পাত্র বদল পর্ব-০৩

0
2204

#পাত্র_বদল
#৩য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক


জুয়েল ঘর থেকে বের হয়ে সোজা চলে গিয়েছে তার ভাই সোয়েলের ঘরে। ওদের দু ‘ভাইয়ের মধ্যে জুয়েলই বড়ো। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাবধান ওদের দুজনের মধ্যে। তবুও সোয়েল জুয়েলকে ভাই বলে ডাকে। বড়ো ভাইকে যতটা সম্মান করতে হয় সে ততটাই করে।
জুয়েল ওর ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় শক্ত পায়ে এক লাথি দিলো। সোয়েল ঘুমের ঘোর থেকেই কেঁপে উঠে জড়োসড়ো হয়ে বিছানার উপর উঠে বসলো। তারপর ভাবতে লাগলো দরজায় কে এমন শব্দ করলো!
জুয়েল আরো একবার লাথি ছুড়ে দিয়েছে দরজায়।স্টিলের দরজা। প্রচন্ড শব্দ হলো আর কাঁপতেও লাগলো সঙ্গে সঙ্গে।
সোয়েল ভেতর থেকে চিৎকার করে বললো,’কে?কে ওখানে?’
জুয়েল তো কথা বলতে পারে না।তার শরীর রাগে এবং ঘৃণায় রি রি করছে তখনও।সে আবার দরজায় লাথি বসিয়ে দিলো।
ভেতর থেকে ভয় রাগ এবং বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দিতে এলো সোয়েল। তারপর দরজার সিটকিনি খুলে দিতেই বাহির থেকে জুয়েল ভেতরে ঢুকেই সোয়েলের কলার চেপে ধরলো। তারপর দেয়ালের সাথে ওকে ঠেসে ধরে ওর গালে এলোপাথাড়ি চড় বসিয়ে দিতে লাগলো।
সোয়েল কিছুই বুঝতে পারছে না।সে বোকার মতো শুধু মার খেয়ে যাচ্ছে।সোয়েলের ঘরে উড়ুম দুরুম শব্দ শুনে ইয়াসমিন বেগম আর তার মেয়ে বিথি দৌড়ে এলো সোয়েলের ঘরে।
ইয়াসমিন বেগমের চোখ কপালে উঠে গেল। শরীর রিম রিম করে কাঁপতে লাগলো।এ কী দেখছেন তিনি দু ছেলের মধ্যে। জুয়েল তার ছোট ভাইকে মারছে।না কোনদিন না।ওই ছোট্ট বেলা থেকে এ পর্যন্ত ওদের দু ভাইয়ের মধ্যে সামান্য ঝগড়াও হয়নি। বরং ওদের দু ভাইয়ের সম্পর্ক ছিল স্বর্গীয়।
একবার স্কুলে জুয়েলকে এক ছেলে অপমান করলে সোয়েল রেগে গিয়ে সেই ছেলেকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল। এমনকি কোন আত্মীয় স্বজন যদি তার সামনে তার ভাইকে নিয়ে কোন হেয় পূর্ণ কথা বলতো তখন সোয়েল সরাসরি মুখের উপর বলে দিতো, আপনি আর আমাদের বাড়িতে আসবেন না। এক্ষুনি আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যান।
আর সোয়েলের প্রতি জুয়েলের যে কী অসীম মায়া তা তো ভাষায়ও প্রকাশ করার মতো না।
একবার সোয়েলের জন্ডিস হলো।সে কিছুই খেতে পারে না। খাওয়ার আগেই হড়হড় করে বমি। শরীর কেমন ভেঙে পড়ছে।জুয়েলও তখন তার ভাইয়ের সাথে সাথে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলো।জোর করেও তাকে খাওয়ানো যায় না।ঘুমাতেও যায় না। তাকে খাওয়ার জন্য, ঘুমাবার জন্য জোর করলে সে খাতায় লিখে দেয়,আমি কী করে খাবো আমার ভাইকে অনাহারী রেখে? আমার চোখের পাতা কীভাবে বুঁজবে আমার ভাইয়ের চোখে জল দেখে?
সেই জুয়েলই কি না আজ সোয়েলের গলা চেপে ধরে আছে।যেন সে মেরেই ফেলবে সোয়েলকে!
ইয়াসমিন বেগম দৌড়ে গেলেন ছেলেদের কাছে। তারপর পেছন থেকে টেনে ধরলেন জুয়েলকে।আর কাঁদতে কাঁদতে বললেন,’এ কী করছিস তোরা? এমন করছে কেন জুয়েল?কী হয়েছে ওর?’
সোয়েল কথা বললো না। ছোট্ট বাচ্চাদের মতো সে কেঁদে উঠলো হাউমাউ করে।
বিথির বয়স কম। এগারো পেরিয়ে বারোতে পড়েছে সদ্য।তার অত বোঝ এখনও তৈরি হয়নি। ভাইয়াকে সে কাঁদতে দেখে সেও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ইয়াসমিন বেগম শুধু বুঝতে পারছেন না তিনি এখন কী করবেন! কেন এমন করছে তার আদরের সন্তানেরা?
তিনি সোয়েলকে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’কেন তোকে মারছিলো তোর ভাইয়া?’
সোয়েল কাঁদতে কাঁদতেই বললো,’আমি জানি না মা! ভাইয়া হঠাৎ এসে দরজায় জোরে জোরে লাথি দিতে লাগলো। শব্দ শুনে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই সে ঘরে এসে আমায় মারতে শুরু করলো!’
কথাগুলো শেষ করে সোয়েল আবার কাঁদছে। হাউমাউ করে কাঁদছে।

ইয়াসমিন বেগম এবার তাকালেন তার বড় ছেলে জুয়েলের দিকে। জুয়েল এখনও বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে রাগে ফুঁসছে।তার গায়ে পাঞ্জাবি নেই। মাথায় টোপড় নেই। গলায় ঝুলানো ফুলের মালাটাও নেই। শুধু গায়ে সেন্ডু গেঞ্জি আর একটা পাজামা পরা। ইয়াসমিন বেগমের কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে।মিতুর সাথে কোন ঝামেলা করে আসেনি তো আবার!
ইয়াসমিন বেগম লিখতে জানলেও এখন তার লিখার শক্তি নাই। তিনি বিথিকে বললেন দৌড়ে ঘর থেকে তার কলম খাতা নিয়ে আসতে।বিথি দৌড়ে গিয়ে ঘর থেকে কলম খাতা নিয়ে এলো। তারপর ইয়াসমিন বেগম বললেন,’লেখ,কী হয়েছে? ভাইয়াকে মারছিলে কেন তুমি?’
বিথি তার চোখের জল মুছে লিখলো কথাগুলো। তারপর সে খাতা নিয়ে তার ভাইয়ের চোখের সামনে মেলে ধরলো। জুয়েল সেই লিখার দিকে তাকিয়ে লিখাটা পড়ে বিথির হাত থেকে একটানে খাতাটা নিয়ে লিখলো,’তোমরা সবাই মিলে এই মেয়েটার সর্বনাশ করেছো।আর আমাকেও পাপী করেছো সাথে।কে বলেছিলো তোমাদের আমার বউ চায়!আমি কতবার না করেছিলাম যে বিয়ে করবো না। কেন তোমরা এটা করলে? তোমাদের এ সাহস কে দিলো একটা মেয়ের জীবন নিয়ে পুতুল খেলবার? তুমি না মা? তোমার নিজেরও তো একটা মেয়ে আছে। তোমার মেয়ের সাথে যদি এমন হতো তবে তুমি তা মেনে নিতে?’
ইয়াসমিন বেগম ছেলের কাছে এলেন।হাত থেকে খাতা টেনে নিলেন। তারপর লিখা গুলো পড়ে কেঁদে ফেললেন। না তিনি তার করা অপরাধের জন্য কাঁদছেন না। তিনি কাঁদছেন তার বোবা ছেলেটার ভেতরের সততা, জ্ঞান আর সূক্ষ্ম বিচারের গুণ দেখে।
ইয়াসমিন বেগম চোখের জল মুছে ছেলের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না। জুয়েল তার মার কাছ থেকে সরে গেল। ইয়াসমিন বেগম ছেলের দিকে তাকালেন।এই কী সেই জুয়েল যাকে তিনি সৌম্য শান্ত জানতেন? কিন্তু অনৈতিকতার বিরুদ্ধে যে তার ছেলে অত সোচ্চার তা শুধু আজকেই তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে