পুকুরের সেই আতংঙ্ক পর্ব-০৪

0
622

#পুকুরের সেই আতংঙ্ক
৪র্থ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

আফসারপুরের প্রাচীন পুকুর ঘিরে যে আতঙ্ক এতদিন বিরাজ করছিল মানুষের মাঝে, একসাথে সেখান থেকে ৪টি মাথাবিহীন কিশোরীর লাশ ভেসে ওঠায় তা মহা আতঙ্কে রূপ নিল। সন্ধ্যার পরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। পুকুরের পাড়ে কেউ এসে দাঁড়ালেই ফকফকে চাঁদের আলোয় পুকুরের মাঝামাঝি পাশাপাশি চারটি লাশ দেখতে পাচ্ছে। পুকুরের পানিও আজ অদ্ভুত রকম ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। কেউই পুকুরে নামার সাহস পাচ্ছে না। পুলিশের লোকগুলোও পুকুরের কিছুটা দূরে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিখোঁজ যাওয়া কিশোরীর পরিবারের লোকেরা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। সকলেই দিশেহারা বোধ করছে। কিন্তু সকালের আগে কিইবা করার আছে তাদের! সময় পেরিয়ে যেতে থাকে, এই বীভৎস দৃশ্য দেখার জন্য মানুষের ভিড় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। একবার লাশগুলোকে দেখেই অবশ্য ভয়ে ছিটকে দূরে সরে যাচ্ছে।

হঠাৎ একটা সি.এন.জি এসে থামলো পুকুরের কাছাকাছি ভিড়ের কাছে। ওটা থেকে দুজন আরোহী নেমে এলো। দুজনেরই গায়ে গেরুয়া পোশাক, মাথায় লম্বা চুল, শরীরে অসংখ্য সুতোর মতো কিছু বাধা। আশেপাশের লোকজন সব কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসলো এদিকে। সি.এন.জির ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ওটা চলে গেল। পুলিশের অফিসার এগিয়ে গেলেন লোক গুলোর কাছে। এরা নিশ্চই তান্ত্রিক!

জালালুদ্দিন মাতবর এবং রশিদ দুজনেই ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে আছেন। এত মানুষের ভিড় পুকুরটার দিকে বাড়ছে দেখেই অনুমান করতে পারছিলেন পুকুরে আবার কিছু একটা ঘটেছে। তারমধ্যে কিছু মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া লাশ শব্দ তাদের কানে পৌঁছেছে। নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারা পুকুরের দিকে এগিয়ে চললেন। প্রতি মুহূর্তে দুজনেই অনুভব করলেন পুকুর থেকে কিছু একটা চাইছে না তারা সামনে বাড়ুক। পায়ে কেমন একটা জড়তা!

চারদিকে কোনো বাতাস নেই। অথচ পুকুরের পানি কোনো একটা উত্তাল নদীর পানির মতোই কাঁপছে। পুকুরের মাঝামাঝি চারটি বাচ্চা মেয়ের লাশ অভাবে দেখে দুজনেরই দম বন্ধ হয়ে এলো যেন। দূর থেকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে ওদের মাথা দাঁড়ালো দাঁত দিয়ে কামড়ে কেউ আলাদা করে ছিড়েছে। রাশেদ জালালুদ্দিন মাতবরের মুখের দিকে তাকালো। ওটা শক্ত হয়ে গেছে। কী একটা ক্রোধে যেন কাঁপছে। তার চোখ দুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে পুকুরের ভেতরে থাকা এমন কিছু যা কারও চোখেই ধরা পড়ছে না। সেও অস্বাভাবিক কিছু একটা যে এই পুকুরে আছে তা অনুধাবন করতে পারছে। হঠাৎ তার মনে হলো লাশগুলোর পাশ থেকে কয়েক জোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন আৎকে উঠল সে।

দুজনেই ঘুরে এলাকার লোকগুলোর কাছে গেল। জালালুদ্দিন বললেন, লাশগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব তুলে ফেলা উচিত। সকলেই কেমন আমতা-আমতা করতে লাগলো। এটাই স্বাভাবিক, সকলে ভয় পেয়ে আছে। পুকুরে যেই অশুভ শক্তিই থাকুক ওটা লাশ গুলোকে নিয়ে কোনো একটা খেলা খেলছে। লাশ যতক্ষণ পুকুরে থাকবে ওটারই লাভ। কেউ পুকুরে এই মুহূর্তে নামতে রাজি নয় বুঝতে পেরে তিনি বললেন আমরা দুজন নামবো। সকলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তান্ত্রিক লোক এরা সাহসী তো হবেই। তবুও কিছুটা আতঙ্কে সকলেরই মন চঞ্চল হয়ে উঠল। এদের কিছু হয়ে গেলে তাদের এই আতঙ্ক থেকে উদ্ধার পাওয়ার ভরসা করার আর কিছুই রইবে না।

গেরুয়া পাঞ্জাবি খুলে এখন তাদের পরনে শুধু লুঙ্গি। নেমে পড়লো দুজনে পুকুরের ঠাণ্ডা পানিতে। গলা-হাত আর কোমরে জড়িয়ে আছে রক্ষা কবজ। রশিদকে সতর্ক করে দিলেন ওস্তাদ, পানির নিচ থেকে কোনো হাতের স্পর্শ বা টান অনুভব করলে উত্তেজিত হবে না। মন্ত্রই রক্ষা করবে তোমাকে। জানে সে। তবুও কিছুটা উত্তেজনা মনে চেপেই রয়েছে।

সাঁতরে পুকুরের মাঝামাঝি চলে গেলো দুজনে লাশ চারটির পাশে। লাশ গুলোর শরীর কাছ থেকে দেখতে আরও ভয়ঙ্কর। শরীর স্পর্শ করতেই রশিদ অনুভব করলো কোনো কারণে শরীরগুলো একটু বেশিই পিচ্ছিল হয়ে আছে। ওস্তাদের দিকে তাকালো, তিনি চোখ ইশারা করে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে পানিতে ডুব দিলেন। বুক ধক করে উঠল তার। প্রায় দুই মিনিট পর জালালুদ্দিন মাতবর পানির উপর ভেসে উঠল। তার কণ্ঠ কাঁপছে, রশিদ দ্রুত লাশগুলোকে নিয়ে পাড়ের দিকে চলো। সঙ্গে দড়ি দিয়ে ছিল লোকগুলো। ওগুলো দিয়েই লাশ চারটির শরীর আটকে দিল তারা দুজন। এরপর একজন সামনে থেকে আরেকজন পেছন থেকে ভেলার মতো করে লাশগুলোকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো পাড়ের দিকে।

পুকুরের কম্পিত পানির স্রোতে খুব একটা কষ্ট করতে হলো না তাদের। তাদের এমন কাজ দেখে অনেকের মনেই সাহস ফিরে এসেছে। ওরা পাড় থেকে লাশগুলো টেনে উপরে তুলতে সাহায্য করলো। পাড়ে তুলে দ্রুত কলা পাতা দিয়ে নগ্ন লাশগুলোকে ঢেকে দেয়া হলো।

ভিজে চুপসে গেছে দুজনেই। সঙ্গে আনা পুটলি থেকে গামছা বের করে গা মুছে পোশাক পাল্টে নিল। উত্তেজিত মানুষের একটা অংশ লাশগুলোকে ঘিরে ভিড় করছে। আর বাকিরা দুই নবাগত সাহসী তান্ত্রিককে। এদের এই কাজটুকুই তারা যে ভণ্ড তান্ত্রিক নয় তার দলিল হিসেবে প্রকাশ পেল সকলের কাছে। জালালুদ্দিন মাতবর বললেন, ‘আমরা দুজন খুবই ক্লান্ত, একটু থাকার ব্যবস্থা করে দেন। আর লাশ গুলোকে দ্রুত দাফনের ব্যবস্থা করেন।’

তান্ত্রিকদের মুখে লেগে থাকা আতংক সকলেই খেয়াল করলেন। পুলিশ জানালেন ময়নাতদন্তের জন্য লাশগুলো নিয়ে যাবেন তারা। জালালুদ্দিন নিষেধ করলেন, বললেন, কোনোই লাভ নেই। আর নিয়ে গেলেও সকালের আগে লাশ গুলোকে যাতে কোথাও না নিয়ে যাওয়া হয়। দাফন করে ফেলাই ভালো। রাতের আঁধারে ওরা বিপদজনক। কিন্তু পুলিশের লোকেরা কিছুতেই তার কথা শুনলেন না। এমনিতেই এই কেসটায় তারা অসংখ্য ব্যর্থতার নমুনা দেখিয়েছেন। তার উপর ভুতের ভয়ে সারারাত লাশ ফেলে রেখেছে দেখলে সকলের কাছে অপদার্থ খ্যাতি পেতে হবে তাদের। দুই তান্ত্রিককে এলাকার মেম্বারের হাতে তুলে দিয়ে বিদায় দিয়ে লাশগুলোকে শাড়ি কাপড়ে মুড়িয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলা হলো। দুজন কনস্টেবল, ভ্যান ড্রাইভার এবং অফিসার চারজন। প্রায় মধ্যরাতে চারটি লাশ নিয়ে রওনা দিলেন থানার উদ্দেশ্যে।

দুই কনস্টেবল পা জড়সড় করে বসে আছেন পাশাপাশি গা লাগিয়ে। এতটা ভয় তারা এই জীবনে আর পায়নি। লাশ চারটিকে পুকুরে ভেসে থাকতে দেখেই তাদের কলজে শুকিয়ে গিয়েছিল। তার উপরে যখন অফিসার বললেন, পুকুরে নেমে লাশগুলোকে তুলে আনতে তখন দুজন প্রায় কেঁদেই দিয়েছিল। হাত জোড় করে অনুনয় করে বলেছিল তাদের ছেলে-মেয়ে আছে বাসায়। এখন পানিতে নামলে নিশ্চিত মৃত্যু হবে। অফিসার বিরক্ত হলেও জোরাজুরি করেনি। ভাগ্যিস তান্ত্রিক দুজন সময় মতো এসেছিল। কিন্তু ভাগ্য কী আর এত ভালো!

ওদের নিষেধ সত্যেও গোয়ার্তুমি করে অফিসার এই রাতে মেয়েগুলোর পরিবারের লোক, গ্রামের মানুষের সাথে ঝগড়া করে পুলিশ ভ্যানে তুলেছে লাশগুলো। আর ওগুলোর পাহাড়া দিচ্ছে তারা দুজন! গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে অফিসার বেটা কী আরামে বসে আছে। চোখ পড়েই যাচ্ছে লাশগুলোর দিকে। শাড়ির পেচের ভেতর থেকেও স্পষ্ট শরীরের আকৃতি বোঝা যাচ্ছে ছোট মেয়েগুলোর। চারটি লাশের একটিরও মাথা নেই ভাবতেই গা গুলিয়ে যাচ্ছে দুজনের। গাড়ি যত এগোচ্ছে তত তাদের আতংক বেড়েই চলেছে। এই মনে হচ্ছে লাশগুলো নড়ে উঠবে। বাইরে থেকে আসা বাতাসে কাঁপছে সত্যিই কাপড়ের খোলা অংশগুলো। ওগুলোর হাত চেপে ধরবে যেন তাদের পা। তারপর! ভাবতেই গা রিরি করে উঠছে।

দুজনে ওরা বাচ্চা ছেলের মতো একে ওপরের হাত চেপে রয়েছে। হঠাৎ ১ম কনস্টেবল আৎকে উঠলেন। তার মনে হলো একটা ঠাণ্ডা হাত তার ঘাড় স্পর্শ করলো। ২য় জনও ঘাড়ের কাছে একটা শীতল স্পর্শে চমকে উঠলেন। এরপরেই তাদের কানে ভেসে এলো কয়েকজন মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হাসির শব্দটাও তাদের সঙ্গে চলছে। চমকে পেছনে তাকালো দুজনে। ভ্যানের পাশের দিকটা কাপড়হীন। গিরিলের রেলিং এর ওপাশে তাদের প্রায় মুখোমুখি তিনটা মেয়ের মুখ। তিনজনই খিলখিল করে হাসছে। কিছু দস্যি মেয়ে যেন চলন্ত গাড়িতে লাফিয়ে উঠেছে। কিন্তু সময়টা যে এখন রাত। ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলো ওগুলো স্রেফ মাথা। মাথার নীচে কোনো শরীর নেই।

আৎকে প্রায় লাফিয়ে পিছিয়ে গেল দুজনে আর্তনাদ করে। মুহূর্তেই তাল হারিয়ে পড়ে গেল লাশ গুলোর উপরে। এবার উল্টো দিকের গিরিলের ওপাশে উদয় হলো আরও তিনজন অপরিচিত মেয়ের মাথা। দুপাশ থেকে ৬জন কিশোরী মেয়ে খিলখিল করে হাসছে। শরীরে রক্ত পানি হয়ে গেল। হঠাৎ অনুধাবন করলো মাথা বিহীন লাশগুলো নড়ে উঠছে তাদের শরীরের নীচে। দ্রুত তারা উঠে পিছিয়ে গেল বাইরের দিকে। ভয়ঙ্কর ভাবে নড়ছে লাশগুলো। একি! তারা কল্পনায় দেখছে নাকি! মাথাবিহীন ৪টি লাশ ধীরে ধীরে উঠে বসে পড়েছে। ওগুলোর শরীর থেকে সরে গেছে কাপড়। ৪টি লাশই তাদের হাত গুলো বাড়িয়ে দিয়েছে কনস্টেবল দুজনের দিকে। প্রথমে মনে হলো ডাকছে তাদের। পরে আবার মনে হলো ঝাঁপিয়ে পড়বে লাশ গুলো ওদের উপর। ভয়ংকর এই পরিস্থিতির সাথে তাদের কান নষ্ট করে দিচ্ছে গাড়ির বাইরের দুপাশ থেকে ভেসে আসা মেয়েগুলোর হাসির শব্দ। গাড়ি চলছে তার গতিতেই। চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে কনস্টেবল দুজন। গাড়ি থামাচ্ছে না কেন! আর কোনো উপায় আরেকটু ঘুরে পেছনে গিয়ে দুজনেই লাফিয়ে নেমে গেল চলন্ত গাড়ি থেকে।

পুলিশ অফিসার আর ড্রাইভার দুজনেই চমকে একে অপরের দিকে তাকালেন। মনে হচ্ছে কেউ পেছন থেকে চিৎকার করছে। ইশারা পেয়ে গাড়ি ব্রেক কসলেন ড্রাইভার। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় ছুটে গাড়ির পেছনে চলে এলেন। যা তারা দেখলেন এই পরিবেশে গভীর রাতে, গাছ-গাছালি ঢাকা পথের মাঝখানে কেউ দেখতে চাইবে না। কনস্টেবল দুজন কোথায়! গাড়ির পেছনে মাথাবিহীন চারটি মেয়ে দাড়িয়ে রয়েছে। ওদের হাতদুটো সামনের দিকে তাক করা। অন্ধকার হাতড়ে এগিয়ে আসছে যেন এদিকে। অফিসার এবং ড্রাইভার আর্তনাদ তুলে উল্টো ঘুরে আফসারপুরের দিকে ছুটতে লাগলেন পেছনের দিকে যতক্ষণ পর্যন্ত না পেছনের খিলখিল হাসির শব্দ মিলিয়ে গেল।

মেম্বার বাড়ির একটা ঘরেই ঘুমোতে দেয়া হয়েছে তান্ত্রিক ওস্তাদ আর শীর্ষকে। ঘুম নেই কারো চোখেই। জালালুদ্দিন মাতবর তাকে যা বললেন এরপর আর ঘুমানো যায় না। রশিদ অবাক কণ্ঠে ওস্তাদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করলো, ‘আমরা কালই চলে যাব মানে কী! আপনিইতো বলেছিলেন এটি কোনো প্রাচীন ভয়ঙ্কর ‘দেও’ এর কাজ। তাহলে! এখন আপনার ভাষায় এই ৬টি কিশোরীর হত্যা যদি কোনো ভূত-প্রেত, পিশাচ কিংবা পুকুরের দেও এর না হয়, তাহলে কার? কোনো মানুষের? তা কী করে হয়? আপনি এত ভয় পেয়ে আছেন কেন? দুই মিনিট পুকুরের ভেতর ডুব দিয়ে কী এমন বুঝলেন যে এমনটা বলছেন?’

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন জালালুদ্দিন মাতবর।…….
……………………………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে