প্রণয়-কাব্য পর্ব-০১

0
767

#প্রণয়-কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

১.

আমার বাবা যেদিন পরনারীর জন্য বাড়ি ত্যাগ করলেন সেদিন ছিল আমাদের জীবনের সবথেকে জঘন্যতম একটা দিন। আর পাঁচটা দিনের মতোই সেদিন সকাল হয়েছিল। রোদ উঠেছিল। কিন্তু আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল সকল আলো। আমার মা মাটিতে গড়িয়ে পড়ে কেঁদেছিলো সেদিন। তার কান্না আর দশটা মানুষের হৃদয় নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখলেও আমার পা*ষাণ বাবার হৃদয় গলাতে পারেনি। মা কতই না অনুনয় করেছিল আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে যাওয়ার জন্য। আঁকড়ে ধরেছিল দু হাত দিয়ে বাবার পা। বারবার চেষ্টা করেছিল তাকে ধরে রাখার। মানুষটা তো তার স্বামী! স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত এটা মেনে নেওয়া একটা নারীর জন্য কতটা যন্ত্রনার তা হয়তো সেই বোঝে যার সাথে এমনটা হয়। কতই না যন্ত্রণাদায়ক ছিল সে চিৎকার। আমার বাবা চলে গেলেন। আমি তখন বুঝতে পারিনি এসব তবে মায়ের অর্তনাদ আর আপার কান্না দেখে বুঝেছিলাম খারাপ হয়েছে কিছু, আমাকেও কাঁদতে হবে। আপার সাথে বসে বসে আমিও চোখের জল ফেলেছিলাম। আপাকে বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেছিলাম,

‘আপা। বাবা কই? মা কেন কান্দে?’

উত্তরে আপা হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,

‘বাবা গেছেগারে পুতুল। বাবা আর আসবো না আমগো কাছে।’

বাবা কেন গেছে এসব বোঝার বয়স আমার ছিল না। তবে বাবা আর আসবেনা শুনে মন খারাপ হয়েছিল। এবার ঈদের জামাটা তাহলে আর পাব না ভেবে ভিষণ রকম মন খারাপ হয়েছিল। বাবা বলেছিল এবার ঈদে লাল রানী ফ্রক কিনে দিবে। পাশের বাড়ির ফুলির সুন্দর একটা ওমন ফ্রক আছে। পড়লে কি যে সুন্দর লাগে! গোল গোল করে ঘুরলে ফ্রকটাও ঘোরে। মন খারাপ করে চুপচাপ বসে ছিলাম আপার পাশে। কিছুক্ষণ পর পর অবুঝ চোখে চেয়ে চেয়ে আপার কান্নায় ফুলে যাওয়া মুখটা দেখতাম। আপনাকে আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি।

বাবার আমাদের ফেলে যাওয়ার কথাটা রটাতে খুব একটা দেরি হয়নি। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বেই পুরো গ্রাম জেনেগিয়েছিলো এ কথা। জনে জনে এসে শান্তনা দিয়ে গিয়েছিল মাকে। কতেক মানুষ দুঃখ নিয়ে আফসোস করেছিল আমাদের ভাগ্য নিয়ে। কেউবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

‘এরম ভাগ্য নিয়ে কেন জন্মাইলিরে মাইয়া। এর থেকে ভালো হতো যদি জন্ম নাই নিতি।’

আমি কিছু বুঝিনি তখন। কেবল ডগর ডগর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতাম। অনেকে এসে বলতো,

‘যা হইসে ভালো হইছে। ওমন ব্যাডা মানুষের সাথে সংসার করবার থেইকা একলা মাইয়া দুইডারে নিয়া থাক। তিনটা প্যাট এরকাছে ওরকাছে চাইয়া ঠিক চইলা যাবে।’

অন্যজন কথায় সমর্থন করে বলতো,

‘আমরা তো আছি। চিন্তা কেন কর?’

কিন্তু এসকল কথা কেবল শান্তনা ছিল তা দুদিন না যেতেই প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। বাবা যাওয়ার পর থেকেই মা কেমন যেন হয়ে যায়। কথা বলে না। খায় না। চুপচাপ ঘরে শুয়ে থাকে। আপা ঘরের সব কাজ করা শুরু করে। ঘরে চাল ছাড়া সবজি ছিল না। পরপর দুদিন পাশের ঘরের কাকিমার কাছ থেকে আলু চেয়ে আনায় সে ভিষণ বিরক্তি নিয়ে আপাকে বলেছিল,

‘আলুকি আমি তোদের জন্য কিইনা রাইখা দিছি? নাকি তোগের ক্ষেতের আলু তুইলা রাইখা দিছি যে রোজ রোজ নিতে আসিস। এই শেষ কিন্তু। আর যেন আসিস নে।’

আপা সেদিন চোখমুখ ফুলিয়ে ঘরে এসেছিল। নিরবে নিজের ঘরে মেয়ে চাপা আর্তনাদ করে কেঁদেছিল। মা হয়তো বুঝেছিল। এরপর থেকে মা টুকটাক বাজার করত জমানো টাকা দিয়ে। মায়ের খুব সখ ছিল আপার ধুমধাম করে বিয়ে দিবার। এজন্যই তো বাবার অগোচরে টুকটাক করে কিছু টাকা ভাঙ্গা মাটির ছোট কলসইটআর মধ্যে জমা করে রেখেছিল। বাবার জন্য মন খারাপটা আমার কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে গেলেও আমার মা আর আগের মতো হলো না। আগের মতো আমার চুলে তেল দিয়ে ঝুটি করে দিত না আর। না মিষ্টি করে হেসে বলত,

‘আমার আম্মাটারে চান্দের মতোন লাগতাছে।’

আপার পড়াশোনাটাও বন্ধ হয়ে গেল। ছোট আমি তখন কেবল ক্লাস থ্রিতে পরি। বিনা বেতনে হওয়ায় বোধহয় আমার পড়াশোনা ঐ শিশুকালে বন্ধ হয়েছিল না। রোজ সন্ধ্যায় আপা আমাকে পড়াতে বসতো। ঘুমের সময় মাথা বিলি কেটে গল্প শোনাত। আপার গল্পে এক রাজকুমার ছিল যে কিনা অসহায় গরীব এক কৃষকের মেয়েকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করত। আমি কৌতুহল হয়ে বলতাম,

‘আমাদের জন্যিও কি রাজকুমার আসব আপা?’

আপা একগাল হেসে বলত,

‘আলবত আসব।’

———————-

অনেকদিন বাদে মুরগি রান্না হচ্ছে। নাকে ঘ্রাণ লাগতেই দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম।

‘গোসত রান্না করতাছ মা?’

‘হ। তোর মামায় আসতাছে।’

মামা আসবে শুনে খুব একটা খুশি হলাম না। মামা আসলেই বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়। মা কাঁদে। তাই মামাকে আমার একদম পছন্দ হয় না। মন খারাপ করে মাঠের দিকে গেলাম। একবার কি ফুলির বাড়িতে যাব? আজ এখনো যে খেলতে আসলো না? কিন্তু ফুলির বাড়িতে গেলে ফুলির মা কেমন করে যেন তাকায়। খাওয়ার জিনিস লুকায়। আমি কি খাইতে চাই? মন খারাপ হলো খুব।

কেটে গেল আরো কিছু দিন। একদিন বিকেলে হঠাৎ করে আপা আমাকে খুব উচ্ছাস নিয়ে বলল,

‘আমাদের আর কোনো কষ্ট থাকবোনারে পুতুল। অনেক বড় বাড়ি থেইকা বিয়ার প্রস্তাব আনছে।’

আপার মুখের হাসি দেখে আমিও খুশি হয়েছিলাম। আপা কখনো মিথ্যা বলে না। আপা যখন বলছে আমাদের দুঃখ থাকবে না তাহলে সেটা সত্যি হবে। কিন্তু কৌতুহল মনে প্রশ্ন করেছিলাম,

‘কার বিয়া আপা? আমিতো এখনো ছুটো।’

আপা একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমার গালে হাত রেখে বলেছিল,

‘তোর বিয়া কেন হবেরে! আমার জন্যি আইসছে।’

আমি তখন আপাকে বলেছিলাম,

‘লোকে যে কয় তুমার আগে আমার বিয়া দিয়ন লাগবে। তুমার থেইকা আমার সুরাত সুন্দার।’

আপার মুখ মলিন হয়ে এসেছিল আমার কথায়। আমার আপার গায়ের রং আমার থেকে চাপা। তাই বলে অসুন্দর নয়। আমার বাবার গায়ের রং ও ওমন। আমি আমার মায়ের মতো হয়েছি এমনটাই সবাই বলে। কিন্তু আমার আপা অপছন্দ করার মতো না। তার রূপের জন্য কেউ তাকে ঠেলে ফেলতে পারবে না। সেদিন আপা উদাস গলায় বলেছিল,

‘তুই তো রাজকন্যেরে পুতুল। তোর জন্যি কোনো রাজপুত্তুর আইসব দেখিস। তোর এর থেকিন ও বড় ঘরে বিয়ে হইব দেখিস। তুই অনেক সুখি হবি।’

দুদিন বাদেই আপাকে দেখতে আসে পাশের গ্রাম থেকে। ছেলের বড় ব্যাবসা আছে। ভিটে বাড়ি ও বিশাল। সব মিলিয়ে আমাদের থেকে অনেক বড় তারা। মা সম্যতি দিতে চাচ্ছিল না। ঘটক কাকাকে পাশে ডেকে মা বলেছিল,

‘উনাদের সাথে আমাগে যায়না ভাই। সমানে সমানে আত্মীয়তা করতি হয়। আমগো সামত্ত নাই তাগে সাথি সম্মন্ধ করার।’

কিন্তু ঘটক কাকা হেসে ও কথা উড়িয়ে দিয়েছিল। মাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল,

‘কি যে কন ভাবী। ওসব লাকতোনা তো। কিচ্চু লাকব না। হেতিরা খালি আপনের মাইয়ারে নিব। আর কিছুই হেরা নিত না। আপনে একদম চিন্তামুক্ত থাকেন। আমিতো আছি নাকি!’

মায়ের মন তবুও অশান্ত ছিল। অজানা কোনো কারণে মায়ের মুখ আঁধারে তলিয়ে ছিল। তারা চলে গেল। আপাকে তাদের পছন্দ হয়েছিল। আপার ও এ বিয়েতে সম্মতি ছিল। একজন্যইতো আপার মুখে সবসময় একটা লাজুক হাসি দেখা যেত। আপার মুখের হাসি দেখেই হয়তো মা এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল। আমার তখন এত কিছু বোঝার বয়স ছিল না। আপার বিয়ে হবে এই খুশিতে নেচে গেয়ে দিন যাচ্ছিল। একমাসের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল আপার। মা যথেষ্ট চেষ্টা করেছে তাদের যত্ন করার। অনেক টাকা ধার করতে হয়েছিল আপার বিয়েতে। আমার পছন্দের রুপার নূপুরটাও মা বিক্রি করে দিয়েছিল কয়েকটা টাকার জন্য। নূপুরটার জন্য দু বেলা না খেয়েও থেকেছি। মা তখন বলেছিল,

‘এমন করতি নেই আম্মা। তুমার আপার জন্যি এটুকু তুমি করতি পারবা না? তুমার বিয়ার সময় আমি তুমারে আরো অনেক কিছু বানাই দেব। এখন আসি ভাত খাওতো কডা। মুখটা একটুকুনি হই গেয়ে।’

জবাবে আমি বলেছিলাম,

‘আপায় বলছে আমার জন্যি নাকি রাজপুত্তুর আসব?’

‘হ আম্মা। তুমার জন্যি দূর দেশ থেকি রাজপুত্তর আসব।’

মায়ের কথায় সন্তুষ্ট হয়েই তবে ভাত মুখে নিয়েছিলাম। আপার বিয়ে হয়ে গেল। আপার সাথে আপার শশুড় বাড়ি গিয়েছিলাম। বিশাল বড় বড়ি। বড় গোয়াল ঘর। এতবড় বাড়ির বউ আপা ভাবতেই ভিষণ খুশি হয়েছিলাম। এবার গ্রামে ফিরে ফুলিকে আপার শশুর বাড়ির অনেক গল্প শোনাবো। কিন্তু আমার খুশি খুব বেশিক্ষণ স্থায়ি হলো না। দুলাভাইয়ের অসহ্যরকম ছোঁয়ায় ছোট্ট আমি চোখ মুখ কুঁচকে নিয়েছিলাম। আমায় আদর করে কাছে ডেকে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অ*শ্লীল ছোয়ায় ভরিয়ে দিয়েছিল। ছোট আমি কাউকে একথা না বললেও বুঝে নিয়েছিলাম দুলাভাইয়ের থেকে দূরে থাকতে হবে। লোকটা একদম ভালো না। আমার আপার জামাই খারাপ মানুষ এটা ভাবতেই ভিষণ মন খারাপ হয়েছিল। মন খারাপ নিয়ে আপাকে বলেছিলাম,

‘আপা বাড়ি চল। এইখানে ভালো লাগে না। আমাগে বাড়িই ভালো। আমরা তিনজনে একসাথ থাকব সেইটাই ভালো। এই বড় বাড়ি আমগোর বাড়ির মতো ভালো না।’

জবাবে আপা হেসেছিল। বলেছিল,

‘এই বাড়িই এখন থেইকে আমার বাড়িরে পুতুল। এখন থেইকে এই বাড়িতেই থাকব আমি। তোর যখন ইচ্ছা হইব আসবি। আমরা একসাথে অনেএএক গল্প করব।’

আমার মন খারাপ হয়েছিল। আপা এখন থেকে এই খারাপ মানুষটার সাথেই থাকবে। সে যদি আপাকেও আমার মতো ব্যাথা দেয়? এসব ভাবতেই চোখ ভিজে উঠেছিল।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে