প্রণয়ের রংধনু পর্ব-০৭

0
353

#প্রণয়ের_রংধনু
#পর্ব-৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
হুট করে চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে এসে অনন্যাকে ‘মা ‘ বলে সম্মোধন করায়, বেশ খানিক্টা চমকে উঠে অনন্যা। মেয়েটা তাকে মা বলে ডাকছে কেন? ছাদের উপরে বসে, মিষ্টির এমন আচরন দেখে ফারিশও অবাক বনে যায়। সে দ্রুত পায়ে নীচে চলে যায়।মিষ্টি অনন্যার ওড়না টেনে ধরে খুশি হয়ে বলে, ‘ মা! তুমি ফাইনালি চলে এসেছো! আজ আমি অনেক হেপ্পি মা। জানো আমি কবে থেকে তোমার জন্যে ওয়েট করছি। সবাই বলে, তুমি নাকি আকাশের স্টার হয়ে গিয়েছো, বাট আমি জানতাম, তুমি আসবে। ‘
অচেনা বাচ্চা মেয়েটার কথা শুনে, বুকের ভিতরে চিনচিন করে ব্যাথা করে উঠলো অনন্যার। সে নিচু হয়ে, পরম মমতা নিয়ে মিষ্টির গালে হাত রেখে বলে,

‘ তুমি কে মামনী? কে তোমার মা? ‘

‘ ওমা! মা, তুমি আমায় চিনতে পারছো না কেন? আমি তো মিষ্টি, আর তুমি আমার হচ্ছো এই মিষ্টির মা। ‘

মিষ্টির কথার বিপরীতে, অনন্যা কিছু বলতে নিলে, পছন থেকে ফারিশ এগিয়ে এসে, হাক ছেড়ে ডাকতে থাকে, ‘ মিষ্টি! তুমি ওখানে কি করছো মা? কাম হেয়ার, মাই প্রিন্সেস! ‘

মিষ্টি অনন্যার হাত ধরে, তাকে নিয়ে ফারিশের সামনে দাঁড়িয়ে, হাঁসিমুখে অনন্যাকে দেখিয়ে বলে,

‘ দেখো বাপি! মিষ্টির মা চলে এসেছে। মিষ্টির মা স্টার হয়ে যায়নি। ‘

ফারিশ গম্ভীর গলায় বলে, ‘ মা, উনি তোমার মা নন।’

‘না, বাপি তুমি মিথ্যে বলছো। আমি জানি উনিই মিষ্টির মা। ‘

কথাটি বলেই বেশ শক্ত করে অনন্যাকে জড়িয়ে ধরে রাখে মিষ্টি। যেন সে ছেড়ে দিলেই, অনন্যা পালিয়ে যাবে। অপরদিকে অনন্যা এক ঘোরের মধ্যে অবস্হান করছে, যেন সে বর্তমানের পরিস্হিতি ঠিক বুঝে – শুনে উঠতে পারছে না। বাচ্চা মেয়েটা, ফারিশকে বাপি বলে সম্মোধন করছে, অর্থাৎ মেয়েটির বাবা ফারিশ, তাহলে মিষ্টির মা কোথায়? নিশ্চই সে ফারিশের স্ত্রী, তবে সেই স্ত্রী এখানে নেই কেন? বাচ্চা মেয়েটিই বা হঠাৎ প্রথম পরিচয়ে অনন্যাকে নিজের মা ভাবছে কেন? বেশ রহস্য! জটিল এক রহস্য! যা ভেদ করতে পারছে না অনন্যা। ফারিশ বেশ বিরক্ত হয়েই, স্টাফকে আদেশের সুরে বলে,

‘ এখুনি মিষ্টিকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে, ব্রেকফাস্ট করাও। ‘

ফারিশের আদেশ শুনে স্টাফ বেশ ভয় পেয়ে, মিষ্টিকে জোড় করে অনন্যার থেকে ছাড়িয়ে নিলো। মিষ্টিকে অনন্যার থেকে আলাদা করে নেওয়ায়, মিষ্টি জোড়ে জোড়ে কান্না করতে লাগলো। স্টাফ তবুও জোড় করে,মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো।
মিষ্টি এইভাবে কান্না করায়, অনন্যারও বেশ খারাপ লাগলো, তার উপর ফারিশের উপরও দ্বিগুন রাগ উঠলো! লোকটা নিজের মেয়ের প্রতিও কেন এতো কঠোর? মিষ্টি তার কাছে কিছুক্ষন থাকলে কি এমন হয়ে যেতো?অনন্যা বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো,
‘ হার্টলেস লোক একটা! ‘

অনন্যার সেই কথা ঠিকই কানে এসেছিলো, ফারিশের। ফারিশ তা শুনে, বাঁকা হেসে আপনমনে বলতে থাকে, ‘ ইউ আর টোটালি রাইট মিস অনন্যা! ফারিশ খানের মতো হার্টলেস কেউ নেই, তার প্রতি পদে পদে আপনি টের পাবেন। ‘

_________________________

অভি তার রুমে বসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কোর্ট পরছিলো, হাতে তার সময় বড্ড কাম! বেশ কিছু জটিল কাজ নিয়ে তাকে আজ ক্লাইন্দের সাথে মিটিং এ বসতে হবে। সে জেল নিয়ে চুল সেট করতে নিলে, ভেবে উঠে, অনন্যা এখানে থাকলে কেমন হতো? সে বোধহয় বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষন তাঁকিয়ে থাকতো,যেন জেল দিয়ে চুল সেট করা, তার জন্যে পৃথিবীর এক অন্যতম অদ্ভুদ কাজ। অনন্যা হয়তো বসা থেকেই উঠে দাঁড়িয়েই এসে, অভির সেট করা চুলগুলো এলোমেলো করে দিতো। অভি তখন রাগান্বিত হলেই, ঠোট ফুলিয়ে হয়তো বলতো, ‘ এলোমেলো চুলে বেশ মানায় তোমায় অভি! বেশ সুদর্শন লাগে, তা কি তুমি খেয়াল করে দেখেছো? ‘

অনন্যার কথা ভাবতেই ফিক করে হেঁসে উঠে অভি। তার অনন্যাকে নিয়ে ভাবনাগুলো যুক্তিহীন হয় বরং চিরন্তর সত্য, কারণ তাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে, অনন্যা প্রায় সকাল সকাল অভিদের বাড়িতে চলে আসতো। লুকিয়ে লুকিয়ে এসে , অভির অফিসে যাওয়ার পূর্বে, তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতো। অনন্যার সেই মায়াবী মুখের দিকে তাঁকিয়ে রাগও করতে পারতো না অভি। হেঁসে উঠে, অনন্যাকে জড়িয়ে ধরতো। অভির ভাবনার মাঝেই, কেউ দরজায় নক করে মেয়েলি কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,

‘ আসবো, অভি? ‘

অভি কিছু না ভেবেই বলে আপনমনে বলে উঠে,

‘ উহু! একদম আসবে না অনন্যা। আজ তোমায় আমি আমার চুলগুলো এলোমেলো করতে দিবো না, এবং আজকে তোমার ওই ইনোসেন্ট ফেস ও আমার রাগ গলাতে পারবে না। খবরদার, বাইরে থাকো।’

অভির কথা শুনে জুঁই থমকে দাঁড়ায়। সে এখানে এসে, এমন মুহুর্তে অভির মুখে ‘ অনন্যা’ নামটি আশা করেনি। অভি কিসব বলে যাচ্ছে? সে কি কোনভাবে অনন্যাকে কল্পনা করছে? জুঁই অভির সামনে এসে, অভিকে নিজের দিকে ফিরিয়ে, কঠোর গলায় শুধায়,’ কিসব বলছো তুমি, অভি? তুমি কী কোনভাবে আমাকে অনন্যা ভাবছো? কি করে পারছো তুমি? এখনো তুমি ওই চরিত্রহীন মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছো? যে তোমাকে এতো বাজে ভাবে ঠকিয়েছে। ‘

জুঁইয়ের কথায় হুশ ফেরে অভির। সত্যি সে কি ভেবে চলছিলো এতোক্ষন? সে কিছুতেই অনন্যাকে ভুলে থাকতে পারছে না। অভি থমথমে গলায় বলে,

‘ আমার জরুরী মিটিং আছে জুঁই। তুমি মায়ের সাথে গিয়ে বরং গল্প করো। পরে দেখা হচ্ছে। ‘

অভি কথাটি বলেই একপ্রকার জুঁইকে এড়িয়ে, বেড়িয়ে যায়। অভি বেড়িয়ে যেতেই, জুঁই
‘ অনন্যা,মাই ফুট। ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠে।

__________________

অনন্যা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে, সর্বপ্রথম দেখে বেশ বড় ড্রাইয়িং রুম তার পাশাপাশিই রয়েছে এটাচ করা ডাইনিং রুমের সাথে রান্নাঘর। রুমা খান টেবিলে সবেমাত্র বসেছেন। রুমা খানের ছোট ছেলে খালেদ খান খবরের কাগজ নিয়ে মায়ের পাশে বসে আছেন। খালেদ খানের বউ রেশমি কাজের লোকদের দিয়ে খাবার পরিবেশন করছিলো। খালেদ খানের বড় মেয়ে এনা ভার্সিটি যাওয়ার জন্যে নীচে এসে, সোফায় বসে ব্রেকফাস্ট করছিলো। রুমা খান, রেশমা খানকে প্রশ্ন করে, ‘ সবাইকে দেখছি, আরশ কোথায়? ‘
রেশমা বেশ বিচলিত হয়ে উত্তর দেয়,
‘ আসলে, আরশ কাল অফিসের কাজে বেশ ব্যাস্ত ছিলো। রাত করে বাড়িতে ফিরিছে, এখন ঘুমাচ্ছে।’

‘ ছেলের দোষ আর কত ঢাকবে বউমা? তোমার ছেলে একবারও অফিসে পা দিয়েছে, বিদেশ থেকে আসার পর? অপরদিকে, আমার ফারিশকে দেখো, সারাদিন শুধু অফিস! কাজ ছাড়া সে চলতেই পারে না, আর অন্যদিকে তোমার ছেলে, পার্টি করে টাকা উড়ানো ছাড়া আর করেই বা কী?’

রুমা খানের কথা শুনে মুখ বেকিয়ে, ব্রেডে জেলি লাগাতে থাকে। খালেদ খানও নিষ্চুপ থাকেন।

অপরদিকে, ফারিশ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে, সকলের সামনে দাঁড়িয়ে,

‘ লিসেন এভ্রিবডি! ইউ নিড সাম এটেনশন ফর ইউ। ‘

ফারিশের কথা শুনে, সকলে ফারিশের দিকে তাঁকাতেই, চমকে উঠে। বিশেষ করে খালেদ খান এবং রুমা খান। কারণ তারা লতিফ হাওলাদের মেয়ে, অনন্যাকে যথেষ্ট ভালো করে চিনে। রেশমা খান অন্যন্যাকে দেখে ভ্রু কুচকে বলেন,

‘ এই মেয়ে কে? দেখে তো ভদ্র ঘরের মেয়ে মনে হচ্ছে।’

‘ ও লতিফ ভাইয়ের মেয়ে না?’

খালেদ খানের প্রশ্ন শুনে, ফারিশ বাঁকা হেসে বলে, ‘ হ্যা! দ্যা গ্রেট বিসনেজম্যান, লতিফ হাওলাদারের একমাত্র মেয়ে, যার এখন বর্তমান পরিচয়, ফারিশ খানের পার্সোনাল সার্ভেন্ট! যার কাজ হবে, ফারিশ খানের সেবা – যত্ন করা। আশা করি, সবার কোন আপত্তি নেই, থাকলেও আমার কিছু যায় আসে না।
আমি এই নিয়ে আর কোন কুইশচেন শুনতে চাই না। ‘

কথাটি বলেই, ফারিশ একজন সার্ভেন্ট করিমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে। ফারিশের ইশারা পেয়ে, করিমা অনন্যার কাছে এসে বলে, ‘ আপা আপনে আমার সাথে আসেন। আমি আপনার ঘর দেহাই দিতাছি। ‘

করিমার কথা শুনে, অনন্যা করিমার সাথে তার পিছনে পিছনে যায়। ফারিশও দ্রুত পায়ে উপরের দিকে চলে যায়। বাড়ির সকলের গতিবিধি দেখে অনন্যার মনে হচ্ছে, তারা সকলেই যথেষ্ট ভালোভাবে তার বাবা, লতিফ হাওলারকে চিনে, কিন্তু কীভাবে? কি সম্পর্ক তার বাবার খান বাড়ির সাথে? কিন্তু তার বাবা তো কখনোই, তাকে খান বাড়ি সম্পর্কে বলেনি। না, সবকিছু জানতে হবে অনন্যাকে। বেশ জটিল সবকিছু, কিন্তু সে সবকিছুর রহস্য ভেদ করবেই।

অনন্যাকে, ফারিশ নিজের কাজের লোক হিসেবে নিয়ে আসায়, খালেদ খানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে যায়। এনা খালেদ খানের কাছে এসে বললেন,

‘ বাবা! ওই মেয়েটা কে? লতিফ খানই বা কে? ‘

মেয়ের কথা শুনে, রেশমি খানও তার স্বামীকে প্রশ্ন করে, ‘ ফারিশের কথা শুনে, মনে হলো বড় লাটসাহেবের বেটি, কিন্তু সে ফারিশের কাজের লোক হয়ে এই বাড়িতে এলো কেন?’

খালেদ খান বিরক্ত হলেন তাদের প্রশ্নে। রুমা খান বললো, ‘ তোমরা মা – মেয়ে চুপ থাকবে? এতো কৌতহূল ভালো না। ছোট খোকাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। নিজেদের কাজে করো। ‘

রুমা খান কথাটি বলেই উঠে দাঁড়ালেন। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। কাল ফারিশের কথা শুনেই, সে বুঝতে পেরেছিলো ভয়ংকর কিছু ঘটাতে চলেছে ফারিশ। রুমা খানের চিন্তা হচ্ছে অনন্যার জন্যে। বাবার করা কৃতকর্মের শাস্তি মাঝখান দিয়ে নির্দোশ মেয়েটা পাবে, না তাকে ফারিশের সাথে কথা বলতে হবে।

____________________

ফারিশ ঘরে এসে দেখে, মিষ্টি বিছানায় বসে মুখ কালো করে আছে। ফারিশকে দেখেই, সে এগিয়ে এসে বলে, ‘ বাপি! মা কোথায়? ‘

মিষ্টির কথা শুনে ফারিশ এগিয়ে গিয়ে, পাশে থাকা টেবিলে থেকে দুধের গ্লাসটি মিষ্টির দিকে এগিয়ে বলে,

‘ ফার্স্ট অফ অল! সে আমাদের বাড়ির সামান্য এক কাজের লোক মা, সে তোমার মা নয়। তুমি এইবার গুড গার্লের মতো দুধ খেয়ে নাও মা। ‘

মিষ্টি দুধের গ্লাস টা সরিয়ে, চিৎকার করে বলে,

‘ আমি খাবো না বাপি। আমি কিছুতেই খাবো না। আমাকে বড় গ্রেনি বলেছে, আমি জানি সেই আমার মা। ‘

মিষ্টির কথা শুনে, ফারিশ ধমক দিয়ে বলে উঠে,

‘ একদম অবাধ্য হবে না, মা। আমি যেমন আদর করতে পারি, তেমনি শাসন করতে পারি। চুপচাপ দুধ খেয়ে নিবে। কিছুক্ষন পর চিটার আসবে। আমি যেন তোমার মুখে এইসব কথা আর না শুনি। ‘

কথাটি বলেই, রেগে বেড়িয়ে যায় ফারিশ। ফারিশের থেকে বকা খেয়ে, মিষ্টি জোড়ে জোড়ে কান্না করা শুরু করে।

অপরদিকে, করিমা বাড়ির শেষ প্রান্তের একটি স্টোর রুমে নিয়ে আসে অনন্যাকে। অনন্যা অবাক হয়ে যায়, এতো বড় বাড়িতে তার ঠায় হলো, পুরাতন এক স্টোর রুমে? করিমা মাথা নিচু করে বলে,

‘ বড্ড খারাপ লাগতাছি আপামনি। আমাদের কাজের লোকেদের রুমও এর থেইকা ভালো। জানি আপনার কষ্ট হবে, কিন্তু কি করার বলেন? ফারিশ স্যারের হুকুম বলে কথা, অগ্রেহ্য করতে পারি না। ‘

অনন্যা করিমার কথা শুনে, আলতো হেঁসে জবাব দেয়, ‘ সমস্যা নেই, আই ইউল মেনেজ। আমি ঠিক থাকতে পারবো। তুমি পারলে একটা ঝাড়ু জোগাড় করে দাও। আমি রুমটাকে পরিষ্কার করে দিবো। ‘

করিমা মাথা নিচু করে ‘আইচ্ছা’ বলে যায়। করিমা চলে যেতেই, অনন্যা স্টোর রুমের দরজা খুলে, সেখানে প্রবেশ করে। স্টোর রুম বেশ অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মাঝে, হঠাৎ এক পুরুষের অবয় দেখে সে চমকে উঠে।

চলবে কি?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে