প্রাণেশ্বরী পর্ব-৩৮+৩৯

0
728

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৮

লন্ডনের বাতাসে শৈত্যপ্রবাহের আগামবার্তা বইছে। দিনের সূর্য হারিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। চারদিকে ঘােলাটে অন্ধকার। যতদূর দৃষ্টি কেবল সজল-কাজল মেঘের আনােগােনা। ফাঁকে ফাঁকে অলৌকিক আলোর ঝলকানি। শরৎ-এর শেষ বর্ষণ। আড়ম্বরহীন হলে কি চলে? প্রাণ ম্লান চোখে বারান্দায় সরু রেলিং-এ দুই হাত ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘে আচ্ছাদিত অন্তরিক্ষ দেখছে। দ*স্যু হাওয়ার আ*ক্র*ম*ণে খুলে গিয়েছে হাত-খোপাটা, শূণ্যে ভাসছে তার কালো রেশম চুলগুলো। প্রাণ মগ্ন নিজের ভাবনায়। তার জীবনের সকল ম*র্মা*ন্তি*ক গল্পগুলো ঘটেছে এই বাদল দিনেই। যখনই সে সব ভুলে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করেছে তখনই বর্ষণের ধারা এসে তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে তার আপনজনকে। তাই তো তার নিকট বর্ষণ মানে বি*ধ্বং*সী। প্রাণ বিরবির করলো। কন্ঠস্বর শান্ত অথচ দৃষ্টি ঘৃণায় পরিপূর্ণ, “আবার কেন এসেছ তুমি? মুক্তি কি দিবে না আমায়? থাকতে দিবে না ভালো?”

সময় অতিক্রান্ত হলো। বৃষ্টি এই নামলো বুঝি। ঠিক সেসময় ছন্দ এসে দাঁড়ালো প্রাণের পিছনে। স্মিথ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “বৃষ্টি নামবে এখন, ভিতরে আসেন।”

প্রাণ ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক পিছনে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। ছন্দ স্মিত হেসে প্রাণের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল, “যাবেন না?”

প্রাণ বলল, “ইচ্ছে করছে না।”

ছন্দ এতে বলল না কিছু৷ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর প্রাণ উদাসীন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠে, “বলতে পারেন, কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?”

ছন্দ পাশ ফিরে পূর্ণদৃষ্টি তাকালো, “সব ভুলে নতুন দমে নিজেকে গড়তে। নব্য এক সূচনা লিখতে।”

“এর জন্য কাউকে নিঃস্ব করা কি জরুরি?”

“কোন কিছু বিনাকারণে হয় না। হয়তো এর মাঝে মঙ্গল কিছু নিহত ছিল।”

প্রাণ ম্লান দৃষ্টিতে তাকালো, “বিষাদময় জীবনটাকে বি*ষা*ক্ত করাটা কি খুব মঙ্গল কিছু ছিল?”

ছন্দ প্রত্যুত্তর করার পূর্বেই প্রাণ পুনরায় শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “আমার প্রতি কেন সর্বদা প্রকৃতির নির্দয় আচরণ? যাকে ধরেই বাঁচতে চাই তাকেই ছিনিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে, কেন?”

প্রাণের কন্ঠ শান্ত,শীতল শুনালেও কথার পৃষ্ঠে লুকিয়ে ছিল অগাধ ক্লেশ। ছন্দ থমকালো কয়েক মূহুর্তের জন্য। আনমনে কথা গুছিয়ে বলল, “মানুষ মানেই নশ্বর, এটাই প্রকৃতির বিধান। যার শুরু আছে তার শেষও আছে৷ জন্ম আছে মানে মৃ*ত্যুও আছে। পৃথিবীর চরম সত্য এটা। তাই এর বিপরীতে অভিযোগ করা বোকামি। আর আপনি বোকা নন প্রাণ।”

প্রাণ এই কথার পিঠে বলার মত কিছু খুঁজে পেল না। ছন্দ তাই বলল, “জানেন বৃষ্টি কেন নামে? পৃথিবীকে শুদ্ধতম করতে। সজীবতায় রাঙ্গাতে। মন ভালো করতে ও সকলের গ্লানি,দুঃখ ধুয়ে মুছে নব্য প্রত্যুষ উপহার দিতে৷”

প্রাণ ছন্দের দিকে তাকাতেই দৃষ্টি এক হলো তাদের। প্রাণ দৃষ্টি অনড় রেখে বলল, “সবার জন্য বৃষ্টি এক হয় না। কারো কারো জন্যে সে আঁধারের সূচনাও লিখে।”

ছন্দ থেমে বলল, “ঝ*ল*সে যাওয়া শরীরও যোগায় মুগ্ধতার আলো, প্রত্যুষের আলোয় ফ্যাকাশে হয়েছে আঁধারের কলঙ্ক যত কালো।”

প্রাণ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। এই ফাঁকে মনস্তাপ নিয়ে নামলো ঝুম বৃষ্টি। পলকে সিক্ত হলো নগরী। ছন্দ সেদিক তাকিয়ে বলল, “জীবনে যতই আঁধার নামুক না কেনো দিনশেষে নতুন ভোরের আলোয় তা মিইয়েই যায়। ধরে রাখতে পারে না নিজের অস্তিত্ব। বৃষ্টিও ঠিক তেমনই। সে নিজের গুরুত্ব কখনো কমতে দেয় না, সুখ-দুঃখের মাঝেই নিজের জায়গায় করে নেয় মনে।”

প্রাণ মাথা নত করে নিশ্চুপ রইলো। ছন্দ প্রাণের বাহু হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আসুন আমার সাথে।”

কথাটা বলে ছন্দ প্রাণকে নিয়ে চলে এলো ছাদে। ভিতরে প্রবেশ করার আগে সে প্রাণকে বলল, “একবার বৃষ্টিকে বরণ করেই দেখুন না। তার প্রতি আর কোন অভিযোগ থাকবে না আপনার।”

প্রাণ দৃষ্টি তুললো, “দেখতে বলছেন?”

ছন্দ হেসে বলল, “ভিজতে বলছি। চলুন।”

ছন্দ প্রাণের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তীব্র বর্ষণের মাঝে৷ সিক্ততার চাদরে মুড়ানোর উদ্দেশ্যে। ছাদের এক কিনারে দাঁড়িয়ে প্রাণের হাত দুটো প্রসারিত করে ধরলো ছন্দ। মাথা নামিয়ে কানের সামনে এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “মনে যত কষ্ট,অভিযোগ আছে তা বলে ফেলুন। স্নিগ্ধ পরশে ধুয়ে মুছে যেতে দিন সকল গ্লানি। অতীতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে আসুন। বর্তমানকে উপভোগ করুন। প্লিজ প্রাণ। কথা শুনুন আমার।”

ছন্দের কথা আঁখিপল্লব দুটো বন্ধ হয়ে এলো প্রাণের। সে সত্যি সত্যি এবার নিজের দগ্ধ হৃদয়টা থেকে মুক্তি চাইলো। সব ফেলে এগিয়ে যেতে চাইলো। তবে মনের চোখে আপনজনদের মুখখানি ভাসতে দূর্বল হয়ে পড়লো সে। অশ্রুসিক্ত হলো নেত্রপল্লব। কন্ঠলগ্ন হতে অস্ফুটস্বর বেরিয়ে আসতেই ছন্দ তাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকে ঠাই দিল। প্রাণও সব ভুলে আকড়ে ধরলো ছন্দকে। অজান্তেই বানিয়ে ফেললো তাকে নিজের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। ছন্দ আলগোছে তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল। আদুরে কন্ঠে বলল, “হুসস! আর কাঁদবেন না। কষ্ট হয় আমার।”

প্রাণ তাও থামলো না। মিনিট দশেক লাগলো ছন্দের তাকে স্বাভাবিক করতে। প্রাণ স্থির হয়ে ছন্দের বাহুবন্ধনী থেকে সরে আসতে নিলে ছন্দ দিল না। কোমরের পাশে শক্ত করে ধরে রাখলো। বৃষ্টি ততক্ষণে কিছুটা কমে এসেছে। ঝিরিঝিরি শীতল কণা ছুঁয়ে দিচ্ছে তাদের। প্রাণ মুখ তুলে উপরে তাকালো। নয়ন দুটো আ*র*ক্ত হয়ে আছে, ফোঁপানোর ফলে অধর কাঁপছে। গৌড়বর্ণ মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ঠান্ডায় নাক টানছে সে বার বার। ছন্দের কি হলো কে জানে? সে একধ্যাণে তাকিয়ে রইলো প্রাণের আর্দ্র অধরের দিকে। অন্তঃকরণে আবদ্ধ সুপ্ত ইচ্ছেগুলো বেরিয়ে আসতে চাইলো, বাঁধা মানলো না কোন। হঠাৎ ছন্দের এমন অদ্ভুত,বেয়ারা দৃষ্টি দেখে প্রাণ কেঁপে উঠলো। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই ছন্দ মাথা নামিয়ে প্রাণের অধর দু’টো নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। ঘটনাক্রমে প্রাণ হতবিহ্বল। গোলগাল চোখে তাকিয়ে থাকলো সে। অতঃপর একসময় বন্ধ করে নিল দৃষ্টি। কিয়ৎক্ষণ পর ছন্দ সরে এসে প্রাণের কাঁধে থুতনি রেখে লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “প্রাণেশ্বরীর নেশা মদ্যপনেশা থেকেও বি*ষা*ক্ত। না পান করা যায়, না ফেলে দেওয়া যায়। গলায় আটকে থেকে পীড়া দেয় শুধু। এর নিরাময় কবে পাবো বলুন তো?”

প্রাণের বুক অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। ঠোঁট দুটো কামড়ে চুপটি করে আছে সে। অদ্ভুত ভালো লাগায় আবিষ্ট মন প্রত্যুত্তর করতে ভুলে গিয়েছে। সে চোখ বুজে ছন্দের পিছন দিকের শার্ট মুঠো করে ধরে রাখলো শুধু৷ মুখ লুকিয়ে রাখলো ব্যক্ত মানুষটার তীরে।

প্রতিক্ষেত্রে ভাষা মনকে সন্তুষ্ট করলেও মাঝে মধ্যে নীরবতা প্রশান্ত করে আত্মাকে। হয়তো এই উপলব্ধিটাই আজ ছন্দ করতে পারছে। তাই তো তার ঠোঁটের কোণে মাধুর্যপূর্ণ হাসিটা ঝুলছে।

_______

মধ্যাহ্নের প্রহর। খাওয়া-দাওয়া শেষে নাফিসার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে প্রাণ। নাফিসা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর টুকটাক গল্প করছেন। এই দু’মাসে দুইজন এতটা ঘুলে-মিশে গিয়েছে যে এখন তাদের সম্পর্ক মা-মেয়ের থেকে অভিন্ন করা যায় না। প্রাণও ধীরে সুস্থে এখানের সকলকে আপন মানতে শুরু করে নিয়েছে। নীরবতার খোলস থেকে বেরিয়ে প্রাণবন্ত হতে শুরু করেছে। আর এটাই তো চাচ্ছিল তারা। অবশেষে তাদের পরিশ্রম সফল হলো বুঝি?

মিনিট খানিক পর ফারিনাজ এলো রুমে। নাফিসার কোলে প্রাণকে শুয়ে থাকতে দেখে গাল ফুলিয়ে বলে উঠলো, “এটা কি ঠিক ভাবি? তুমি আমাকে ছাড়াই আম্মুর আদর সব লুফে নিচ্ছ। আমি কিন্তু আমার ভাগ চাই।”

ফারিনাজের কথা শুনে প্রাণ মৃদু হাসলো। মুখ খুলার আগেই নাফিসা হেসে বলে উঠলেন, “তো প্রাণ কি তোকে ধরে বেঁধে রেখেছে নাকি? এপাশে জায়গায় আছে দেখিস না? এসে পড়।”

নাফিসার বলতে দেরি কিন্তু মায়ের কোলে ফারিনাজের ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি নেই৷ সামান্য সময়ের ব্যবধানে আড্ডা জমে গেল তিনজনের মাঝে। আধাঘন্টার মত এভাবে থাকার পর ফারিনাজের মনে পড়লো সে এখানে প্রাণের খোঁজে এসেছিল। কথার তালে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। তাই চটজলদি উঠে সে প্রাণকে নিয়ে ছুটলো নিজের রুমে।
.
.
ঘন্টা দুই-এক ধরে প্রাণ ফারিনাজের রুমে বসে। সন্ধ্যায় না-কি ফারিনাজের কোন বান্ধবীর জন্মদিন। তবে সে মনমতো কোন কিছু খুঁজে পাচ্ছে পড়ে যাওয়ার মত। প্রাণের যেহেতু ফ্যাশন সেন্স অনেক ভালো তাই সে প্রাণকে বলেছে তাকে সাহায্য করতে। প্রাণও নাকচ করেনি। তখন থেকেই ফারিনাজের সাথে সে৷ সব মিলিয়ে-টিলিয়ে দিচ্ছে তাকে।
এদিকে কয়েকক্ষণ যাবৎ ছন্দ প্রাণের দেখা না পেয়ে খুঁজতে বের হলো তাকে৷ ফারিনাজের রুমের সামনে আসতে কথার শব্দ পেয়ে থমকালো। দরজা ভিড়িয়ে রাখা ছিল দেখে দুইবার নক করে নবটা ঘুরিয়ে ভিতরের দিকে উঁকি দিল সে৷ দৃষ্টি ঘুরাতেই দেখতে পেল ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ ফারিনাজকে মেকাপ করে দিচ্ছে। তার আগমনে তারা দুইজনই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ছন্দ সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ফট করে ঢুকে পড়লো রুমে। তা দেখে ফারিনাজ চেঁচিয়ে বলে উঠলো, “তুই এখানে কেন? দেখছিস না দু’টো মেয়ে আছে রুমে? যা ভাগ।”

ছন্দ মুখ বাঁকিয়ে বলল, “দু’টো মেয়ের মধ্যে একটা আমার বোন, আরেকটা আমার বউ। তো এখানে আসার শতভাগ অধিকার আছে আমার৷”

কথাটা বলে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। চারদিকে নজর বুলিয়ে বলল, “রুমটাকে বস্তি বানিয়ে রেখেছিস কেন? আমার বউকে দিয়ে খাটানোর ধান্দা নাকি?”

সেসময় জামা পছন্দ হচ্ছিল না বলে ফারিনাজ পুরো কাবার্ডের জামা নামিয়ে রুমের অবস্থা নাজেহাল করে ফেলেছিল। যা দেখেই ছন্দ মন্তব্যটা ছুঁড়ে। ফারিনাজ তেতে উঠে বলল, “আমাকে কি তোর ভ্যাম্প টাইপ ননদ লাগে? যে নিজের ভাবিকে খাটিয়ে মা*রে?”

ছন্দ ব্যঙ্গ করে বলল, “মুখ তো ভ্যাম্পায়ারের মতই। স্বভাব যে এক হবে না তার নিশ্চয়তা কি?”

ফারিনাজ কথায় না পেরে প্রাণকে বলল, “ভাবি কিছু বল না ভাইকে।”

প্রাণ চোখ তুলে তাকালো এবার। এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে দুইজনের ঝগড়াই দেখছিল সে। ফারিনাজের কথা রাখতে সে বলল, “আপনার কি কিছু লাগবে?”

ছন্দ মাথার পিছনে হাত গলিয়ে কোমল কন্ঠে বলল, “না! তেমন কিছু না।”

ছন্দের কন্ঠস্বরে হঠাৎ করে পরিবর্তন আসতে দেখে ফারিনাজ আড়চোখে তাকালো। ঠেস দিয়ে বলল, “বোনের বেলায় গলা উঁচু অথচ বউয়ের বেলায় নিচু? দেখেছ কারবার।”

ছন্দ চোখ পাকিয়ে বলল, “বেশি কথা বলিস তুই।”

ফারিনাজ ভেংচি কেটে বলল, “ভাবি যেতে বল তো ভাইকে। আমার দেরি হচ্ছে।”

ছন্দ ফোড়ন কা*টা*র আগেই প্রাণ ছন্দের চোখের দিকে তাকালো। দুইজন দৃষ্টি বিনিময় হতেই ছন্দ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিক যেতে যেতে বলল, “আচ্ছা যাচ্ছি৷”

ছন্দের যাওয়ার দিক তাকিয়ে ফারিনাজ হাসি চেপে বলে উঠলো, “বুঝলে ভাবি, বিয়ে করলে জুনিয়র কাউকেই করা উচিৎ। এরা প্রচন্ড বউপাগলা হয় আর বউয়ের কথা চুপচাপ শুনে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে না। প্রচন্ড আদুরে হয় ও খুব ভালোবাসতে জানে। আমি তো ঠিক করে ফেলেছি বিয়ে করলে নিজের জুনিয়রকেই করব।”

ছন্দ তৎক্ষনাৎ থেমে ফারিনাজের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ফারুর বাচ্চা।”

ফারিনাজ দ্রুত নিজের জায়গায় ছেড়ে উঠে ছন্দকে ঠেলে রুম থেকে বের করে বলল, “আমার বিয়ে হয়ে নিক তারপর ভাগনিকে ডেকো আমার বাচ্চা৷ এখন বিদায় হও তো।”

কথাটা বলেই ফারিনাজ ছন্দের মুখের দরজা লাগিয়ে দিল। ছন্দ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলে উঠলো, “জীবনের শিক্ষা, বউ সিনিয়র হলে ভুলেও তা কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। নাহলে জীবন হবে রসুনবাটা।”

#চলবে

#প্রাণেশ্বরী
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
#পর্ব-৩৯

রৌদ্রজ্বল মধ্যাহ্ন। গাড়ি চলছে হাইওয়ের ওপর। গন্তব্য নটিংহামে অবস্থিত রিকালভার টাওয়ার ও রোমান ফোর্ট৷ অনেকদিন ধরেই ছন্দ প্রাণকে নিয়ে সেখানে যেতে চাচ্ছিল কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে পারেনি। তবে আজ সুযোগ পেতেই তার সৎ ব্যবহার করতে কৃপণতা করলো না। আরশাদ বাসায় ছিলেন বিধায় ছন্দ অনুমতি নিয়ে তার গাড়ি নিয়ে বের হলো। গাড়ির চালানোর একফাঁকে ছন্দ প্রাণের দিকে তাকালো৷ ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে সিটে গা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। অবাধ্য চুলগুলো খেলা করছে তার রৌদ্রস্নাতা মুখে। চোখের পাতায় স্বর্ণবর্ণা আলোক রশ্মি ঠিকরে পড়ায় কপাল সামান্য কুঁচকে আছে তার। তাই ছন্দ হাত উঁচিয়ে গাড়ির সান ভিসোর নামিয়ে দিল। মুখের উপর ছাঁয়া পড়তেই বিরক্তি সব উবে গেল প্রাণের। বিড়ালছানার মতো শরীর গুটিয়ে শুয়ে থাকলো। ছন্দ মিহি হাসলো। মেয়েটাকে একদম ননির পুতুলের মতো, সামান্য আ*চ*র পড়লেই বুঝি টুপ মাটির সাথে মিশে যাবে। প্রীতিপূর্ণ নয়নজোড়া বহু কষ্টে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়ি চালানতে মন দিল। অন্যথায় আজ তার দ্বারা কোন অঘটন ঘটেই যাবে।

দুই ঘন্টার পথ পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছালো রিকালভার টাওয়ারে। প্রাণের ঘুমও ভেঙেছে ইতোমধ্যে। ছন্দ এক সাইডে গাড়ি পার্ক করে নামলো প্রথমে। অতঃপর ঘুরে এসে প্রাণের জন্য দরজা খুলে দিল৷ প্রাণ বেরিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে দেখতে থাকলো। বিস্তৃত আকাশের নিচে এক পাশে নীলাভ সমুদ্র, পাড়ে বৃহৎ বৃহৎ চতুর্ভুজ আকৃতির ধূসর পাথরের সমাহার৷ অন্যপাশে সবুজ দূর্বাঘাসের ওপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন কেল্লাটি। তীরের একদম কিনার ঘেঁষে। মাটি খোসলেই বুঝি সোজা অতল পানির গভীরে তলিয়ে যাবে। কেল্লাটির চারদিক জুড়ে রয়েছে ছোট ছোট ইট-পাথরের দেয়াল। উচ্চতায় হাটু সমান। প্রাণ যখন মোহনিয়া দৃষ্টিতে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত ছন্দ তখন ব্যস্ত প্রাণের ঠোঁটের কোণে স্বল্প হাসিটা দেখতে। মাতাল হাওয়া যেন বইছে তার অন্তঃকরণ জূড়ে। সে সন্নিকটে এসে প্রাণের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের আঙ্গুল গলিয়ে শক্ত করে ধরলো। এগিয়ে চলল উদ্দেশ্যহীন পথে। হাঁটতে হাঁটতে কেল্লার দিক চলে গেল তারা। চারদিক পরিদর্শন করে সূর্যাস্ত দেখার জন্য ছন্দ প্রাণকে নিয়ে বসলো সমুদ্রের পাড়ে নরম ঘাসের ওপর।

নীলাভ মেঘের মাঝে খেলা করছে লাল, হলুদ, কোমলার স্নিগ্ধ মিশ্রণ। কোথাও কোথাও আবার গোলাপি, বেগুনি রঙের দেখাও মিলছে৷ মধ্যের র*ক্তি*মা সূর্যটি অর্ধনিমীলিত সমুদ্রকান্তার কোলে। পাখিরা গুনগুন করতে করতে ছুটছে নীড়ে। বাহারি রঙে সজ্জিত অন্তরিক্ষটি আজ রূপকথার মায়াবী ক্যানভাসের ন্যায় ঠেকেছে।

প্রাণ তাকিয়ে আছে টলটলে জলের উপর রঙতুলি দিয়ে আঁকা আকাশটার পাণে। দৃষ্টি সরাতে পারছে না প্রকৃতির লীলাময়ী রূপটা থেকে৷ অথচ ছন্দ তাকিয়ে তার মাধুর্যপূর্ণ হাসিটার পাণে। প্রণয়িনীর সামান্যটুকু হাসিই যথেষ্ট তার হৃদয়ে উথাল-পাথাল ঢেউ সৃষ্টি করতে। শান্ত মনকে অশান্ত করতে। অথচ পাশে বসা রমণীটি এসব থেকে অবিদিত। নির্বাক। প্রকৃতির মোহ কাটিয়ে উঠতে প্রাণের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল তাকে কেউ গভীরভাবে লক্ষ্য করছে। সে তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরালো। ছন্দকে তার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিবশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?”

ছন্দ উত্তর দিল না। মোহাবিষ্ট নয়নে তাকিয়ে থাকলো শুধু। ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে প্রাণের এলোমেলো চুল কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে তার দিকে সামান্য ঝুঁকে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, “প্রাণপাখি! লেভিউ।”

উত্তপ্ত নিঃশ্বাস কর্ণকুহরে প্রবেশ করামাত্র সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো। প্রাণ কেঁপে উঠলো যেন। ছন্দ সড়ে আসার আগে তার শুষ্ক,অমসৃণ ঠোঁট দুটো আলতো করে ছোঁয়ালো প্রাণের কোমল গালে। দ্বিতীয়বারের একচমক কেঁপে উঠলো প্রাণ। হিম শিহরণ বয়ে গেল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সূর্যের আ*র*ক্ততা দেখা দিল তার মসৃণ গাল জুড়ে। লজ্জালু ভাব দেখা দিল নয়নের অক্ষিকাচে। নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে জুবুথুবু কন্ঠে বলল, “আ..পনি সূর্যাস্ত দেখুন।”

ছন্দ হেসে বলল, “আপনি লজ্জা পাচ্ছেন, প্রাণ?”

প্রাণ হকচকিয়ে উঠলো। নিমিষেই মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করে বলল, “নাহ তো।”

“তাহলে আপনার চোখ অন্য কথা কেন বলছে?”

প্রাণ স্তিমিত কন্ঠে উত্তর দিল, “এমন কিছুই না। আপনি বেশি বেশি বুঝচ্ছেন।”

ছন্দ অমায়িক হাসলো, “তাই নাকি?”

প্রাণ দ্রুত মাথা উপর-নিচ করে হ্যাঁ সূচক উত্তর জানালো। ছন্দ পুনরায় সান্নিধ্য বাড়িয়ে বলল, “নিজের অনুভূতি কবে বুঝবেন আপনি? ক’দিন আর লুকিয়ে-চুরিয়ে বেরাবেন? একদিন তো ধরা দিতে হবেই আমার তীরে, তখন কোথায় পালাবেন, শুনি?”

প্রাণ কন্ঠস্বর কয়েক ধাপ নামিয়ে বলল, “আপনি বড্ড বাজে এক লোক জানেন?”

ছন্দ মাথা পিছে আঙ্গুল বলল, “প্রেয়সীর অপবাদ নাকচ করার দুঃসাহস কিভাবে দেখাই বলুন তো?”

প্রাণ কথা পালটানো জন্য বলল, “টিয়া পাখিটাকে আপনি ইচ্ছে করে ওই কথা বলা শিখিয়েছিলেন, তাই না?”

ছন্দ দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার ভাণ করলো, “শিখিয়েছিলাম নাকি? মনে পড়ছে না তো।”

প্রাণ মিনমিনে কন্ঠে বলল, “বদ, ধুরন্ধর লোক একটা। এর চালাকিতে আমি ফেঁসে গেলাম কি করে?”

ছন্দ পুনরায় প্রাণের গালে অধর ছুঁয়ে বলল, “এভাবে!”

প্রাণের মুখশ্রী র*ক্তি*ম আভায় ঢাকা পড়তে সে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। তা দেখে ছন্দ প্রশস্ত হাসলো। পা*ষা*ণ হৃদয়ে আজ বুঝি অনুভূতি জোয়ার উঠেছে? নির্জীব,নিরলস,প্রাণহীন মন অনুরাগের প্রাণোচ্ছলতায় ভাটা পড়েছে?

______

ফিরতি পথে ছন্দ গাড়ি থামালো রাস্তার ধারে। ঘুরাঘুরির পর চরম খুঁদা পেয়েছিল তার। তবে নাথিংহামের আশেপাশে খাবার-দাবারের তেমন সুবিধা না থাকায় শহরে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা ছিল সে। গাড়ি ‘পেটিকোট লেন মার্কেট’-এর কোলাহলপূর্ণ রাস্তায় উঠতে ই ফুটপাতে স্ট্রিটফুডের সমাহার দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সে। আচমকা ব্রেক করায় প্রাণ ঈষৎ ভড়কে গেল, অভিভূত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “গাড়ি থামালেন যে?”

ছন্দ প্রত্যুত্তর দেওয়ার বদলে পালটা প্রশ্ন করে বসলো, “কখনো স্ট্রিটফুড ট্রায় করেছেন?”

প্রাণ ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলল, “না।”

ছন্দ দুর্দম হেসে বলল, “তাহলে আজ ট্রায় করবেন, চলুন!”

কথাটা বলে ছন্দ বেরিয়ে পড়লো এবং প্রাণকেও একপ্রকার টেনে বের করলো। আশেপাশের ঝিকিমিকি আলো স্ফু*লি*ঙ্গের ন্যায় দেখাচ্ছে৷ মানুষের যেন উপচে পড়ছে ছোট ছোট ফুড স্টলগুলায়৷ ছন্দের বরাবরই মিষ্টি প্রিয়। তাই ওয়াফেলসের দোকান চোখে পড়তেই প্রাণকে নিয়ে গেল সেখানে। প্রাণ বাংলাদেশ থাকাকালীনও কখনো স্ট্রিটফুড খাইনি। ছোটকালে হুমায়রা বেগম আর বড়কালে আশা বেগম দুইজনই ছিলেন অত্যাধিক মাপের স্বাস্থ্যসচেতন। যার দরুণ প্রাণ তারা কখনো রাস্তার খাবার খেতে দেননি। উপরন্তু, স্কুলে টিচাররাও বলতো এসব খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই যে বয়সে মেয়েরা ফুচকা আর আইসক্রিম বলতে পাগল থাকতো সে বয়সে প্রাণ এসবের ধার দিয়েও ঘেঁষতো না। খাবে আর কি? তাই আজ ছন্দ স্ট্রিটফুডের কথা বলায় দ্বিধায় ভুগছিল সে। ছন্দ হয়তো বুঝলো বিষয়টা। তাই বলল, “কোনকিছু নিয়ে ভালো-মন্দ বিচার করার আগে একবার হলেও তা ট্রায় করে দেখতে হয়। এতে অভিজ্ঞতা বাড়ে।”

কথাটা শুনে প্রাণ আর দ্বিমত পোষণ করলো না। ছন্দ ওয়াফেলস আনতেই খেয়ে নিল। আর বিস্ময়ের বিষয়, রেস্টুরেন্টের নামি-দামি খাবারের চেয়ে এটা স্বাদে,মানে দ্বিগুণ সুস্বাদু। প্রাণ তৃপ্তি সহিতই খেল। ছন্দের সাথে ঘুরাফেরা মানেই নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা করার সুযোগ।

ওয়াফেলস খাওয়া শেষে ছন্দ কয়েক স্টলের পর থেকে দুইটা স্টাফ চিকেন ও ভেজিটেবল রোল নিল। দুইজন সাইডরোডের মার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখছিল আর খাচ্ছিল। এর ফাঁকে ছন্দের চোখে দিয়ে আটকালো একটা ব্রেসলেটের দিকে। নকশাটা আকর্ষণীয় হওয়ায় খুব মনে ধরালো তার। তাই প্রাণের দৃষ্টির অগোচরে সে কিনে ফেললো সেটা। কোন এক বিশেষ মূহুর্তে প্রাণকে উপহার দিবে বলে। এদিকে প্রাণও বাসার সকলের জন্য টুকটাক জিনিস কিনতে থাকলো। কেনাকাটা শেষে ছন্দ প্রাণকে এক কিনারে দাঁড় করিয়ে গেল প্রাণের জন্য কিটকেট মিল্কশেক আনতে। প্রাণ যখন দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিল তখন পাশ থেকে একজন বলে উঠলো, “এক্সকিউজ মি!”

প্রাণ পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো পঁচিশ কি ছাব্বিশ বয়সী শেতাঙ্গ ছেলে তার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো ধূসর বর্ণের, বাদামি চুলগুলোতে ছোট এক ঝুঁটি করা ও এককানে দুল ঝুলছে। দেখতে কেমন উদ্ভট দেখাচ্ছে৷ প্রাণ বিরক্তিসহিত বলল, “ইয়েস?”

ছেলেটা হুট করে বলে উঠলো, “আ’ম আমেজড উইথ ইয়্যুর বিউটি। ক্যান আই গেট ইয়্যুর নাম্বার, প্রিটি লেডি?”

প্রাণ বিতৃষ্ণায় দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ক*র্ক*শ কন্ঠে বলল, “নো!”

“বাট হুয়াই? আ’ম আই নট গুড ইনাফ ফর ইয়্যু?”

কথাটা বলার মুহূর্তে ছন্দ এসে হাজির হলো। ছেলেটার কথা শুনে তার বাকি রইলো ঘটনা কি। ক্ষণেই প্রেমিক পুরুষের হৃদয় স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে উঠলো। কয়েক পা এগিয়ে এসে আগামবার্তা ছাড়াই প্রাণের কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে নিজের দিক টেনে আনলো। মধ্যখানের দূরত্ব ঘুচতেই সে দারুণ ঈর্ষান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো, “শি ইজ মাইন ব্রোহ। সো ডোন্ট ইয়্যু ডেয়ার টু কিপ আইস অন হার।”

ছেলেটার পাশাপাশি প্রাণও ভড়কালো। গোলগাল দৃষ্টিতে একবার তাকালো নিজের কোমরের দিকে, আরেকবার মানুষটির দিকে। ছন্দের প্রত্যেক শব্দ কর্ণরন্ধ্রে আলোড়ন তুলতেই আ*র*ক্ত হলো তার গাল দুটো। বুঝে উঠতে পারছে না নিজের স্বভাবের বিপরীত ধারায় কেন চলছে সে? এমন তো হওয়ার কথা নয়। আসলেই কি সে সত্য থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে তরঙ্গিত হতে শুকনো গলায় ঢোক গিললো প্রাণ। অপরদিকে ছেলেটা অপ্রস্তুত হেসে বলল, “রিল্যাক্স ব্রোহ! আই ডিড নট নো ইট। সরি!”

কথাটা বলেই ছেলেটি কেটে পড়লো। ছন্দ তা দেখে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “পুরান পাগলের ভাত নাই, নতুন পাগলের আমদানি। যতসব!”

প্রাণ কথাটা শুনে নীরব রইলো। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ছন্দের মুখপানে। ছন্দ প্রাণের দিকে দৃষ্টি রেখে আক্রোশ ভরা কন্ঠে বলল, “আমি ব্যতীত আপনি কারো নন। বুঝেছেন?”

প্রাণ প্রত্যুত্তর না করে স্বল্প পরিসরে হাসলো শুধু। ভাবান্তরহীন ভঙ্গিতে ছন্দের হাত থেকে মিল্কশেকটা নিয়ে খেতে খেতে এগিয়ে গেল সামনে। ছন্দ সেদিকে তাকিয়ে বিরবির করে উঠলো, “উফফ! আমাকে জ্বা*লিয়ে-পু*ড়িয়ে ছার*খার না করা পর্যন্ত দম নিবে না এই মেয়ে।”

________

সূর্যের দেখা নেই একাধিক দিন হলো। শীতের মৌসুম হওয়ায় আবহাওয়া নেমে গিয়েছে চার সেলসিয়াসের কাছাকাছি। শৈত্যপ্রবাহের প্রকোপে প্রতি মুহূর্তে কেঁপে উঠছে নগরী। বন্য হাওয়াদের জ্বালায় দুদণ্ড দাঁড়ানো যাচ্ছে না বাহিরে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে থাকে। উইন্টার কোটটা গায়ে ভালো মত জড়িয়ে নিয়ে কলিংবেল চাপলো ছন্দ। প্রাণের ঔষধ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেগুলো আনতে বেরিয়েছিল সে। লাগাতার তিনবার ডোরবেল বাজানোর পর তার মনে পড়লো, বের হওয়ার আগে নাফিসা জানিয়েছিল তাকে সে ও ফারিনাজ নিউ ইভের শপিং করতে যাবে। প্রাণকেও হয়তো সাথেই নিয়ে গিয়েছে তারা, ভিতর থেকে সাড়াশব্দ আসছে না কোন। ছন্দ এবার পকেট হাতড়ে ডুপ্লিকেট চাবিটা খুঁজতে থাকলো। নাফিসা তাকে দিয়েছিল একটা নিজের কাছে রাখার জন্য। বাম পকেট থেকে চাবিটা উদ্ধার করে ছন্দ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো। গায়ের কোটটা করিডরের হ্যাংকারে ঝুলিয়ে শু-সেল্ফটার উপর ঔষধের ব্যাগটা রেখে নিজের জুতা খুলে নিল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই সোফার উপর ঘুমিয়ে থাকা রমণীটার দিকে দৃষ্টি গেল তার৷ গায়ে পাতলা এক ব্ল্যাঙ্কেট জড়ানো। সামনেই লো ভলিউমে টিভিটা চলছে। তার আড়ম্বরি আলোয় টলমল করছে রমণীর সুষুপ্ত মুখশ্রী। হয়তো টিভি দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে। হাই পাওয়ার মেডিসিন সেবন করার ফলে প্রচন্ড তন্দ্রালু হয়ে গিয়েছে মেয়েটা৷ দিগবিদিক খেয়াল না করে প্রায়শই এদিক-সেদিক ঘুমিয়ে পড়ে। ছন্দ মৃদু হেসে রুমে চলে গেল। হাত-মুখ ধুয়ে পুনরায় ড্রয়িংরুমে আসলো সে। টিভি অফ করে খুব সন্তর্পণে কোলে তুলে নিল প্রিয়তমাকে। গা থেকে ব্ল্যাঙ্কেট নামিয়ে রাখল আগেই। স্পর্শ গভীর হতে বুঝতে পারলো শরীর তার একদম হিম শীতল। ছন্দ তাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিল সাবধানতার সাথে। পায়ের কাছ থেকে শেরপা কুইল্ট ব্ল্যাঙ্কেটটা টেনে গ্রীবাদেশ পর্যন্ত জড়িয়ে দিল ভালোভাবে। অতঃপর তার কপালে স্নিগ্ধ এক পরশ এঁকে পাশে তাকাতেই সাইড টেবিলে অযত্নে পড়ে থাকা প্রাণের ফোন দেখতে পেল। আলো জ্বলতে তাতে। টানা কয়েকদিন ব্যবহার না করার ফলে ধুলোর পালতা আস্তরণ জমেছে ওপরে। ছন্দ একটু ঝুঁকতে দেখতে পেল কয়েকটা হেডলাইনের নোটিফিকেশন ঝলঝল করছে। তার নিচেই ঝুলছে চৈতি মেসেজ। ছন্দ ফোনটা হাতে নিয়ে লক না খুলেই উপর দিয়ে চেক করলো সব। মুহূর্তেই মুখ পণ্ডুবর্ণ ধারণ করলো তার। একপলক প্রাণের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো সে। অতঃপর ফোনটা অফ করে কাবার্ডের ভিতরে রেখে নিজের ফোন নিয়ে চলে গেল বাহিরে। তবে যাওয়ার পূর্বে দরজা ভিড়িয়ে যেতে ভুললো না।

#চলব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে