প্রাঙ্ক কাপল পর্ব-০১

0
1266

#প্রাঙ্ক কাপল [সূচনা পর্ব]
#রাকিব হাসান রাজ

আজ আমি দ্বিতীয় বিয়ে করে আমার প্রথম স্ত্রী মিমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। মিম একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেক বার তাকাচ্ছে আমার দ্বিতীয় স্ত্রী রিমির দিকে। সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তবে আমি নিরুপায় ছিলাম। এই কাজটা আমাকে করতেই হতো। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাকে দ্বিতীয় বিয়েটা করতে হয়েছে।

||ঘটনার সূত্রপাত||

খাবার খেতে বসতে না বসতেই আমার স্ত্রী মিম ইচ্ছকৃতভাবে ধাক্কা দিয়ে খাবার থালাটা ফেলে দিলো। মিমের এমন অদ্ভুত কাজে আমি একটুও বিচলিত হলাম না। এসব তার নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড। তবে আজ যা করল তা একটু বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে আমার কাছে।

‘‘মিম, তুমি করলে কী? খাবারের উপর কেন রাগ দেখালে?’’ খানিকটা উঁচু গলায় প্রশ্ন করলাম।

‘‘তো কী করব? তুমি বেশ ভালো করেই জানো যে, আমার হলুদ রঙ অপছন্দ। তবুও তুমি আমার জন্য হলুদ শাড়ি নিয়ে এসেছ।’’

মিমের রেগে যাওয়ার কারণটা এবার আমার বুঝে এলো। তবে এই সামান্য কারণের জন্য এতটা বাজে ব্যবহার আমি মানতে নারাজ।

‘‘তাই বলে তুমি খাবারের থালাটা ফেলে দেবে? খাবার হলো আল্লাহ তাআলার দেওয়া রিজিক। এই রিজিকের জন্যই বহির্বিশ্বে যুদ্ধ হয়ে থাকে। কত মানুষ অনাহারে দিন কাটায়। আর তুমি কি না সেই রিজিক নষ্ট করলে!’’

মিম বিরক্তিকর স্বরে বলল, ‘‘আবার শুরু করলে নিজের বকবক। এতই যখন দার্শনিকের মতো করে সবকিছু খেয়াল রাখো, তাহলে আমার কী পছন্দ আর কী অপছন্দ তার দিকে কেন খেয়াল রাখতে পারো না?’’

প্রশ্নটা করেই মিম শপিং ব্যাগ থেকে আমার নিয়ে আসা হলুদ শাড়িটা ফ্লোরে ফেলে দিল। তারপর সেই শাড়িটা দিয়ে ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার করতে লাগল। আমার প্রতি ক্রমশ মিমের ব্যবহার নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।

মিমের উপর অভিমান করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন মিমের রাগের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে। মিমের অপছন্দের রঙ হলুদ, এটা সত্যি আমার জানা ছিল না। আর তাছাড়া আমার পছন্দের রঙ হলুদ। একজন পুরুষের পছন্দের রঙ হলুদ হবে, এটা কেউ আন্দাজ করতে পারবে না। ভেবেছিলাম আমার দেওয়া উপহার স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করবে মিম। কিন্তু হলো উলটোটা। তবে ক্রমাগত মিমের রাগের মাত্রা এভাবে বেড়ে গেলে ভবিষ্যতে বড়ো কোনো সমস্যাতে পড়তে হবে।

সেই সন্ধ্যার দিকে আমি বাসা থেকে বের হয়েছি। এখনও বাসায় ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। মিমের অহেতুক রাগের কারণে আমি বেশ দেরি করেই বাসায় ফিরি। আমার চাকরির সময়কাল বিকাল পর্যন্ত হলেও আমি সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরি। আর আজ তো আমি সন্ধ্যা নাগাদই বাসা থেকে বেরিয়েছি, না জানি কখন ফিরে যাই?

গভীর রাতে বাসায় ফিরলাম আমি। না চাইতেও বাসায় ফিরতে হলো আমাকে। দুই বছরের সাংসারিক জীবন আমাদের। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম মিমকে। বিয়ের আগে থেকেই মিমের ক্রোধ সব সময় তার নাকের ডগায় থাকত। ভেবেছিলাম বিয়ের পর আমার ভালোবাসা দ্বারা তার ক্রোধকে দমিয়ে ফেলব। কিন্তু পারিনি। বরঞ্চ ক্রমাগত তার ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাচ্ছে।

বাসায় ফিরতেই নিজের রুমে চলে গেলাম। মোবাইলে ফ্ল্যাশ চালু করতেই কিঞ্চিত আলোকিত হলো চারপাশ। সেই আলোতেই দেখতে পেলাম মিম ঘুমোচ্ছে। আমিও চুপিসারে মিমের পাশে গিয়ে উলটো পাশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। মিমের ক্রোধকে কীভাবে চিরতরে শেষ করা যায়, এসব ভাবতে ভাবতে আমি নিদ্রায়মাণ হয়ে গেলাম।

সকাল হতে না হতেই কারও উচ্চস্বরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি নিজের চোখ খুলে সর্বপ্রথম মিমকে অগ্নিশর্মার বেশে দেখতে পেলাম। আমি কিছু বলব তার আগেই মিম বলে উঠল, ‘‘রাতে কার অনুমতি নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছ? বাসার প্রবেশদ্বারের চাবি আছে বলেই যে বাসায় আসতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তোমার যখন ইচ্ছা হবে বাসায় আসবে আর যখন ইচ্ছা হবে বাসা থেকে চলে যাবে, এমন মনোবাসনা থাকলে মন থেকে তা মুছে ফেলো। কারণ, আমার সংসারে এসব বেহায়াপনা চলবে না।’’

মিমের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। গতকালকের ক্রোধের কারণ নাহয় মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু আজকেরটা! পুরো বাসায় মাত্র এই একটা থাকার ঘর। মা-বাবা গ্রামে থাকে। শহরে ভালো বেতনের চাকরি করি। ভবিষ্যতে একটি ফ্লাট কেনার চিন্তাভাবনা আছে, যেখানে গ্রাম থেকে মা-বাবাকে এনে একসাথে বসবাস করব। তাই বর্তমানে ছোট একটি ভাড়া বাসায় থাকি।

মিমের কথাগুলো হজম করে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে এভাবে হুট করে উঠে আসতে দেখে মিম কিছুটা বিব্রত হলো। সে আরও কিছু বলবে তার আগেই আমি বললাম, ‘‘তুমি চাচ্ছো কী? আজকে শুক্রবার। ভেবেছিলাম শান্তিতে ঘুমাব। কিন্তু না, আজকেও তোমার বকবকানি শুনে আমার সকালটা শুরু হলো। নিজের বাসায় কখন আসবো, তার জন্য তোমার থেকে অনুমতি নিতে হবে নাকি?’’

আমাকে এভাবে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখে মিম উলটো বাজখাঁই গলায় বলল, ‘‘এটা যেমন তোমার বাসা, তেমনি আমারও। এতই যখন বিরক্তিকর ও অপ্রয়োজনীয় মনে হয় আমাকে, তাহলে যাও না, যাও! আরেকটা বিয়ে করে নিয়ে আসো। সে এসে এই সংসারের হাল ধরুক। কোন অপয়াক্ষণে যে তোমাকে পছন্দ হয়েছিল, জানি না আমি।’’

পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করার স্বভাবটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মিমের। যথাসম্ভব এর চিকিৎসা না করলে মিম বড়ো কোনো কান্ড করে বসবে।

‘‘হ্যাঁ যাব। নতুন বউ নিয়ে আসব। তবুও তোমার মতো ঝগড়ুটে মেয়ের সাথে জীবনেও সংসার করব না। এই দুইটা বছর না একটু ভালোবাসলে আর না একটু কেয়ার করলে আমার। সব নিজেকেই করতে হয়। আমার জীবনের সবচে’ বড়ো ভুল ছিল তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করা। ডিভোর্সের জন্য তৈরি থেকো।’’

কথাটা বলেই আমি হনহন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মিমকে চিন্তিত দেখলাম। আজ পর্যন্ত আমাকে এত রাগতে দেখেনি সে। বোধহয় আজ একটু বেশিই রাগ দেখিয়েছে আমার উপর, এটা ভেবে সে অনুতপ্ত। তবে আর কিছু করার নেই। বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়ে গিয়েছে।

সন্ধ্যা নাগাদ বাসার কলিং বেল বাজতেই মিম এসে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। মিমের সামনে আমি আর আমার সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ দাঁড়িয়ে আছি। অবশ্য তেমন সাজগোজ করা নেই আমাদের। তবে গলায় বিয়ের মালা দেখেই যে কেউ বুঝতে পারবে, আমরা সদ্য বিয়ে করেছি। মিম এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কর্কশ গলায় বললাম,

‘‘এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে সরে যাও। নতুন বউ এসেছে ঘরে।’’

মিমকে ধাক্কা দিয়ে আমি আর রিমি অর্থাৎ আমার নতুন বউ প্রবেশ করলাম। রিমি সোফায় বসলো। আমি মিমকে উদ্দেশ্য করে আবার বললাম, ‘‘কী হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? নতুন বউ বাসায় এসেছে। চা মিষ্টি নিয়ে আসো।’’

আমার কথায় মিমের ঘোর কাটে। অজান্তেই
তার চোখ থেকে দু-ফোঁটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘এ….সব কী?’’

নিজের কর্কশ কণ্ঠ বজায় রেখে বললাম, ‘‘কী মানে? তোমার চোখ নেই? নতুন বিয়ে করে এসেছি আমরা। তুমিই তো সকালে বলেছিলে আরেকটি বিয়ে করার জন্য। এখন থেকে রিমিই এই সংসারের হাল ধরবে। তোমাকে আর দরকার নেই। তুমি বিদায় নিতে পারো।’’

রিমি আমাকে শান্ত হতে বলল। সে বলল,
‘‘হা-হা রাকিব, এত হাইপার কেন হচ্ছো? সবে মাত্র বিয়ে করে বাসায় এলাম। আজ না আমাদের বাসর রাত। তা কোথায় হবে আমাদের বাসর?’’

‘‘হ্যাঁ, হবে তো। চলো, তোমাকে বেডরুমে নিয়ে যাই।’’

মিম এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে, সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছুটা সময় লাগল তার, ব্যাপারটা হজম করতে। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি, ব্যাপারটা তার সহ্য হচ্ছে না। সকালে রাগের মাথায় কী না কী বলেছে, তার জন্য আমি সত্যি বিয়ে করে ফেলব, মিম অনুমানও করতে পারেনি? জলদি সে নিজের পা চালিয়ে বেডরুমে গেল।

আমি রিমিকে নিয়ে বেডরুমে আসতেই রিমি অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘‘এ কি! আজ আমাদের বাসর রাত। আর এদিকে ঘরে সাজসজ্জার কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।’’

আমি উত্তর দিব তার আগেই মিম আমার পিছন থেকে সামনে এসে বলল, ‘‘হ্যাঁ নেই। কারণ আজ কারও বাসর হবে না। এই শাঁকচুন্নি, তুই এক্ষুণি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। নাহলে তোকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেবো।’’ কথাটা বলেই মিম রিমির হাত ধরে টানতে টানতে রুমের বাহিরে নিয়ে গেল।

মিম রিমিকে ধাক্কা দিবে এমন সময় আমি রিমিকে টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললাম। মিম এই ঘটনাতে আরও রেগে গেল। সে আমাদের কাছে আসতেই আমি মিমের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম। মিম গালে হাত দিয়ে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।

‘‘তোর সাহস কীভাবে হয়, আমার স্ত্রীকে ধাক্কা দেওয়ার? কানে খুলে শোন, রিমিকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। আজ থেকে রিমিই আমার জীবন। তুই এই মুহূর্তেই আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। আমি আমার আর রিমির সংসারে কোনো তৃতীয় ব্যক্তিকে চাই না।’’

মিমে চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে, তার শব্দ করে কাঁদতে মন চাচ্ছে। তবে কেন জানি তার চোখ থেকে অশ্রু বের হচ্ছে না। হয়ত তার পাষাণ হৃদয়ে অশ্রুর কোনো জায়গা নেই। আজ পর্যন্ত আমিন তার সাথে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলিনি। কিন্তু আজ! আজ তার গায়ে হাত তুলেছি।

‘‘এসব উটকো ঝামেলা যথাসম্ভব বিদায় করাটা শ্রেয়। তবে এখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। তাই ওকে এখন বিদায় না করে আগামীকাল বিদায় করলে ভালো হবে। তোমার রাগ করে থাকতে হবে না। আজকে না আমাদের বাসর হবে? তাহলে চলো। আমার আর তর সইছে না।’’

রিমি মিমের চোখের সামনেই আমাকে নিয়ে বেডরুমে চলে গেল। মিম কিছুই করতে পারলাম না। ঘরের ভিতর থেকে দরজার ছিটকানি লাগিয়ে দিলাম আমি।

তবে দরজা লাগানোর আগে মিমের চেহারা দেখে মিমের ভেতরের তুফান অনুভব করতে পারলাম। সে নিশ্চই মনে মনে ভাবছে, ‘‘না, মিম। তুই এভাবে হেরে যেতে পারিস না। এসব তোর ভুলের জন্যই হয়েছে। তোর অতিমাত্রার রাগের জন্যই রাকিব দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। তুই আবার রাকিবকে ফিরিয়ে আনবি। তুই ওই শাঁকচুন্নির সাথে রাকিবের মিলন কখনো ঘটতে দিতে পারবি না।’’

মিম দরজার কাছে এসে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। কিন্তু আমরা কেউ দরজা খুললাম না। সে ক্রমাগত দরজায় নক করতেই লাগল। এক পর্যায়ে সে ক্লান্ত হয়ে দরজার সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল।

সহসা রুমের ভিতর থেকে কিছু অতিপরিচিত শব্দ তার কানে ভেসে এলো।
শব্দগুলো মিমের অপরিচিত নয়। রুমের ভিতরে কী হচ্ছে, তা ভাবতেই মিমের ডুকরে কেঁদে উঠতে মন চাইছে। একজন নারীর চিৎকার শুধু একজন নারীই বুঝতে পারে। বিশেষ মুহূর্তের শব্দ এগুলো। আজ আমি অন্য একজন মেয়ের সাথে অন্তরঙ্গতায় মেতে উঠেছি, বিষয়টা মিমের বুঝে আসতেই সে ডুকরে কেঁদে উঠল। নিজের অশ্রুধারাকে আর বাধা দিতে পারল না সে। আজ নিজেকে শেষ করে দিতে মন চাইছে তার।
কিন্তু কীভাবে? এই পাষাণ হৃদয়ে এত সাহস নেই যে নিজের জীবন শেষ করে ফেলবে।
তাহলে কী করবে সে? আমাকে তার দিকে ফিরিয়ে আনতে নতুন কোন পদক্ষেপ অবলম্বন করবে সে?

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে