নীড় পর্ব-০৯

0
697

#নীড় #নবম_পর্ব

#সুহা

ওই দেখো তো সব ঠিকঠাক মতন হইসে নাকি? দিদির ভালা লাগবো তো?(নাইমা)

সব ঠিকই আসে কিন্ত তুমি ঠিক নাই।ঘররে এত্ত সাজাইসো এবার নিজেরেও একটু সাজাও। যাও সুন্দর কইরা রেডি হইয়া লও। (আনিক)

আনিকের কথায় সায় জানিয়ে নাইমাও প্রস্তুত হতে চলে গেলো। আর আনিক ঘরের সব ঠিক করে আবার দোকানের দিকটাও ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে গেলো। আজ তারা সবাই অনেক ব্যস্ত অঙ্কিতা আসবে বলে কথা তারউপর অঙ্কিতা বলেছে সবকিছু পরিপাটি রাখতে বিশেষ করে দোকানটা। আর যেহেতু অঙ্কিতা বলেছে তাহলে কোনো কারণ থাকবেই এই ভেবে আনিক আর নাইমাও দিরুক্তি না করে অঙ্কিতার কথামতো সকালে উঠেই সবকিছু গোছগাছ করতে লেগে পরে। আনিক সব দিক গোছগাছ করে মাত্র ঘরে প্রবেশ করবে এমন সময়,গাড়ির হর্ণের শব্দ তার কানে আসলেই দ্রুত সদর দরজার দিকে পা বাড়ায় সে। আনিক অঙ্কিতার গাড়ির কাছে আসলেই দেখতে পায় গাড়ি থেকে শুধু অঙ্কিতা নয় একজন বৃদ্ধা মহিলা এবং ফর্মাল পোশাক পড়া লোকও নামলেন। অঙ্কিতা আগে আগে এসে আনিকের সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে লাগলে ওপর দুজন তার পাশে এসে দাড়ায়। অঙ্কিতা আনিকের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি বুঝতে পেরে বলে-

আপনাকে তো এনাদের সাথে পরিচিত করাতেই ভুলে গেছি এ হলো আমার ঠাম্মি আর ইনি হলেন মজুমদার সাহেব। আমাদের একটা এনজিও আছে তার ম্যানেজার হিসেবে উনি নিয়োজিত আছেন। আর আপনাদের আগেই বলেছিলাম না আনিকের কথা ইনিই সেই আনিক।

আনিক তাদের সাথে সৌজন্যেতার কথাবার্তা বলে তাদের নিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে চাইলে অঙ্কিতা বাধা প্রদান করে প্রথমে দোকান দেখার আবদার করলো। তাই আনিকও তাদের প্রথমে দোকানে নিয়ে গেলো সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে দিলো। প্রায় আধা ঘন্টা দোকান পর্যবেক্ষণ করার পর তারা বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। তাদের সহ আনিক বাড়িতে আসলে আনিক বাকিদের সাথেও তাদের পরিচয় করিয়ে দিলে সবাই একত্রে খাওয়া দাওয়া করে খোশগল্পে মেতে উঠলো। গল্পের এক পর্যায়ে অঙ্কিতা আনিক কে উদ্দেশ্য করে বললো –

অনেক তো হলো আড্ডা, আনন্দ এবার নাহয় আপনাদের সারপ্রাইজটা দিয়ে দেই। কি বলেন আপনারা ?

ঠাম্মা আর মজুমদার সাহেব মাথা নেড়ে অঙ্কিতার প্রস্তাবে সায় জানায় আর বাকিরা নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত। অতঃপর মজুমদার সাহেব অঙ্কিতার হাতে একটি ফাইল ধরিয়ে দিলে সেটা অঙ্কিতা আনিককের উদ্দেশ্য বাড়িয়ে দিয়ে আনিক প্রশ্ন করে-

কিসের ফাইল এডা? আর আমারে দিতেসেন কেন?

আমাদের দেশে প্রতিদিন বহু উদ্যোক্তা নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে বা করার পরিকল্পনা করে। যাদের মধ্যে অনেকের উদ্যোগ অনেক ভালো এবং সফল হওয়ার পূর্ণ সুযোগ থাকে থাকে কিন্তু পর্যাপ্ত সহায়তার অভাবে তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই উদ্যোগ টাকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় না অথবা বাস্তবায়ন করলেও তার সঠিক মূল্যায়ন হয় না । তাই গত কয়েক বছর ধরে আমাদের এনজিও প্রতিবছর নতুন ৫জন উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেয়ার কাজ শুরু করেছে। যেন উদ্যোক্তারা সফল হতে পারে দেশের এবং নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে পারে। আর এ বছর সেই পাঁচজন উদ্যোক্তাদের মধ্যে আপনাদেরও নির্বাচন করা হয়েছে। আর এটা মোটেও ভাববেন না যে আপনি পরিচিত বলে আপনায় কোনো প্রকার দয়া করছি, আপনার কাজের সঠিক পর্যালোচনা করেই আমরা আপনাকে এই সহায়তাটি প্রদান করছি। এবার নিন এই কাগজগুলোয় সাইন করে চেকটি নিন।

আনিক অঙ্কিতার কথা শুনে কাঁপাকাঁপা হাতে ফাইলটি হাতে নেয়।সত্যি কথা বলতে সে আসলেই বুঝেছিলো যে অঙ্কিতা তার উপর দয়া করছে কিন্তু পরে অঙ্কিতার কথা শুনে তার ভুল ধারণা ভাঙলো। আনিক একবার নাইমা আর চাচা-চাচির দিকে তাকায়, তাদের চোখে এখন খেলা করছে আকাশসম বিস্ময় আর সুন্দর একটা ভবিষ্যতের আকাঙ্খা। আনিক এবার নিশ্চিত মনে সাইন করে দেয়। অতঃপর চেকটি হাতে নিয়ে তাতে টাকার পরিমানে দেখলো পাঁচ লক্ষ টাকা।এই টাকায় সে সকল ধার-দেনা চুকিয়ে তার ব্যবসা এর পরিধিটাও বড় কোর্টের পারবে। এই চেকটির মাধ্যমে আনিক যেন এক উজ্জল ভবিষ্যতের আলোর এক টুকরো ঝলকানি দেখতে পেলো।

আর একটা কথা বলবো আনিক সাহেব কিছু মনে করবেন না, ব্যবসায়িক কার্যক্রমে আপনি যদি শুদ্ধ ভাষার প্রয়োগ করেন তো ভালো হয়। আর এমনও নয় যে আপনি মোটেও পড়াশোনা করেন নি আপনি তো ইন্টার পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন তাহলে আপনি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন না কেন? আমি এমন বলছি না যে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা যাবে না বা অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা কোনো খারাপ বিষয়। কিন্তু বেপারটা হচ্ছে যে প্রত্যেকটা জিনিসের একটা নিজেস্ব মান আছে আর আমাদের উচিৎ তা বজায় চলা, যেমন-বিদ্যালয়ে প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী একটা নিদিষ্ট নিয়মে চলে এতে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আবার আমরা আমাদের সন্তানদের ইংরেজি শিখাই, আরবি শেখাই তার মানে কি এই যে বাংলার কোনো মূল্যই আমাদের কাছে নেই? উহু বরং তারা যেন স্থানভেদে প্রত্যেকটা ভাষার প্রয়োগ করতে পারে কোথাও যেন আটকে না যায় এটাই থাকে আমাদের মূল উদ্দেশ্য।তেমনি আমরা ব্যক্তিগত জীবনে যে যেই ভাবে কথা বলে কমফোর্টেবল ওভাবেই বলি কিন্ত কর্মজীবনে যদি আমরা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি এতে একটা শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। আশা রাখবো আপনি আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারছেন।

আনিক এতক্ষন মাথা নিচু করে সব শুনলো অতঃপর সে বললো –

হুম আমি মানি আপনার কথা এবং আমিও এসব বুঝি। আসলে হয়েছে কি সন্তানের উপর থেকে বাবা-মার ছায়া যখন মাথা হতে সরে যায়না তখন দুনিয়ার আসল রূপ তার সামনে আসে। আমারও হইছে তাই বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর যখন উপার্জনের পথে নামলাম প্রত্যেকটা পদে পদে অপদস্ত হইলাম। শেষমেশ উপায় না পাইয়া দিনমজুরের কাজে নামলাম। ওখানেও সবাই সুযোগ পাইলেই অপদস্ত করতো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতাম বইলা নানান কথা শুনাইতো, একবারও তো বড় সাহেবেরা ………।

আর বলতে পারলো না আনিক চোখগুলো জ্বলছে তার, নাইমা তার পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তার কাঁধে হাত রাখলে সে হাতটি আঁকড়ে ধরেই পূর্ণরায় বলে –

এরপর থিকাই ধীরে ধীরে শুদ্ধ কথা বলার অভ্যাস ছাইড়া দিতে থাকি এইটা মাইনা নেই যে আমাদের মতন দিনমজুরগো লাইগা শুদ্ধ ভাষা না।এগুলা সব সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকেগো লাইগা। আর এত্ত বসর পর এহন আর শুদ্ধ ভাষায় কথা কইতে ভক্তি হয় না।

আমি বুঝতে পারছি আনিক সাহেব। আসলেই আমরা এই সমাজের মানুষরা বড়োই বিচিত্র। সমাজকে দুইভাগে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এক নিচু শ্রেণী ওপরটা উঁচু শ্রেণী। আর সমাজের যত ভালো দিক আছে তার সব উঁচু শ্রেণীর জন্য আর খারাপ সব নিচু শ্রেণীর জন্য এক অস্তিত্বহীন দলিলে লিখে দেয়া হয়েছে। আর সেটা যুগের পর যুগ মানুষ পালন করেই আসছে। আমরা আজকাল নিজেদের ডিজিটাল যুগের মানুষ হিসেবে দাবি করি কিন্ত এই ডিজিটাল যুগের নামে আমরা কি আমরা নিজেদের একটু পরিবর্তন করতে পেরেছি? কোথাও কোনো অন্যায় দেখলে কাউকে বিপদে দেখলে হয় সেটাকে ভিডিও করি নয় এড়িয়ে যাই। আবার বাড়িতে এসে সেইসব বিষয় নিয়েই সোশ্যাল মিডিয়াতে বড় বড় প্রতিবাদমূলক পোস্ট দেই, সমালোচনা করি। আর কেউ একজন যদি সাহস করে প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসে তার পাশেও কেউ একজন দাড়ায় না। সত্যি কথা বলতে আজকের সমাজে আমরা ডিজিটাল বলতে সোশ্যাল মিডিয়ার কয়েকটা প্রতিবাদী পোস্ট আর লাইক, কমেন্টই বুঝি আর কিছুই না।

খালি কি এগুলাই? আরও আসে, আমি জন্মের মাস দুয়েক আগেই আমার আব্বা মারা যায় আমার মায় মাইষের বাড়িত কাম কইরা আমারে পালসে। নুন আনতে পান্তা ফুরাইতো আমাগো ওহানে পড়ালেহা তো আমাগো লাইগা বিলাসিতাই। আর এগুলা বিয়ার আগেই ওয় জানসে। তাই ওয় আরও শুদ্ধ ভাষায় কথা কয় না কারণ আমি যে ওর থিক্কা কম এটা ওয় আমারে বুঝবার দিতে চায় না।(নাইমা)

সবাই কি বলবে কিছুই বুঝতে পারে না তাই নীরব থাকাটাই শ্রেয় মনে করে।কিন্তু নাইমা পূর্ণরায় বলে-

কিন্ত আর না তোমার ব্যাবসার কামের লাইগা যদি শুদ্ধ ভাষা দরকারি তাইলে কইবা। ক্ষতি কি আমারেও শিখাইবা আমিও চেষ্টা করুম। আমরা বাসায় যেমনে ইচ্ছা কথা কমু কিন্তু বাইরে আমরা যেইটা উপযুক্ত সেটায় বলমু সম্যসা তো নাই।

আনিক এর বিরোধ করে কিছু বলতে চাইলেও নাইমার জোরাজুরি তে হার মেনে বলে সে চেষ্টা করবে। কিন্তু সেটা শুধুই ব্যবসায়িক কাজে। সবাই আনিকের কথা মেনে নিলে অঙ্কিতা এবার ফেরত যাবার কথা বলে।সবাই মন খাড়াপ করলেও রাত হয়ে যাচ্ছে বলে মানা করে না। অতঃপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে অঙ্কিতা, ঠাম্মা আর মজুমদার সাহেব নিজেদের গন্তব্য তে যাত্রা শুরু করে।

চলবে…………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে