পাত্র বদল পর্ব-০২

0
3490

#পাত্র_বদল
#২য়_পর্ব
#অনন্য_শফিক



মিতু আরেকবার জুয়েলের মুখের দিকে তাকালো।অমন সরল সহজ মানুষের চোখে কী জল মানায়! পুরুষ মানুষেরাও কী কখনো এভাবে কাঁদে?
অন্য কারোর হয়তো এই দৃশ্য দেখে মায়া লাগতো জুয়েলের জন্য। কিন্তু মিতুর বাড়লো রাগ।রাগ বাড়ার কথাও। মিতুর তো কোন খুঁত নাই ‌।দেখতে যেমন সে সুন্দর পড়াশোনাও তার ভালো। বাবার অর্থ সম্পত্বিও আছে ঢের। তার কী আর বড় ঘরের বিয়ের অভাব হতো! এমন একটা বোবা ছেলে কী তার যোগ্য হলো!

মিতু একটানে জুয়েলের কাছ থেকে খাতা কলম টেনে নিয়ে আবার লিখলো,’শুনুন, আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়নি।বর সেজে তো আপনি যাননি!’
জুয়েল লিখাটা পড়লো। তারপর সে লিখলো,’ও শুধু বর সেজেই গিয়েছিল। কিন্তু কাগজ পত্রে নাম আমারই।ওর নাম সোয়েল।সোয়েল নাম রেজিস্ট্রার খাতায় নাই! কিন্তু এই বিয়েটা আপনার সাথে যেহেতু প্রতারণামূলক হয়েছে সুতরাং আপনি আমায় ডিভোর্স দিতে পারেন।’
মিতুর লিখাটা পড়ে মেজাজ গরম হয়ে উঠলো।
সে খাতা টেনে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে লিখলো,’আপনি তো একটা বোবা, আপনার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেলে আপনার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমার কী হবে ভেবেছেন? আপনার লজ্জা শরম নাই। কিন্তু আমার আছে। আমি মানুষকে মুখ দেখাবো কী করে!’
জুয়েল আবার কাঁদছে।হোক সে বোবা! কিন্তু মানুষ তো সে।কথা বলতে পারে না।শুনতে পায় না কারোর কথা। কিন্তু অনুধাবন তো করতে পারে সবকিছু। জুয়েল এই যে এতোটুকু বড় হয়েছে তার সবটুকুই দুঃখে দুঃখে! তাদের গ্রামে তো আর প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা স্কুল নেই।কলেজ নেই।তাই গ্রামে অন্য সব সুস্থ স্বাভাবিক ছেলেদের সাথে এক স্কুলেই পড়তে হয়েছে তার।
স্কুল কলেজে পড়ার সময় কত ছেলে মেয়ে যে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছে!এমনকি তার একটা বন্ধুও নেই পর্যন্ত।কেউ তার সাথে মিশতো না।বোবা বলে সবাই তাকে এড়িয়ে যেতো! আত্মীয় স্বজনেরাও তাকে ভালোবাসতো না। এই জন্যই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কোনদিন সে বিয়ে করবে না।সে ঠিক জানতো কোন মেয়ে তাকে মেনে নিতে পারবে না জীবন সাথী হিসেবে!
মিতুর লিখা কথাগুলো তার বুকের ভেতর বিঁষকাটার মতো বিঁধে গেছে।সে বুঝতে পারছে বোবা বলে তাকে অপমান করছে মিতু।বোবাদেরও মনে কষ্ট আসে। জুয়েলেরও কষ্ট এলো।রাগও পেলো খুব।সে রাগে নিজের গায়ে জড়ানো পাঞ্জাবিটাই একটানে ছিঁড়ে ফেললো। তারপর মাথায় পরা টুপুর, গলায় ঝুলিয়ে রাখা মালা সবকিছু টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলো মেঝেতে। তারপর দু চোখ মুছে খাতাটা নিয়ে ওখানে লিখলো,’আমি চলে যাচ্ছি আপনাকে মুক্তি দিয়ে। আর প্রতারণার বিয়ে কখনো সত্য হতে পারে না।তাই ডিভোর্স দেয়ারও কোন প্রশ্ন আসে না এখানে।আর কথা দিয়ে যাচ্ছি আগামীকাল আপনার সাথে যেভাবেই হোক সোয়েলের বিয়ে দিবো আমি। আপনাদের মঙ্গল হোক।’
কথাগুলো লিখে মিতুর হাতে খাতাটা ধরিয়ে দিয়ে জুয়েল চোখ মুছতে মুছতে জোরে শব্দ করে দরজাটা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মিতু তখনও লিখাটা পড়েনি।সে হতবাক হয়ে শুধু এতোক্ষণ দেখলো একটা বোবা মানুষের ভেতর থেকে প্রকাশ হওয়া কিছু অভিমান,কষ্ট এবং রাগ! এইসব কিছু দেখেও যে মিতুর মন শান্ত হয়েছে তা কিন্তু না।মুখে বলা সহজ যে একটা মানুষ সে কালো হোক, অসুন্দর হোক,মূর্খ হোক,হাত-পা না থাকুক,বোবা,অন্ধ যায় থাকুক তাকে বিয়ে করলে দোষ কী!সেও তো মানুষ। মানুষ তো সবাই সমান!
কিন্তু বাস্তবতা?এই বাস্তবতা যে খুব কঠিন। এই কঠিন বিপাকে পড়ে গেছে মিতু।সে তাই প্রচন্ড রেগে আছে।এই মুহূর্তে সহজ করে কিছুই ভাবতে পারছে না সে।

মিতু পাতাটা তার চোখের সামনে মেলে ধরলো। জুয়েলের চোখের জলে ভিজে আছে খাতায় লিখা অক্ষর গুলো। জুয়েল লিখেছে,’আমি চলে যাচ্ছি আপনাকে মুক্তি দিয়ে। আর প্রতারণার বিয়ে কখনো সত্য হতে পারে না।তাই ডিভোর্স দেয়ারও কোন প্রশ্ন আসে না এখানে।আর কথা দিয়ে যাচ্ছি আগামীকাল আপনার সাথে যেভাবেই হোক সোয়েলের বিয়ে দিবো আমি। আপনাদের মঙ্গল হোক।’
মিতুর এই লিখাটা পড়ে কেমন যেন লাগছে। জুয়েলের জন্য কেমন সমীহ হচ্ছে তার। তবে এই সমীহটা আদৌও ভালোবাসা কি না মিতু জানে না। হয়তোবা এটা মায়া। অসহায় কোন মানুষের দীর্ঘশ্বাস দেখে যেমন একজন মানুষের মায়া হয় তেমন!

মিতুর মন না চাইলেও সে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।তার কেন যেন মনে হয়েছিল জুয়েল এখান থেকে যাবে না।সে
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে মিতুর জন্য। হয়তো ভাববে মিতু এগিয়ে যাবে তার কাছে। তারপর বলবে,সরি! আপনার সাথে আমি খারাপ বিহেভ করেছি।যা হয়ে গেছে তা কাটকুট। আমি আপনাকে মেনে নিয়েছি। আসুন আমরা একসাথে এক ঘরে থাকি। সংসার সাজাই।
কিন্তু মিতুর ধারণা ভুল হলো। দরজা থেকে এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি বেয়েও সে জুয়েলের দেখা পেলো না। জুয়েল একেবারেই অদৃশ্য!
এই জন্য তার মন কেমন হওয়ার কথা। কিন্তু তার মন খারাপ হলো না।উল্টো রাগ পেলো।সে শব্দ করেই বলে উঠলো,’বোবা হয়ে জন্ম নিয়েছে আবার এতো তেজ!’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে