পরী পর্ব ১১..

0
862

পরী পর্ব ১১..

সকলে এখনও হতভম্ব হয়ে সোফায় চুপচাপ বসে আছি। একটু পর ভাইয়ার কল এলো। সে কথা বলতে বলতে বাইরে চলে যায়। না যেতেই ভাইয়ার চিৎকারের আওয়াজ বাহির থেকে ভেসে এলো। আমরা সবাই দৌড়ে বাইরে গেলাম। ভাইয়া দোয়ারের কাছে মাটিতে পড়ে আছে। তার সামনে বড় একটা বাঘ হুংকার ছাড়ছে। নাদিয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠে। সে ভাইয়ার কাছে যেতে চাইল। আমি তাকে কোনোভাবে আটকিয়ে রাখলাম। তাকে আটকে রাখার কারণে ভাইয়াকে বাঁচাতে যেতে পারছি না। সজীব এই মুহূর্তে উপরের তলায়। চিৎকার করে সজীবকে ডাক দিই। ওইদিকে বাঘটা ভাইয়ার কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ার উপর বাঘটা লাফ দিতে যাবে এমন সময় পাশ থেকে সাবিলা দৌড়ে গিয়ে ভাইয়াকে সরিয়ে দিলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ঘটনাটা হয়ে যাওয়ায় আমি কেবল তার নামটাই উচ্চারণ করতে পারলাম। ভাইয়ার পরিবর্তে বাঘটা ওর উপরেই এসে পড়ল। ইতোমধ্যে সজীবও চলে এসেছে। আমি এবং সে কোনোভাবেই সাবিলার উপর থেকে বাঘটাকে সরাতে পারছি না। সাবিলা বাঘটাকে কিছুই করছে না। কিছুক্ষণ পর বাঘটা শান্ত হয়ে গেল। নিজেই সাবিলার গায়ের উপর থেকে উঠে এলো। সাবিলা একটু ব্যথা পেয়েছে। আমি তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অপরদিকে বাঘটা এবার সজীবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি আর ভাইয়া সেদিকে দৌড় দিই। একটি লাঠি নিয়ে বাঘটার সামনে দাঁড়াতেই সেটি নুয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ আমাকে দেখে পিছিয়ে গেল। কিন্তু কেন বুঝছি না। সাবিলা তার ব্যথা বাদ দিয়ে আমাকে থামিয়ে বলল, ‘প্লিজ, ওটাকে কিছু করো না। ওদের কাছেও মানুষের মতো প্রাণ আছে।’
সাবিলা বাঘটার কাছে গিয়ে সেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাঘকে দেখে লাগছে, এটা এই সাধারণ জঙ্গলের নয়। আমিও গিয়ে নির্ভয়ে হাত বুলিয়ে দিলাম। বাঘটার চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে, যেন অনেক বেদনা তার মনে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। আমিও উদ্ভট সব কথা ভাবছি। বাঘটি অবাক করিয়ে দিয়ে আমাদের ঘাড়ের পাশে মুখ গুঁজিয়ে দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।
‘বাঘটা তোদের কিছু করছে না কেন?’, ভাইয়া বলে উঠল। একথায় বাঘটা ভাইয়ার দিকে ফিরে হুংকার ছাড়ে।
ওটা আমাদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে কয়েকবার বড় বড় করে গর্জন দিলো, পুরো জঙ্গল কেঁপে উঠার মতো। দেখতে দেখতেই কয়েকটা শেয়ালের ডাক শোনা গেল। আমরা সবাই তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালাম। জঙ্গলের সেদিক থেকে কিছু একটা যেন আসছে। একি, কয়েকটা শেয়াল! আমরা বাসায় ঢুকে পড়ি। সাবিলা এখনও বাইরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চিৎকার করলাম, ‘সাবিলা, চলে এসো।’
সে আসছেই না। ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর থেকে অনেক প্রজাতির প্রাণী এসে পড়ল। সবাই সাবিলাকে ঘেরাও করে ওকে দেখছে। সাবিলা একা বিধায় আমি ওখানে ছুটে গেলাম। যাওয়ার পর আমাকেও সেসব প্রাণী ঘিরে ধরল। কিন্তু কিছুই করছে না। সাদাকালো সুন্দর একটি বানর সাবিলার গা বেয়ে উঠে ওকে দেখছে। কোত্থেকে যেন একটি তোতাপাখি উড়ে এসে আমার ঘাড়ে বসেছে। আর বারংবার বলছে, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি, আমি তোমায় ভালোবাসি।’
আমরা আশ্চর্যের ওপর আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি। এসব প্রাণী কোথা থেকে এসেছে? কেমন এক অদ্ভুত মায়া কাজ করছে এদের প্রতি। সাবিলা এদের আদর করছে, হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। একটু পর একেক করে এরা জঙ্গলের আঁধারে মিলিয়ে গেল। আমরাও বাসার ভেতর ঢুকে পড়লাম। কারও বিস্ময় কাটছে না। আমি তোতাটাকে রেখে দিই। সেটি এখনও ভালোবাসি ভালোবাসি করছে। আমিও তাকে রিপিট করে বললাম, ‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি কিউটি।’ বলতেই সেটি উড়ে গিয়ে সাবিলার ঘাড়ে বসল। আমার কথাটা ওকে বলতে লাগল। সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। সাবিলা কিছুটা লজ্জা পেয়ে তোতার ঠোঁট চেপে ধরে রান্নাঘরে চলে যায়। এরপর আমার সবাই খাওয়ার পর্ব শেষ করে যে যার যার রুমে শুতে যাই। নাদিয়া সাবিলাকে শাড়ি পরিয়ে আমার রুমে এনে দরজা বেঁধে দিয়ে চলে গেল। রুমে ঢোকার আগে আমি সাবিলাকে থামতে নির্দেশ দিই। সে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি হেসে ড্রয়ারের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুটো নূপুর এনে তার পায়ে পরিয়ে দিলাম। সাবিলা বলে উঠল, ‘ওয়াও! সো বিউটিফুল। আবির, চল আমার ঘুরতে যাই।’
‘এই সময়?’ রাতটা কি আমরা বাইরে কাটাব?
‘কোনো সমস্যা আছে?’
বিরস মুখে বললাম, ‘তা নেই।’
‘তবে চলো। বাহিরের চাঁদের আলোতে এই সময় ঘুরতে খুব মজা লাগবে।’
তার কথায় হেসে উঠলাম, ‘চলো যাই।’
দু’জনই বাসা থেকে বেরিয়ে তার সাইকেলটা বের করে নিই। তাকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে তার সাথে চাঁদনী আলোয় সাইকেল চালিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরলাম। আজকের রাতটির কথা আমি কখনও ভুলব না। এটি আমার জীবনের অধ্যায়ের অদ্ভুত এক রোমান্টিক রাত। ভোলার মতোই নয়। এরপর বাসায় এসে ক্লান্ত হওয়ায় আমরা দু’জন সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ি।
.
সকাল চারটার দিকে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় মেঘের গর্জনে। চোখ পাকিয়ে দেখি বাইরে মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। একটু পর পর ভয়ানক বজ্রপাত। পাশ ফিরে দেখলাম, সাবিলা নেই। লাইট অন করে তার নাম ধরে ঘরের চারিদিকে তাকে খুঁজতে লাগলাম। রুম থেকে বাইরে গেলাম হাঁক পেড়ে। আমার চিৎকারে ইতোমধ্যে সবাই ঘুম থেকে উঠে এলো। ভাইয়া বলল, ‘কী হয়েছে আবির? এই আধ সকাল চিৎকার করছিস কেন?’
‘সাবিলাকে কোথাও পাচ্ছি না।’ কারও আতঙ্কের সীমা রইল না।
সকলে সাবিলাকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। বিদ্যুতও নেই বাসায়। আমরা ছেলেরা ছাতা নিয়ে বেরুলাম। যখন সূর্য উঠে চারিদিকে কিরণ দিতে শুরু করল, তখনও আমরা তাকে খুঁজে পেলাম না। তার বাসায়, আজাদ আঙ্কেলের বাসায় চারিদিকে খুঁজে হতাশ হয়ে বাসায় ফিরতে হলো। আসতেই নাদিয়া দৌড়ে এসে বলল, ‘আবির, তোর রুম পরিষ্কার করতে গিয়ে আমি একটা চিরকুট পেয়েছি দেখ।’
চিরকুটটা হাতে নিয়ে সবাইকে শুনিয়ে পড়তে লাগলাম।
‘প্রিয় আবির,
আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি এভাবে তোমাকে না বলে চলে যাওয়ার জন্য দুঃখিত। যে কাজটা করতে বেরিয়েছি তা আমি না করে শান্তি পাব না। আমাকে আমার নিয়তি এখানে আনিয়েছে। তোমার সাথে দেখা করিয়েছে। আমি তোমাকে সবকিছু বলতে চেয়েছিলাম। বলার সুযোগ পাইনি। গতকাল পেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে বলতে দাওনি। আমি কখন আসব ঠিক জানি না। তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করব। তুমি কষ্ট পেও না। তুমি কষ্ট পেলে আমার ভালো লাগবে না। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। নিজের খেয়াল রেখো।
ইতি,
তোমার সাবিলা
আমি চোখে ঝাপসা দেখতে লাগলাম। নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে সোফায় বসে নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম, তাকে না পেতেই হারিয়ে ফেলার ভয়ে। তোতা পাখিটা এসে আমার কাঁধে বসল। আমার হাতের দিকে চোখ গেলে দেখি, আমার হাতে এখন একটি নয়, দুটো তাবিজ। সাবিলা কি তারটাও আমাকে পরিয়ে দিয়ে গেছে?
আজ শুক্রবার বিধায় মা-বাবা অনেক তাড়াতাড়িই চলে এসেছে। যাকে দেখতে এসেছে তাকেই দেখানো হলো না। সাবিলার চলে যাওয়ার কথা ভাইয়া তাঁদের জানায়। সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যস্ত। ইভা খবর পেয়ে সকালে চলে এসেছিল।
এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share


দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে যায়। সাবিলা আসে না। মা-বাবা আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমিই যাইনি। কারণ এখানে সাবিলার অনেক স্মৃতি। তাঁরা নিজের মতো করে চলে গিয়েছে। আমি অনেক দিন পর বাইরে বেরুলাম। পিংক সাইকেলটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চালানোর মানুষটা এখন নেই। বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল অজ্ঞাত এক আশংকায়। নিজেকে সামলিয়ে আজাদ আঙ্কেলের বাসায় গেলাম। তাঁকে বললাম, ‘সাবিলা তো এখনও আসছে না। তাই বাসাটি ছাড়তে পারছি না। সে আমার জন্য কেবল কিছু স্মৃতি রেখে গেছে। ওই বাসায় তার অনেক স্মৃতি। এখন ওইগুলোই আমাকে একটু শান্তি দেয়। প্লিজ আঙ্কেল, ওই বাসাটি আমাকে দিয়ে দিন। আপনি যত টাকা চাইবেন আমি দেব।’
‘এ কী বলছ?’ আঙ্কেল বললেন, ‘বাসাটাকে এখন থেকে তুমি নিজের ভাবতে পারো। আমার কাছে কোনো টাকা লাগবে না। তুমি আমার ভাইয়ের আত্মার শান্তির জন্য যা করেছ তা আমি কখনওই ভুলব না বরং তোমাকে কিছু দিতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’
দুইদিনের ভেতর আজাদ আঙ্কেল বাসাটি আমার নামে করে দিয়ে আমাকে তার ডকুমেন্টের পেপার দিয়ে দিলেন। আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। নিজেকে আগের চেয়ে শক্ত করলাম। আজ কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে রাস্তা দিয়ে আসার সময় একটি ছোট ছেলেকে দেখলাম, ফুটপাতে বসে কিছু গোলাপ বিক্রি করছিল। কিন্তু কেউ নিচ্ছে না। তার অসহায় মুখ দেখে সাবিলার চেহারা ভেসে উঠল। মেয়েটিও একদিন ফুটপাতে থাকত। ছেলেটির কাছ থেকে চওড়া দামে আমি ফুলগুলো কিনে নিই।
জঙ্গলের পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সে রাস্তা দিয়ে, যেখানে সাবিলা আমাকে পেছনের সিটে নিয়ে সাইকেল চালিয়েছিল। সবই আজ স্মৃতি। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে মন চাইছে না। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একটু দূরে সেই গর্তটা। তার পাশ দিয়ে যেতেই কঙ্কালটা উঠে এলো আগের মতো। কিন্তু সেটি কিছুই করতে পারল না। দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে রইল, হয়তো আমার হাতে এখন সাবিলার তাবিজ দুটোই আছে বলেই। আমি কঙ্কালটির উদ্দেশ্যে বললাম, ‘পৃথিবীর মানুষগুলো অনেক খারাপ, অনেক। নিজ স্বার্থে তারা কাউকে খুন করতেও ভয় পায় না। আমি জানি, আপনি একটি অতৃপ্ত আত্মা। সেই অভিশপ্ত রাতে একটি মেয়েকে যখন দুটো লোক ক্ষত অবস্থায় জোর করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন আপনি ওই অপরাধের সাক্ষি ছিলেন। ওই কাপুরুষদের বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়ায় তারা আপনাকেও ছাড়েনি। আপনার সম্বন্ধে জেনে অনেক খারাপ লেগেছে। ভালো মানুষদের ভাগ্যই এমনটা হয়। তবে আমি আপনার রূহকে শান্তি দেওয়ার জন্য আপনার খুনিকে শীঘ্রই শাস্তি দেওয়াব। আর শুনুন, ওই দু’জনের একজন করুন শাস্তি পেয়েছে, মৃত্যু। আশা করি, অন্যজনও পেয়ে যাবে। তাকে পেতেই হবে। জানি না, সে আপনার মতো কত নির্দোষ মানুষকে মৃত্যু দিয়েছে।’
কঙ্কালটি তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়, সম্ভবত জড়িয়ে ধরার জন্য। আমি হাতের ব্যান্ডগুলো খুলে মাটিতে রাখলাম, যাতে করে “তিনি” আমাকে স্পর্শ করতে পারেন। কঙ্কালটি সাদরে আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখে। বোধ হলো, যেন জীবন্ত কাউকে জড়িয়ে ধরেছি। একসময় এটিরও প্রাণ ছিল। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমাকে আশীর্বাদ করে ওই গর্তে আবার শুয়ে পড়লেন। আমি ব্যান্ডগুলো আবার পরে নিয়ে তাঁর গর্তের পাশে হাতের গোলাপগুলো রেখে চলে এলাম।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার