ভোরে মীরাদের বাড়ির মেইন গেইটের কলিং বেইল বাজছে, আগের রাতেই পিয়ালীর আকদ অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে বাই-এয়ারে ঢাকায় ব্যাক করেছে ওরা। বাড়ির কেয়ারটেকার অসুস্থ, তাই এসেই তাকে ছুটি দিয়েছে আবীর।

শোয়া থেকে উঠে বেড রুম থেকে ড্রাইংরুমে আসে মীরা কে এসেছে তা দেখতে। এ ঘরের জানালা দিয়ে গেইটের দিকটা দেখা যায়। তাকিয়ে দেখে পিয়ালী দাঁড়িয়ে। বেশ অবাক হয় মীরা ওকে এত সকালে এখানে দেখে, আরো বেশী অবাক হয় ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে। এ ছেলেটা আবার কে?

গতকাল বিকেলে ওর আকদ অনুষ্ঠান হয়। কাজের ব্যাস্ততা থাকায় তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে বেরিয়ে গেছে ওরা। মীরার চৈতন্য ফেরে পুনরায় কলিংবেলের শব্দে।

গায়ে ওড়না জড়িয়ে চাবি হাতে বের হয় মীরা। মেইন গেইটের তালা খুলতেই পিয়ালী “ভাবী” বলে জড়িয়ে ধরে মীরাকে। চিন্তিত মুখে তাকায় মীরা ছেলেটার দিকে। অস্বস্তিতে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। আলিঙ্গন মুক্ত করে মীরা ” ভেতরে আসো” -বলে বাড়ির ভিতরে আনে ওকে। পিছু পিছু ছেলেটাও ঢুকে বাড়িতে, দরজা আটকে মীরা ওদেরকে বাড়ির ভেতরে আনে।

বসার ঘরে ওদেরকে রেখে বেড রুমে যায় আবীরকে ডাকতে। মীরার পিছুপিছু আসে পিয়ালী। কান্না করে যা বলে তা শুনে পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় ওর। যদিও এমন কিছুই আশংকা করেছিলো ও। তবুও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে যেন কষ্ট হয় ওর। নিজের কিশোরী বয়সে ফিরে গেলো মীরা। ঠিক এমন একটা জায়গায় ও নিজে ছিলো দেড় যুগ আগে। ও যে ভুল করেছিলো তেমনি একটা ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে আবারো। এমনটা ভাবতেই ছেলেটার দিকে তাকায় মীরা একপলক। রাজীবের প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পায় ও তার মাঝে। সুন্দর, সুঠাম, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী যুবকের চোখেমুখে উদ্ধত ভাব। একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে আসার মতো এত গর্হিত অপরাধ করেও তার মধ্যে অনুতপ্ততার ছিটেফোঁটাও নেই। যেমনটা ছিলো না রাজিবের। জীবনে চলার পথের অনেক বাঁধা অনেক বিপত্তি অনেক পরিণত করেছে ওর চোখকে। এ চোখ ভুল দেখে না কখনো।

মীরা ঠান্ডা মাথার মেয়ে, ওদেরকে চা, নাশতা দিয়ে বসতে বলে নূহাকে তৈরি করতে যায় ও। নূহারও স্কুলের সময় হয়ে গেছে। গাড়ি এসে পরবে একটু পরেই।

ঝটপট নূহাকে তৈরি করে গাড়িতে তুলে দিতে যায় মীরা। সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে শুনতে পায় ওদের কথোপকথন। ছেলেটা ঝাড়ি দিচ্ছে ওকে এখানে কেন এলে তা বলে। মীরা শব্দ করে জুতা জোড়া কাবার্টে রাখে, যেটার কোন প্রয়োজনেই ছিলো না, ওদেরকে ওর উপস্থিতি জানানো ছাড়া।

কাবার্টের শব্দে নিরবতা নেমে এলো ঘরে। মীরা একপলক চেয়ে দেখে দুজন দুজনের বিপরীতের সোফায় বসে আছে। দুজনের কেউই চা-নাশতার কিছুই ছোঁয় নি।

গাম্ভীর্য একটা ভাব নিয়ে চা হাতে ঘরে ঢুকে মীরা। তারপর পিয়ালীর পাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করে –

: “কাজটা কি তোমরা ঠিক করেছো?”

মাথা নত করে রাখে দুজনই, আঙুল খুটছে ছেলেটা, যাতে অস্থিরতা ফুটে উঠে স্পষ্ট ভাবে। একটু পরে টের পেল পিয়ালী কাঁদছে। নিজের ওই সময়টাতে এক মুহূর্তের জন্য আবার ফিরে গেলো মীরা। পিয়ালীর মত এমনই অন্ধ ছিলো সে রাজীবের প্রতি, ঠিক ভুল, ন্যায়-অন্যায়ের সীমানা তখন অস্পষ্ট ছিলো ওর কাছে। একটা মানুষকে নিজের করে পাওয়াটাই তখন ছিল মুখ্য বিষয়, তাকে পেতে গিয়ে ভুল হচ্ছে কি সঠিক তা দেখবার সময় ছিল না ওর। তবে মীরার জীবণে ভুল শুধরে দেয়ার মতো কেউ ছিলো না। পিয়ালীর জীবনে ও আছে। সব ঠিক করে দিবে ও।

ভাবনার জাল ছিঁড়ে মীরা আবার প্রশ্ন করে পিয়ালীকে-

: “এখন কি করতে চাও তোমরা? ”

এবার মুখ খুললেন স্বয়ং নবাবজাদা। হুম, দেখতে শুনতে, আচারে, স্বভাবে নবাবি ঠাট আছে তার। ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট কন্ঠে বললেন-

: “আজই বিয়ে করবো আমরা”

মীরা শক্ত গলায় বলে-

: “বিয়ে কি ছেলেখেলা যে করবো বললেই করা যাবে? গতরাতে বিয়ে হয়েছে ওর। যার সাথে হয়েছে ও এখনো তার স্ত্রী। তার সাথে ছাড়ছাড়ি না হলে আবার বিয়ে কিভাবে সম্ভব?”

পিয়ালী মীরার দিকে এগিয়ে এসে ওর হাত দুটো ধরে বলে-

: “ভাবী আমরা দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসি, আমার কিংবা তাউসিফ কারোর পক্ষেই অন্য কাওকে মেনে নেয়া সম্ভব না ”

: “ভালোবাসো দুজন কিন্তু দায়িত্ব তো সব তুমিই নিয়ে নিয়েছো কাঁধে,”

মাথা তুলে তাকায় তাউসিফ মীরার দিকে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মীরা পিয়ালীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে- “দিনশেষে আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মুসলিম, মুসলিম রীতিনীতিতে বিয়ের ব্যাপারে অনেক নিয়মকানুন রয়েছে সেগুলো মেনে চালাও আমাদের কর্তব্য, তাছাড়া তোমাদের মনে যখন এসবই ছিলো তাহলে বিয়ের আগে কেন চলে গেলে না? একটা নির্দোষ ছেলে তাহলে এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়তো না। ওর দোষটা কি এখানে? কেন তোমরা ওর সাথে এমন অন্যায় করলে ”

কান্না জড়ানো গলায় পিয়ালী বলে-

: “ভাবী আমি জানি আমি আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ওর ব্যাপারে বহুবার বাবা মা, চাচিকে বলেছি। তারা আমার কথার পাত্তাই দেননি, বরঞ্চ দিনের পর দিন মানসিক শারীরিক অত্যাচার করেছে। নিজেদের পছন্দে বিয়ে ঠিক করেছে, এমনকি কোন কিছু না জানিয়ে আকদের আয়োজন ও করে ফেলেছে। তাদের এসব কি অন্যায় না? নাকি তারা বাবা মা বলে তাদের কোন অন্যায় অন্যায় না? ”

: “দেখো পিয়ালী কাটাকাটির খেলা খেলতে বসিনি আমি, যেটা অন্যায় সব অবস্থাতেই অন্যায়। ”

মীরা তাউসিফের দিকে চেয়ে বলে –

: ” কিছু মনে করো না, এখন তুমি চলে যাও। ওর ভাই বাসায় আছে তো তোমাকে দেখলে কেলেংকারী হয়ে যাবে। আমি একটু ভেবে দেখি কি করা যায়।

কোনমতে বাহানা দিয়ে তাওসিফকে বাসা থেকে বের করলো মীরা। ওর মনে যা আছে তা তো আছেই।

তাউসিফ বের হওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে আসে আবীর। চমকে যায় পিয়ালীকে ওর বাড়ির ড্রইংরুমের সোফতে বসে থাকতে দেখে। তাউসিফ উঠে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। আবীর অবাক কন্ঠে বলে-

: “কি ব্যাপার? ”

যদিও সবটাই বুঝেছিলো ও, তবুও যেন আবারো শুনতে চাইছে ওর ভাবা ভাবনাটা মিথ্যে প্রকাশের মিথ্যে খেলায়। কিন্তু মীরা তাই বললো যা ও ভেবে ফেলেছিল মুহূর্তের মধ্যেই।

সবটা শুনে মাথায় আগুন জ্বলে যেন আবীরের। মাথা নিচু করে কান্না করা পিয়ালীর দিকে তেড়ে যায় আবীর রাগান্বিত ভাবে। যেন নিজেরবসাথে হওয়া অন্যায়টার প্রতিবাদ করতে একটা সুযোগ পেয়েছে ও। রাগান্বিত কন্ঠে বলে-

: ” এত যখন ভালেবাসা তবে আগে কেন বাড়ি ছাড়িস নি, কি দোষ ঐ ছেলেটার? কোথায় পেলি তুই এত সাহস একটা মানুষের জীবন নিয়ে খেলার? ”

: ” আমাকে তোরা মাফ করে দে ভাইয়া”

: ” আমরা কে মাফ করার? তুই জানিস এ সমাজ, সমাজের মানুষ কি করবে ওর সাথে? বেঁচে থেকেও মরে যাবে ও। তোর কোন অধিকার নেই একটা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার। মীরা ফোন করো বাড়িতে, বলো ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা।

আবীরের এমন মূর্তি এর আগে দেখেনি মীরা। ছোট বোনকে শাসন করার অধিকার আছে ওর। ওরাও বড় বলে সম্মান করে আবীরকে। তবে আবীরের এই কাঠিন্য কষ্ট দিলো মীরাকে। নিজের করা অপরাধের সূক্ষ্ণ যন্ত্রণাও বাজতে থাকলো বুকে। ও-ও তো এমনি করেছিলো আবীরের সাথে। কিন্তু মীরার মতো সবার জীবনে ভুলটা “প্রিয় ভুল” হয়ে ফিরে আসে না। কারন আবীরেরা রাজীবদের তুলনায় শক্তিশালী হলেও সংখ্যায় খুবই নগন্য।

চলবে….

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৬.১
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

সেদিন নূহা স্কুল থেকে ফিরলে সবকাজ ফেলে রেখে আবীর ওদের নিয়ে রওনা দেয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আবীর যেন মরিয়া হয়ে গেছে এ অঘটন রুখতে, যে করেই হোক এ অন্যায় ও রুখবেই। কড়া নজরদারিতে পিয়ালীকে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামে। তবে মীরার এসবে মত ছিলো না। মীরা আবীরকে বোঝাতে চেয়েছে এ সময় এমন হটকারিতা ঠিক হবে না, তাতে হীতে বিপরীত হতে পারে। এ যুগের ছেলেপেলে আবেগী হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ওর পরামর্শ ছিলো পিয়ালী থাকুক কিছুদিন এখানে, বাড়িতে সবার মাথা ঠান্ডা হলে ওকে নাহয় দিয়ে আসবো, কিন্তু আবীর সে কথায় কান দেয় নি, উল্টো রাগান্বিত হয়ে বলেছে-

: “তুমি এসবে একদম নাক গলাবা না, তুমি কি বুঝবে এসবের? আসছে চোরের সাক্ষী মাতাল…”

কথাটা বলে মীরার সামনে থেকে হনহন করে চলে গিয়েছিল আবীর। আবীরের এমন আচরণে খুব লজ্জিত, আর অপমানিত বোধ করেছিলো মীরা৷ ও তো এমনিতেই পুড়ছিলো ভিতরে ভিতরে নিজের করা অপরাধের কথা ভেবে। পিয়ালী কোন অঘটন না ঘটায় তাই ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে চেয়েছে মীরা। এর বেশী কিছু না, আর আবীর! কি বললো ও?

চোরের সাক্ষী মাতাল? মানে কি এ কথার?

মানে ও নিজেও যে একই কাজ করেছিলো দেড় যুগ আগে সেটার তুলনা দিলো দিলো আবীর? এতটা বছর পর? কতটা বদলে গেছে ও, আবীর তা জানে না?

আবীর দেখে না ওর ঐ ভুলের জন্য কতটা অনুতপ্ত ছিলো ও?

মীরার কেন, যে কোন আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষের অবশ্যই রিয়্যাক্ট করা উচিত এসব কথার বিপরীতে।কিন্তু না, এখন মীরা এ ব্যাপারে কোন রিয়্যাক্টই করবে না। আপাততঃ এ ঝামেলাটা মিটমাট হোক, পরে দেখা যাবে আবীরকে, এর ঝাল ঠিক সুদ উসুলে তুলবে মীরা।

ঠিক এই রুলসটা ওদের সংসারে শান্তি বজায় রাখে। একজন আগুন হলে অন্যজন হয় পানি, একজন কঠিন তো অপরজন তরল, দুজনের একজন কেউ রেগে গেলে অপরজন তাকে ঘাটে না। এ রুলসটা সকল দম্পতির মানা উচিত। কারন কথা কাটাকাটির খেলায় জিতার জন্য পুরো দুনিয়ার লোক আছে ঘরের মানুষকে এসব থেকে বাইরে রাখে ওরা দু’জনই।

অবশেষে সন্ধ্যার মুখে চট্টগ্রাম পৌঁছালো ওরা। গাছপালার আড়ালে অন্ধকার জেঁকে বসেছে যেন হানা দিতে। এখানকার এ সময়টা কেমন রহস্যময় লাগে মীরার।

সারাটা পথ কেঁদে বুক ভাসিয়েছে পিয়ালী। ওর হাবেভাবে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে ও মীরাকে এখন ওর শত্রু ভাবছে। কারন মীরা ওকে বুঝিয়েছে – যে ছেলে সময়মতো বাড়ির লোকেদের সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে না, যে ছেলে ভালোবাসার টানে না বরং একসাথে তোলা কিছু ক্লোজ ছবি, ভিডিও, চিঠিপত্রের ভয় দেখিয়ে প্রেমিকাকে বাড়ির বাইরে টেনে আনে সে আর যাই হোক ভালো প্রেমিক, ভালো মানুষ না। রাজিব আর তাউসিফের পার্থক্য এখানেই। কে জানে দেড় যুগ আগে ফোন, ছবি তোলা, ভিডিও করাটা এত এভেইলেভল হলে রাজীবও হয়তো এমনটাই করতো।

বাড়ি পৌঁছানোর পর হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়। পিয়ালীর বাবা ওকে দেখেই তেড়ে আসে মারতে। মীরা আর আবীর থামায় তাকে। তখন পিয়ালী অগ্নিমূর্তি ধারন করে। কর্কশ কন্ঠে বলে- এখন কেন আলগা দরদ দেখাতে এসেছো তোমরা? সরে যাও, মেরে ফেলুক আমাকে, সেটাই ভালো।

মীরা স্তব্ধ চেয়ে থাকে পিয়ালীর দিকে। এসব নিয়ে রাগারাগির এক পর্যায়ে পিয়ালীর মা অজ্ঞান হয়ে পরেন। ঘটনার আকস্মিকতায় হুলুস্থুল শুরু হয়ে যায় তাকে নিয়ে। গাড়ি যোগে হসপিটালে পৌছানোর পর জানা যায় অতিরিক্ত টেনশনে প্রেশার হাই হয়ে মেজর হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন তিনি। তার পরিস্থিতি খুবই সংকটাপন্ন। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। পিয়ালীর বাড়ি পালানো রেখে ওর মায়ের অসুখের বিষয়টা সকলের চিন্তার কারন হলো।

এমন পরিস্থিতিতে পিয়ালীকে চোখে চোখে রাখার কথাটা কারো মাথায় না থাকলেও পিয়ালীর হবু বর পরোক্ষভাবে এক কাজটাইমযেন করে যত্নের সাথে। খবর পেয়ে হসপিটালে এসে স্বান্তনা দিতে সকলকে। একটা সময় একা বসে কান্না করতে থাকা পিয়ালীর কাছে গিয়ে স্বান্তনা দিতে থাকে ওকে। বেচারা নতুন বর, লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে আপ্লুত পিয়লীকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যাস্ত। পাশে দাঁড়ািয়ে থাকা নিজের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে সে তার স্ত্রী পিয়ালীকে৷ বড়রা কি ভাববে? নিজের বাড়ির লোকই বা কি মনে করছে এসব যেন থোড়াই কেয়ার করছেন উনি। পিয়ালী প্রথমটাতে লোকটাকে পাত্তা না দিলেও একটা সময় ভেঙে পরে ওর মমত্বের কাছে। বাড়ির কেউ ওর সাথে কথা বলছে না, ওকেই দোষী ভাবছে এসবের জন্য। এত মানুষের ভিড়েও যেন একঘরে করে দিয়েছেন তারা ওকে।

পিয়ালীর বর আফনান ওর অবজ্ঞাকে পরিস্থিতির কারন ধরে নিয়ে ‘হাল ছেড়ো না মাঝি’র মতো লেগে থাকে নিরলস৷ টানা চারদিন পর জ্ঞান ফিরে পিয়ালীর মায়ের। জ্ঞান ফিরে পিয়ালীরও। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় ধরাবাঁধা আসাটাকে বেখাপ্পা ভেবে হসপিটালে থাকার ডিউরেশন কমিয়ে আনে আফনান। বিপরীতে পিয়ালী টের পেতে থাকে গত চারদিনের মমত্ববোধের। তবে এখনো ভালোবাসে ও তউসিফকে। ভীতি কাজ করতে থাকে ওদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কিছু সফটকপির জন্য। পঞ্চম দিন বাড়ি ফিরে মীরা আবীর। ঝড়ের তোরে কাটা পাঁচটা দিন কেউই কথা বলেনি কারোর সাথে। মীরা বলেনি অভিমানে, আর আবীর অপরাধবোধে। ঢাকায় ফিরবার দিন হসপিটাল থেকে বাড়িতে এসে নূহাকে খুঁজে পায় না ওরা। চিন্তায় মীরা আবীরের গলা শুকিয়ে যায়। বাড়ির উল্টোদিকে শালবন আর তার সীমানায় ঝর্ণার পিচ্ছিল ঢালুর কথা ভেবে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয় ওর। আবীর কথাটা শুনেই দৌড়ে যায় সেদিকটায়। পিছু পিছু মীরাও যায় আবীরের। বাকীরাও এদিকসেদিক খোজা শুরু করে দিয়েছে। সেখনে পৌঁছে কিছুই দেখে না ওরা, না নূহা না ওর চিহ্ন। নিচে নামবে আবীর এমন সময় কল আসে আবীরের। আবীর কথা বলা অবস্থায় ধীর পায়ে নেমে যায় মীরা ঝর্ণার ঢাল বেয়ে। এ জায়গাটা নূহার অনেক পছন্দের। একা আসতে নিষেধ থাকায় সুযোগ পেয়ে এখনে আসলো কি-না তাই ভবাছে ও। আবীর ভবছে নিচে পরে গেলো কি-না। আবীরের কথা শেষ হতেই ও ঘুরে বলে নূহা পাশের বাড়ির ছাদে ঐ বাড়ির মেয়েদের সাথে নাকি খেলছে। কথাটা শুনে ফিরে আসে মীরা। কিন্তু তরতরিয়ে নামা গেলেও একা উঠতে পারছে না ও, আবীর সিগারেট ধরাতে গিয়ে চোরা চোখে দেখে মীরার চেষ্টা। সংকচে আবীরের সাহায্য ও চাচ্ছে না ও। নামার পথটার মুখে হাঁটু গেড়ে বসে আবীর, তারপর কিছু একটা বলতে গিয়েও চেপে যায়।

গত পাঁচদিন ওরা কথা বলে না একে অপরের সাথে। কিন্তু আবীরের আচার আচরণ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু মীরা যেন থুম ধরে আছে, ঝড় হয়ে ভেঙে পরারর জন্য। মীরা উপরে উঠে দ্রুত পায়ে রওনা দেয় মেয়ের দিকে। আবীর কাকে যেন ফোন দেয়। মীরা পিছন ফিরে তাকায় না একবারও। আবীর বুঝতে পারে কোন কথার দোষে মীরা এমন বেশে। থমকে দাঁড়ায় আবীর, মাথা চুলকে ওর দ্রুত গতির হাঁটা দেখে হেসে দেয়। যেন ছায়াও মাড়াবে না ও আবীরের।।

অবশেষে ছেলেমেয়ে নিয়ে সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বিদায় নিয়ে রওনা দেয় ওরা। বাই এয়ারে জলদি ঢাকা পৌঁছে গেলেও জ্যামের কারনে সাড়ে ১১টায় বাসায় পৌঁছে ওরা। এদিকে বাচ্চা দুজনেই ঘুমে কাঁদা। বাড়ি পৌঁছে ওদেরকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে মীরা। বাথরুম থেকে ফিরে চুল ঝাড়ে, হাত-পায়ে লোশন দেয়। এমন সময় হঠাৎ পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে যায়। চমকে য়ায় মীরা ওদের আইপিএস আছে তাও আলো জ্বললো না কেন?

আশেপাশে চেয়ে দেখে আলো জ্বলছে ল্যাম্প পোস্টে। তারমানে বাড়ির কোথাওই সমস্যা হয়েছে। ভাবতেই ঘর থেকে বেরিয়েই দেখে ফ্ল্যাটের মেইন দরজা থেকে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি আলোকিত। কাছে গিয়ে দেখে ছোট ছোট লাইটের সাদা জোনাকির মতো আলো দিয়ে সাজানো। দরজা বাইরে থেকে আটকে অবাক হয়ে আলোর পথ ধরে ছাদে যায় মীরা। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পা দিতেই পুরো ছাদ আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। দুই পাশ থেকে সকলে এসে উইশ করে মীরাকে ”হ্যাপি এনিভার্সেরী”। ভীষণ অবাক হয়ে যায় মীরা, বিয়ের ছয় বছরে এমন বিবাহ বার্ষিকীর উৎযাপন করে নি ওরা। ইরা, ওর বর, মীরার ভাই, ভাইয়ের বৌ, তমা, ফাহাদ, সকলেই উপস্থিত। তলে তলে এত বড় আয়োজন কখন করলো আবীর? গত পাঁচদিন তো চট্টগ্রামেই ছিলো ওরা। পুরো ছাদে চোখ বুলায় মীরা। সিম্পলি এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে ছাদটাকে বলার মতো না। সবাই ঘিরে আছে ওদের দুজনকে। কিন্তু কাছাকাছি থেকেও যে ওরা কত দূরে আজ এক সপ্তাহ ধরে তা কাওকে টের পেতে দিলো না দুজনের কেউই।

তারপর কেক কাটা, খাওয়াদাওয়া, সবার হাসি কথোপকথন, আড্ডায় জমে উঠলো রাতটা। মীরা স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বললেও একবারের জন্য ও তাকায় নি আবীরের চোখে। মীরার মান ভাঙাতেই এই উদযাপনের আশ্রয় নিয়েছে ও। তবুও যেম মান ভাঙছে না প্রিয়ার৷ রাত অনেক হলে সকলকেই থেকে যেতে বলে রাতটা। নিজেদের গাড়ি নিয়ে আসায় সকলেই ফিরে যায় নিজ নিজ বাড়িতে। মুরসালিন পৌঁছে দেয় ফাহাদকে, আর মীরার ভাই নাজিবদের সাথে যায় তমা আর ওর বরকে। ওকে বাড়ির কাছে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরবে ওরা।

রাতে ঘরে ফিরে আবার সেই মূর্তি ধরে মীরা। এত কিছুতেও যেন মন গলেনি তার। বুঝতে পেরে আবীর কাপড় গুছাতে থাকা মীরাকে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। এক মূহুর্তের জন্য যেন জমে যায় মীরা। তখনি তৎক্ষনাৎ ঘুরে দাঁড়ায় আবীরের দিকে। তারপর জমে থাকা অভিমানের মেঘ রূপান্তরিত হয় কথার বৃষ্টিতে। আবীরের কান যেন বধির। ও কেবল মীরার রাগান্বিত মুখভঙ্গি আর ঠোঁটে নড়ন দেখছে। হাত দুটো ও নাড়ছে মীরা সবসময়কার মতো। এটা ওর পুরোনো অভ্যাস। এটা ওর কথার অলংকার যেন। রাগলে ওর সুন্দরী বউটার মুখ আরক্ত হয়ে যায়। মীরাকে ও তাই শামারুখ ডাকে ভালোবেসে। এটা ওর আদুরে নাম।

আবীর বুঝলো পরিস্থিতি, যুক্তি, তর্ক, সবই আবীরের বিপক্ষে। মীরার বিপরীতে জিতবার একটা অবলম্বনই কেবল রয়েছে ওর। সেটারই আশ্রয় নিলো ও দিশেহারা হয়ে। হুট করে দুই কান চেপে ধরে মীরার যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র ঠোঁট জোড়াকে ডুবিয়ে নিলো নিজের ঠোঁট। হতচকিত মীরার রাগ যেন আরো বাড়লো। রাগে ক্ষোভে ফেটে পরা মীরা অনেক চেষ্ট করলো নিজেকে আলাদা করতে। ততক্ষণে আবীর মীরার পুরো দখল নিয়ে নিয়েছে ওকে দেয়ালের সাথে আটকে ধরে। ঘাড়ের কাছে চুমু খেয়ে আবীর মীরার কানে ফিসফিস করে বলে- ‘আই্ম সো সরি’ ক্ষমা না করে যাবে কোথায় তুমি?

চলবে……

প্রিয় ভুল
লেখা: মাহবুবা মিতু
পর্ব : ১০৬.২
(অনুগ্রহ করে অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করবেন না)

অভিমানের সব মেঘ ভালোবাসার বৃষ্টি নামিয়েছিল সে রাতে। অমবস্যার অন্ধকার রাতটা রঙিন আলোয় আলোকিত হয়েছিলো দুই নর-নারীর উদ্দাম ভালোবাসায়।

আবীর এসব ঝামেলা থেকে ফিরে কাজে ডুবে যায়। ডুব দেয় মীরাও। সামনের মাসে ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে জার্সি তৈরীর বড় অর্ডার সরাসরি পেয়েছে ওরা। এটা ওদের ফ্যাক্টরির এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্ডার হতে যাচ্ছে। গত ৫ দিন ঐসব ঝামেলার দরুন বাড়িতে থাকার কারনে কাজের তদারকিতে ঢিল পরায় কাজ একটু পিছিয়ে গেছে। তবে সময় এখনো আছে হাতে। সেখান থেকে ফিরে উদয়াস্ত কাজ করে ওরা। বেঁধে দেয়া সময়ে কাজ শেষ করতে ৩ রাত নাইট ডিউটি ও করায়। অবশেষে কাজ শেষ করে সময় মতোই শিপিং কম্পিলিট করে ওরা।

এদিকে চট্টগ্রামের বাড়ি থেকেও কল আসতে থাকে ওদের। দেশের বাইরে থাকা সবার উপস্থিতির সুবিধার্থে পিয়ালীর বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো ২ মাস পর। কিন্তু ছেলে এবং তার পরিবার চান যতদ্রুত সম্ভব বউ ঘরে তুলতে৷ এটা মূলত পিয়ালীর শ্বশুর বাড়ির লোকেদের ইচ্ছে না, ইচ্ছেটা পিয়ালীর বরের। তাছাড়া
মাঝখানে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, পিয়ালির বাড়ির লোকেরাও মেয়ে বিদেয় করতে পারলে বাঁচে। তাই হুট করে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়, দেশের বাইরে থাকা ওদের জন্য আর অপেক্ষা করা সম্ভব না হওয়ায় বিয়ের তারিখ পরে নিকটবর্তী শুক্রবারে।

সময়মতো ব্যাগপত্র নিয়ে পৌঁছে যায় আবীর-মীরা দম্পতি। বিয়ের তারিখ পরিবর্তন হওয়ায় সব কাজ ফেলে ছুটে আসে অনেকে। পিয়ালীর ভাই, ভাবী, ফিওনার বর আসতে না পারলেও দুটো বাচ্চা নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একাই ছুটে আসে ফিওনা। একত্রে হওয়ার, আনন্দ উপভোগ করার কোন সুযোগই হাতছাড়া করতে চায়-না ওরা। অবশেষে বুধবার বিকেলে শুরু হলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। পিয়ালীকে স্বাভাবিকই দেখালো। তবে মীরা ওর আগের ব্যাবহারের কথা ভেবে এড়িয়ে গেলো ওকে। তবে পিয়ালীর চোখে-মুখে লেপ্টে থাকা অনুতপ্ততা ঠিকই টের পোলো মীরা।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই ভীষণ সুন্দর করে সাজলো। বাড়িটা সেজে উঠলো নতুন করে। বাড়ির ছেলেমেয়েরা দেশের বাইরে থাকায় বাড়িটা যেন নি:সাড় কঙ্কাল হয়ে থাকে সবসময়। ওরা এলেই প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয় ছবির মতো সুন্দর এই বাড়িটায়৷

জমকালো হলুদের অনুষ্ঠান আরো রঙিন হয় হবু বর
আফনান এর আগমনে। ঐ বাড়ি থেকে বিয়ের শাড়ি গহনা দিতে আসা লোকেদের সাথে সেও এসেছে। ভাবটা এমন যেন অত্যান্ত অনিচ্ছায়, একান্ত বাধ্য হয়ে, ঠেকায় পরে এসেছে সে এখানে।

এমন সময় হবু বরকে পেলে এ বাড়ির ছেলেপুলেরা ছাড়বে কেন? বাড়ির ছোটবড় সকলে মিলে লুফে নিলো যেন হবু বরকে। বাড়ির ছোটরা একপ্রকার তুলেই আনলো তাকে। সংকোচ আর লজ্জায় সত্যি গুটিয়ে গেছে বেচারা, সবাই কেমন ভাবে নেয় বিষয়টা এটা ভেবে । কিন্তু এই কথা, হাসাহাসিটাকে সত্যি উপভোগ করলো পিয়ালী। ওকেও দেখা গেলো মিটিমিটি হাসতে। পাশাপাশি বসে থাকা দুজনকে এক পর্যায়ে দেখাগেলো ফিসফাস কথা বলতে। মীরা তো সেই লেভেলের অবাক। এদের এত ভাব হলো কবে?

ক্যামেরাম্যান খাওয়া শেষে এসে ব্যাস্ত হয়ে গেলো বর-কনের যৌথ ফটোশ্যুট করতে। ছবি তোলার সময় কোন আড়ষ্টতা ছিলো না দুজনের কারোরই। এত মিষ্টি লাগছিলো দুজনকে বলার মতো না। মীরা মন থেকে দোয়া করে দুজনের জন্য। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে ওর। একটা বিশাল খাদের কিনারা থেকে পিয়ালীকে টেনে আনতে পেরেছে ওরা শেষ পর্যন্ত। এর সবটুকু কৃতিত্ব আবীরের। ও শক্ত হাতে সামলেছে সবটা, জরুরী সব কাজ ফেলে পাঁচটা দিন থেকেছে চট্টগ্রামের বাড়িতে।

হবু বর-বউ দুজন নিজেদের মধ্যে ভাব করে নিলেও পিয়ালী কিন্তু এখনো গম্ভীর মীরার প্রতি। এটা গাম্ভীর্যতা নাকি সংকোচ তা বোঝা মুশকিল। সত্যি বলতে মীরার কোন আক্ষেপ নেই ওর দূর্ব্যাবহারের কারনে। পিয়ালী যে খাদের কিনারা থেকে বেঁচে ফিরেছে, সহজ হয়েছে আফনানের সাথে এটাই অনেক ওর জন্য।

ছবি তোলা খাওয়াদাওয়া শেষে জমাটি আড্ডা বসে সকলে মিলে৷ দফায় দফায় চা নিয়ে আসছে মীরা সকলের জন্য। ফিওনা মীরার হাতটা ধরে বলে-
: “খুব আপ্যায়ন হয়েছে, এবার বসো তো তুমি, খেলা জমে উঠেছে ” মীরা চেয়ে দেখে টেবিলে গোল করে বসে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলছে ওরা। চা সামলে বসে পরে মীরাও। তিন রাউন্ড পর বোতল চলে আসে মীরার দিকে।

বড় চাচার ছেলে জাদিদ মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
” ট্রুথ নাকি ডেয়ার?
মীরা সহাস্যে বলে- “ট্রুথ”
এবার আহনাফ বলে-
: ” জীবনের এ পর্যায়ে এসে পেছন ফিরে তাকালে সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটাকে মনে হয়? ”
একটু যেন ভাবতে সময় নেয় মীরা। তারপর ছোট্ট করে বলে-
: “আবীর”
সকলে উৎফুল্ল হাসিতে ফেটে পরে মীরার উত্তরে। মীরার চোখে চেয়ে মুচকি হাসে আবীরও।
এরপর এক এক করে একেকজনের পালা পরে। ঘুরতে ঘুরতে এবারবএকটু দেরি করেই আসে মীরার পালা।
পিয়ালীর ভাই প্বার্থ যে কিনা পড়াশোনা করে অস্ট্রেলিয়ায়, সে মীরাকে বলে –
: “ভাবী এমন কোন গল্প বলো যা সবার শোনা উচিত বলে মনে করো তুমি”
এটা কি ট্রুথ অর ডেয়ার খেলা হলো?
মাথা চুলকে মুচকি হাসে সে। তারপর বলে আপনার স্টোরি টেলিং স্কিল খুব ভালো। বলুন না একটা গল্প।
এবারও একটু ভাবে মীরা। গল্পতো কত আছে জীবনে, কোনটা বলবে ও?
তারপর মীরা বলে-
: গল্পটা এক অনিন্দ্য সুন্দরীর, যার প্রেম হয় এমন এক যুবকের সাথে যে ওকে ভালোবাসতো না, কেবল জিতে নিয়েছিলো বন্ধুর সাথে বাজিতে। অথচ মেয়েটা পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলে ওকে। অন্যত্র বিয়ে হওয়ার পরও ঘর ছাড়ে তাকে পাওয়ার আশায়।
গল্পের এ পর্যায়ে আবীর চমকে উঠে তাকায় মীরার দিকে। এ গল্প সকলের অজানা হলেও জানা আছে আবীরের।

আবারো বলতে শুরু করে মীরা-
: মেয়েটা বাবা মায়ের খুব আদরের হওয়া সত্ত্বেও বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করে ছেলেটাকে। আত্নীয় পাড়াপ্রতিবেশি সকলে বলেছিলো “একদিন ঠিক বুঝতে পারবে কত বড় ভুল করেছে সে”
আভিজাত্যে বড় হওয়া সে মেয়েটা ঘর বাঁধে বস্তির এক কুঁড়ে ঘরে। গায়ের গয়না বেঁচে চলতে থাকে তাদের সংসার। ছেলেটা সামান্য বেতনের চাকরী করলেও দুজনের সংসারের জন্য তা খুবই নগন্য থাকায় কাজে নেমে পরে মেয়েটাও। কোচিং সেন্টারের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেও সুন্দরী হওয়ার দরুন নানান ঝামেলায় কাটে ওর দিন। ওরই সৌন্দর্যের কারনে চাকরী হারায় মেয়েটার বর, কারন ছেলেটার মালিকের বদ নজর পরে ওর বউয়ের উপর। যে রূপ আর সৌন্দর্যের জন্য একটা সময় গোপন অহমিকা ছিলো মেয়েটার ঠিক সেই সময়টাতে তারই জন্য নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হতে থাকে মেয়েটার। স্বামীর চাকরি হারানোর পর উদয়াস্ত খেটে সংসারের ঘানি একাই টানতে থাকে মেয়েটি। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের প্রেক্ষাপট দুঃখে বদলে গেলেও মেয়েটা সুখী ছিলো ওকে পেয়ে।

এসবের ঘোর না কাটতেই ছেলেটার অনেক বড় একটা অসুখ হয়, যার চিকিৎসা অত্যান্ত ব্যায়-বহুল। কোন দিশা না পেয়ে মেয়েটাকে তার স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করে নিজেকে বন্ধক রেখে । শর্ত ছিলো মেয়েটার স্বামীর চিকিৎসা শেষ হলে মেয়েটা বিয়ে করবে ঐ লোককে। সে টাকাতেই চিকিৎসা হয় ওর৷ তবে ভাগ্য এবার সহায় হয় ওর, ওর বন্ধুরা দাতব্য সংস্থা থেকে ওর স্বামীর চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করে। ফেরত দিয়ে নিজের বন্ধক ছুটানোর জন্য চলে যায় তার কাছে। লোকটা মেয়েটাকে বন্ধকি থেকে মুক্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু টাকা গুলো উপহার দেয় নতুন করে কিছু করার শুরু করার জন্য। মেয়েটা আজও ওর জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রুর কাছে কৃতজ্ঞ। তবে মজার ব্যাপার হলো অনেক, অনেক বছর পরে মেয়েটা জানতে পারে আসলে ঐ টাকাগুলো কোন দাতব্য সংস্থার দান ছিলো না।

গল্পের ঠিক এ পর্যায়ে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয়া আবীর তড়াক করে সোজা হয়ে বসে, তাকায় মীরার চোখের দিকে। যেন অলৌকিক কোন ক্ষমতা বলে নিজের চোখ দিয়ে বন্ধ করে দিতে চাইছে মীরার জবান। কাজটা করতে ব্যার্থ হয়ে সে মনে মনে ভাবে “গল্পের এ অংশটা ত মীরার জানার কথা না”
এবার আবীর মাথা নিচু করে বসে পরে। যেন এ অংশটা মীরার জানা হওয়ায় ও ভীষণভাবে লজ্জিত।

পিয়ালী জিজ্ঞেস করে –
: ” টাকাগুলো কে পাঠিয়েছিলো তবে?”
পিয়ালীর এমন প্রশ্নে টের পাওয়া যায় ওর মনোযোগের অখন্ডতা। ওর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে আবারো বলতে শুরু করে মীরা-
: ” ঐ টাকাগুলো পাঠিয়েছিলো তারই ফেলে আসা ১ম স্বামী, যাকে মেয়েটা কলঙ্কময় জীবন ছাড়া কিছুই দেয়নি, অথচ মেয়েটার সুখের কথা ভেবে গোপনে টাকাগুলো পাঠিয়েছিলো মেয়েটারই বন্ধুদের হাতে। চিকিৎসা তদারক করতে পাঠিয়েছিলো তারই কাছের এক বন্ধুকে । এই বন্ধুই এত বছর পরে সামনে এসে এত বছর আগের জট খুলেছিলো মেয়েটার সামনে।

একটু থামলো মীরা। এত বলে গলা শুকিয়েছে যেন ওর। গ্লাসে থাকা পানি পুরোটা শেষ করে একটু থমকে থাকে সে। আহনাফ কৌতুহলী কন্ঠে প্রশ্ন করে –
: “তারপর? ”

মীরা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আবার শুরু করে-
: এরপর শুরু হয় মেয়েটার নতুন যুদ্ধ। নিজে পায়ে ঘুরে দাঁড়াবার। দিনরাত এক করে খাটা ক্লান্ত মেয়েটা হঠাৎ টের পায় ঘুরে দাঁড়াবার এ যুদ্ধটা ওর একার। দিন ঘুরবার ঐ সময়টাতে ওর স্বামী ব্যাস্ত ছিলো বাইক আর স্মার্ট ফোনের নতুন নতুন ভার্সন ক্র্যাক করায়। মেয়েটা ওর স্বামীকে ছাড় দিতো অসুস্থ ভেবে, এত বড় ধকল সামলে বেঁচে ফিরেছে, অতিরিক্ত স্ট্রেস, অতিরিক্ত পরিশ্রম ওর হার্টের জন্য হানিকর তাই, পরিণামে ঐ ছাড় পেয়ে পেয়ে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠে মেয়েটার প্রেমিক বর। দায়িত্বজ্ঞানহীন ঐ পুরুষটার দিন কাটতো টো টো করে। কাজ বলতে ব্যাবসার মার্কেটিংটা দেখতো সে অপরদিকে মেয়েটাকে দেখতে হতো পুরো ব্যাবসা সাথে সংসার ত রয়েছেই। বিয়ের অনেক বছর পেরুলেও সন্তান না হওয়ার যে যন্ত্রণা তা-ও একাই বয়ে যেতে হয়েছে ওকে। অনেক সাধনার পর একটা পরীর জন্ম হয় ওদের ঘরে। সবাই বলেছিলো ঘরে সন্তান এলে বোহেমিয়ান স্বামীর মন বসে যাবে। কিন্তু যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন। নিজের জন্মের মেয়ের প্রতিও মেয়েটার স্বামীর রাজ্যের অনিহা। মেয়ের অসুখ, বিসুখ ভালোমন্দ সব কিছুতেই গা ছাড়া ভাব তার। মেয়েটার ১ম স্বামী আর ওদের মেয়ের একটা বিষয়ে সাদৃশ্য থাকায় মাঝেমধ্যে হাসির ছলে বাজে কথা বলতেও ছাড় দেয়নি সে।

এত কিছুর পরও একটা সময় ও জানতে পারে ছেলেটা আবার বিয়ে করেছে ওর নিজেরই কাজিনকে। তাকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ের কারন হিসেবে দাখিল করেছে ১ম স্ত্রী বিবাহিত, ব্যবহৃত শরীর আনকোরা মেয়ে বিয়ের বাসনা। অথচ ঐ মেয়েটার প্রথমে অন্যত্র কাবিন হলেও কয়েকটা বাক্য বিনিময় ছাড়া কোন সম্পর্কই হয়নি মেয়েটার ১ম স্বামীর সাথে।

“একদিন ঠিক বুঝতে পারবে কত বড় ভুল করেছো তুমি ” সকলের বলা এই কথাটাই কেবল মাথায় ঘুরপাক খেতো।

ভুল যে ও করেছে তা মেয়েটি টের পেয়েছিলো অনেক আগেই। অথচ মেয়েটা সব জেন বুঝেও অন্ধ ছিলো, মগ্ন ছিলো সকলের বলা কথা ভুল প্রমাণের বাজে খেলায়। ভুল কে ভুল প্রমাণের খেলায় পুরো জীবণটাই শপে দেয় সে। বিনিময়ে অবহেলা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, সবচেয়ে কষ্টের বিষয় এই ছেলেটাকে বিয়ে করার অপরাধে মেয়েটাকে তার বাবার লা*শটাও দেখতে দেয়া হয়নি। একটা মেয়ে যার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলো দিনশেষে কি পেলো?

সংসারের প্রতি অনিহা, কাজকর্মে অনিহা, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি অনিহা একের পর এক তার করা অন্যায় মেনে নিয়েছে সে, নর্দমা থেকে তুলে ধুয়ে মুছে বিছানায়ও তুলেছে একাধিক বার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েটির সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় যখন নিজের গড়া ব্যাবসাটা সম্পূর্ণ নিজের নামে নিয়ে নেয় মেয়েটির বর। এত বড় প্রতারণার সাথে যোগ হয় গোপণে ২য় বিয়ের খবর। সব মিলিয়ে মেয়েটির প্রথমে স্বামী হত্যার পরিকল্পনা থাকলেও মেয়েটার জন্য বেঁচে থাকতে হবে বলে সরে আসে সে পথ থেকে।

এবার একটু থামে মীরা, এত আগের ঘটনা, কত কিছু ভুলে গেছে, কিছুটা আবছা হয়েছে স্মৃতি সময়ের স্রোতে। ফিওনা মীরার দিকে চেয়ে বলে-
: “তারপর ”
মুচকি হেসে আবার শুরু করে সে-

: “অনেক ঘটনা ভুলে গেছি আমি, যতটুকু শুনলে ঘটনা বুঝতে সুবিধা হবে তোমাদের ততটুকুই বলছি-

: ” মেয়েটা অবশেষে ডিভোর্স দেয় তার প্রেমিক স্বামীকে, যে তাকে ভালোবেসে ছিলো কিনা কোনদিন তা সে জানে না, তার কাছে ঐ মেয়েটি সুন্দরী, ওয়ান্ডারফুল ইন্সটুমেন্ট ফর এনজয় ছাড়া কিছু ছিলো না। ডিভোর্সের পরদিন নিজের গড়া ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান নিলামে উঠে স্বামীর দেনার দায়ে। অনেক কষ্টে নিজের জমানো টাকা, বন্ধুবান্ধবদের থেকে ধারদেনা করে সেটাকে নিলামে কেনে মেয়েটি। এরপর ভাগ্যক্রমে ঘুরেও দাঁড়ায় । ঘুরে দাঁড়ানোর এ পথে গুটি কয়েক মানুষ দেব দূত হয়ে এসেছিলে মেয়েটার জীবনে। যাদের সাহায্য ছাড়া ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব ছিলো।

সুন্দরী যুবতী ডিভোর্সি মেয়ে সমাজের একটা দায়, একটা বেঝা। একা থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও আশপাশের সকলে ২য় বিয়ে করার তাগিদ দেয়। কিন্তু একা থাকায় অনড় থাকে মেয়েটি। যে কষ্ট সে পেয়েছে ভালোবেসে সংসার গড়ে তার পুনরাবৃত্তি করতে চায় না সে।
তাছাড়া ও বিয়ে করলে স্বামী পাবে, কিন্তু মেয়েটা কি বাবা পাবে? কিন্তু সমাজ তাকে ছাড়বে কেন? পদে পদে, সর্বত্র লালসার শিকার হয় সে।

এই যে একটা ভুল, একটা ভুল সিদ্ধান্ত একে একে কতগুলো মানুষের জীবন নষ্ট করেছে…
যাকে ভালোবেসেছিলো, দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো সে তাকে কোনদিন ভালোই বাসে নি জিতে নিয়েছে বন্ধুর থেকে বাজীতে। আবীরদের সবচেয়ে ছোট কাজিন স্নেহা অস্ফুটে বলে উঠে-
: “তারমানে কি ভালোবাসা ভুল? ”
মীরা ওর চোখে চোখ রাত রেখে বলে-
: “অবশ্যই না, ভালোবাসা ভুল না, ভুল মানুষকে ভালোবাসা ভুল”
কথাটা বলেই পিয়ালীর দিকে তাকায় মীরা। পিয়ালী বুঝতে পারে এমন হতে পারা জীবনের খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছে সে।
মীরা নিজের দৃষ্টি গুটিয়ে স্নেহার দিকে তাকিয়ে বলে-
: “হিন্দিতে একটা কথা আছে – ঝুকনে সে আগার আপকি রিসতে টিক যাতে হ্যে তো ঝুক যাও, লেকিন বার বার আপকো হি ঝুকনা পারতে হ্যে তো রুখ যাও”
সম্পর্কে যখন দুজনের সমান কন্ট্রিবিউশান না থাকে, একজনের অপরজনের প্রতি ভরসা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ না থাকে তাহলে সেখানে ভালোবাসা থাকে না। থাকে ভুল করবার দায়। যেটা দিনকে দিন বাড়তে থাকে চক্রবৃদ্ধি হারে, আর একদিন তার বিপরীতে নিজেকে বড় তুচ্ছ মনে হয়।

বলেই থেমে থাকে মীরা।
বাজিতে যে ছেলেটা হেরেছিলো তার সম্পর্কে কিছু বললেন না ভাবী? কি হয়েছিল তার শেষে? তিনি কি বাজি হেরে গিয়ে এ গল্পের প্রেক্ষাপট থেকে সরে গিয়েছিল? একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে ফিওনা৷

চমকে উঠে মীরা ফিওনার মুখের কথা শুনে। অবাক হয় এমন প্রশ্ন শুনে। কেমন বেমালুম ভুলে গেছে ও এত বড় ব্যাক্তিকে, যে ওর জীবণ নাটকের এত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মনে পরার ভঙ্গিতে বলে-
: “নাহ্ বাজিতে হেরে গিয়ে সে থেমে থাকে নি, মেয়েটার বরের বন্ধু হওয়ায় তার সবটাই জানতো সে৷ খুঁজে খুঁজে দূর্বল দিক গুলো নিয়ে প্রতিশোধ নিতে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ শুরু করে সে। মেয়েটার বর এমনিতেই বেপরোয়া ছিলো, তার সাথে যোগ হয়েছিল ওমন বন্ধুর সান্নিধ্য। মেয়েটার সংসার, ব্যবসা এমন কোন কিছু নাই যেটাতে নাক গলায় নি সে, ক্ষতি করার চেষ্টা করে নি সে। অথচ মেয়েটা তাকে কোনদিনই ভুলেও শত্রু ভাবে নি। সবকিছু টের পেয়ে যেদিন মুখোমুখি হয়েছিলো মেয়েটা তার – কথার বাণে জর্জরিত করে দিয়েছিলো শত্রুর অন্তর, এবং ক্ষমাও করে দিয়েছিলো তার কৃতকর্মের জন্য। পরে একদিন সকালে মেয়েটা হঠাৎ শুনতে পারে লোকটা নাকি আ*ত্ন*হ*ত্যা করেছে। স্বামীর বন্ধু হিসেবে সহমর্মিতা দেখাতে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো সেই মেয়েটি। সেখানে গিয়ে মাথায় আকাশ ভাঙে তার, সেদিনই মেয়েটা জানতে পারে এত বছরের সংসার যে ছিলো তার সেটা বাজির দানে জিতা একটা খেলা ছিলো৷ যেটা হেরেছিলো তার বন্ধুর বর আর জিতেছিলো নিজের প্রেমিক স্বামী। সংসার তো ভেঙে আগেই গিয়েছিলো, যতটুকু সহমর্মিতা ছিলো মানুষ হিসেবে ততটুকুও শেষ হয়েছিল সেদিন।

এরপর খেলাটা চলতে থাকে তার নিজস্ব গতিতে। বোতল ঘুরে, ঘুরে চলে সময়, সাথে গল্প। ঘুরতে ঘুরতে অনেক সময় পর পিয়ালীর দিকে মুখ করে থামে বোতল। জাদিদের নিয়মিত প্রশ্নের উত্তরে ট্রুথ নেয় পিয়ালী-

পিয়ালীর মা পেছন থেকে এসে বলে-
: ” ট্রুথ না ডেয়ার নেবে পিয়ালী, এবং মীরাকে জড়িয়ে টাইট একটা হাগ করবে”

পিয়ালীর মা খেলার বাইরে হলেও তার মন পরে আছে যেন টেবিলের কেন্দ্রে থাকা বোতলে মধ্যে। কেমন ইতস্তত ভাব হয় পিয়ালীর। মীরার ভাবসাব বোঝা যাচ্ছে না চা খাওয়ার ব্যাস্ততায়। সংকোচে জমে থাকা পিয়ালীকে নিজে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মীরা।
মীরার আচমকা আলিঙ্গনে স্তব্ধ পিয়ালীর কান্নার বাঁধ ভাঙে একটু পর । মীরা পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করে ওকে। পিয়ালী কান্না জড়ানো গলায় বলে-
: “ভাবি আমাকে ক্ষমা করে দাও, আমি অন্ধ ছিলাম সত্যি, তবে সময় থাকতে চোখ খুলেছে আমার।

ওদের কান্না দেখে চোখ আর্দ্র হয় সকলের। এরপর আর খেলা জমে না, হলুদের আসরে পর্দা নামে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলার। যে খেলা অনেক না জানা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে আবীরের। যা কোনদিনই স্বামী হয়েও জিজ্ঞেস করে নি মীরাকে।

ঘরে এলে মীরা দেখে আবীর শুয়ে পরে ঘুমের ভান ধরছে। অথচ অসুখবিসুখ ছাড়া ওরা দুজন সবসময় একসাথেই ঘুমোতে যায়। মীরা মুচকি হাসে ওর এই লুকোচুরি খেলা দেখে। কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে চোখ রাখে আবীরের দিকে। ঘুমিয়ে পরলো না তো? তবে আবীরের উশখুশ ভাব তখনো বিরাজমান। মনে মনে বলে মীরা-
: “শকের যে ডোজ পরেছে আজ রাতে আর ঘুম আসবে না”

হাত-পায়ে লোশন দেয়া শেষ হলে ছেলেকে পাশে রেখে আবীরের পাশে শোয় ও। চিত হয়ে শোয়া আবীরের বুকে মাথা রাখতেই নড়েচড়ে পাশ ফিরে সে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মীরা বলে-
: “আমি জানি আপনি এখনো ঘুমান নি”

কিছু সময় পর পাশ ফিরে আবীর। তারপর মীরাকে জিজ্ঞেস করে –
: ” বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে, বাইরে উথাল পাথাল জোছনা, ঝরনার ধারে যাবে?”
ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসা মীরার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক ফোটে। এক লাফে খাট থেকে নেমে চাদরে জরিয়ে নেয় নিজেকে। আবীরও ততক্ষণে তৈরী যাওয়ার জন্য।

সেই প্রথম দিনের মতোই সকলের দৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচাতে পেছনের দরজা ধরে বের হয় ওরা। বড় রাস্তা ছাড়িয়ে বাড়ির অপরদিকের ঝাউ বনে হাঁটা দেয় ওরা। আকাশের চাঁদ, নিশুতিরাতে দেখা যাচ্ছে ঝাউবনের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে এক যুগল। ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে হাঁটছে মেয়েটা মাথা হেলিয়ে রেখেছে ছেলেটার গায়ে৷ যেন নিজের ভরের সবটুকু টানিয়ে নিচ্ছে ছেলেটাকে দিয়ে। টুকরো টুকরো কথা বলছে দুজনে। মাঝে মাঝে হাসির শব্দ ও আসছে। কে বলবে একটু আগেও অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলো দুজনে। ভালোবাসা এদেরকে এমনি ধাঁচে গড়েছে যে যত যাই হোক সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনে আগায় এরা দুজনের হাতে হাত রেখে।

সমাপ্ত……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে