পাত্র বদল পর্ব-০৬

0
2185

#পাত্র_বদল
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



একটা রাত কেটে যায় চারটে মানুষের চোখ খোলা রেখেই।মিতু একটুও ঘুমাতে পারেনি। পারেনি ইয়াসমিন বেগমও।আর ও ঘরে জুয়েল সোয়েল দু ভাই সারাটা রাত বসে বসেই কাটিয়ে দিয়েছে।সোয়েল ঘরে খাটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে বসে এলোমেলো কত কী যে ভেবেছে। বারবার আল্লাহর কাছে অভিযোগ তুলেছে।হে আল্লাহ, তুমি এমন কেন? আমার ভাইটার জবান দিলে তোমার এমন কী ক্ষতি হয়ে যেতো?
তারপর বলে, আল্লাহ,এরচে তুমি আমার জবানটাই কেড়ে নাও। আমার জবান নিয়ে আমার ভাইটাকে সুস্থ করে দাও।ওর মুখে জবান দাও!
মনে মনে এইসব কিছু আল্লাহর কাছে সে বলে আর চোখ মুছে। সারাটা রাত সে এমন করেই কাটিয়ে দেয়।
আর জুয়েল ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের পর বড় রাস্তাটা পেরিয়ে কংশের কাছে চলে যায়। তারপর এই শীতের বরফ মাখা বাতাস শরীরে নিয়েই বসে থাকে শিশির জমা ঘাসের উপর। বসে বসে ভাবে, এমন দূর্ভাগা জীবন রেখে কী লাভ! এরচেয়ে তো মরে যাওয়ায় অনেক ভালো!
জুয়েল এই সময় একটা ভয়ংকর কাজও করে।তার কাঁধে ঝোলানো ছিল একটা গামছা। সেই গামছাটা গলায় পেঁচিয়ে জোরে টেনে ধরে। ফাঁস লেগে সে আজ মরে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। আকাশের চাঁদটার দিকে তাকায়, নদীটার দিকে।মার মুখটা,বিথির,সোয়েলের ভাইয়া ডাকটা গলায় বাজে। কেঁদে উঠে জুয়েল।সে মরতে চায় না। বাঁচতে চায়। পৃথিবীর মায়া যে বড় মায়া! এই মায়া সহজে ছাড়া যায় না!

সকাল বেলা বিথি যখন পড়তে বসে তখন মিতু তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।বিথি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে তার বুবু দাঁড়িয়ে আছে।মিতু এবার বলে,’বিথি,একটা কথা রাখবে আমার তুমি?’
বিথি অবাক হয়ে বলে,’তোমার একশোটা কথা রাখতেও আমি রাজি!’
মিতু মৃদু হাসে। হেসে বলে,’একশোটা রাখতে হবে না।একটা কথা রাখলেই হবে।’
বিথি মিতুর মুখের উপর তাকায়।
মিতু এবার চুপিসারে বলে,’তোমার বড় ভাইয়াকে বলবে আমার সাথে একটু দেখা করার জন্য।আমি বারান্দার ঘরে থাকবো!’
বিথি মনে মনে খুব খুশি হলো। খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল বড় ভাইয়ার খুঁজে। কিন্তু বড় ভাইয়াকে সে কোথাও খুঁজে পেলো না!

বিথি তো ছোট্ট মানুষ।এই বয়সে তার অত বোঝ হয়নি। ভাইকে বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। মনে মনে ভেবে ফেলে ভাইয়া কী তবে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে?
বিথির চোখ ঝাঁপসা হয়।সে তার ঝাঁপসা চোখ নিয়ে মিতুর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কান্নাভেজা গলায় সে বলে,’বুবু, ভাইয়াকে পাচ্ছি না!’
মিতু মৃদু হেসে বলে,’পাবা।হয়তো কোথাও গেছে!’
মিতু বিথির মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দেয়।
বিথি এবার বুবুর জামায় খামছে ধরে তার বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে উঠে। চোখের টলটলে জলে ভিজিয়ে দেয় মিতুর জামা।মিতু বলে,’এই বোকা, কাঁদছো কেন?’
বিথি কাঁদতে কাঁদতে বলে,’ভাইয়া আর আসবে না।’
ছোট্ট মানুষ।অতকিছু না ভেবেই তার মনে গেঁথে যাওয়া ধারণার কথাটা বলে ফেলে।সে বলে,’বুবু, ভাইয়া রাগ করে চিরদিনের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেছে!’
কথাটা শুনে মিতুর বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠে!না জুয়েলের প্রতি তার কোন অনুভূতি কিংবা ভালোবাসা নাই। তবুও কেন জানি একটা অজানা আশংকায় তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটানোর শব্দ হয়।কানের কাছে দ্রিম দ্রিম বোল বাজে!
মিতুর চোখেও জল জমে। সেই জল সে আড়ালে আবডালে মুছে নেয় হাতের আঙুল দিয়ে।

ইয়াসমিন বেগম চুলোয় রান্না বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে তরকারি খুঁটছেন।মিতুও গিয়ে বসে পড়লো তরকারি খুঁটতে। ইয়াসমিন বেগম বললেন,’আরে কী করো তুমি মা কী করো!উঠো,উঠো! তোমার কাজ করতে হবে না।’
মিতু জেদ ধরে বলে,’মা আপনি আমায় দূরের ভাবছেন এখনও? আমার প্রতি আপনার অনেক রাগ তাই না!’
ইয়াসমিন বেগম জড়িয়ে ধরে ফেলেন মিতুকে। তারপর বলেন,’না মা, তুমি আমার মেয়ে। তুমি এই ঘরের একজন।তোমারে আমি দূরের কেউ ভাবি না। কোনদিন ভাববো না।’
মিতুর শরীরে মুহুর্তের জন্য পুলক খেলে যায়। কেন জানি তার মনে আনন্দের উচ্ছাস জাগে।সে কিছুই বুঝতে পারছে না কেন তার এমন হচ্ছে। কেন এই মানুষগুলোর প্রতি তার বুকে মায়া জন্মাচ্ছে!সে কী পারবে এই মোহ মায়া ছেড়ে এখান থেকে চলে যেতে?
একটু পর বিথি দৌড়ে আসে। তারপর মিতুর কাছে এসে দাঁড়িয়ে দমের উপর দম ফেলতে ফেলতে বলে,’বুবু,একটা কথা আছে তোমার সাথে!’
মিতু চমকে উঠে।বলে,’বলো কী কথা।’
বিথি বলে,’এখানে না।ওই ঘরে আসো।’
মিতু ইয়াসমিন বেগমকে বলে,’মা আমি এক্ষুনি আসছি।’
বলে মিতু বিথির হাত ধরে ও ঘরটায় চলে যায়।
ইয়াসমিন বেগম তাকিয়ে থাকেন।বিথির কী গোপন কথা মিতুর সাথে?
তিনি বুঝতে পারেন না। তবুও তার ভালো লাগে।মিতু তাদের আপন করে ভাবতে শুরু করেছে তবে!

বিথি বলে,’বুবু,ভাইয়া কোথাও যায়নি।’
মিতু যেন প্রাণ ফিরে পায়।সে বলে,’সত্যি?’
‘সত্যি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস না করলে আমার সাথে আসো এক্ষুনি।’
মিতুর কী হয়েছে সে নিজেও জানে না। নিজের উপর সবটুকু নিয়ন্ত্রণ সে হারিয়ে ফেলেছে।কে কী বলবে সে কথা না ভেবেই মিতুর হাত ধরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর বিথির হাত ধরে উঠোন পেরিয়ে বড় রাস্তাটায় গিয়ে দাঁড়ায়।রাস্তার পাশ ঘেঁষে বয়ে গেছে কংশ। সেই কংশের তীরের সবুজ দূর্বাঘাসের উপর বসে আছে জুয়েল। কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে তাকে। নদীর স্বচ্ছ টলটলে জলের উপর তাকিয়ে আছে সে।
বিথি আঙুল তুলে দেখালো,’ওই দেখো ভাইয়া বসে আছে।’
মিতু বললো,’তুমি কী তোমার ভাইয়ার কাছে বলেছিলে আমার সাথে দেখা করার জন্য?’
বিথি ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,’উহু। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাইয়াকে দেখেই তো আমি দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম তোমার কাছে!’
মিতু বলে,’অহ।’
তারপর মিতু আবার বলে,’বিথি, তুমি দৌড়ে ঘরে যাও।খাতা কলম নিয়ে আসো।’
বিথি দৌড়ে ঘরে গিয়ে খাতা কলম নিয়ে আসে।
মিতু খাতা কলম হাতে নিয়ে একটা বড় রেইন্ট্রি গাছ দেখিয়ে বলে,’তুমি ওই গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াও।আমি তোমার ভাইয়ার কাছ থেকে না আসা পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।আমি এখান থেকেই তোমাকে নিয়ে ঘরে যাবো।’
‘আচ্ছা।’
বলে চলে গেল বিথি গাছটার আড়ালে।
আর মিতু হাঁটতে হাঁটতে যেতে লাগলো রাস্তা পেরিয়ে নদীর কাছে।

মিতু গিয়ে দাঁড়ালো জুয়েলের ঠিক পেছনে। এবার মিতুর কেমন লজ্জা করছে।কী জানি কী ভেবে বসে জুয়েল!তাই সে সামনে যেতে পারছে না।
জুয়েলই কী মনে করে একবার পেছনে তাকালো।আর তাকিয়ে ভীষণ চমকে উঠলো।সে নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।সে ভাবছে তার চোখ ভুল কিছু দেখছে। মিতুকে নিয়ে অনেক ভাবার কারণে এমন হয়েছে হয়তো তার। নয়তো মিতুকে সে নদীর পাড়ে দেখবে কেন?তাও একা!
কিন্তু তার ভুল ভাঙলো তখন যখন সে দেখলো মিতু একটা খাতার সাদা পাতায় লিখে দিলো,’আপনি কেমন আছেন?’
জুয়েল খাতা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে লিখাটা দেখলো। তারপর সে কলম নিয়ে লিখলো,’আমি ভালো আছি। কিন্তু আপনি এখানে এসেছেন কেন?’
মিতু তাকিয়ে দেখলো জুয়েলের চোখের নিচে জলের দাগ বসে আছে।সে ঠিক বুঝতে পারলো জুয়েল অনেক কেঁদেছে।
মিতু এবার লিখলো,’আপনাকে দেখতে এসেছি।’
জুয়েল লিখাটা পড়ে হাসলো। তারপর সে লিখলো,’চলে যাবেন কখন আমাদের বাড়ি থেকে?’
মিতু লিখলো,’আমি আপনাদের বাড়িতে থাকায় আপনাদের খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না? এই জন্যই তো চলে যাওয়ার কথা বললেন!’
জুয়েল লিখাটা পড়ে লজ্জিত হলো।সে মিতুর চোখের উপর মায়া মায়া চোখে তাকালো।
মিতুর তাকিয়ে থাকতে কেমন অস্বস্তি লাগছে।তাই সে চোখ নামিয়ে নিয়ে খাতাটা টেনে নিয়ে লিখলো,’আমি অনেক সরি! গতকাল আপনার সাথে অনেক খারাপ বিহেভ করে ফেলেছি আমি। আমার এমন করা আসলে উচিৎ হয়নি!’
জুয়েল লিখাটা পড়লো।পড়ে সে লিখলো,’সব দোষ আমাদের। আপনার সাথে যা হয়েছে তা ক্ষমার অযোগ্য।আজ আঙ্কেল আন্টি আসলে কীভাবে তাদের সামনে যাবো বুঝতে পারছি না!’
মিতু লিখলো,’বুঝতে হবে না। আপনার আঙ্কেল আন্টি আসবে না।’
মিতু হাসলো।
হাসলে এতো ভালো লাগে মিতুকে!
জুয়েল সবকিছু কেমন গুলিয়ে ফেলছে। কিন্তু বলতে পারলো না।রাস্তা দিয়ে মানুষের চলাচল শুরু হয়ে গেছে।মিতু চটজলদি একটা পাতায় লিখলো,’আমি যাচ্ছি এখন।টা টা।’
খাতাটা জুয়েলের হাতে দিয়েই মিতু চটজলদি এখান থেকে চলে গেল।
জুয়েল অনেকক্ষণ ধরে তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইল।মিতু চলে যাওয়ায় তার বুকে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব হচ্ছে।কেউ চলে গেলে বুকের ভেতর এমন শূন্যতা অনুভব হবে কেন?
এই ভীষণ শূণ্যতাটুকুর নাম কী?
জুয়েল একটুও জানে না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে