প্রণয় কাব্য পর্ব-০২

0
558

#প্রণয়_কাব্য
#লাবিবা_আল_তাসফি

২.

আপার বিয়ের মাস পেরোতেই তার শশুর বাড়ির লোকেরা তাদের আসল রূপ দেখাতে শুরু করেছিল। ভালো মানুষের মুখশের আড়ালে তাদের কুৎসিত রূপটা কারো নজরে এসেছিল না। এসব দুই রূপের মানুষগুলো হয় খুব ভয়ংকর। তাদের ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়া ভার! আমার আপাও পায়নি মানুষরূপী পিশাচগুলোর কবল থেকে।

হঠাৎ করেই একদিন আপা কল করে খুব কান্নাকাটি শুরু করল। মা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বারবার জিজ্ঞাসা করার পরও আপা কোনো সঠিক জবাব দিয়েছিল না। আমার আপাটা এমনই। সহজে মুখ ফুটে কিছু বলে না। আমার বোনটা মুখ ফুটে তার কষ্টের কথা বলতে পারেনি। কেবল বলেছিল,

‘তোমগো খুব মনে পরে মা। পুতুলটারে খুব দেখবার মন চায়।’

মা ও আপার এই মিথ্যা কথাকেই সত্যি ভেবে নিয়েছিল। ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো সত্যিই তাদের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। মা আদুরে গলায় বলেছিল,

‘তবে আয় না! একটু ঘুইরা যা। আমরাও তো তরে কতদিন দেখি না। পুতুল খালি তোর কথা কয়। জামাইরেও সাথে করি নিয়া আয়।’

আপা হয়তো বেদনার হাসি হেসেছিল। বলেছিল,

‘আসবনি মা। তোমার জামাই মেলা ব্যস্ত জানোই তো। তিনার সময় হইলেই আসব।’

আরো কিছু টুকটাক কথা হয়েছিল হয়তো সেদিন। আমি ঘুমে ছিলাম বলে আমার সাথে কথা হয়নি। তার দশদিনের মাথায় আপা আসলো। দুলাভাই আসেনি সাথে। আপাকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম সবাই। চোখ কেমন গর্তে চলে গেছে। শুকিয়ে কি অবস্থা। খাওয়া দাওয়া হয়তো করেনা ঠিক করে। কপালে কাটা দাগ। নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট। আপাকে এভাবে দেখে মা ঝাপটে ধরে কান্না শুরু করেছিল। বারবার বলছিল,

‘আমার মা-ডার এইডা কি অবস্থা। কি হইলো আমার আম্মার। এমন দেখায় কেন তরে মা।’

আপা শক্ত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ঠোঁট টেনে হেসে বলছিল,

‘কিচ্চু হয়নায় মা। দেখ বাইচা আছি আমি। এখনো শ্বাস নিতাছি।’

আপার আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না। মা বুঝে নিল তার মেয়ে কতখানি সুখে আছে। এই সুখ দেখার জন্যই হয়তো সে তার মেয়েকে অমন বড় বাড়িতে বিয়ে দিয়েছিল! আসলে সুখ আমাদের মতো মানুষের জন্য না। আমাদের জন্ম হয়েছে কেবল দুঃখকে আলিঙ্গন করার জন্য।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে মা আপার মাথায় বিলি দিয়ে দিতে দিতে সব জিজ্ঞাসা করলে আপা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। আপা জানায় তার শাশুড়ি তাকে প্রতিদিন বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ার জন্য বলে। সেই টাকা দিয়ে দুলাভাইয়ের নতুন ব্যাবসা দায় করাবে। প্রথম প্রথম নরম ভাবে বললেও বেশ কিছুদিন হলো খুব খারাপ ব্যাবহার করে। দুলাভাই গায়ে হাত তোলে আপা টাকার কথা না বলায়। আপার শশুর ও আপার গায়ে হাত তোলে। খাবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিন বেলার একবেলা খাবার মেলে। বাকি দু বেলা এক গ্লাস পানি খেয়েই কাটাতে হয়। এমন কথা শোনার পর মায়ের মন আর ঠিক থাকে? মা তার পরদিনই এর ওর হাতে ধরে কিছু টাকা ধার করে। আমার জন্য বাঁচিয়ে রাখা গহণাটুকুও বিক্রি করে মোট ত্রিশ হাজার টাকা জোগাড় করে আপার হাতে দেয়। আপার সে কি কান্না। আপা ঐ টাকা নিতে চায় না। আর্তনাদ করে বলে,

‘ওরা জানোয়ার মা‌। এই টাকাতেও ওদের ক্ষিদা মেটবে না। ওরা আরো চাইব। আমার সাথে তোমগোরেও শেষ করে দেবে মা। আমার পুতুলটার জন্যি এই টাকা রাখো।’

আপার সাথে সাথে মা ও সেদিন অনেক কেঁদেছিল। একপ্রকার জোর করেই মা টাকাগুলো দিয়ে পাঠিয়েছিল। এরপর সব ভালোই চলছিল। আপার সংসারে অশান্তি ছিল না। মা ও খুশি ছিল। আমি আর কখনো আপার শশুর বাড়ি যাইনি। ছোট ছিলাম তবুও কেন যেন দুলাভাইকে দেখলেই গা গুলিয়ে আসতো। লোকটার কাছ থেকে সবসময় দূরে দূরেই থাকতাম।

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল কয়েকটা বছর। আমি এখন প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পার হয়ে হাইস্কুল উঠেছি। মা গ্রামের জমিদার বাড়িতে টুকটাক কাজ করে। ও বাড়ির গিন্নি ভিষণ ভালো মানুষ। মা যে তার বাড়ির কাজের মহিলা এমনটা ভাবতেই দেন না কখনো। আমি পড়াশোনায় ভালো হওয়ায় তিনি আমার পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি। পড়াশোনার খরচের টাকা তিনিই দিন। আমি এখন চঞ্চল এক কিশোরী। বনে বাদারে ঘুরে বাদাম কুড়ানো, বিল থেকে আঁচলে ছেঁকে মাছ ধরা এগুলো আমার নিত্যদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো বা পাশের বাড়ির ফুলিকে সাথে নিয়ে হরি কাকার বাগান থেকে ফল চুরি করে খাওয়া। এর জন্য অবশ্য মায়ের হাতে বেশ ভাল পিটুনি খেতে হয়েছে। ঐ বজ্জআত হরি চাচা কিছু হলেই নালিশ নিয়ে আসে। বলি দু একটা ফল পারলে কি এমন ক্ষতি হয়? পুরো বাগানটাতো আর নিয়ে নিচ্ছি না।

——————-

এক উজ্জ্বল ঝলমলে সকাল। সকালের ঘুম রোজকারের মতো মায়ের গালমন্দ শুনেই ভাঙলো।

‘এমনে পরে পরে ঘুমোলে চলব? উঠতো তাড়তাড়ি করি। তোর মানতি মাসির কাছ থেকি পাঁচ কেজি কাঁচা ভালো দেখি আম নিয়ে আয়।’

‘এই সক্কাল সক্কাল আম দিয়ে কি করবা?’

ঘুমে এখনো ঢুলছি। এই বুঝি পরে যাব যাব ভাব। মা কিসব শুকন মসলা গুঁড়া করছে। ঘ্রাণে পেট ফেরে আসতে চাইছে। মা কাজ করতে করতেই উত্তর দিল,

‘তিহান বার বার করি বলল আঁচারের কথা। ছেলেটার জন্যি একটু আঁচার না বানানো পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিনে। চাঁদ খানা টুকরো ছেলে। মুখ ফুটি বলিতে এই তো অনেক।’

‘পরের ছেলের অত কদর না করি আমার দিকে একটিবার দেখলিও তো পার।’

‘অমন রত্ন যদি পেটে ধরতাম তাইলে আলবত কদর করতাম। এখন যা দেখি। কাঁচা বেত পিঠে পড়বার আগে যা। নয়তো পা ধরলিও কিন্তু কিচ্ছুটি হবে না।’

‘রত্ন না ছাই।’

কথাটা মুখেই রয়ে গেল। বের করার সাহস হলো না। বাধ্য হয়েই বিছানা ছেড়ে নামলাম। নয়তো সত্যিই পিঠে বেত পড়লো বলে। কলপাড় থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে টিনের ঢালা থেকে এক মুঠো মুড়ি নিয়ে চললাম বিনু মাসির বাসায়। হরি কাকা এ সময় বাড়িতে না থাকলেই হলো। কালযে বেটার বাগান থেকে পেয়ারা নিয়েছি ধরতে পারলে শেষ।

——————–

গ্রীষ্মের ছুটি শেষ। স্কুল খুলেছে। মন আনন্দে নেচে উঠলো। তাড়াহুড়ো করেই তৈরি হয়ে বের হলাম। মওড়এর ধারের চায়ের দোকানের কাছে আসতেই চোখাচোখি হলো তিহান ভাইয়ের সাথে। পাশেই তার দামি সাদা রঙের গাড়ি। বাজারে এত দোকান থাকতে উনার এখানেই কেন চা খেতে আসতে হয় বুঝিনা। চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেই বাজখাঁই গলার স্বরে পা থেমে গেলো।

‘এক পা ও সামনে আগাবি না।’

ঢোক গিলে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তিহান ভাই ততক্ষণে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন।

‘দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলি কেন?’

আমি চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বললাম,

‘এমাআআ তা কখন করলাম?’

তিহান ভাই ভ্রুকুচু করলেন। কিছুটা এগিয়ে এসে বললেন,

‘তবে কথা বললি না কেন?’

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উত্তর বা কি দিব? তিহান ভাই নিজ থেকেই বললেন,

‘এখন থেকে দেখা হলে যদি কিছু বলার নাই থাকে তাহলে সুন্দর ভাবে সালাম দিবি কেমন? মনে থাকবে?’

আমি‌ উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালাম। তিহান ভাই সরে দাঁড়াল। তারমানে আমি এখন যেতে পারি। এই মানুষটার আমার সাথে কিসের এত দ্বন্দ্ব জানিনা। যখনি দেখা হয় তখনই কোনো কারণ ছাড়া শাসন করবে,ভয় দেখাবে। আবার কিনা তার সাথে কথাও বলতে হবে! আসছে আমার মহারাজা, দেখা হলেই কথা বলতে হবে, হুহ।

চলবে………..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে