নীরবে_নীরবে পর্ব ৭…

0
938

নীরবে_নীরবে পর্ব ৭…

দুই সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এখনও চারিদিকটা নিস্তব্ধ মনে হচ্ছে দিলুর। মনে পড়ছে, সাখাওয়াতদের ফ্ল্যাটের দূরের এক ব্যালকনিতে থাকা মেয়েটির কথা। সে কি ভাবছে, সাখাওয়াতরা এখনও কেন আসছে না? নাকি আন্দাজ করে ফেলেছে, দিলুকে নেওয়ার কথা ছিল না? নাকি ধরে নিয়েছে ওরা কখনও ওখানে আর ফিরে যাবে না? নাকি ভাবছে, তারা দু’জন কোনো বিপদে পড়েছে? তাকে যেন দিলু মনে মনেই বলল, আমি ঠিক আছি। ওই ও একটু অসুস্থ এই যা। অসুস্থ বলতে প্রায় সেরে গেছে। উন্নতি হয়েছে। তবে একদিকে অবনতি দেখতে পাচ্ছি। ও তেমন কথা বলছে না। সবসময় নির্লিপ্ত হয়ে থাকে। আমারও বা এমন আশা করা উচিত নয় কি? সে বাবাকে হারিয়েছে। তবে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তাঁর বয়স হয়েছিল বটে। তাঁর মৃত্যুর শোক বেশিদিন থাকবে বলে মনে হয় না। এরই মাঝে কী কী কাণ্ড শুরু হয়েছে তুমি শুনলে অবাক হবে। যেন বাঘের সামনে মাংস রাখা হয়েছে এমন অবস্থা। জাহানারা ভাবীর কথা আমার মনে এখন শেকড় গাড়ছে। তিনি ভাবেন, রাগীব ভাইয়ের বিয়ের পেছনে কোনো কারণ আছে। ইদানীং সে কথার ছলে তার বাবার ভাগের সম্পত্তির কথা তুলছে। আরে লোকটা এইমাত্র মারা গেল, বছর খানেক সবুর করো। এইতো দুপুরে বলছিল, বাবা যদি নিজের মৃত্যুর কথা আগে টের পেতেন, তবে আমাকে আর বড় ভাইয়াকে সবই দিয়ে যেতেন। যাকগে, আমার এসবে মাথা ব্যথা নেই। আমার স্বামী যাই বলে আমি চুপচাপ শুনব। কারণ রাগীব ভাইয়ের মতো না সে।
দিলু উঠে ঘরে খাবার নিয়ে আসে। সাখাওয়াত চুপচাপ খেয়ে নেয়। একসময় গলা পরিষ্কার করে সে বলল, “খাবার টেবিলে এখন কি সবাই আছে?”
দিলু কথা শুনে আশ্চর্যান্বিত হলো। এতদিন পর সে এতো লম্বা একটা লাইন বলেছে।

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

“হ্যাঁ।” পরক্ষণে বলল, “এক মিনিট। আপনি দুপুরের কিছু শুনেননি তো?”
“আমি শোনার মতো করেই তো বলা হয়।”
ভীত চোখে দিলু তার দিকে তাকালো। এতটা শান্তভাবে কথা বলতে সাখাওয়াতকে খুব কম দেখেছে। লোকটির মতো কঠিন নীরব মানুষ আগে কখনও সে দেখেনি। হয়তো বা যারা অংকে পটু তারা অংকের সমীকরণের মতোই জটিল হয়। কেবল সূত্র জানলে সহজ মনে হয়।
সাখাওয়াতকে আসতে দেখে টেবিলের চারিদিকের আলোচনা থেমে গেল। সে একটা চেয়ার টেনে বসল।
“খাবার খেয়েছ?” তার বড় ভাই জিজ্ঞেস করল, “এখানে আসার কষ্ট কেন করতে গেলে?”
“আমি খাবার খেয়েছি।” সে রাগীবের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিসের অপেক্ষা করছ? যা বলার এখনই আমাকে পুরোপুরি বলো। পুরোপুরি সুস্থ হবার কী দরকার?”
রাগীব নড়েচড়ে বসল, “এভাবে কেন কথা বলছ?”
“রাগীব, সোজাসুজি পয়েন্টে আসা উচিত নয় কি?”
“কিন্তু এভাবে কেন কথা বলবে?”
“কেমন কথা আশা রাখ তুমি? আমি তো তোমাদের কাছে কিছু আশা রাখতে পারি না। রাতদিন তো আমাকে নিয়ে যথেষ্ট বলা হয়।”
রাগীব দাঁতে দাঁত চেপে নীরব রইল। একটু পর নীরবতা ভাঙল।
“এজন্যই আমি এসব করছি। আমি চাই না তোমার মতো এটিচিউডের একটা ছেলে বাবার কিছুই পাক।”
“তাই নাকি?”
রাগীব রেগে আরও গিজগিজ করছে। বাকি সবাইও চুপ হয়ে রয়েছে, যেন এই ব্যাপারটা কেবল দুজনের মাঝের। অথচ এই নীরবতাই নির্দেশ করছে রাগীবের পক্ষপাতিত্ব।
“ভাইয়া, এভাবে কথা বলবে না। মনে রাখবে, আমার আগে গর্হিত অন্যায়টা তুমি করেছিলে। আমি তো যথেষ্ট বয়স হবার পর ওই পথে গিয়েছি। এই কারণেই আমার মনে হয়, আব্বা তোমাকে গুরুত্ব কম দিতেন। যাইহোক, তুমি তাঁর সন্তান হিসেবে একটা ভাগ নিতেই পারো। তবে আমি চাই না, ওটা আমাদের দু’জনের সমান হোক।”
সাখাওয়াত শীতল দৃষ্টিতে নীরবে তার হাতের আঙুলের দিকে চেয়ে রয়েছে। কিন্তু দিলুর সহ্য হচ্ছে না। তার স্বামীর সম্বন্ধে যাই পারছে, তাই বলে চলেছে লোকটা।
“মুখ সামলে কথা বলবেন ভাইয়া। একে তো, বাবা মারা যাওয়ার একমাস না হতেই ভাগাভাগি শুরু করে দিয়েছেন, দ্বিতীয়ত আমার স্বামীকে বলার আগে নিজে ভাবেননি নিজে কতটা হেয় করে কথা বলছেন, তার উপর আবার বলছেন, আপনাদের মতো সমান অধিকার ওর নেই? তাহলে একটা কথার উত্তর দিন। বাবা কেন ওর সাথেই কিশোরগঞ্জে থাকতেন বা চলে যেতে চেয়েছেন? আপনাদের সাথে কেন না?..”
দিলুর কথা শেষ হওয়ার আগে, লাভলীর হস্তক্ষেপ করার আগে রাগীব ফুঁসে উঠে কিছু বলার আগে সাখাওয়াত টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দিলুর হাত টেবিলের নিচ থেকে ধরে ফেলল তাকে থামাতে। তৎক্ষণাৎ নিজেও উঠে দাঁড়াল।
“তুমি ঠিকই বলেছ রাগীব। তোমাদের মতো অধিকার পাবার যোগ্য আমি নই।” কথাটা বলেই পরিবেশটা শীতল করে দিয়ে সে বলল, “তাই আমি কাল চলে যাচ্ছি। আশা করি, কোনোকিছুতে আমার স্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে না।”
আর কিছু না বলে সে দুর্বল শরীরে নিজ ঘরে ফিরে এলো। দিলু এসে দেখে সাখাওয়াত চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না একটু আগে কিছু হয়েছে। দিলু কী করবে ভেবে পেল না। লোকটা তাকে এই কয়দিন শাস্তি দেয়নি। আজ হয়তো বা দিতে পারে। সে ব্যাগ গুছাতে লাগল। এখন পরিস্থিতি আরেকটা রূপ নিয়েছে। এখন থেকে তো দিলুকে কেউ একেবারে পাত্তা দেবে না। সে সিদ্ধান্ত নিল, এখানে থাকার চেয়ে বরং নিজ পরিবারের কাছে চলে যাবে। এখানে প্রশ্ন করার থাকবে না। করে থাকলেও সে চলে যাবে। কিন্তু এই লোকটি আরেকবার তাকে ছেড়ে চলে যাবে এটা তার সহ্য হচ্ছে না। দিলুর অজান্তে তার গাল চোখের পানিতে ভিজে গেছে। এমন সময় পাশ থেকে এক গম্ভীর স্বর শোনা গেল।
“এখানে আমার বলো কী… তোমার একটা জিনিসও যাতে না থাকে।”
দিলু চমকিয়ে পাশ ফিরে তাকায়। ততক্ষণে সাখাওয়াত হাতে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। দিলুর নীরব কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল। লোকটির দিকে চেয়ে সে মৃদু কাঁপতে লাগল। এরচেয়ে বেশি খুশির কিছু আর কী হতে পারে?
সাখাওয়াত আবারও চোখ খুলল, “আমি চাই না তুমি এখানে থাক কিংবা নিজ বাড়িতে চলে যাও। দুইদিকেই তুমি লাঞ্ছনা ছাড়া কিছু পাবে না।”
সাখাওয়াত চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে ঘুমিয়ে পড়ল। দিলু নিঃশব্দে উঠে তার কাছে যায়। মেঝেতে বসে সে তার বুকে হাত রাখল। এরপর সে করুণামাখা দৃষ্টিতে কাছাকাছি থাকা বিষাদময় মুখটির দিকে চেয়ে রইল। এই রাতটা খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে, যেন শেষ হওয়ার নয়।
.
তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটটার দিকে যেতে যেতে দিলুর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলেছে। কবে এটি তার স্বপ্নের এক খণ্ড বাস্তব অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সে টেরই পায়নি। সে ভেতরে ঢোকার পর স্বপ্নের বাড়ি দেখার মতো করে মুগ্ধ দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। অনেক গ্লানি শেষে আজ তার আনন্দ হচ্ছে। এটা স্বর্গের একটা টুকরোই। সে একমাস এখানে থেকেছে, জায়গাটির দেখাশোনা করেছে। এই জায়গাটি এখন অনেক আপন।
দিলুকে চমকিয়ে দিয়ে সাখাওয়াত বলল, “আমি জিনিসগুলো আব্বার রুমে নিয়ে যাও।”
“কী?”
“আমার জিনিসগুলো আব্বার রুমে নিয়ে যাও।”
“কেন?”
“এখন থেকে আমি ওখানে থাকব।”
“আর আমি?”
“আমার রুমে।”
সে কিছু বুঝে উঠতে পারল না, “আমার শাস্তিগুলো?”
সাখাওয়াত তার দিকে শীতল সৃষ্টিতে তাকালো। এই দৃষ্টিতে কোনো তাপ। কোথাও একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। সে কিছু না বলে আমজাদের ঘরে চলে গেল। দিলু হনহন করে হেঁটে তার কাছে গেল।
“এটা কেমন কথা? আপনি আবার ভিন্ন রুমে কেন থাকবেন?”
“আমাকে প্রশ্ন করবে না। একা থাকতে দাও আমাকে।”
পরক্ষণে দিলুর রাগ মিইয়ে গেল। এখানে আসার পর মাথায়ই ছিল না ফরিদপুরে ঘটা কাণ্ডটা। পরিবারের মানুষের বিচ্ছিন্নতা, বাবার বিয়োগ, ভাইদের ছাড়াছাড়ি এসবের পর তো যে কেউ এমন আচরণ করবে। তাকে কয়েকদিন সময় দেওয়া উচিত। সাখাওয়াত শারীরিক কী মানসিক দিক থেকে সুস্থ হয়ে উঠুক।
দিলু ব্যালকনিতে বসার পর আপনা থেকেই দূরের ব্যালকনিটার দিকে নজর পড়ল। আজ ওখানে মেয়েটি নেই। ব্যাপার কী? সবসময় ওখানেই মেয়েটি সময় কাটায়। আজ গেল কোথায়? দিলু ঘন্টাখানেক বসে থাকার পরও কারও দেখা পেল না। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিলো। মেয়েটি দিলুদের দেখার জন্য ওখানে বসে থাকে না তো?
(চলবে..!)
লেখা: ফারিয়া কাউছার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে