পদ্মপাতার জল পর্ব -০৬

0
966

#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০৬

__’কত কাবিন করেছিস?এ-এ-এক কোটি সতেরো টাকা?’

মাজেদা বেগম ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।তার হাত থেকে কাবিনের কাগজটা খসে পড়ে গেল।তিনি ভাবতে পারছে না,এরকম একটা অশিক্ষিত,অন্ধ মেয়েকে কি না তার বিদেশ পড়ুয়া ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে!একে তো তিনি কিছুতেই বিয়েটা মেনে নিতে পারছেন না,তার উপর কাবিনের টাকার পরিমাণ হার্ট অ্যাটাক ঘটানোর জন্য লাফালাফি শুরু করেছে।তিনি কোনোরকমে বললেন,

__’পানি!পানি!এক গ্লাস পানি।’

রেখা দৌঁড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে মাজেদা বেগমের মুখের সামনে ধরলো।তার চোখে মুখে হাসি উপচে পড়তে চাইছে।কিন্তু অনেক কষ্টে সে আটকে রাখছে।নইলে চাকরি নট হয়ে যেতে পারে!

মাজেদা বেগম পুরো এক গ্লাস পানি এক চুমুকে শেষ করলেন।মুখ মুছে রেখার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,

__’তুই খুশিতে লাফাচ্ছিস কেন রেখা?মনে হচ্ছে, তোর নিজের মেয়ের বিয়ে হয়েছে!’

রেখা ফ্যালফ্যাল করে বলল,

__’আফা কি যে কন না!আমি লাফামু ক্যান?আমার তো মেজাজ খারাপ হই যাচ্ছে মাইয়াডার কর্মকান্ড দেইহা।তয় কি আর করা!দুইজনি ছোডো মানুষ। একটা কাম কইরাই ফ্যালছে,আামাগো মাইনা লওয়া উচিত।’

মাজেদা ভীষণ বিরক্ত হলো।বলল,

__’তুই যা তো।রান্না তুলে দে।আমার মন ভালো নেই। আমার জন্য বেগুন দিয়ে টেংরা মাছ রান্না কর।আর খাবারটা রুমে দিয়ে আসিস।’

মাজেদা বেগম এক নজর মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো।মেয়েটাকে বিয়ের সাজে কি সুন্দর লাগছে!কিন্তু সৌন্দর্যই তো সবকিছু না।মেয়েটার কোনো গুণ নেই।তাছাড়া সেই ছোটবেলা থেকে তার কলিজার টুকরো ছেলেটা মেয়েটার জন্য পাগলপ্রায়।সে মা বলে কোনো কিছু বুঝতে বাকি রাখেনি।সেজন্য মেয়েটাকে কেন জানি তার পছন্দ হয় না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে পা বাড়ালেন।

অনিরুদ্ধর বাবা আজাদ খান এতক্ষণে মুখ খুললেন।শব্দ করেই হেসে ফেললেন।

__’আমার ছেলে দেখছি ভীষণ ফাস্ট!দেশে ফেরার তিন দিনের মধ্যে সরাসরি বিয়ে করে নিলো।আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।অবশেষে বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকবে।’

বাবার কথা শুনে দুভাই হেসে ফেলল। অনির্বান অনিরুদ্ধর পিঠে হালকা চাপড় মেরে বলল,

__’এসব কি!হ্যাঁ?আমার শ্যালিকাকে আমার অজান্তে বিয়ে করে নিলি?কাজটা কি ঠিক?’

__’আহ!ভাইয়া।স্যরি।তবে তুমি যদি চাও তাহলে আরেকবার বিয়ে করতে আমার আপত্তি নেই।’

দুজন আবারো হেসে উঠলো।শুভ্রা এতক্ষণ সিঁড়ির পাশে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও আর পারলো না।এদের দু-ভাইয়ের হাসি শুনে তার কানে জ্বালা করছে।অনিরুদ্ধ যে এরকম কাজ করে ফেলবে তা তার ধারণাতে ছিল না।

শব্দহীন ভাবে হেঁটে মৃন্ময়ীর সামনে দাঁড়ালো।এক হাত দিয়ে টান মেরে দাঁড় করালো।মৃন্ময়ী অস্ফুটস্বরে একবার উচ্চারণ করলো,

__’বুবু! ‘

শুভ্রা তাকে টানতে টানতে রেখা খালার রুমে নিয়ে গেল।

অনিরুদ্ধ মুখ চুপসে বলল,

__’ভাইয়া,তোমার বউটা এরকম কেন?আমাদের লাভ স্টোরিতে ভিলেন না হলে কি এর পেটের ভাত হজম হবে না?’

__’এ তুই থাম।খবরদার আমার বউকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।তাইলে আমিও ভিলেন হতে দুবার ভাববো না।’

অনিরুদ্ধ হেসে ফেলল। বাড়িতে আসার পর তার ভাবীর সাথে বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু শুভ্রা ভাবী সুনিপুণ ভাবে তাকে ইগনোর করেছে!

অনিরুদ্ধর অন্তিকের কথা মনে পড়লো।আজ সকাল থেকে দেখেনি একবারো।

__’ভাইয়া অন্তিক কোথায়?দেখছি না তো!’

__’এই রে,ওর কথা তো ভুলেই গেছি প্রায়।রাত আটটা বাজে এখন।অন্তিক ওর ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে গেছে। আমাকে বলেছে রাতে গিয়ে নিয়ে আসতে।আমাকে উঠতে হবে এখন।’

অনির্বান উঠে দাঁড়ালো।অনিরুদ্ধ তার হাত ধরে বাচ্চাদের মতো বলল,

__’আমার বউকে ঘরে দিয়ে যাও ভাইয়া।নইলে ভাবী ওর ব্রেন ওয়াশ করবে।অলরেডি করে ফেলেছে।’

অনির্বান হেসে ফেলল।

__________________

মৃন্ময়ী অনিরুদ্ধর রুমে সোফাতে বসে আছে।অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে সে।

গা চুলকাচ্ছে তার।সারাদিন গোসল করা হয়নি।তাছাড়া সারা গায়ে ভারী গহনা।প্রচুর অস্বস্তি লাগছে।

রুমটাতে নতুন সে।ছোটবেলাতে দু একবার অনিরুদ্ধর রুমে সে এসেছিল।কিন্তু রুমের কোথায় কি আছে সব ভুলে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা, এত বছর পর অনিরুদ্ধ কোন রুমে উঠেছে তাও অজানা।

রুমের কোথায় কি তা বুঝতে পারছে না সে।ওয়াশরুম কোন দিকে তা বোধগম্য হচ্ছে না।ঠিক এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।সত্যি সে অসহায় আর অন্যের বোঝা বৈকি কিছুই নয়।

না চাইতেও অনিরুদ্ধর প্রতি তার অভিমান জমে উঠলো।সেই কখন তাকে সোফাতে বসিয়ে রেখে চলে গেছে।কিন্তু ফেরার নাম নেই!

হঠাৎ করে তার বুবুর কথা মনে পড়লো।জীবনে প্রথম তার বুবু তাকে একটা চড় মেরেছে।মারার সাথে সাথে তাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছে।

বু্বুর ধারণা অনিরুদ্ধ তার রুপের মোহে পড়ে দুদিনের জন্য বিয়েটা করেছে।মোহ কেটে গেলেই তার মতো অসহায়কে সরিয়ে দেবে নিজের জীবন থেকে। এরকম ঘটনা নাকি বিদেশে অহরহ হয়।আর অনিরুদ্ধ জীবনের অনেকটা সময় বিদেশে কাটিয়েছে।এটা সত্যি যে ধারণা টা শুধু তার বুবুর নয়।এই একই ধারণা তার নিজেরো।

রূপের মোহো!কথাটা দুবার উচ্চারণ করলো মৃন্ময়ী।সে কি সুন্দরী?রূপবতী? জানা নেই তার।কত বছর হলো সে নিজের চেহারা আয়নাতে দেখে না।তবে রেখা খালা প্রায়ই তার রূপের প্রশংসা করে।কিন্তু সেটা তো স্রেফ সান্ত্বনার বাণী ভেবে এসেছে এতদিন।

তবে কি সে সত্যিই রূপবতী?

অনিরুদ্ধ দরজা ঠেলে রুমে ঢুকলো।তার এক হাতে খাবার,আরেক হাতে একটা প্যাকেট।

মৃন্ময়ী এখনো সেভাবেই বসে আছে যেভাবে সে রেখে গেছিল।মন খারাপ হয়ে গেল তার।প্যাকেটটা মৃন্ময়ীর হাতে দিল।

নরম গলায় বললো,

__’এখানে পোশাক আছে।শাওয়ার নিয়ে পড়ে আসো।’

মৃন্ময়ী চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।

অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলো বিষয়টা।মৃন্ময়ীর হাত ধরে ওয়াশরুমের কাছে নিয়ে গেল।মৃন্ময়ী যাওয়ার সময় গুণে গুণে পা ফেলল।

ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো অনিরুদ্ধ। বাইরে থেকেই একটু জোরে বলল,

__’প্যাকেটে শাড়ি আছে।যদি পড়তে না পারো তাহলে বলো আমাকে।আমি পড়িয়ে দিবো!’

মৃন্ময়ী উত্তর দিল না।তার জানা নেই একজন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন মানুষের জীবনের সাথে একটা অন্ধ মেয়ের জীবন কিভাবে সূত্র মেলাবে!

ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই অনিরুদ্ধ হাত ধরে এনে বেডে বসালো।

মৃন্ময়ীর পরণে এখন কালো জর্জেটের শাড়ি।অনিরুদ্ধ তাকিয়ে আছে তার দিকে।সে ভেবেছিল মৃন্ময়ী হয়তো শাড়ি পরতে পারবে না ঠিকমতো।কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো সে বেশ সুন্দর ভাবেই গুছিয়ে শাড়ি পড়েছে।

মৃন্ময়ীর মাথায় টাকো পেঁচানো এখনো।সারা মুখে, গলায় এখনো হালকা গুড়িগুড়ি পানি।কি সুন্দর, স্নিগ্ধ লাগছে তাকে!বৃষ্টি ঝরে যাওয়ার পরমুহূর্তের আকাশের মতো লাগছে!

অনিরুদ্ধ টেবিল থেকে খাবারের প্লেট হাতে নিল।মৃন্ময়ী বাড়িতে আসার পরো তার সাথে একটা কথাও বলেনি।

__’এখন চুপচাপ খেয়ে নিবে।বাড়তি কথা বলা আমার একদম অপছন্দের। হা করো!’

অনিরুদ্ধর কথা শুনে মৃন্ময়ীর মেজাজটা চরমে ওঠে গেল।কিন্তু কিছু বলল না।এখন পর্যন্ত অনিরুদ্ধ তার একটা কথারও দাম দেয়নি।সে আর কথাই বলবে না।

__’কি হলো,হা করো।নাকি অন্য পন্থা অবলম্বন করতে হবে?’

অনিরুদ্ধর ধমকানিতে মৃন্ময়ী খাওয়া শুরু করলো। তার সাথে সাথে অনিরুদ্ধও খেয়ে নিল।

খাওয়া শেষে অনিরুদ্ধ নিজের হাত বাড়িয়ে বলল,

__’এ রুমে তো তুমি নতুন।আমার হাত ধরো।সবকিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।কোনটা কত দূরে,কোন দিকে সব বুঝিয়ে দেই।এখন থেকে তো এ রুমেই থাকতে হবে।’

মৃন্ময়ী কথা না বলে আর থাকতে পারলো না।

কাঠ গলায় জবাব দিল,

__’আমি নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো আপনার আর কোনো কথা মানতে বাধ্য নই।আমি ঘুমাবো এখন।আর খবরদার!আমাকে কোনো প্রকার স্পর্শ করার চেষ্টা করবেন না।তাহলে সকালে আমার মুখ আর দেখতে পাবেন না।’

শেষের কথাগুলো অনিরুদ্ধর বুকে গিয়ে লাগলো।সে কি কোনো ভুল করলো?মৃন্ময়ীর ভালো করতে গিয়ে তাকে আরো কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিল না তো?

কিন্তু বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধন ছাড়া তো সে মৃন্ময়ীর কাছাকাছি যেতে পারতো না।তার উপর কোনো অধিকার দেখাতে পারতো না।

এখন মৃন্ময়ী তার বউ।তার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলিয়ে তাকে এক চিলতে সুখ দেয়াই তোর কাম্য। তার অনুভূতিহীন মনে বসন্তের ফুল ফোটানো তার দায়িত্ব।

অনিরুদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইদানীং দীর্ঘশ্বাস গুলো অনেক ঘনঘন হয় আর স্থায়ী কালও অনেক দীর্ঘ হয়।এর কারণ জানা নেই। হয়তো জানাও আছে।কিন্তু মন মানতে চায় না।

মন!দুই অক্ষরের কি অসীম,গভীর একটা শব্দ। সত্যি একে বোঝার সাধ্য দূর্লভ।

অনিরুদ্ধ শান্ত গলায় বললো,

__’তুমি তাহলে ঘুমিয়ে পরো।বেডেই ঘুমাও।আমি সোফাতে ঘুমাচ্ছি।রাতে কোন কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে।লাইট কি অফ করবো?’

মৃন্ময়ী কোনো প্রতিত্তর করলো না।অনিরুদ্ধর নিজের উপর নিজেরই রাগ উঠলো।বার বার ভুল কথা কেন বলছে?শিট!!

মৃন্ময়ী মাথার টাওয়ালটা বেডের এক পাশে রেখে বালিশের অবস্থান ঠাওড়ে মাথা রাখলো।তারপর গলা পর্যন্ত চাদর টেনে চোখ বন্ধ করলো।সে একটু বেশিই ক্লান্ত!

অনিরুদ্ধ বেডের দিকে এগিয়ে আসলো।মৃন্ময়ীর দিকে ঝুঁকতেই মৃন্ময়ী দ্রুত চোখ খুলল।ভীত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

__’কি করছেন কি?অনিরুদ্ধ ভাই আপনি আ……..’

অনিরুদ্ধ তার ঠোঁটে আঙুল রেখে চুট করিয়ে দিল।বলল,

__’আমি বালিশ নিতে এসেছি জাস্ট।ভয় পাওয়ার কিছু নেই।তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।’

মৃন্ময়ীর ডান পাশ থেকে বালিশ টেনে নিয়ে অনিরুদ্ধ সরে আসলো।মৃন্ময়ী লম্বা করে নিঃশ্বাস নিল।

অনিরুদ্ধ সোফাতে বালিশ রেখে হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।লাইট বন্ধ করলো না।তার দৃষ্টি মৃন্ময়ীতে নিবন্ধ।

মৃন্ময়ী মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে পিঠ দিল।

অনিরুদ্ধ তবুও তার থেকে দৃষ্টি সরালো না।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে