পদ্মপাতার জল পর্ব -০৭

0
965

#পদ্মপাতার জল
#মুন্নি আরা সাফিয়া
#পর্ব_০৭

অফিস থেকে ফিরে হাতের কোটটা বিছানায় ছুঁড়ে রাখলো অনিরুদ্ধ।বড্ড ক্লান্ত সে।সারা রুমে নজর বুলালো একবার।মৃন্ময়ীকে কোথাও দেখতে পেল না।

বেলকনির দিকে কয়েক পা এগিয়ে সামান্য পর্দা সরালো। মৃন্ময়ী বেলকনিতে মাঝ বরাবর বসে আছে। তাকে দেখে স্বস্তিতে হালকা ঠোঁট প্রসারিত হলো।মুহূর্তে ভেতরের সব ক্লান্তি উবে গিয়ে স্বচ্ছ প্রশান্তিতে মন ভরে উঠলো।

ওয়ারড্রব থেকে ট্রাউজার আর টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।

শাওয়ার ছেড়ে তান নিচে দাঁড়াতেই শীতল পরশ ছুঁইয়ে গেল।দুচোখ বন্ধ করে সামনের লেপ্টে থাকা চুলগুলো ঠেলে সরালো অনিরুদ্ধ।

মৃন্ময়ীর চেহারাটা ভেসে উঠলো দুচোখের পাতায়।কতটা কাছে অনুভব করলো তাকে। তার সাথে মিশে আছে যেনো।

আজ তাদের বিয়ের দুই মাস পূর্ণ হলো।তাদের সম্পর্কটা আর বিশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক থাকলে আজকে রাতটা সেলিব্রট করে কাটাতো।

কিন্তু তা আর হলো কই!সে আজ পর্যন্ত মৃন্ময়ীর ততটা কাছে যেতে পারেনি।

মৃন্ময়ীর উপর ভালোবাসার অধিকার খাটানোর জন্য সে বিয়েটা করেছিল।ভেবেছিল, জোর করেই মৃন্ময়ীর সব দুঃখ দূর করবে।সে পারেনি।কেন জানি সে মৃন্ময়ীর উপর জোর ফলাতে পারে না।তবে সে সম্পর্কটাতে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে বন্ধুত্বে পরিণত করার।

দেড় মাসের মতো হলো বাবার অফিসে জয়েন করেছে অনিরুদ্ধ।বিজনেস সম্পর্কে তার দক্ষতা ঈর্ষণীয়।এ কয়েক দিনেই তাদের প্রজেক্টের সুনাম তরতর করে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

অনিরুদ্ধ ড্রেস পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।

মাথা মুছে সরাসরি টেবিলের উপর তাকালো সে।আজও টেবিলে এক কাপ ধোঁয়া উঠা চা।

সে মুচকি হাসলো।

এটা তার রুটিনে পরিণত হয়ে গেছে অনেকটা।অফিস জয়েন করার দিন থেকেই সে অফিস থেকে ফিরলে মৃন্ময়ী তার জন্য চা করে নিয়ে আসে।

প্রথমদিকে অনিরুদ্ধর ভয় হতো।মৃন্ময়ীকে অনেক বকা দিতো কিচেনে যাওয়ার জন্য। যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় এই ভয়ে।

কিন্তু মৃন্ময়ী তার বারণ শোনেনি।রোজ তার জন্য নিজ হাতে চা করে।মৃন্ময়ীর হাতে বানানো চা খেতে যে কি পরিমাণ ভালো লাগে তা শুধু সে ই জানে।ত্রিভুবনের কোনোকিছুর তুলনা হয় না এই চায়ের স্বাদের সাথে!

অনিরুদ্ধ চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে মৃন্ময়ীর পাশে গিয়ে বসলো।মৃন্ময়ীর দিকে তাকালো। মৃন্ময়ীর হাতেও এক কাপ চা।

তার মনটা একটু খারাপ হলো।ভেবেছিল, দুজন এক কাপে চা খাবে।কিন্তু মৃন্ময়ী তো আরেক কাপ চা হাতে নিয়ে অলরেডি খাওয়া শুরু করেছে।

অনিরুদ্ধ কিছুক্ষণ ভেবে দ্রুত মৃন্ময়ীর চায়ের কাপটা নিজের হাতে নিল।মৃন্ময়ী মাথা ঘুরালো তার দিকে।তার মুখে স্পষ্ট অবাকত্ব ফুটে উঠেছে।

অনিরুদ্ধ নিজের কাপে এক চুমুক দিয়ে দ্রুত সেটা মৃন্ময়ীর হাতে ধরিয়ে দিল।

গলা কেশে বলল,

__’এটা খাও।তোমার কাপে বাইরে থেকে পাতা উড়ে এসে পড়েছে।’

মৃন্ময়ী আস্তে করে ওহ বলল।তাপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনিরুদ্ধর আড়ালে হেসে ফেলল। সে জানে অনিরুদ্ধ ইচ্ছে করে তার চা টা খাওয়ার জন্য বানিয়ে বলল সব।

এটা নতুন নয়।নানা বাহানায় সে তার এঁটো চা খায়।কিন্তু কখনো সরাসরি বলবে না। কখনো তার চিনিতে মিষ্টি কম হয়,কখনো পোকা পড়ে,কখনো পাতা পড়ে,কখনো ধূলো উড়ে আসে।মৃন্ময়ী আবারো হেসে ফেলল।

শব্দহীন নিরব সে হাসি।যা সবার দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায় প্রতিটা সময়!

অনিরুদ্ধ সম্মুখ থেকে দৃষ্টি সরালো।মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলল,

__’মিস মৃন্ময়ী অতন্দ্রীলা।ওহ,স্যরি।মিসেস অনিরুদ্ধ, বাইরে ঘুরতে যেতে মন চায়? ‘

মৃন্ময়ী নিচু স্বরে বলল,

__’না!’

__’কিন্তু আমার তো যেতে মন চায়। ‘

__’যান না তাহলে।ধরে রেখেছে কে!চোখ, নাক,কান অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয় ঠিকঠাক আছে।তার চেয়ে বড় কথা টাকাও আছে। তাহলে যেতে বাধা কোথায়।আর যাওয়ার সময় দেখেশুনে গাড়ি চালাবেন।কারো গায়ের উপর উঠিয়ে দিবেন না কিন্তু। ‘

__’এই,তুমি এতো কথা বলা শিখেছো কবে থেকে?’

__’ওমা!কথা বললেও দোষ,না বললেও দোষ।অনিরুদ্ধ ভাই,আপনি আসলে চান টা কি বলেন তো?’

অনিরুদ্ধ সামান্য হাসলো।তারপর গম্ভীর হয়ে বলল,

__’আমি কি চাই?আমি তো অনেক কিছু চাই।কিন্তু তুমি কি তা দিবে?’

মৃন্ময়ী ভয়ে ঢোক গিলল।তার এরকম প্রশ্ন করা যে উচিত হয়নি মাত্র মগজে ঢুকলো তা।

অনিরুদ্ধ বড় করে দম নিয়ে বলল,

__’তবে আপাতত আমি সিম্পল তিনটা জিনিস চাই। এক,আমাকে নাম ধরে ডাকবে।না পারলে ওগো বা এই যে বা জাহান্নাম বলে ডাকো,কিন্তু খবরদার ভাই বলে ডাকবে না।দ্বিতীয়ত,তুমি করে বলবে।আর তৃতীয় এন্ড আজকের মতো শেষ চাওয়া আমার সাথে একটু বাইরে বের হবে।কি পূরণ করতে পারবে?’

__’প্রথম দুটো চেষ্টা করবো।আর শেষেরটা সম্ভব নয়।আমি এখন ঘুমাবো।’

মৃন্ময়ী উঠে দাঁড়ালো।রুমের দিকে পা বাড়াতেই অনিরুদ্ধ তাকে কোলে তুলে নিল।

মৃন্ময়ী ছোটাছুটি করতে করতে বলল,

__’আপনার এই বদঅভ্যেস টা কবে যাবে বলুন তো?কোনোরকম সতর্কবাণী না দিয়েই হুটহাট কোলে তুলে নেন।যত্তোসব!’

__’সতর্কবাণী দিলে কি তুমি কোলে তুলতে দিতে?তোমাকে আমি খুব ভালো করে চিনি।’

মৃন্ময়ী হঠাৎ করে থমকে গেল।সত্যি কি অনিরুদ্ধ তাকে চিনে?তাহলে তার মনের ভাষা কেন পড়তে পারে না?কেন বুঝতে পারে না তার সবটা জুড়ে যে এই মানুষ টার বিচরণ?দুজনের মাঝে এই যে যোজন যোজন দূরত্ব, তা যে তাকে ভীষণ ভাব৷ পোড়ায় কেন বুঝতে পারে না?

তার চোখ ভিজে উঠলো।

অনিরুদ্ধ মৃন্ময়ীকে বিছানায় শুইয়ে তার পাশে নিজেও শুয়ে পড়লো।মৃন্ময়ীর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ বন্ধ করলো।মৃন্ময়ী নিজের হাতটা সরানোর চেষ্টা করলো।

অনিরুদ্ধ আস্তে করে বলল,

__’বাইরে যেতে চাইলাম যেতে দিলে না।এখন ঘুমাবো,হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করো না।ঘুম হবে না।’

__’আপনি কিছু খাবেন না?অফিস থেকে ফিরে তো কিছু খাননি।’

__’ক্ষুধা নেই।দুপুরে খেয়েছি তো!ঘুমাও এখন।’

মৃন্ময়ী আর কিছু বললো না।চোখ বন্ধ করে হাসলো একটু।

নিজের হাসিতে নিজেই অবাক হলো।ইদানীং কি অনেক ঘনঘন হাসে সে?তবে কি অবশেষে এতগুলো বসন্ত পড়ে তার বাগানেও সুখের বসন্ত ধরা দিল?এ বসন্ত কি চিরস্থায়ী হবে নাকি কাকডাকা ভোরের মতো ক্ষণস্থায়ী?

জানা নেই!

__________________

গভীর রাত।অনিরুদ্ধ আর মৃন্ময়ী ছাদে বসে আছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে মুগ্ধ চারিপাশ।দুজনের কেউ কথা বলছে না।

যেনো বসে বসে নিস্তব্ধতাকে অনুভব করছে!

অনিরুদ্ধ আচমকা কবিতার লাইন আওড়ানো শুরু করলো।

“আমার কাছে আধেকটা সম্পূর্ণের চেয়ে বেশি
প্রচন্ড ব্যথায় ফুসফুসে যখন বাতাস আটকে যায়
তখন আধেক শ্বাসটাই আমার হৃদপিণ্ডটা সচল রাখে।

আধেক স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে
তাইতো সম্পূর্ণ দেখতে হাপিত্যেশ করি।
আধেক চাঁদে বিমুগ্ধ হই
সম্পূর্ণ আমায় উপহাস করে।
দিনের আধেকটা কাটে নিরবতায়
বাকিটা যন্ত্রণায়।
আধেক নামে ডাকো যখন
মর্ম স্পর্শ করে।

___(আধেক উপাখ্যান, ®স্কাইলার্ক স্মৃতি)

কবিতার প্রতিটা শব্দ যেনো ছুঁয়ে গেল মৃন্ময়ীকে।তাকে নিয়েই যেনো স্বযত্নে প্রতিটা শব্দ লেখা।ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার।

কি বোঝাতে চাইছে অনিরুদ্ধ তাকে?

__’মৃন? ‘

অনিরুদ্ধর ডাকে মৃন্ময়ী চমকালো।কিন্তু তা এই অন্ধকারেই আচ্ছন্ন থেকে গেল।সে আস্তে করে বলল,

__’হু?’

__’তুমি এই যে আমার আধেক বউ হয়ে আছো,এটাই আমার কাছে স্বর্গীয় সুখ মনে হয়।এই আমরা পাশাপাশি বসে আছি,কথা বলছি এসব আমার কাছে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়।অফিসের সময়টুকু তোমাকে ভেবেই কেটে যায়।অফিস শেষে আমার একটাই উদ্দেশ্য থাকে।দ্রুত বাসায় এসে এক নজর তোমাকে দেখা।তোমার হাতের চা টা একসাথে বসে উপভোগ করা।তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা সোনাঝরা বিকেল আমার কাছে অমূল্য স্মৃতি।

তোমাকে একদম নিজের করে না পেলেও আমার এই আধেক বউকে নিয়েই আমি সুখী।পরম সুখী। ‘

মৃন্ময়ী কিছু বলল না।তার চোখ আবারো ভিজে উঠেছে।কিছুক্ষণ নিজের অনুভূতির সাথে লড়ে মাথাটা অনিরুদ্ধর কাঁধে এলিয়ে দিল।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে