পূর্ণিমা_সন্ধ্যায় পর্ব_৩৬

0
820

পূর্ণিমা_সন্ধ্যায়
পর্ব_৩৬
#লেখিকাTasneem Tushar

আদনান ঘরে পায়চারি করছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ চিন্তিত। আদিলকে বাসায় ফিরতে দেখেই সে আদিলের রুমের দিকে ছুটে যায়। আদিল আদনান কে দেখে হেসে বলে,

“কিরে? কেমন আছিস?”

“এই তোর আসার সময় হলো? কই ছিলি তুই গতকাল? আম্মু পাগল প্রায়, আর বাবা তো পুরোই ক্ষেপে আছে। তোর না সুহানির সাথে দেখা করার কথা। করেছিস?”

“আদনান, তুই একটু বোস। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে বলছি।”

“তুই এত শান্ত আছিস কিভাবে বলতো?”

আদিল মুচকি হেসে হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে বলে,

“তুই ও একটু শান্ত হ। আমি এক্ষুনি আসছি। বাবা বাসায় আছে নাকি সেটা বল।”

“হুম আছে।”

“তাহলে একটা কাজ কর। বাবা, আম্মু আর আপুকে নিয়ে একসাথে বস। আমি এক্ষুনি আসছি।”

“হঠাৎ? কেন?”

“তোকে যা বলছি তাই কর। আমি আসলেই জানতে পারবি।”

*“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন


মুজদাহীর পরিবারের সবাই লিভিংরুমে জড়ো হয়েছে। নাদিম মুজদাহীর ভীষণ ক্ষেপে আছে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিবে। নওরীন মুজদাহীরের কান্নাকাটি থেমেছে কিন্তু তিনিও ছেলের উপর রাগ করেছে ভীষণ। আদিলের উপস্থিতিতে সবাই নড়েচড়ে বসেছে। আদিল সবার আগে যেয়েই নওরীন মুজদাহীরকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“আমি খুব দুঃখিত মা। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি। বিশ্বাস করো আমি নিজেও অনেক কষ্ট পেয়েছি। কথা দিচ্ছি আর কষ্ট দিবোনা। এবার হাসো।”

নওরীন মুজদাহীর এতক্ষন অভিমান করে থাকলেও আদিলের কথায় আর রাগ করে থাকতে না পেরে আদিলের কপালে চুমু খেয়ে বলে,

“আমি জানিত আমার ছেলের পাগলামি করার পেছনে নিশ্চই কোনো কারণ আছে। কি হয়েছিল তোর বল তো আমাকে।”

“তোমাকে না বললে কাকে বলবো মা?”

নাদিম মুজদাহীর খেঁকিয়ে কেশে উঠে রাগিত কণ্ঠে বলে উঠে,

“মা ছেলের আদিখ্যেতা বাদ দিয়ে, এখন আসল কথায় আসো। সুহানির সাথে দেখা হয়েছিল? পছন্দ হয়েছে তোমার? আমি চাইছি আলিয়া আর তোমার বিয়ে একই সময়ে সম্পন্ন করতে।”

এবার আদিল সবার সামনে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে এসে বলে,

“সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, বিশেষ করে বাবাকে; আমি সুহানি কে বিয়ে করতে পারবোনা। আমি…”

আদিল কথা শেষ করতে না করতেই নাদিম মুজদাহীর গর্জে উঠে বলেন,

“তোমার এত সাহস আসে কোত্থেকে? আমার কথার বাইরে তুমি কথা বলছো? সুহানিকেই তোমার বিয়ে করতে হবে।”

“বাবা… আমার কথা তো শোনো।”

“যত নষ্টের মূল এই আদনান। সেই তোমার মাথা নষ্ট করছে তাইতো? শোনো আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি সুহানির সাথেই তোমার বিয়ে হবে। আমি ডাঃ সামির কে কথা দিয়ে দিয়েছি। আমি চাই আলিয়ার বিয়ের দিনই তোমার বিয়ে হবে।”

“বাবা.. এখানে আদনান কিছু করেনি। ওকে কেন দোষ দিচ্ছ বাবা? আমি নিজে থেকেই বলছি আমি সুহানিকে বিয়ে করতে চাইনা। আমি অন্য একজন…”

“মুখে মুখে তর্ক করাও শিখেছ এখন তাহলে? আমি যেটা বলেছি সেটাই ফাইনাল।”

তারপর একটু শান্ত হয়ে নাদিম মুজদাহীর আবার বলে উঠেন,

“তোমরা আগেই জানো যে আমি ডাঃ সামিরের সাথে একটা বিজনেসে যোগ করছি আর সেটা শুধু মাত্র সম্পন্ন হবে যদি তুমি সুহানিকে বিয়ে করো। আমি এর কোনো হেরফের চাইনা। তুমি আমার একমাত্র যোগ্য সন্তান। আশা করছি তুমি আমাকে আমার বন্ধুর কাছে ছোট করবেনা। আর আমি যা করছি আমার পরিবারের ভালোর জন্যই করছি। তোমাদের জন্যই তো করছি। আর হ্যাঁ, তোমার মুখে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না সুহানিকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে। নতুবা এর জন্য শাস্তি ভোগ করবে আদনান।”

আদিল চমকে যেয়ে বলে উঠে,

“বাবা, আদনান তো কিছু করেনি। ওকে কেন টানছো?”

“দেখো কথা বাড়িও না বেশী। যদি আমার অমত হও তাহলে জেনে রেখো, শাস্তি স্বরূপ আদনানকে আমি ত্যাজ্য করে দিবো। এখন ভেবে দেখো তুমি সুহানিকে বিয়ে করবে কি করবে না।”

আদনান এতক্ষন চুপ থাকলেও এবার কথা না বলে পারেনা। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠে,

“সত্যি বাবা আমি ভীষণ অবাক হচ্ছি তোমাকে দেখে। তুমি খুব ভালো করে জানো ভাইয়া আমাকে ভীষণ ভালোবাসে… তাই এভাবে আমাকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছো ভাইয়াকে?”

তারপর আদিলের পাশে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে বলে,

“ভাইয়া… আমার কথা ভাবিস না তো। ত্যাজ্য করলে করবে। আর করলে তো আরো ভালো, এই নরক থেকে বেঁচে যাবো। বাবা যে আমাকে ভালোবাসে না সেটা তো অনেক আগেই বুঝেছি, আর আজ তার প্রমাণ মিললো। কিন্তু আমার জন্য তুই নিজের সুখ বিসর্জন দিবিনা। এই প্রথম তুই নিজের কোনো ইচ্ছের কথা বলেছিস। সারাটা জীবনই তো বাবার ইচ্ছায় সব করলি, এবার না হয় নিজের মনে যা চায় তাই করলি।”

এদিকে আদিলের মনে হাইস্পীডে সব চিন্তা ভাবনা ঘুরছে। কিছুক্ষন চিন্তার হাইওয়ে তে ছুটোছুটি করে শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার বাবাকে বলে উঠে,

“বাবা… আচ্ছা, তুমি যা বলবে তাই হবে। তবে বিয়েটা আমি এত তাড়াতাড়ি করতে পারবোনা। আমার একটু সময় লাগবে। আলিয়া আপির বিয়েটা হয়ে যাক। এর মাঝে আমি নিজেকে একটু তৈরি করি।”

“দ্যাট’স লাইক এ গুড বয়। থ্যাংক ইউ মাই সান।”
“আমি জানতাম তুমি পরিবারের জন্য কোনটা ভালো, সেটা বুঝতে পারবে।”

নাদিম মুজদাহীর প্রচন্ড খুশি হয়েছে। আদিলকে জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপড় দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে তাকিয়ে বলে,

“আলিয়ার বিয়ের তারিখ সামনের মাসেই ঠিক করা হোক। আর আদিল, আদনান ও নওরীন তোমরা আয়োজন শুরু করে দাও বিয়ের। মেয়ের বিয়েতে আমি কমতি রাখতে চাইনা। আর আদিল, যাও তোমাকে এই একমাস সময় দেয়া হলো সুহানির সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ার।”

কথাগুলো সেরেই নাদিম মুজদাহীর প্রস্থান করে বসার ঘর। বাকি সবাই আদিলের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নওরীন মুজদাহীরের চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। আলিয়া ও আদনান নির্বাক। আদিল সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ছলছল চোখে কিন্তু ঠোঁটর কোণে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলে,

“কি হলো এভাবে বসে থাকলে হবে? দেখে তো বিয়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। উঠো, চলো সবাই বিয়ের আয়োজন শুরু করি।”

বলেই আদিল তার নিজের রুমে চলে যায়। পেছন পেছন আদনানও যায়। আদিল নিজের রুম অন্ধকার করে বারান্দায় ইসি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আর ভাবছে কি বলবে তিয়াশাকে? ওর কিইবা করার ছিল? নিজের সুখ চাইতে গিয়ে যে ভাইকে বাবার আক্রশে পড়তে হবে সেটা তো সে বুঝেনি। বাবা বেশ ভালো করেই জানে আমি এই পরিবারকে কখনো খণ্ডিত হতে দিবোনা। কিন্তু এখন কি উপায়? তিয়াশাকে যে বললাম আমার উপর ভরসা রাখতে। এখন মেয়েটাকে সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে এসে সেই স্বপ্ন ভাঙব কি করে?

“ভাইয়া”

আদনানের ডাকে সংবিত ফিরে আদিলের। আদিল আদনানকে দেখে হকচকিয়ে উঠে মুখ লুকিয়ে চোখ মুছে হেসে বলে,

“কিরে এখানে কি করছিস?”

“তুই কি কাউকে পছন্দ করিস?”

“এই প্রশ্ন কেন করছিস?”

“সোজাসুজি বল।”

“আজ থেকে আর করবো না।”

“যা বুঝার আমি বুঝেছি। তুই সুহানিকে বিয়ে করবিনা। এই আমার শেষ কথা।”

“পাগলামি করিস নাতো।”

“এবার একটু স্বার্থপর নাহয় হো। আমার জন্য নিজের মনের মানুষকে বিসর্জন দিবি? এটা আমি মেনে নিবো কি করে?”

“আচ্ছা, এবার আমাকে একটু একা থাকতে দে।”

*

তিয়াশার মনটা বেশ ভালো আজ। কখনো কল্পনা করেনি তার জীবনে কেউ আসবে খুশির বার্তা নিয়ে। গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর ভাবছে আদিলকে একটা ফোন দিবে কিনা। ঠিক তখনই আননোন নাম্বার থেকে তিয়াশার ফোনে একটা মেসেজ আসে,

“আদিলের পথ থেকে সরে দাঁড়ান। নতুবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর জন্য দায়ী থাকবেন আপনি।”

তিয়াশার হার্টবিট বেড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ডায়াল করে বসে আদিলের নাম্বারে। আদিল ফোন ধরতেই তিয়াশা বলে উঠে,

“হ্যালো, তুমি কোথায়? তুমি ঠিক আছো তো?”

আদিল গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

“তিয়াশা?”

“হুম। বলোনা কেমন আছো?”

“ভালো আছি। এত রাতে ফোন করলে যে?”

তিয়াশা ভেবেছিল আদিল খুশি হবে, কিন্তু আদিল যেন কিভাবে কথা বলছে। হঠাৎ খেয়াল হয় সে আদিলকে তুমি করে বলে ফেলেছে। সাথে সাথে লজ্জিত বোধ করে। এমন তো হওয়ার কথা নয়, মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। হয়তো সে জন্য গম্ভীর হয়ে কথা বলছে।

“মিঃ আদিল, আমি দুঃখিত, ভুল করে আপনাকে তুমি বলে ফেলেছি। আসলে আমার ফোনে হঠাৎ…”

আদিল তিয়াশার কথা এড়িয়ে বলে উঠে,

“ভালোই করেছ ফোন দিয়েছো। তোমাকে কিছু বলার ছিল।”

“জ্বি, বলুন।”

আদিল এবার শক্ত হয়ে নিজের বুকের তীব্র বেদনা চেপে রেখে শান্ত কন্ঠে তিয়াশাকে বলে বসে,

“মানুষ হাজারটা স্বপ্ন দেখে, কিন্তু তাঁদের সব স্বপ্ন কি পূরণ হয় বলো?”

“বুঝলাম না।”

“আমার সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্নটি বোধহয় স্বপ্ন রয়ে যাবে। যার নিজের স্বপ্ন দেখার অধিকার নেই, সেখানে অন্যজনকে স্বপ্ন দেখানো দন্ডনীয় অপরাধ। তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, নিশ্চই আমার কথার মর্ম তুমি বুঝে গিয়েছ। আমাকে ক্ষমা করো।”

তিয়াশার বুকে কেমন যেন যন্ত্রনা হচ্ছে। গলা ধরে এসেছে। কোথা থেকে যেন আপনাআপনি চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। ফোনের দুপাশেই নীরবতা। আদিলও নীরবে কাঁদছে। সেই নিস্তব্ধতার মাঝে হঠাৎ মেঘের গর্জন জানান দিচ্ছে দুজনের হৃদয়ে হয়ে যাওয়া কষ্টের ঝড়। কিছুক্ষন পর নীরবতা ভেঙে তিয়াশা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

“মিঃ আদিল, ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। যেখানে কোনো কিছুর শুরুই হয়নি সেখানে স্বপ্ন ভাঙার প্রশ্নই আসেনা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনার উপরে আমার কোনো রাগ নেই।”

“তিয়াশা?”

“জ্বি, বলুন।”

“আমরা কি বন্ধু থাকতে পারি না?”

“আমরা কি বন্ধু ছিলাম না?”

“হুম। তুমি এত স্বাভাবিক আছো কিভাবে?”

“ওমা। অস্বাভাবিক হওয়ার মতো কিছু হয়েছে নাকি? আচ্ছা বলুন আপনার বিয়ে হচ্ছে কবে সুহানির সাথে? দাওয়াত পাবো তো?”

“…সময় নিয়েছি। আপির বিয়ে সামনের মাসে।”

“হুম, দাওয়াত পেয়েছি। আদনান বলেছে।”

“আসবে তো?”

“ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা শুনুন এখন রাখি। আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে।”

তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দেয় তিয়াশা। অপরপাশ থেকে আদিলের শেষ কথাটা শোনা হলোনা আর।

ভালোই হয়েছে তিয়াশার আর কষ্ট করে মেসেজের কথা বলতে হলোনা। বরং সেই মানুষটি যা চেয়েছে তাই হয়েছে।

এক সমুদ্র কষ্ট নিয়ে তিয়াশা ও আদিল দুজনই চুপচাপ বসে আছে যার যার বারান্দায়। তাদের নেই কোনো অস্থিরতা। এদিকে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। গাছপালায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনছে আর নির্বাক তাকিয়ে সামনে বৃষ্টির ঝরনাধারা দেখছে। আজ যেন আদিল ও তিয়াশার কান্নাই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে ধরণী তলে।

চলবে…

আগের পর্ব: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/947465892350797/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে