পুকুরের সেই আতঙ্ক পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
984

#পুকুরের সেই আতঙ্ক
৮ম এবং শেষ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

জালালুদ্দিন মাতবর আর রশিদ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ডোবাটার দিকে। এই জঙ্গলের ভেতরে এমন অদ্ভুত একটা ডোবা থাকতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ডোবাটাকে ঘিরে আছে উঁচু ঝোপ আর ঘন গাছের সারি। তাই পথ থেকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না ওগুলোর পরে একটা ডোবা আছে। রশিদ চারদিকে চোখ বুলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের দিকে। জালালুদ্দিন মাতবর হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন ঝোপটা দেখে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন একটা মন্ত্র। তারপর এগিয়ে যেতে লাগলেন ঝোপটার দিকে। রশিদ লক্ষ্য করলো ওদিকে গাছের সারি বেশ ঘন। সেও ওস্তাদকে অনুসরণ করলো। দুজনে অনেকটা ঠেলে-ঠুলেই ঝোপটা পার হলো। এরপরই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ডোবাটা। আয়তনে ১৫ ফুট লম্বা, ১০ ফুট পাশের হবে। কিন্তু গভীরতা অনুমান করা যাচ্ছে না।

ডোবার পানির রঙের কারণেই এটাকে অদ্ভুত ডোবা মনে হচ্ছে রশিদের কাছে। এত কালো পানি সে আর কখনো দেখেনি। এটাকে পঁচা পানিও বলা চলে না। কোনো দুর্গন্ধ নেই। উল্টো অদ্ভুত একটা সুভাষ ভাসছে নাকের কাছে দিয়ে। সে কৌতূহলতা নিয়ে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকালো। তার মুখও সন্দিহান। মুখে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে যাচ্ছে কিছু। রশিদের মনে পড়লো অশুভ শক্তির সম্মোহনের প্রভাব থেকে বাঁচতে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে বা অনুভব করলে মন্ত্রটা উচ্চারণ করে বলেছিলেন তিনি। সেও শব্দহীন ভাবে শুধু ঠোঁট নাড়িয়ে আওড়াতে লাগলো ওটা। নাকের সামনে থেকে সুভাষটা উবে গেল মুহূর্তেই। উৎকট একটা পঁচা গন্ধ অনুভব করে নাক কুঁচকে ফেলল সে। ডোবাটার চারদিকে ঘুরে এটার খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতে লাগলো দুজনেই। ডোবাটার পাড় সামান্য ঢালু হয়ে এরপর কুয়োর মতো সোজাসুজি নীচে নেমে গেছে। ঢালু পাড় থেকে পানি অন্তত ৬ ফুট নীচে। তাই ভালোমতো ডোবার কিনার উপর থেকে দেখা যাচ্ছে না।

কেউ কোনো কথা না বললেও দুজনেই মনে মনে বিশ্বাস করছে এই ডোবাটার সঙ্গে প্রাচীন সেই পুকুর, পুকুরের পিশাচ, ৬টি কিশোরী মেয়ের মৃত্যু জড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। এক অশুভ শক্তির তীব্র অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে দুজনেই। কিনার ঘেষে বসে উঁকিঝুঁকি মেরে ডোবার নিচু অংশটা দেখছিল রশিদ। হঠাৎ তার চোখ কিছু একটায় আটকে গেল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ওদিকে তাকান ওস্তাদ!’ টর্চটা জ্বেলে ডোবার পানি থেকে সামান্য উপরের একটা জায়গায় আলো ফেলল সে। জায়গাটা থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি বেরিয়ে আসছে। সেগুলো বেয়ে নীচে নেমে মিশে যাচ্ছে ডোবার পানির সাথে। অবাক হলো দুজনেই।

এখন বৃষ্টির মৌসুম নয়। পানি আসছে কোথা থেকে! একবার অনুমান করলো, সেই প্রাচীন পুকুরটা থেকে আসছে। না, এটা অসম্ভব! পুকুরটা কত , কত দূরে। মাইলের উপরতো হবেই। কোনো সুরঙ্গপথ এতদূর মাটির ভেতর দিয়ে পানি আনতে পারবে না। জালালুদ্দিন মাতবর বললেন ‘পানির পিশাচ ওটা। একবার যদি ওটা পুরো ক্ষমতা পায় তাহলে তার পক্ষে কিছুই করা অসম্ভব নয়।’

রশিদ অবাক হয়ে বুড়ো তান্ত্রিকের দিকে তাকালো। দুজনের চিন্তার দ্বারা যে একই পথে প্রবাহিত হচ্ছে সন্দেহ নেই। সে বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘সেই প্রাচীন পুকুরটার সঙ্গে এটার পানির সংযোগ আছে বলতে চাইছেন?’

‘পানির সংযোগ নয় শুধু, আমার মনে হচ্ছে এমন একটা পথ আছে যেই পথ দিয়ে স্বয়ং সেই পিশাচটা চলাচল করতে পারে।’ গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন তান্ত্রিক মাতবর।’

‘মানে পিশাচটা কিশোরী মেয়েগুলোর লাশগুলো সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে এখানে নিয়ে আসতো! তাই পুরো পুকুর তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েগুলোকে পাওয়া যেত না! সবই আমাদের অনুমান। কিন্তু মনে হচ্ছে এটাই যুক্তিযুক্ত ঘটনা।’

‘পুরোটা অনুমান নয় রশিদ, ভালো করে জায়গাটা দেখ।’

রশিদ আরেকটু ঝুকে গেল সামনে, টর্চের আলোয় যেখান থেকে পানি চুইয়ে নামছে সেখানে একটা হাতের ছাপ লক্ষ্য করলো। বুকটা ধড়ফড় করে উঠল তার। এমন সময়েই ভূমিকম্প অনুভূত হলো। তার পায়ের নিচ থেকে সামান্য মাটি সরে গেল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পড়ে গেল ডোবার পানিতে। বুড়ো তান্ত্রিক দ্রুত ছুটে এলো কিনারে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গিয়ে রাতের আধারে ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। আর ডোবার চারপাশে ঝোপ থাকায় জায়গাটা আরও অন্ধকার।

রশিদ প্রায় ডুবে গেল বিচ্ছিরি গন্ধ যুক্ত পানির ভেতর। নাক-মুখ দিয়ে কাঁদা ঢুকে গেছে। কোনোরকম করে মাথাটা পানির উপর তুলে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। পুরোপুরি সোজা হতেই দেখল পানি তার কোমর পর্যন্ত। ডোবাটা বেশি গভীর নয় তাহলে! তার টর্চ আর খুঁজে পেল না। জালালুদ্দিন মাতবর উৎকণ্ঠা নিয়ে তার লাইটের আলো রশিদের উপর ফেলে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময়, হঠাৎ পানির কুলকুল শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। রশিদ একটু এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের যে অংশ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে সেদিকে এগিয়ে গেল। একটা ধাক্কার মতো খেল পানির তীব্র স্রোতে সে। মাটি সরে গিয়ে জায়গাটা ফুঁড়ে নলমুখ সৃষ্টি করে হঠাৎ বেরিয়ে আসতে লাগলো পানি। কোথা থেকে আসছে! দেখতে দেখতে তার পাশের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো। নড়তে গিয়ে রশিদ অনুভব করলো কাঁদা মাটির সঙ্গে শক্তভাবে আটকে আছে তার পা। তীব্র টানে কিছু একটা আটকে রেখেছে যেন ওকে।

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যেতে হলো তাকে। পানি প্রায় গলার কাছাকাছি উঠে এসেছে। সে যদি সাঁতরাতে না পারে কতক্ষণ আর দম বন্ধ করে পানির নিচে থাকতে পারবে! আর যে ভয়ানক পানি! জালালুদ্দিন মাতবরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রশিদকে অভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তবে তার কৌতূহলতা জুড়ে ঝাপাঝাঁপি করছে পানির তোর আসছে কোত্থেকে! সে রশিদকে ওখানে আধারে রেখেই ঝোপ পেরিয়ে মাটিতে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলেন পানির চলার কম্পন। অবাক হতে হলো তাকে। যেখান দিয়ে ডোবাটিতে পানি ঢুকছে। সেই বরাবর লম্বা একটি পথ মাটিতে কান পাতলেই পানির চলার শব্দ আর কম্পন শোনা যাচ্ছে। অর্থাৎ মাটির সামান্য তোলা দিয়ে একটি নালার মাধ্যমে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কিসের নালা, কিভাবে সৃষ্টি হলো এটা, পানির উৎসই বা কোথায়! আর এগোলেন না তিনি। ফিরে এলেন ডোবার কাছে। ওটা প্রায় ভরে এসেছে। কিন্তু রশিদ এখনো উঠতে পারেনি! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বেগ পেতে হলো না তাকে। ডুব দিলেন মুহূর্তেই। টর্চটা ডাঙায় রেখে এসেছেন।

আধারেও রশিদকে খুঁজেস3 পেতে কষ্ট হলো না তার। সে দম বন্ধ করে ঝুকে নিজের পা ছোটানোর চেষ্টা করছে। বুড়ো তান্ত্রিক আর তার চেষ্টায় অবশেষে মুক্ত হলো পা। দুজনেই ভেসে উঠল পানির উপরে। ভেজা কাপড় আর টর্চ নিয়ে দুজনেই এবার মাটিতে কান পেতে পেতে এগিয়ে যেতে লাগলো নালার উৎস মুখের সন্ধানে।

আসতে আসতে থমকে দাঁড়ালেন আরেকটা ঝোপের সামনে। একবার তাদের মনে হলো আগের জায়গায় ফিরে এসেছেন কিনা! কিন্তু ঝোপ বেদ করে এগিয়ে যেতেই আবিস্কার করলেন একটা বেদীবিহীন কুয়ো। কুয়োর মুখটা খুবই ছোট, মাটির সঙ্গে মিশে আছে। আনমনে কেউ ঝোপে ঢুকলেই পড়ে যাবে ওটার ভেতর। ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই বুকটা ধক করে কেঁপে উঠল রশিদের। কুয়োয় উকি দিলে অন্তত ৫-১০ ফুট নীচে পানি আছে ভেবেই তাকায় সবাই। তবে এটার পানি প্রায় মাটি ছুঁইছুঁই!

‘এটার কথাই আমাকে ওরা বলেছিল, এটার খোঁজই আমাদের দরকার ছিল।’ বুড়ো তান্ত্রিকের কণ্ঠে উত্তেজনা।

‘একটি ডোবা, একটি কুয়ো, একটি পুকুর ও একটি দাও পিশাচের সম্পর্ক , রশিদ! সারাদিনে সাধনা করে আমি বিভিন্ন শক্তির কাছে পুকুরের ওই পিশাচটা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। ওরা নিজেদের প্রজাতি সম্পর্কে খোলাসা করে কিছুই বলে না। শুধু এটুকু বলেছিল জঙ্গল, ডোবা, কুয়ো, পুকুর আর পিশাচ। তখন কিছু না বুঝলেও এখন সব পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। আগেকার সময়ের জলে, স্থলে দুই জায়গাতেই সমান শক্তিশালী আর ভয়ঙ্কর পিশাচ ছিল এই দাও পিশাচরা। এরা পুকুরের দেও থেকে ভিন্ন। মানুষের কাছে না গিয়েও তাকে ধোকায় ফেলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এটার। ওটার ক্ষমতা সম্পর্কে আমরা বিস্তারিতই জেনে গেছি এতদিনে। মূলত সেই পিশাচগুলোকে বন্ধি করার একমাত্র উপায় ছিল তাদেরই কৌশল ছল এবং ভ্রম।

একটা ডোবা এবং কুয়ো তৈরি করে তন্ত্র বলে, অনেক সময় পিশাচ চলাচলের পথে ডোবা তৈরি করে মৃত মানুষের শরীর ডোবায় ভাসিয়ে ওদেরকে আহ্বান করা হতো। পিশাচ ডোবায় উপস্থিত হলেই পবিত্র পানি, ফল, পাতা ফেলে মন্ত্র উচ্চারিত করা হতো। ডোবার পানি আতঙ্কে পরিণত হতো পিশাচটার। ওটার শরীর যেন আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। ডোবার চারপাশে সুরক্ষা সৃষ্টির কারণে ওটা ডোবা থেকে বাইরে যেতে পারে না। তখন সাধকদের পরিকল্পনা মতো পিশাচটা ঢুকে পড়ে সুড়ঙ্গে। পৌঁছে যায় কুয়োয়। কুয়োর মুখ আগে থেকেই বন্ধ থাকে। এরমধ্যে ডোবা থেকে সুড়ঙ্গটাও বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সাধকের দল মাটি ফেলে।

ফলে আটকে পড়তো পিশাচটা চিরদিনের জন্য। এই পিশাচটা সম্পর্কে আমার সাধনা জীবনের শুরুতে অনেক শুনতাম। কিন্তু এটাই যে সেই পিশাচ তা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেললাম। বুঝতেই পারছো রশিদ পিশাচটার জন্য কুয়ো আর ডোবা এমন জায়গায় এমন ভাবে সাধকরা তৈরি করতো যাতে কোনো সাধারণ মানুষ ওটার কাছে গিয়ে শয়তানটাকে মুক্ত করতে পারে। কিন্তু দেখ হয়তো অনেক যুগ কেটে গেছে পিশাচটা এখানে বন্ধি, সাধকেরা আর এটার খোঁজ রাখেননি। বন জঙ্গল উজাড় হতে হতে এটা মানুষের অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে।

দীর্ঘদিন শয়তানটা বন্ধি থাকায় ওটার প্রতিরক্ষা দুর্বল হয়ে পড়ে। হয়তো কিশোরী মেয়ের দল জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই ওটা দূর থেকে কোনো এক ইশারা , ছলের আশ্রয় নিয়ে টেনে এনেছে মেয়েগুলোকে এই কুয়ো মুখের কাছে। মেয়েগুলো কৌতূহল হয়ে পুরোনো কুয়োর মুখ খুলে দিয়েছে। আর মুক্ত হয়ে শয়তানটা নিজের ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য নরবলি দিতে থাকে। এই কুয়ো আর ডোবা যেমন পিশাচটাকে বন্ধি করতে পারে। আবার স্বাধীন অবস্থায় এই দুটোই ওটাকে শক্তিও দিতে পারে। কুয়ো এবং ডোবায় পানির স্রোত সৃষ্টি করে একটা অদ্ভুত মায়ার সুড়ঙ্গ ওটা সৃষ্টি করতে পারে যা কিনা শয়তানটাকে সরাসরি এই কুয়ো থেকে কয়েক সেকেণ্ডে সেই প্রাচীন পুকুরে নিয়ে যেতে পারে। এই কুয়ো থেকে ঐ পুকুর পর্যন্ত কিন্তু দীর্ঘ মাটির নিচে দিয়ে সুড়ঙ্গ নেই। এটা স্রেফ এক অলৌকিক পথ বলা যায়। পিশাচটা মেয়েগুলোর লাশ প্রথম এই কুয়োয় এবং পরে ওই ডোবায় এনে রাখতো।’

বিস্ময় নিয়ে জালালুদ্দিন মাতবরের দীর্ঘ বক্তব্য শুনলো রশিদ। অবিশ্বাস্য লাগছে সব কিছু। কিন্তু এই মৃত্যু রহস্যের এর চাইতে আর ভালো ব্যাখ্যা তার নিজের কাছে নেই। বুড়ো তান্ত্রিক যে আন্দাজে এসব কথা বলছে না, তা সে জানে। লোকটা তার পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছে পিশাচ জগৎ নিয়ে। ভালো করে কুয়ো মুখ খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েই লক্ষ্য করলো রশিদ আসলেই ওটার উপরে একটা ঢাকনা ছিল। কিছুক্ষণ চারপাশে খোঁজ করার পর একটা বড় গাছের গোড়ার কাছে সত্যিই একটা ঢাকনা খুঁজে পেল তারা। লোহা কিংবা স্টিলের ওটা! জং ধরে গেলেও অদ্ভুত ভাষায় ওটার উপর যে কিছু লেখা রয়েছে তা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত , অচেনা কিছু চিহ্নও আঁকা রয়েছে ওটার উপর। জালালুদ্দিন মাতব্বর বললেন, ‘আমাদের দুজনকেই কাজটা শেষ করতে হবে, এবং আজ রাতের মধ্যেই। যত সময় যাবে তত ওটার ক্ষমতা বাড়বে। আমার মনে হয় ৬টি মেয়ের লাশ ওই ডোবাতেই আছে। পানির স্রোত ওটা পাঠিয়েছে লাশগুলোকে নিয়ে যেতে। লাশগুলোকে আমাদের আটকাতেই হবে ডোবার ভেতরে!’

প্রথমেই তারা অপশক্তির বিরুদ্ধে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে ঢাকনাটা কুয়ো মুখের উপর পুনরায় স্থাপন করলো। গাছের ডাল দিয়ে এমন ভাবে ঢাকনাটা চাপা দিল যাতে সহজে না খোলে। এরপর হাজির হলো ডোবাটার কাছে। পুরোপুরি পানিতে ভরে গেছে ওটা। কিন্তু ডোবার মাঝে যে প্রাণীটি ভেসে রয়েছে টর্চের আলোতে ওটার দিকে তাকাতেই দম বন্ধ হয়ে এলো দুজনের। পিশাচটা মাথা বের করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের দুজনের আসার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। কুৎসিত জিহ্বা নড়ে উঠছে ওটার মুখ থেকে। চুকচুক শব্দ ভেসে আসছে ওখান থেকে। দিশেহারা বোধ করলো রশিদ। হঠাৎ পেছনে পায়ের আওয়াজ শুনতেই আতঙ্কে নিয়ে দুজনেই ঘুরে তাকালো পেছনে। ৬টা মেয়ে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছে, ওদের সবার হাতেই ধারালো দা। ওগুলোর গায়ে লেগে আছে রক্ত। যেন সাক্ষী দিচ্ছে অস্ত্রগুলো কারো প্রাণ নেয়ার। মেয়েগুলোর গলার কাছাকাছি কালো দাগের রেখাগুলো ফুটে আছে যেই স্থান থেকে তাদের মাথাগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। পিশাচটা পুনরস্থাপন করেছে ওগুলো!

ধারালো অস্ত্রধারী মেয়েগুলো যে অশরীরী নয় তা বুঝতে পেরেই গা হীম হয়ে গেল দুজনের। জ্বলে আর স্থলে দুই দিকেই আতঙ্ক। মেয়েগুলো ভয়ানক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তাদের দিকে। ঘুরে পেছনে তাকাতেই দেখল তারা,, পিশাচটাও এগিয়ে আসছে সমানতালে।

দুজনেই সম্মিলিত ভাবে মন্ত্র উচ্চারণ করে যেতে লাগলো কিন্তু কোনো লাভই হলো না। হঠাৎ থমকে গেল মেয়েগুলো, পিশাচটাও অনেক গুলো মানুষের হাঁটার শব্দ আর কথা বলার শব্দ কানে আসছে। অসম্ভব! গ্রামের লোকেরা তাদের উদ্ধার করতে এসেছে! কাউকেই দেখা যাচ্ছে না যদিও। রশিদ আর জালালুদ্দিন মাতবর দুজনেই চিৎকার করে নিজেদের উপস্থিতির জায়গাটা জানান দিলেন। মেয়েগুলো উল্টোঘুরে মানুষ গুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিশ্চিত বিপদের মুখে পড়তে চলেছে সবাই। বুড়ো তান্ত্রিক রশিদের হাত চেপে ধরলো, ‘গ্রামের লোকগুলোর ভয়ানক ক্ষতি করতে পারবে এই মেয়ে ৬জন, ডাঙায় পিশাচটার ক্ষমতা এখন পুরোপুরি ফিরে আসেনি। এই কারণে এতদিন ধরে মেয়েগুলোকে একে একে খুন করে ওদের নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওটা। যাতে ওটার ক্ষমতা লাভের পথে কেউ বাঁধা দিলে ক্ষতি করতে পারে ওরা! আর সময় নেই। পিশাচটাকে বন্ধি করতে হবে। তুমি ডোবার সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে যাও, ওটা তোমাকে কুয়োটায় নিয়ে যাবে। পিশাচটা তোমাকে অনুসরণ করে কুয়োয় পৌঁছুবে আর তখন তুমি ৩য় অলৌকিক সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রাচীন সেই পুকুরে পৌঁছে ওটার মুখে এই কবজগুলো বেঁধে দেবে তাহলে আর ওটা মুখ দিয়ে বের হতে পারবে না।’ এই বলে রশিদের শরীরে সুতোর সঙ্গে বাধা কবজগুলো দেখালেন।

এক মুহূর্ত না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়লো রশিদ ডোবার পানিতে। পিশাচটাকে পাশ কাটিয়ে হাতড়ে হাজির হলো সুরঙ্গটার মুখে। বেশ প্রস্তুত পথ সুরঙ্গটার কুয়ো পর্যন্ত। পানিতে ভরে আছে এটি। এতটা পথ এক নিঃশ্বাসে পাড় হওয়া অসম্ভব। কিন্তু একটা অলৌকিক শক্তিই যেন সাহায্য করলো তাকে দ্রুত কুয়ো পর্যন্ত পৌঁছুতে। জালালুদ্দিন মাতবর দেখলেন পিশাচটাও যেন রশিদের কাজে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। ওকে অনুসরণ করে পানির নিচে ডুব দিল শয়তানটাও।

ভাগ্যের জোর আর দৈব কোনো শক্তিই যেন রাতটাতে সাহায্য করলো তান্ত্রিক দুজনকে। কুয়ো থেকে অন্ধকারেও পানির ঘূর্ণি অনুভব করে অলৌকিক সুড়ঙ্গ ধরে প্রাচীন পুকুরে পৌঁছে গেল রশিদ এবং বন্ধ করে দিল সুড়ঙ্গ পথটা। পিশাচটা সুড়ঙ্গে ঢুকে যেতেই দ্রুত কমতে লাগলো আবার ডোবার পানি। পানির স্তর সুড়ঙ্গ মুখের নীচে নেমে গেল দেখতে দেখতেই। এমন সময় ঝোপ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো পুলিশের দলটা। তান্ত্রিক বিস্মিত হলেন। কিন্তু সময় নষ্ট করলেন না। দ্রূত নেমে পড়লেন ডোবায় এবং নিজের শরীরের সব কবজ খুলে তা সুড়ঙ্গ পথে বেঁধে বন্ধ করে দিলেন ওটার ডোবায় ঢোকার পথটাও।

পিশাচটা কুয়োয় বন্ধি হয়ে যাওয়ার পরেই ৬টি মেয়ের শরীরই নিষ্প্রাণ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। স্থানীয় লোক আর পুলিশের কাছে পরে তারা জানতে পেরেছিল সন্ধ্যার পরই ধারালো অস্ত্রগুলো হাতে মেম্বার বাড়িতে হাজির হয় মৃত মেয়েগুলো। তারা যেন খুঁজছিল কাউকে। সকলে আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি শুরূ করে দেয়। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই আঘাত করেছে দা দিয়ে। তুলিকে জীবিত দেখে তুলির মা ছুটে গিয়েছিল তার কাছে। কিন্তু ৬জন মিলে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে তাকে।। এরপর মেয়েগুলো জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ এবং গ্রামের লোকেরা অনুমান করে দুই তান্ত্রিক জঙ্গলেই রয়েছে। তাদের হত্যা করতেই মেয়েগুলো মেম্বার বাড়িতে এসেছিল। তারপর তারা সদলবলে জঙ্গলে প্রবেশ করে।

এরপরের কয়েকদিনে মেয়েগুলোকে আবার দাফন করার ব্যবস্থা করা হলো। প্রাচীন পুকুরটা থেকে কুয়োর সুড়ঙ্গ এবং ডোবা থেকে কুয়োর সুড়ঙ্গ শক্ত উপাদান দিয়ে চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো। কুয়োর মুখটা আরও শক্ত লোহার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে তার উপর সিমেন্ট, খোয়ার ঘন প্রলেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো। জঙ্গলের ঐদিকটায় প্রবেশ নিষেধ করে সতর্ক করে দেয়া হলো সবাইকে।

তিনদিন পর:
আফসারপুর গ্রাম এখন পিশাচটা থেকে নিরাপদ। রশিদ জালালুদ্দিন মাতবরকে বলল, ‘পিশাচটাকে ধ্বংস করা গেল না। আগে সাধকরা যে কাজ করেছে আমরা তাই করলাম শুধু। তারা যদি ডোবাটা মাটি দিয়ে পূর্ণ করে দিত। তাহলে তো পিশাচটার পক্ষে মুক্ত হয়ে অলৌকিক সুড়ঙ্গ সৃষ্টি করে প্রাচীন পুকুরে ফিরে যাওয়া সম্ভব হতো না। আমরাও একই কাজ করলাম। সব কিছু বন্ধ করলেও ডোবাটাকে মাটি দিয়ে ভরে ফেলছিনা কেন?’

মুচকি হাসলেন বুড়ো তান্ত্রিক, ‘ওই ডোবাটাই কেবল পিশাচটার স্বাধীনতার পেছনের প্রধান বাধা। ওটা না থাকলে আজ এত সহজে ওটাকে আটকে ফেলতে পারতাম না। আমার বিশ্বাস ওটা যদি আর কোনোদিন মুক্ত হয়, নিজের ক্ষমতা জাহির করার আগে ও এই ডোবাটা বন্ধ করার চেষ্টা করবে!’

• * * * সমাপ্ত * * *

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে