প্রাণেশ্বরী পর্ব-৪০

0
715

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৪০

নাফিসা ও ফারিনাজ শপিং করে ফিরলো বিকেলের দিকে। সন্ধ্যা গড়াতে ব্যস্ততা পাশে ঠেলে আরশাদও চলে আসলেন। এখানে সকলে রাত আটটার মাঝে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে ফেলে বিধায় সকলে ঠিক আটটার দিকে একত্রিত হলো ডায়নিংরুমে। ডিনার শেষে খালি সময়টুকু সবাই ড্রয়িংরুমে বসে কাটালো। এর মাঝে নাফিসাও সকলের জন্য আনা গিফট বুঝিয়ে দিলেন। প্রাণের জন্য বেশ কয়েকটা জিনিসই কিনেছিলেন তিনি। প্রাণ এ বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে আসার পর পরিস্থিতির কারণে তিনি তাকে সেভাবে বরণ করে নিতে পারেননি বলে সুযোগ পেয়ে ইচ্ছেমতো শপিং করেছেন। প্রায় চারটে ব্যাগই প্রাণের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। প্রাণের সংশয়িত চাহনি ব্যাগগুলোর দিকে, সে খুঁজে পাচ্ছে না কি বলবে নাফিসাকে। নাফিসা প্রতি পদক্ষেপেই একজন মায়ের ন্যায় আচরণ করে এসেছেন তার প্রতি। এই আড়াই মাসে তিনি কখনো প্রাণকে অনুভব করতে দেননি সে এই বাড়ির কেউ না বা তার মেয়ের মতো না। সবসময় ফারিনাজ ও তাকে এক চোখেই দেখেছেন। আগলে রেখেছেন। এসবের বিনিময়ে প্রাণ কখনো কৃতজ্ঞ চাহনিতে তাকায়নি, তাকিয়েছে বরং শ্রদ্ধান্বিত দৃষ্টিতে। আজও এর বিপরীত নয়।
নাফিসা ছন্দের জন্যও অনেককিছু এনেছিলেন। যদিও তিনি দেওয়ার সময় ভেবেছিলেন ছন্দ তার থেকে কিছু নিবে না, তাই তটস্থ ছিলেন। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে ছন্দ হাসিমুখে উপহারগুলো নিল। ধন্যবাদও জানালো। তা দেখে ক্ষণে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো কোমল হাসি, নয়নযুগল হলো সিক্ত৷ আশার আলো ধপধপ করে জ্বলে উঠলো মনের আঙ্গিনায়।অবশেষে ছেলের অভিমানের বরফ বুঝি গলতে শুরু করেছে? দূরত্ব সব ঘুচে আসছে? আরশাদও বিষয়টা খেয়াল করে প্রশান্তি অনুভব করলেন।

রাত দশটা বাজতেই যে যার মত উঠে চলে যায় রুমে৷ তবে জিসানের কল আসায় ছন্দ চলে যায় ড্রয়িংরুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় কথা বলতে। কথা শেষে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো কতক্ষণ। অতঃপর বাবা-মায়ের রুমের সামনে দিয়ে আসতে নিলে নাফিসার কথা শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালো সে। দরজা সামান্য ফাঁক করে রাখা ছিল যার দরুণ স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছিল সব। নাফিসা বলছেন, “ফায়াজকে কেন দিবে না তুমি? এত কষ্ট করে আনলে।”

আরশাদ বিষণ্ণ কন্ঠে বললেন, “তুমি তো জানোই ফায়াজের আমার উপর কতটা রাগ,অভিমান। এতদিন ধরে এসেছে তবুও একসাথে বসে ভালোমতো কথা বলা হয়নি। আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।”

নাফিসা বিবশ কন্ঠে বললেন, “রেগে কি শুধু তোমার উপর না-কি? আমার উপরও তো। কিন্তু তাও আমার আনা জিনিসগুলো নিয়েছে ও। তাহলে তোমারটা কেন নিবে না?”

“তোমার প্রতি ওর রাগ বরাবরই কম। কারণ মা তুমি ওর। প্রিয় মানুষ। তাই তোমার থেকে উপহারগুলো নিয়েছে। কিন্তু আমি! ভালো বাবা পর্যন্ত হয়ে উঠতে পারিনি কখনো ওর চোখে। আমার দেওয়া কোন কিছুই নিবে না, দেখো।”

নাফিসা বুঝানোর চেষ্টা করলেন, “দিয়েই দেখো না। প্রতি বছর ওর জন্য কিছু না কিছু কিনো তুমি অথচ সাহস করে কখনো পাঠাও না। চেষ্টাও কর না ওর রাগ ভাঙ্গানোর। এভাবে আর কতদিন?”

আরশাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “দোষটা তো ওর ও না। আমিই বেশি কঠোর হয়ে গিয়েছিলাম ওর প্রতি। সবরকম বাঁধা দিয়েছিলাম ওকে, স্বপ্নের পিছে দৌড়াতে। মা*রধ*র কি কম করেছি না-কি? দূরত্ব কিন্তু আর একদিনে আসেনি।”

“তখন তুমি তোমার জায়গায় ঠিকই ছিলে। সব বাবা-মা চায় তার সন্তান পড়ালেখা করে জীবনে উন্নতি করুক। তাই তারা শাসন করে সন্তানদের। তুমিও ব্যতিক্রম ছিলে না।”

আরশাদ পাশে তাকিয়ে বললেন, “এখন লাগছে ব্যতিক্রম হওয়ার দরকার ছিল। ক্রিকেটের প্রতি ওর নেশা প্রখর ছিল জেনেও ওকে আমি কখনো সাপোর্ট করিনি। উলটা জোর করে গিয়েছি খেলা ছেড়ে ফারহাজের মত পড়ালেখায় ভালো করার জন্য। কখনো বুঝার চেষ্টা করিনি। এমনকি ওর প্রতি রাগ আমার এতই ছিল যে, জাতীয় দলে ঢোকার পর ওর প্রথম খেলা পর্যন্ত দেখতে যায়নি।”

কথাটা শুনে নাফিসা দ্বিরুক্তি করলেন না। দোষ তো তারও কম ছিল না। দুইজনই ছন্দের প্রতি এতটা কঠোর ছিলেন যে অভিমানের দেয়াল কবে গিয়েছে তাদের মাঝে বুঝতেই পারেনি। আরশাদ বললেন, “আমি আমার দুই সন্তানের বন্ধু হয়ে সাপোর্ট করেছি অথচ আরেক সন্তানকে অবহেলা। ফারহাজ আর ফারিনাজের বেলায় যতটা নরম ছিলাম ঠিক ততটাই কঠিন ছিলাম ফায়াজের প্রতি। তখন ওকে আগলে নিতে পারিনি, পারলে হয়তো আজ আমাদের সম্পর্কটা ঠিক থাকতো।”

ছন্দ সবটা শুনে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু। গলা তার ধরে আসছে। এত বছর ধরে বাবা-মায়ের প্রতি তার যতটা না মান-অভিমান ছিল তার চেয়েও বেশি এখন আফসোস হচ্ছে কেন সে বাবা-মাকে বোঝার চেষ্টা করেনি কখনো। সে শুধু নিজের কষ্টটাই বড় করে দেখলো অথচ তারাও যে কষ্ট পেয়ে আসছে তা কখনো দেখার চেষ্টা করলো না। ফারহাজও কতবার বুঝিয়েছে তাকে কিন্তু সে একটা কথাও শুনেনি। আর শুনবেই বা কি? ছোটবেলা থেকে তাকে নিজের বড় ভাইয়ের সাথে তুলনা করা হতো। পড়ালেখা থেকে শুরু করে সবকিছুতে। যা তাকে ভে*ঙ্গে*চু*রে দিতে থাকে। সে সাথে একসময় ভাইয়ের প্রতি তার চলে আসে প্রতিহিংসা। যদিও সেটা সময়ের সাথে চলে যায় কিন্তু ক্ষোভ থেকে যায় বাবা-মায়ের প্রতি। দূরে সরে যায় সে। তবে আজ বাবা-মায়ের কথা শুনে বক্ষঃস্থল কেঁপে উঠে তার।
সে কোন ক্রমেই সাহস করতে পারলো না নাফিসা-আরশাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো। লাগছে, তার যোগ্যতাই নেই তাদের সম্মুখে যাওয়ার। যৎসামান্য সময় ইতস্তত করার পর নিজেকে শান্ত করলো সে। শব্দহীন পায়ে এগিয়ে গেল, আলতো করে দরজা ধাক্কা দিয়ে আলতো স্বরে ডাকলো, “মা!”

নাফিসা ভড়কে গেলেন কিছুটা, “এ সময় তুই এখানে? কিছু কি লাগবে বাবা?”

ছন্দ আধভাঙ্গা কন্ঠে বলল, “যাওয়ার পথে শুনলাম তোমরা দুইজন মিলে আমার গিফট হাতানার প্ল্যান করছো। এটা কিন্তু ঠিক না। আমার গিফট আমায় দাও বলছি।”

ছন্দের কথা শুনে নাফিসা এবং আরশাদ দুইজনই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। গোলগোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন শুধু। ছন্দ পুনরায় বলে উঠলো, “কি হলো দাও?”

আরশাদ কি যেন মনে করে তার পাশে রাখা ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন, ছন্দ নিল সে-টা। খুলে দেখলো তার পছন্দের ‘গুন এন্ড মোরি’ ব্র‍্যান্ডের একটি ব্যাট। সাথে কাগজে মুড়িয়ে রাখা জার্সি। ছন্দ বলল, “এত সুন্দর গিফট আমার থেকে লুকিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র করছিলে, নট ফেয়ার।”

আরশাদের আঁখিপল্লব ঝলঝল করে উঠলো যেন। কম্পিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তোর পছন্দ হয়েছে?”

ছন্দ মাথা নাড়িয়ে স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলল, “অনেক!”

আরশাদ বললেন না কিছু না। তৃপ্ত, নিবৃত্ত নয়নে তাকিয়ে থাকলেন শুধু। প্রফুল্ল মন লুকিয়ে গেলেন। ছন্দও বলল না কিছু। নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো একই স্থানে। অতঃপর ম্রিয়মাণ কন্ঠে বলে উঠলো, “সরি বাবা-মা!”

ককন্ঠস্বর কাঁপলো কিছুটা। নাফিসা বিস্ময়ান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন?”

ছন্দ মাথা নত রেখেই বলল, “তোমাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

নাফিসা ও আরশাদের বুঝতে আর বাকি রইলো না ছন্দ তাদের দুইজনের কথা সব শুনে নিয়েছে। তারা চেষ্টা করলেন বুঝানোর, এতে তার দোষ ছিল না। তার ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ছন্দ শুনলো না। চেয়ে গেল ক্ষমা। নাফিসা,আরশাদও সকল কিছু মিটমাট করে নিলেন। ভুল বুঝাবুঝি সব দূর হওয়ার পর অবশেষে সকল মান-অভিমানের সমাপ্তি ঘটলো।

___________

আজ রাতেই নিউ ইয়ার ইভ। লন্ডন নগরী চাতক পাখির ন্যায় রাত বারোটার অধীর অপেক্ষায়। চারদিকে উৎসব মুখর পরিবেশ। ঝলমলে শহর আজ একটু বেশি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। প্রতিবছরের মত এবারও এগারোটা বাজতেই বাসার সকলেই বেরিয়ে যায় লন্ডন টাওয়ার ব্রিজের উদ্দেশ্য। তবে যায়নি শুধু প্রাণ ও ছন্দ৷ প্রাণের কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ পছন্দ নয় বলে ছন্দ তাকে জোর করেনি বাহিরে যাওয়ার জন্য। নাফিসা যদিও থাকতে চেয়েছিলেন সাথে কিন্তু ছন্দ বুঝিয়ে আরশাদ ও ফারিনাজের সাথে তাকে পাঠিয়ে দেয়।
ঘড়িতে তখন এগারোটা বায়ান্ন বাজে। প্রাণ আগেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়। গায়ে মোটা উলের সোয়েটার, উপর ল্যাদারের জ্যাকেট জড়ানো। আনমনে তাকিয়ে আছে লন্ডন আই-এর পাণে। দুর্দম হাওয়া চুল উড়ছে অবিন্যস্ত। ছন্দ নৈঃশব্দ্য পায়ে এগিয়ে আসলো। প্রাণের পিছনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলো তাকে জড়িয়ে ধরবে কি-না? প্রাণ যদি কিছু মনে করে? অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর মাথায় আস্তে করে গাট্টা মেরে আনমনে নিজেকে নিজেই শাঁসালো, “প্রাণ কোন পাশে বাসার ভাবি না যে তাকে জড়িয়ে ধরতে চৌদ্দ ভাবতে হবে তোর। নিজেরই বউ। জড়িয়ে ধরতেই যদি এত লজ্জা পাস তাহলে তোর আর এই জন্মে বাচ্চার বাপ হওয়া লাগবে না।”

নিজেকে এসব বুঝ দিয়ে ছন্দ লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর এক-দুই পা এগিয়ে প্রাণের একদম সন্নিকটে চলে আসলো। বলিষ্ঠ হাত দুটো তার নেমে এলো কোমরের দুইপাশে। গলদেশে থুতনি রাখতেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো প্রাণ। ছন্দের উপস্থিতি অনুভব করেছিল ঠিক কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না বিধায় স্থির ছিল। আকস্মিক ছন্দের স্পর্শে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও বলল না কিছু। ছন্দ প্রাণকে জ্বালানোর জন্য ইচ্ছে করে গ্রীবায় নিজের গাল ঘেঁষে দিল আলতো করে। ক্লিন সেভ করে থাকায় খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো বিঁ*ধ*লো নিবিড়ভাবে। প্রাণ অস্ফুটস্বরে শব্দ করে উঠলো। ছন্দ প্রশস্ত হাসলো, গালে আবির্ভাব হলো ছোট দুইটি নিখুঁত গর্তের। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, “আপনি অনেক নাজুক প্রাণ।”

কথাটা বলতে দেরি তবে প্রাণের গাল দুটোয় লাজের আ*ক্র*ম*ণ করতে নয়। শীতের ফ্যাকাশে হয়ে আসা ত্বক আর*ক্ত দেখালো, সামান্য টোকা দিলেই বুঝি র*ক্ত ঝরে পড়বে। চিত্তে অনুভূতির উথাল-পাতাল ঢেউ আঁচড়ে পড়লো। যদিও সে নিজের অভিব্যক্তি সহসা প্রকাশ করে না তবে সে মানতে বাধ্য ছন্দের উপস্থিতি তার শান্ত, গোছানো মনকে অশান্ত,অগোছালো করে ফেলে। ভালো লাগার মূর্ছনা ভাসে আশে-পাশে। যেমন এখন হচ্ছে।
এদিকে কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ঘড়ির কাটা টিকটক টিকটক শব্দ তুলে পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত ঘরে। বারোটা বাজলো। সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট আলোকরশ্মি ছেঁয়ে গেল, তীব্র আলোড়ন তুললো ধূসর আকাশ জুড়ে৷ এর সাথে লন্ডনের আই এর সৌন্দর্য মিশে রূপান্তরিত হলো অপরূপ,নৈসর্গিক এক দৃশ্যে। আশপাশ থেকে ভেসে এলো জনমানবের উল্লাস ধ্বনি। প্রাণ তাকিয়েছিল সেদিকেই। ছন্দ একপলক তাকিয়ে প্রাণের কোমল,পাতলা চামড়ার ভাঁজে আলতো করে নাক ঘেঁষে দিল। গাঢ়,শীতল কন্ঠে বলল, “হ্যাপি নিউ ইয়ার প্রাণপাখি৷”

প্রাণ থমকালো। পলক ফেললো কয়েকবার। কণ্ঠলগ্নে মৌনতারা পথরোধ করে থাকায় অস্পষ্টস্বরে বলল, “হু!”

ছন্দ প্রাণের মাঝে ডুবে থেকেই বলল, “আই ওয়ান্ট ইয়্যু এভ্রি মোমেন্ট অফ মাই লাইফ মিস. ল্যাভেন্ডার। উপস মিসেস!”

দীর্ঘকাল পর ছন্দের মুখে সেই অতি পরিচিত ডাক শুনে অজানা শিহরণে বেষ্টিত হলো সে। ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো আপনা-আপনি। জড়তা কাটিয়ে বলে জিজ্ঞেস করে উঠলো সে, “আপনি আমায় ল্যাভেন্ডার কেন ডাকুন বলুন তো? কোন বিশেষ কারণ?”

ছন্দ আকন্ঠ মুগ্ধতায় ডুবে বলল, “আছে তো কারণ।”

প্রাণের কৌতূহলী কন্ঠ, “কি?”

ছন্দ বিভোর, বিবশ কন্ঠে বলল, “ল্যাভেন্ডার নীলের শান্ত স্থিতিশীলতা এবং লালের উগ্র শক্তিকে একত্রিত করে। ল্যাভেন্ডার হচ্ছে বিশুদ্ধতা, স্বাধীনতা এবং প্রেম প্রতীক। রাজস্ব, প্রশমন, রহস্যঘন, নীরবতা এবং প্রজ্ঞার আভ্যাস প্রতীক।”

প্রাণ প্রবল আগ্রহ শুনছে দেখে ছন্দ একটু থেমে পুনরায় বলল, “আপনার সাথে আমার যখন প্রথম সাক্ষাৎ আপনি তখন ল্যাভেন্ডার কালারের একটা গাউন পড়ে ছিলেন। যা কি-না আমার নজর কাড়ে। আপনার রহস্যে ঘেরা কথাবার্তা, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা দেখে মনে জাগে কৌতূহলোদ্দীপক। অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতেও আপনার বক্র,শানিত কন্ঠ, নিষ্প্রভ দৃষ্টি, ঠোঁটের কোণে ম্লানতা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এক সময়ের বিষাদসিন্ধুর বন্দী রাজকন্যা ফিনিক্সের মতন পুড়ে হয়ে উঠেছে নিজের প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের রাণী।। যে ভিতরে ভঙ্গুর কিন্তু বাহিরে পাথর। কোনক্রমেই হার মানতে রাজি নয় সে। তাই লাগলো নামটা আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে বেশ যায়, তাই ডাকা।”

প্রাণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। প্রথম দেখায় ছন্দ তাকে এত গভীরভাবে খেয়াল করেছিল? অথচ তার মতো বিচক্ষণ প্রকৃতির মেয়ে তা একটিবারের জন্যও উপলব্ধি করতে পারলো না? প্রাণ স্তিমিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো, “আর প্রেমে কেন পড়েছিলেন আমার? কি দেখে?”

ছন্দ মাথা তুললো। কোমল কন্ঠ তার, “প্রেমে তো পড়িনি আপনার। কৌতূহলে পড়েছিলাম। রহস্যে ঘেরা আপনাকে জানার প্রবল আগ্রহ জন্মেছিল মনে। এরপর আপনাকে নিয়ে ভাবনায় মশগুল থাকতে থাকতে কবে না কখন যে আপনার মাঝে ডুব দিয়ে ফেলি জানা নেই। প্রেম বিহীন ভালোবেসে ফেলি আপনাকে।”

“এই জন্যই বুঝি আমার ব্রেকাপের কথা শুনে খুশি হয়েছিলেন?”

ছন্দ ইতস্তত করে বলল, “পথের কাটা সরে গেলে প্রসন্ন কে না হয়?”

কথাটা শুনে প্রাণের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দেখা দিল।প্রেমিক পুরুষটা কোন কথাই চেপে যেতে পারে না। মনে যা থাকে ঠোঁটেও তাই। ছন্দ আবারও বলে উঠলো, “সাধ্যের বাহিরে গিয়ে আপনাকে চেয়েছিলাম অন্যের জেনেও। বিরহে পু*ড়*ছিলাম। লাগছিল, বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখছি। অথচ আজ! চাঁদ আমার বাহুবন্ধনে।”

প্রাণ প্রত্যুত্তরে বলল, “চাঁদ যদি কখনো হারিয়ে যায়?”

ছন্দ প্রাণকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, “যেতে দিলে নাহয় যাবে।”

কথাটা বলে ছন্দ প্রাণকে এক হাতে আগলে অন্যহাতে পকেট হাতড়ে দুইটা ব্রেসলেট বের করলো। এটা সেদিন মার্কেট থেকে কিনেছিল সে৷ খুব সন্তর্পণে প্রাণের হাতে একটা ব্রেসলেট পড়িয়ে দিয়ে অন্যহাতে নিজেও পড়লো। প্রাণ আতশবাজির নরম আলোয় হাতের দিকে তাকালো। চিকন চেইন ও সুতোর কাজ করা ব্রেসলেটের নিচের দিক ঝুলছে ভাঙ্গা একটুকরো হৃদয়৷ ছন্দ নিজের ও প্রাণের হাত পাশাপাশি ধরতে আধভাঙ্গা হৃদয় দু’টি জোড়া লেগে পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করলো। তা দেখে ছন্দ বলল, “আমি আজীবন আপনার সাথে এভাবে চিপকে থাকবো। বুঝলেন?”

প্রাণের প্রত্যুত্তরে বলার মত কিছুই রইলো না। সে যেমন ছন্দকে অস্বীকার করতে পারে না, তেমনই নিজের অনুভূতিও স্বীকার করতে পারে না। বলার যে অনেককিছুই আছে কিন্তু তার অন্তর্মুখী স্বভাব যে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে৷ ছন্দ এবার একটু থেমে বলল, “প্রাণ!”

“হু!”

ছন্দের মোহাচ্ছন্ন কন্ঠ, “আমার প্রাণেশ্বরী হবেন? একান্ত আমার?”

“উত্তর যদি না হয়?”

“অপেক্ষা করবো। দিন,সপ্তাহ, মাস, বছর অথবা আজীবন।”

অকস্মাৎ প্রাণ স্বভাবের বিপরীত পথে চললো। উপেক্ষা সব পাশে রেখে ঘুরে দাঁড়ালো ছন্দ বরাবর। অনুরাগী কন্ঠে বলল, “আপনার অপেক্ষার প্রহরের ইতি এখানে।”

কথা বলে প্রাণ দুইজনের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে আনলো। ছন্দের পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গলার মাঝে হাত গলিয়ে অধরে অধর ছোঁয়ালো৷ ঘটনাক্রমে ছন্দ হতবিহ্বল। রাজ্যসম বিস্ময় দৃষ্টির আনাচ-কানাচ জুড়ে৷ অচল মস্তিষ্কে প্রাণের কর্মকাণ্ডে লুকায়িত উত্তর টনক নাড়তে ছন্দ প্রাণকে নিয়েই পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। পরক্ষণেই আগলে নেয় তাকে৷ ঠিক তখনই গভীর উষ্ণতায় আচ্ছাদিত দুইটি মনকে হিংসে করে আকাশ চিরে নামলো শীতল তুষারকণা৷ তুলোর ন্যায় জবুথবু কণাগুলো ছুঁয়ে দিল তাদের নির্বিকারে৷ ছন্দ সড়ে এলো কিছুটা। প্রাণের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “ধরা কিন্তু আপনি দিয়ে দিয়েছেন। এবার আর পালানোর কোন সুযোগ নেই।”

_____

প্রণয়প্রত্যুষের আবরণে নব্য বছর ও জীবনের সূচনা ঘটলো এক কপোত-কপোতীর। স্নিগ্ধ আলোর ছটার রমণীর স্বর্ণবর্ণা মুখে উপচে পড়ছে লাজ। আর রম! সে তো ব্যস্ত সেই সৌন্দর্যে আকন্ঠ ডুবে থাকতে। অনুভূতি প্রগাঢ় করতে। কাঙ্ক্ষিত সময়টি অনাকাঙ্ক্ষিতই লাগছে তার নিকট। মন বিশ্বাস করতে পারছে না প্রা*ণ*না*শী*নি নারীটি আজ সত্যিকার অর্থে তার প্রাণেশ্বরী। সময় হয়তো এভাবেই বদলায়।

গোসল শেষে প্রাণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছচ্ছিল। বিছানার উপর একহাতে ভর দিয়ে শুয়ে ছন্দ তার দিকেই তাকিয়ে দিক মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে। কিয়ৎক্ষণ পর প্রাণ তার দিকে ঘুরতেই গলদেশে উপস্থিত লালচে আভাটা নজর কাড়লো। আনমনে হাসলো সে। বলল, “বাহিরে যাওয়ার আগে গলা ঢেকে নিয়েন। নাহলে মানুষ উল্টাপাল্টা ভাববে।”

প্রাণ নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে তি*র্য*ক দৃষ্টিতে তাকালো৷ কপট রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “সাধু সাজা হচ্ছে এখন?”

ছন্দ উঠে বসলো। অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল, “আমি অসাধু হলাম কবে যে সাধু সাজতে যাব?”

প্রাণ পুনরায় ঘুরে উত্তর দিল, “সাধু ছিলেন কবে? শুরু থেকেই ধুরন্ধরবাজ।”

ছন্দ এবার উঠে প্রাণের কাছে গেল। পিছন থেকে তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সিক্ত চুলে নাক ঘেঁষে বলল, “তা আর কি কি আমি শুনি?”

প্রাণ বলতে যাচ্ছিল কিন্তু এর আগেই দরজায় ফারিনাজের ডাক পড়লো নাস্তার জন্য। ছন্দ বিরবির করে বলে উঠলো, “কাবাব ম্যায় হাড্ডি!”

অতঃপর প্রাণ ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে জানালো তারা একটু পর আসছে। ফারিনাজ যেতেই ছন্দ দরজা ভিড়িয়ে দিল। প্রাণ ততক্ষণে হেয়ার ড্রায়ার নিয়ে বসেছে চুল শুকাবে বলে। ছন্দ পুনরায় বিছানায় গিয়ে বসেতে প্রাণ জিজ্ঞেস করে উঠলো, “আমার মোবাইল দেখেছেন কোথাও? পাচ্ছি না আমি।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে