প্রাঙ্ক কাপল পর্ব-০২

0
822

#প্রাঙ্ক কাপল [২য় পর্ব]
#রাকিব হাসান রাজ
________________
নিজের স্বামীকে অন্য নারীর সাথে বাসর করবে, এটা কোনো পতিব্রতা স্ত্রী মেনে নেবে না। নিজেকে দোষারোপ করতে করতেই মিম গভীর নিদ্রায় হেলিয়ে পড়ল ফ্লোরে।

সকাল বেলায় দরজা খোলার শব্দে মিম জেগে গেল। কারণ সে দরজার সাথে ঠেস দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এক রাতেই মিমের অবস্থা বেহাল হয়ে গিয়েছে। চুলগুলো রুক্ষ হয়ে গিয়েছে, চোখে নিচে কালশিটে পড়ে গিয়েছে। মিম ভেবেছিল তার এই দুর্দশা দেখে আমার মনে তার জন্য মায়া জন্মাবে। কিন্তু সে ভুল! মিমের প্রতি আর কোনো ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই আমার মনে। আমি ধমকের সুরে বললাম, ‘‘এখানে বসে আছিস কেন? তোকে না সকাল হতেই চলে যেতে বললাম। এই মুহূর্তেই তুই এই সংসার থেকে চলে যাবি। তোর মতো একজন অপয়ার কোনো স্থান নেই এই বাসায়। আগে তো সারাদিন আমার সংসার, আমার সংসার বলে বকবক করতি। কিন্তু এখন আর নয়। এখন আর এটা তোর সংসার নয়। এই মুহূর্তে তুই এই বাসা থেকে বের হয়ে যাবি।’’

মিম আমার ধমক শুনে প্রথমে ঘাবড়ে গেল। সে আমার পা ঝাপটে ধরল। অশ্রুরুদ্ধ হয়ে বলল, ‘‘দয়া করো আমার উপর। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। আমাকে নিজের হৃদয়ের এক কোণে স্থান দিলেই হবে। বেশি জায়গা চাই না আমার।’’

আমি কিছু বলব তার আগেই পিছন থেকে রিমি আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে বলল,
‘‘এই উটকো ঝামেলা এখনো দূর হয়নি? জান, এই ঝামেলাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।’’

মিম শব্দ করে কেঁদে উঠল। ‘‘না, আমাকে বের করে দিয়ো না। এই শহরের থাকার মতো কোনো জায়গা নেই আমার। কোথায় যাব আমি?’’

‘‘কেন? তোর মতো মেয়েদের থাকার জন্য এই শহরের জায়গার অভাব হবে না। শহরের প্রতিটা অলিগলিতে তোর মতো মেয়ের জন্য পতিতালয় রয়েছে।’’

রিমির কথাশুনে মিম আরও প্রবল শব্দে কেঁদে উঠল। আমি রিমিকে বললাম, ‘‘আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এসেছে। তুমি তো ঘরের কাজ করতে পারবে না। এই যেমন রান্নাবান্না, ঘর ধোয়া ইত্যাদি। এসব কাজ তো কাজের মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। তোমার কোমল হাতে এসব করতে হবে না। এই মেয়েকে বরং রেখেই দেই কাজের বুয়া হিসেবে। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকবে। থাকাখাওয়ার বিনিময়ে একজন কাজের মহিলা হিসেবেই নাহয় রেখে দিলাম।’’

আমি বাকা হাসি দিয়ে মিমের দিকে তাকালাম। সে স্তব্ধ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক রাতের ব্যবধানে আমার এই পরিবর্তন কিছুতেই তার বুঝে আসছে না।

‘‘যে রাকিব সর্বক্ষণ আমাকে মাথায় নিয়ে নাচতো, আজ সেই কি না আমাকে কাজের মহিলা বানাতে চাচ্ছে।’’ মিমের ক্লান্ত হৃদয় তাকে পুনঃপুন কথাগুলো বলছে।

রিমি কিঞ্চিত ভাবুক হয়ে বলল, ‘‘তুমি মন্দ বলোনি। এসব লো-ক্লাসের কাজকর্ম শুধু এই মেয়েকে দিয়েই সম্ভব। আমি তো শুধু তোমাকে ভালোবেসে যাব আর তুমি আমাকে।’’ রিমি মিমকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘‘যাহ্, আমাদের জন্য নাস্তা তৈরি কর। আমি আমার জানের সাথে প্রাতঃস্মান সেরে আসছি।’’ কথাটা বলেই রিমি আমার উদ্দেশ্যে দুষ্টুমির স্বরে বলল, ‘‘চলো জান, আজকে আমরা একসাথে গোসল করব।’’

আবার আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। আজ মিমের সাথে যা কিছু হচ্ছে, সবই তার নিজের দোষ। নিজের আধিপত্য তৈরি করতে সব সময় সে আমার উপর তেজ দেখিয়েছে। কারণে-অকারণে আমার সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে, আমাকে ঠেস দিয়ে কথা বলেছে। আর এজন্যই তার এই পরিণতি। তবে সে হার মানবো না। যত যাই হয়ে যাক না কেন, আমাকে পুনরায় নিজের ভালোবাসা দ্বারা ফিরিয়ে আনবে- নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করে মিম রান্না ঘরে চলে গেল।

প্রাতঃস্মান সেরে আমি আর রিমি বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। এখনো মিমের নাস্তা বানানো হয়নি দেখে রিমি বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে বলল,

‘‘এই বাসায় থাকতে হলে সময়মতো সব কাজ করতে হবে। কোনো অজুহাত দিলে চলবে না। জান, তুমি বলে দিবে সেই মেয়েকে, সে যদি এই বাসায় কাজ করে থাকতে চায়, তাহলে সে যেন নিজের কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করে।’’

রিমির কথা শেষ হতে না হতেই মিম নাস্তার ট্রে নিয়ে হাজির হলো। মিম বেশ বিনয়ী কণ্ঠে বলল, ‘‘আর এরকম ভুল হবে না। এবারের মতন ক্ষমা করে দিন। এটাই প্রথম আর এটাই শেষ।’’

ক্ষমা চেয়ে মিম আমার আর রিমির প্লেটে খাবার দিয়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। মিম খাবার খেতে বসতেই আমি ধমক দিয়ে উঠলাম, ‘‘এ কি! তুই একজন কাজের মেয়ে হয়ে মনিবদের সাথে বসার সাহস কোথা থেকে পেলি? আমাদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তুই নিচে বসে খাবি। আমার হুকুমের নড়চড় হলেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো।’’

আমার প্রত্যেকটা কথা মিমের হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। ভাতের প্লেটটা নিয়ে সে রসুইঘরে চলে গেল। সেখানেই মাটিতে বসে বসে খেয়ে নিলো। আমি ও রিমি দুজনেই একসাথে অফিসের জন্য বের হলাম।

মিম আমাদের যাত্রাপথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার বুঝতে বিলম্ব হলো না যে, আমরা একই অফিসে চাকরি করি আর সেখান থেকেই আমাদের প্রেমকাহিনী শুরু।

মিম তার বেডরুমে গেল। এখন অবশ্য তার বেডরুম নয় এটা। বিছানায় বসে চাদরের উপর হাত বুলালো সে। এই বিছানায় গতকাল আমি অন্য একটি মেয়ের সাথে…….ঘটনাটা ভাবতেই মিম ক্রোধিত হয়ে বিছানার চাদর টান দিয়ে নিচে ফেলে দিলো। আমার ও রিমির স্পর্শ যেসব বস্তুর উপর পড়েছে, সেসব সে ছুড়ে ফেলে দিলো ফ্লোরে। সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফ্লোরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগল। আচমকা তার বমি পেল। ছুটে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই কেমন যেন মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল তার।

সন্ধ্যা নাগাদ আমি আর রিমি বাসায় পৌঁছালাম। কয়েকবার কলিং বেল বাজানোর পরও যখন মিম দরজা খুলল না, তখন একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। রিমি ব্যাকুল গলায় বলল,

‘‘মিমের ভালোমন্দ কিছু করে ফেলেনি তো!’’

রিমির কথায় আমারও চিন্তা বেড়ে গেল। ব্যাগ থেকে ডুপ্লিকেট চাবি বের করে লক খুললাম। বাসায় প্রবেশ করতেই দেখতে পেলাম চারপাশটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ চালু করে সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে ঘরের সকল লাইট চালু করে দিলাম। চারপাশটা আলোকিত হতেই আমি আর রিমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঘরের সব জিনিসপাতি এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মিমকে ঘরের কোনো জায়গায় দেখতে না পেয়ে বেডরুমে গেলাম। বাথরুমের সামনে মিমকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পেয়ে ছুটে তার কাছে গেলাম।

ধীরে ধীরে মিম নিজের চোখ খুলতেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল তীব্র মাথাব্যথার কারণে। হঠাৎ কানে কারও কোমল কণ্ঠ ভেসে এলো। পুনরায় চোখ খুলতেই চক্ষুগোচর হলো, আমি তার পাশে বসে আছি আর রিমি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। আবারও সেই কণ্ঠ তার পাশ থেকে ভেসে এলো।

‘‘এখন কেমন আছো মিম?’’

মিম পাশে তাকাতেই ডাক্তার আংকেলকে দেখতে পেল। শহরে আসার পর উনার সাথে বেশ আত্মীয়তা গড়ে উঠে আমাদের।

‘‘মাথা ব্যথা করছে প্রচুর।’’

আমি বললাম, ‘‘আংকেল, আমরা মিমকে বাথরুমের সামনে অচেতন অবস্থায় পাই। ওর কিছু হয়নি তো?’’

অনেকদিন পর মিমের জন্য আমাকে ব্যাকুল হতে দেখে বেশ প্রশান্তি পেল মিম।

‘‘আরে তেমন কিছু হয়নি। এই অবস্থাতে অজ্ঞান হওয়াটা স্বাভাবিক।’’

আমি ভ্রু কুঁচকালাম। ‘‘এই অবস্থা মানে?’’

ডাক্তার আংকেল হাসিমুখে বললেন, ‘‘আরে তুমি বাবা হতে যাচ্ছ আর মিম মা হতে যাচ্ছে! মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। সেটা মিস করলে চলবে না।’’

[সবাই আমার গ্রুপ রাকিবের গল্প কুটির – মাফিয়া, ফ্যান্টাসি, ভৌতিক ও থ্রিলার গল্পের সমাহার এ এড হয়ে নিবেন]

ডাক্তার আংকেলের মুখ থেকে খবরটা শুনে আমার মুখটা বিষাদের আঁধার মেঘে ঢেকে গেল। মায়া আমার দিকে তাকালো। সে ভেবেছিল, এবার আমি অতীতের সকল কিছু ভুলে গিয়ে তাকে আবারও আপন করে নেবো। কিন্তু আমার চেহারায় খুশির ঝলক নেই। রিমি আমার কাঁধের উপর হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি কৃত্রিম একটি হাসি দিয়ে বললাম, ‘‘মিষ্টি খাওয়াবো তো। আসুন, এগিয়ে দেই আপনাকে।’’ ডাক্তার আংকেলকে এগিয়ে দিয়ে আবার নিজের রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে মিমের উদ্দেশ্যে বেশ গম্ভীর ও শীতল গলায় বললাম, ‘‘এই বাচ্চাটা কার?’’

আমার মুখে এই প্রশ্ন শুনে মিমের অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। বিস্মিত কণ্ঠে সে জবাব দিলো, ‘‘কার মানে? এটা আমাদের বাচ্চা। আমার আর তোমার ভালোবাসার স্মৃতি।’’

‘‘চুপ!’’ আমার ধমকে মিম কেঁপে উঠল। ‘‘এটা আমার বাচ্চা হতেই পারে না। যখনি তোর কাছে আসতে চাইতাম, তখনি তুই আমাকে দূরে ঠেলে দিতি। কখনো ভালোবেসে কাছে আসতে চাইলে তোর অবহেলাই পেয়েছি সবসময়। তাহলে এই বাচ্চা এলো কোথা থেকে?’’

রিমি বলল, ‘‘কোথা থেকে এলো, বুঝতে পারছ না? আরে বাহিরে ফ’ষ্টিন’ষ্টি করে এসেছে। এখন কার না কার বাচ্চা, তোমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছে। ’’

মিম কষ্টেসৃষ্টে নিজের অশ্রুকে থামালো।
রিমি মিমের উদ্দেশ্যে বলল, ‘‘রাকিব শান্ত মাথায় জিজ্ঞাসা করছে। বলে দেও , কে এই বাচ্চার বাবা? নাকি এতজনের সাথে রাত কাটিয়েছ যে এই বাচ্চার আসল বাবা কে, তুমি জানোই না?’’

মিম এবার আর সহ্য করল। সকল বাঁধ ভেঙে অশ্রুর ধারা বয়ে গেল গাল বেয়ে। তাএ নিজের উপরই ঘৃণা চলে আসছে। বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করতেই রাকিব আমি তাকে বিছানার সাথে চেপে ধরলাম।

‘‘খবরদার! বিছানা থেকে এক পা নামালে তোর পা ভেঙে ফেলে দিব। আগামীকালই তুই তোর পাপের ফসল নিয়ে চলে যাবি। তোর চেহারাও দর্শন করতে চাই না আমি।’’ প্রচণ্ডমূর্তি হয়ে কথাগুলো বললাম।
রিমির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘‘রিমি, তুমি এর কাছে থাকো। যে-কোনো সময় পালিয়ে যেতে পারে। আগামীকাল সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো। এখন বাহিরে গিয়ে সিনক্রিয়েট করতে পারে।’’

কথাগুলো বলেই আমি মিমকে ছেড়ে দিয়ে বাহিরে চলে গেলাম। রিমি মিমের পাশেই বসে রইল।

শরীরে ক্লান্তিভাব দূর করার জন্য বিশ্রামের প্রয়োজন মিমের। তাই অক্ষিযুগল বন্ধ করতেই নিদ্রাবিষ্ট হয়ে পড়ল সে। সকালে কিছু একটার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। শোয়া থেকে উঠে বসল সে। আশেপাশে তাকিয়ে আমাকেব কিংবা রিমিকে, কাউকেই দেখতে পেল না।

বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফ্রেশ হয়ে যেই রুমের বাহিরে যাব, তখনি দেখতে পেল, দরজা বাহির থেকে বন্ধ।

মিম দরজায় ধাক্কা দিল, কিন্তু খুলল না। ভয়ে সে আঁতকে উঠল। পরবর্তীতে তার সাথে ঠিক কী হতে যাচ্ছে, ভাবার সাহসও পাচ্ছে না সে। শুধু জানে, ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে