আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০১

0
309

আকাশ_তীরে_আপন_সুর
|সূচনা পর্ব|
লাবিবা ওয়াহিদ

সদ্য বিবাহিত স্বামীর কোলে একটি তিন বছরের বাচ্চা ছেলে। সেই বাচ্চা বঁধুরূপে প্রণয়াকে দেখে অনবরত কাঁদছে এবং প্রণয়ার স্বামীকে বলছে,
–“এই মা ভালো না বাবা। আমাকে মেরেছে এই মা।”

প্রণয়া অবাক হয়ে বাচ্চাটির দিকে চেয়ে ঘনঘন মাথা নাড়াল। সে যে মারেনি এই বাচ্চাকে। ছুঁয়েও দেখেনি এখন অবধি। প্রণয়া কৈফিয়ত দিতে বলল, “বিশ্বাস করুন, আমি ওর গায়ে হাত অবধি দেইনি। মারা তো দূরে থাক।”

কিন্তু প্রণয়ার স্বামী তা মানতে নারাজ। সে চেঁচিয়ে ধমক দিয়ে উঠল প্রণয়াকে। প্রণয়া তার স্বামীর হাত ধরে বোঝাতে চাইলে স্বামী তাকে ধাক্কা দিল। প্রণয়া নিজেকে সামলাতে না পেরে দেয়ালের সাথে কপালে আঘাত পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম ভেঙে যায়। হকচকিয়ে উঠে বসে প্রণয়া। চারপাশে নজর বুলিয়ে বুঝল এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।

প্রণয়া নিজের ওপরই চরম বিরক্ত হলো। মুখ-ভঙ্গি এরকম যেন সকাল সকাল তেঁতো কিছু মুখে তুলেছে। পরপর বিরক্ত হলো মায়ের ওপরও। মা এসব কী আজারে সিরিয়াল দেখে? এদের ভিত্তিহীন সিরিয়ালের গল্প প্রণয়ার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে! মায়ের সাথে গতকাল একটু বসেছিল টিভির কাছে, ফলস্বরূপ এই সকালেই এমন তিক্ত স্বপ্ন। প্রণয়া কপাল কুচকে মিনমিন করে বলল, “ধুর!”
.
সবুজ, শ্যামলা সৌন্দর্যে ভরপুর শ্রীমঙ্গল। বাতাসে ভেসে বেড়ায় চা পাতার নেশালো ঘ্রাণ। এক ঝাঁক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল আকাশ জুড়ে। গাছ-গাছালির পাতা, ডালের ফাঁক ফোকর দিয়ে চা বাগানে প্রবেশ করেছে নরম, আবেশী রোদ। প্রণয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে চা বাগানের সৌন্দর্যে নজর বুলাচ্ছে। এই সৌন্দর্য প্রণয়ার জন্যে নতুন কিছু নয়।

উপর থেকে ড্রোনের শুট নিলে দেখা যাবে সমগ্র সবুজের মাঝে এক টুকরো বাড়ি। সেই বাড়িটার নাম চা বিলাস। সেই চা বিলাস বাড়িটা প্রণয়াদের৷ চা বাগানের মাঝামাঝিতে তাদের বাড়িটা। প্রায় একুশ শতাংশ জমি মিলিয়ে উঠান আর বাড়িটা। কাঠের দো’তলা বাড়ি এবং তার চারপাশে খোলা উঠান। উঠোনের আশপাশ জুড়ে আবার কাঠের বেড়া। এই বাড়িটা প্রণয়ার দাদার ভীষণ শখের গড়া। তিনি প্রতিনিয়ত চিন্তা করতেন কী করলে বাড়িটার সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পাবে? জীবিত থাকা অবস্থায় তিনি বাড়ির প্রতি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তাইতো স্ত্রী মূর্ছা যাওয়া সত্ত্বেও এই বাড়িতে দুজন কাজের লোক নিয়ে একাই থাকতে শুরু করে দিলেন।

স্থানীয় বাচ্চাদের কাছে এই চা বিলাস ভূতুড়ে বাড়ি লাগলেও পর্যটকদের কাছে এই বাড়ি চোখ ধাঁধানো সুন্দর। চা বিলাসের দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে পাতাবাহার ঝুলে পড়েছে নিচের হলদে বাতি অবধি। কত মানুষ যে এ বাড়ির সামনে এসে ছবি তুলে গেছে। তাদের এ বাড়ি আসা নিয়ে আলাদা ভিজিটের প্রয়োজন হয় না। পর্যটক’রা নিজেদের মতো করে এসে ঘুরে চলে যায়। আর প্রণয়া শুধু তাদের নীরবে দেখে যায়।

প্রণয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে চলে যায়। কলেজের পোশাক পড়ে বেরিয়ে আসতেই দেখল প্রণয়ার মা অর্থাৎ মিসেস ফাহিমা নাস্তা তৈরি করে ফেলেছে। ঘড়ির কাঁটা এখন ছয়টার ঘরে। ছয়টা বেজে পঁয়ত্রিশ। প্রণয়া খাবার টেবিলে বসলেও খাবারে হাত দিল না। মূলত প্রণয়া তার বাবা অর্থাৎ নুহাশ সাহেবের অপেক্ষায় বসে রইলো। নুহাশ সাহেব প্রতিদিন ফজরের পরপর বেরিয়ে যায় তার কুড়ি বিঘা চায়ের বাগানে চোখ বুলাতে। আশেপাশে মসজিদ নেই বললেই চলে। তাই ফজরের নামাজটা নুহাশ সাহেবের ঘরেই পড়তে হয়।

প্রণয়াকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। নুহাশ সাহেব মিনিট তিনের মধ্যেই এলেন। তবে তার স্বাভাবিক মুখে অস্বাভাবিক রাগ জ্বলজ্বল করছে। যা মা-মেয়ে দুজনেই লক্ষ্য করলো। নুহাশ সাহেব খাবার টেবিলে বসেই কঠিন গলায় স্ত্রীর উদ্দেশে বললেন,
–“প্লাবনকে কালকের মধ্যে বাসায় দেখতে চাই রোকসানা। স্কুল-স্টুল কী যাবে না? এত মানুষের বাসায় বেড়ানো কিসের?”

শেষ দুটি বাক্য নুহাশ সাহেব গলার স্বর বাড়িয়েই বললেন। প্রায় ধমকই বলা চলে। প্লাবন প্রণয়ার ছোটো ভাই। সবে ক্লাস ফোরে পড়ছে। প্লাবন সহজে বাড়ি থাকতে চায় না। মামাদের বাড়ি বেড়াতে ভীষণ পছন্দ করে। তাইতো প্রণয়ার বড়ো মামা আসলেই আবদার করে প্লাবনকে তার সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রণয়া আজও বুঝে না, মামা বাড়িতে এত কী মজা পায় সে?

প্রণয়া, ফাহিমা দুজনেই এই পরিস্থিতিতে চুপ থাকল। ফাহিমা আশ্বাসের সুরে স্বামীকে বলল,
–“আচ্ছা প্রণয়ার বাবা। আপনি শান্ত হন। আমি আজই কল করে বলব ভাইকে। কাল সকালের মধ্যেই প্লাবনকে বাড়ি দিয়ে যাবে।”

নুহাশ সাহেব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। যা প্রণয়ার চোখ এড়াল না। সকালে নিজের ঘর থেকে বাবার ফুরফুরে গলাই তো শুনেছিল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে কী এমন হলো যে বাবা এতটা তেঁতে আছে? চা বাগানে কিছু হলো নাকি?

প্রণয়া সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা করল না নুহাশ সাহেবকে। রয়েসয়ে কিছুটা সময় নিয়েই জিজ্ঞেস করল,
–“কী হয়েছে বাবা? বাগানে বা কারখানায় কী কোনো সমস্যা হয়েছে?”

নুহাশ সাহেব কিছুটা নিভে এলো। তবুও গলায় তেজ মিশিয়ে উচ্চস্বরে বলল,
–“শু* বাচ্চা ইমরানে হিসাবে ভালো রকম গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রাখছে। কর্মচারীরাও বলল, কত টাকা নাকি মেরে দিছে। এর নামে যদি আমি মামলা না ঠুকছি!”

ইমরান নুহাশ সাহেবের ম্যানেজার ছিল। যে কী না নুহাশ সাহেবের এত বড়ো চা ব্যবসার হিসাব-নিকাশ রাখত। সেই লোক যদি বিশ্বাসঘাতক হয় তাহলে রাগ তো হবেই। প্রণয়া বলল,
–“বের করে দিছ না?”

–“তা আর বলতে? ও এখন জুতারও যোগ্য না। যে মানুষ বিশ্বাস ভঙ্গ করে আর যাই হোক, মানুষের কাতারে পড়ে না।”

–“তো এখন কী করবা? নতুন ম্যানেজার কাকে বানাবা? বিশ্বাসযোগ্য কেউ আছে?”

এই পর্যায়ে নুহাশ সাহেব নিশ্চুপ রইলেন। তারপর নাস্তায় আর কোনো কথা হলো না। খাওয়া শেষে নুহাশ সাহেব মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন কলেজের উদ্দেশ্যে। এদিকের কিছু রাখাইন মেয়ে এবং স্থানীয় এক দুইজন কলেজ যায়, নুহাশ সাহেব ওদের সাথে প্রণয়াকে অটোতে উঠিয়ে দেন। রাস্তা থেকে কলেজ যেতে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট-ই লাগে। যার কারণে বেশ আগে আগেই বের হতে হয় প্রণয়াকে। ক্লাস শুরু হয় আবার নয়টা, সাড়ে নয়টা থেকে।

প্রণয়া অটোতে বসে সারি সারি সবুজ চা বাগানে নজর স্থির রাখল। প্রণয়ার চোখে যেন জ্বলজ্বল করছে এক টুকরো সবুজ রং। প্রণয়ার পুরো নাম প্রণয়া শেখ। এবার অনার্সে ভর্তি হয়েছে। গায়ের রং আহামরি ফরসা না হলেও কিছুটা পরিষ্কার। এছাড়া তার মুখের মায়া, টানা ছোটো চোখ, কোমড় অবধি আঁকা-বাঁকা চুল সবটাই একজন সুন্দরীর পরিচয় বহন করে। তবে তার গায়ের রঙের চাইতে মুখের মায়া বোধ হয় সকলকে বেশি আকৃষ্ট করে। প্রণয়া স্বভাবতই শান্ত স্বভাবের। খুব মেপে মেপে কথা বলার মানুষ। নিরিবিলি, শান্তিপ্রিয় মানুষও সে।

প্রণয়ার জন্ম হয় সিলেট শহরে। নুহাশ সাহেবের ছোটো থেকেই শখ ছিল শহরে থাকার। এজন্যে ফাহিমাকে নিয়ে প্রথমে শহরেই থাকত। শহরেই মোটামুটি বেতনের একটা চাকরিও করত। অথচ প্রণয়ার দাদার অঢেল সম্পদ, চায়ের বড়ো ব্যবসা। এসবকে তুচ্ছ করে নুহাশ সাহেব তার শখ মিটিয়েছেন।

প্রণয়ার বয়স যখন চৌদ্দ-পনেরো তখনই প্রণয়ার দাদা অসুখে ভুগে হঠাৎ মারা গেলেন। দাদা গত হওয়ার পরপর নুহাশ সাহেব আচমকা বদলে গেলেন। শহুরে চাকরি ছেড়ে পরিবার নিয়ে সোজা চলে গেলেন বাবার ভিটেতে। প্রণয়ার বাবা দাদার একমাত্র ছেলে হওয়ায় সব সম্পত্তি তার নামেই হয়ে গেল। তাই নুহাশ সাহেব তার বাবার ব্যবসাকে আবার আঁকড়ে ধরলেন। মারা যাওয়ার আগে নুহাশ তার অসুস্থ বাবার হাত ধরে কথা দিয়েছিলেন এই চা সাম্রাজ্য তিনি সামাল দিবেন।

নুহাশ সাহেব ব্যবসায় হাত দিলেও তাকে অনুতপ্ত বোধ বেশ কুড়ে কুড়ে খায়। বাবার শেষ সময়ে পাশে থাকতে পারেননি। মাকে হারিয়ে ফেলার পরেই নুহাশ সাহেব শ্রীমঙ্গল ছেড়েছিলেন। তার শখ, চাওয়ার তীব্রতা এতটাই বেড়ে যায় যে একা বাবা কী করে এখানে থাকবেন মাথতেও আসেনি। ভেবেছিলেন বিশ্বস্ত দুজনের সঙ্গে আছেন, আর চিন্তা কিসের? মাসে দুই একবার বাবার সাথে দেখা করে আসলেই হবে। তাই করতেন।

প্রণয়ার দাদা নুহাশকে প্রতিবার ব্যাকুল চিত্তে বলতেন,
–“নাতি-নাতনি গুলাকে নিয়ে এখানেই থেকে যা নুহাস। একা একা ভালো লাগে না।”
এখন সেই মানুষটা আর নেই। তবে থেকে গেছে এক বুক আফসোস এবং অনুতপ্ত বোধ।

বিকালে প্রণয়া ঝুল বারান্দায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে রইলো। মাথার নিচে এক হাত দিয়ে পলকহীন চোখে ভাসা ভাসা মেঘের আকাশ দেখতে লাগল। এদিকে নেটওয়ার্ক তেমন নেই বললেই চলে, যার ফলস্বরূপ প্রণয়ার সেরকম মোবাইলের প্রতি আসক্তি নেই। নুহাশ সাহেব চার মাস আগে একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছিল মেয়েকে। কিন্তু সেটা বেশিরভাগ সময়ে অবহেলাতেই পড়ে থাকে। প্রণয়ার সময়গুলো এভাবেই শুয়ে বসে একাকী কাটে। হয় ঝুল বারান্দায়, নয়তো উঠান ঘুরে। বিকাল সময়টা একটু বেশি-ই অবসর কাটে। এই সময়ে বাড়িতেও তেমন কাজ-টাজ থাকে না।

পরেরদিন সকাল এগারোটার মাঝেই বড়ো মামা প্লাবনকে নিয়ে এলেন। প্রণয়া সেদিন কলেজ যায়নি। বাড়ি থেকে কলেজ যেহেতু দূরের পথ এজন্য কলেজে খুব কম যাওয়া – আসা করে সে। সপ্তাহে দুই বা তিন দিন যায়।

প্লাবন তো ফিরেই গল্প জুড়ে বসল। সেখানে গিয়ে কী করেছে, কী খেয়েছে, কোথায় ঘুরেছে ইত্যাদি। প্রণয়া এক্ষেত্রে নীরব স্রোতার ভূমিকা পালন করল। সন্ধ্যার পরপর নুহাশ সাহেব ফিরলেন। ফিরেই জানালেন,
–“নতুন ম্যানেজারের খোঁজ পেয়ে গেছি!”

নতুন ম্যানেজার হিসাবে কাকে নির্বাচন করল, তার পরিচয় কী এসব সম্পর্কে বিশেষ কিছু বললেন না নুহাশ সাহেব। তবে নুহাশ সাহেবকে বেশ নির্ভার এবং শান্ত লাগছিল। মোটকথা, নুহাশ সাহেবের কপালে যেই চিন্তার ভাজ পড়েছিল সেই ভাজটা আজ দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক হলেও প্রণয়া আগ্রহ দেখালো না।
.
ঠিক দুই দিন পর খুব সকালে নুহাশ সাহেব বললেন তাদের খালি দুটি ঘর পরিষ্কার করে দিতে। খালি দুই ঘর পেছনের দিকে ছিল। এমনিতে দোতলা মিলিয়ে মোট পাঁচটা ঘর প্রণয়াদের। চাইলে বাড়িয়ে আরও দুই তিনটা ঘর তোলা সম্ভব উত্তর দিকটায়।

নুহাশ সাহেবের হঠাৎ ঘর পরিষ্কার করার কথায় ফাহিমা অবাক হয়। তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করল,
–“দুটো ঘর হঠাৎ খালি করতে বললেন যে? কে আসবে?”

–“বাড়ির সদস্য-ই আসবে। আমি দুজন কাজের লোক পাঠাব। ওরাও তোমাদের সাহায্য করে যাবে।”

বলেই নুহাশ সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সময় মতো দুজন মহিলাও আসে সাহায্য করতে। প্রণয়া বাবার কথায় বেশ অবাক হয়েছে। বাবাকে প্রশ্ন করল না মা করেছে ভেবে। তবে নুহাশ সাহেব তো বিশেষ কিছুই বললেন না। কে আসবে বাড়িতে?

দুপুরের মধ্যে ঘর পরিষ্কার হয়ে যায়। এক ঘরে পুরাতন একটা খাট আছে। সেই পুরাতন খাটে ফাহিমা নতুন চাদর বিছিয়ে দেয়। নুহাশ সাহেব যেহেতু ঘর পরিষ্কার করতে বলেছেন সেহেতু মেহমান কেউ আসবেনই। আরেক রুম প্রায় ফাঁকা। একটা তোষক আর একটা ল্যাপ ছাড়া তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই।

তবে বিপত্তি ঘটল প্রণয়ার বেলায়। সে হঠাৎ-ই জ্বর এবং মাথা ব্যথায় কাবু হয়ে গেল। তাইতো বিকাল থেকে বিছানাতেই পড়ে রইল। সন্ধ্যার পরপর নিস্তব্ধ বাড়িটায় হঠাৎ নতুন মানুষের গলা শোনা গেল। প্রণয়ার ঘরটা দোতলায় হওয়ায় সেরকম স্পষ্ট কিছু শুনল না। শুধু নুহাশ সাহেবের গলাই শোনা গেল। তবে কী বাবার অতিথি চলে এসেছে? সে রাতে বাবার অতিথিদের আর নিজ চোখে দেখা হলো না প্রণয়ার। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল খুব দ্রুতই।

পরেরদিন সকাল আটটা বাজে প্রণয়ার ঘুম ভেঙে যায়। ফরজের নামাজ মিস হয়ে যাওয়ায় প্রণয়া কিছুটা আহত হলো। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে অনুভব করল সারা গা জুড়ে নিদারুণ ব্যথা। তবুও প্রণয়া নিচে গিয়ে হাত মুখ ধুঁয়ে নেয়। বাড়িতে নুহাশ সাহেব নেই। প্রণয়ার একবার পেছন দিকে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল যে কে এসেছে? কোনো পুরুষ মানুষ থাকতে পারে এই শঙ্কায় এলোমেলো প্রণয়া আর সেদিকে আগায় না। সে বাড়ির ভেতরে মায়ের কাছে চলে যায়। ফাহিমা মেয়েকে দেখে বলল,
–“জ্বর কমেছে? দেখি আয় তো কাছে, কপাল ছুঁয়ে দেখি।”

ফাহিমা প্রণয়ার কপালে হাত দিয়ে বুঝল জ্বর নেই তেমন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। প্রণয়া বলল,
–“গতকাল সন্ধ্যায় কে আসল আম্মা?”

মুহূর্তেই ফাহিমার অধরে হাসি খেলে যায়। হাসি বজায় রেখে বলল,
–“নীলু আপা আসছে। নির্মলও আসছে। নির্মল এখন তোর বাবার নতুন ম্যানেজার।”

নামগুলো প্রণয়া প্রথম শুনেছে। অথচ ফাহিমা এমন ভাবে বলল যেন প্রণয়ার কতদিনের চেনা-জানা তারা। প্রণয়া ভ্রু কুচকে বলল,
–“ওনারা কারা আম্মা?”

ফাহিমা বোধ হয় ভুল বুঝতে পারে। জিভে কামড় দিয়ে বলল,
–“ওহ! তুই তো ওদের চিনিস না। নীলুফা আমার গ্রামের মানুষ। আত্নীয়তার সম্পর্ক আমাদের মাঝে না থাকলেও আত্মিক সম্পর্ক আছে। ওরাই আসছে সুনামগঞ্জ থেকে। সেই ছোট্ট নির্মল এখন যে কত বড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও একটা দুঃসংবাদ, নির্মলের বাবা আর নেই।”

শেষ কথাটা বেশ দুঃখী স্বরেই বলল ফাহিমা। প্রণয়া আর কিছুই বলল না। চুপচাপ শুনে গেছে। ফাহিমা দুপুরের খাবারটা প্রণয়ার হাত দিয়েই পাঠাল নির্মলদের ঘরে। প্রণয়া এই কাজে বেশ বিরক্ত হয়েছিল। তবে সে ঘরে গিয়ে দেখতে পেল জীর্ণশীর্ণ এক ভদ্রমহিলা সবে যোহরের নামাজ পড়ে জায়নামাজ ছেড়ে উঠছেন। উনি-ই বুঝি নীলুফা আন্টি?

নীলুফা বাহিরের দিকে নজর যেতেই প্রণয়াকে দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে শুকনো মুখে ফুটে ওঠে তার সুন্দর হাসি। তিনি ব্যস্ত গলায় বললেন,
–“তুমি বুঝি প্রণয়া? আসো আসো ভেতরে আসো!”

প্রণয়া কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সালাম দিল নীলুফাকে। নীলুফা সালামের উত্তর দিয়ে প্রণয়াকে ভেতরে এনে বসিয়ে দিলেন। প্রণয়া ঢেকে রাখা বাটির খাবার নীলুফার দিকে বাড়িয়ে বলল,
–“মা পাঠিয়েছে!”

নীলুফা হাসি-মুখেই সে খাবার নিলেন। সঙ্গে বললেন,
–“এসবের কী প্রয়োজন ছিল?”
প্রণয়া কিছু বলল না। জোরপূর্বক শুধু হাসল। আলাপ-আলোচনায় প্রণয়া অপটু। তাই বেশিক্ষণ বসল না। কাজের ছুতোয় চলে আসল বাড়ি। বাড়ি এসে দেখল নুহাশ সাহেব এসেছেন। নুহাশ সাহেব মেয়েকে সামনে পেয়ে নির্মলের নামে প্রশংসার ঝুলি নিয়ে বসলেন। নির্মল নাকি প্রথম দিনেই বেশিরভাগ হিসাব ধরে ফেলে। কোথায় কী ত্রুটি আছে সেটাও মিলিয়েছে মোটামুটি। প্রথমদিন-ই নির্মলের কাজের প্রতি এত স্পৃহা দেখে নুহাশ সাহেব ভীষণ সন্তুষ্ট। শুধু অসহায় প্রণয়া সেসব নীরবে গিলে নিল।

প্লাবন স্কুল থেকে ফিরে খেলতে গিয়েছিল। খেলা থেকে ফিরে সেও গলায় উচ্ছাস ঢেলে বলল,
–“নির্মল ভাইয়া কত ভালো জানো আপু! আমাকে বাসায় পৌঁছেও দিল আবার দেখো চিপসও কিনে দিল। নির্মল ভাইয়াকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে!”

প্রণয়া এই পর্যায়ে এসে বিরক্ত হলো। একটা মানুষ এসেছে সবে। তাকে যাচাই-বাছাই না করেই তাকে নিয়ে এত লাফালাফির কারণ বুঝল না সে। প্লাবনের এত এত প্রশংসা শুনে ভাবল, নির্মল নামের লোকটা তো এত আহামরি কেউ নয়। তবে সবাই কেন সেই নির্দিষ্ট মানুষটার প্রশংসায় ব্যস্ত? কী এমন পানি পড়া খাইয়েছে এই লোক? কে এই নির্মল? প্রণয়া তাকে নিজ চোখে দেখতে চায়!

চলবে~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে