নিয়তি পর্ব-১৮

0
1118

#নিয়তি
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
#পার্ট১৮

-তোর সাম্যদা আর সিঁথি দির বাচ্চা দেখে কষ্ট লাগলো না?

হৃদি আবার দিয়ার সাথে সব শেয়ার করে।এইবারও তার ব্যাতিক্রম হয় না।সবটা শুনে দিয়া কথাটা বলে।তার জবাবে হৃদি বলে,,

-কী লাভ কষ্ট করে!যা হয়েছে সব মেনে নিয়েছি।নিয়তিতে হয়তো ওপরওয়ালা আমার জন্য আরও ভালো কিছু রেখেছে যা আমি ভেবে রেখেছি। আর জ্বলে পুড়ে মরার চেয়ে সব কিছুকে ভাগ্যের লেখন হিসেবে মেনে নেওয়াই ভালো।
-শুনলাম সিঁথিও নাকি বিভোর ভাইয়ার এক্স?তো বিভোর ভাইয়া?
-উনিও মেনে নিয়েছেন।
-তুই এখনো উনারে আপনি বলিস?
-হু তুমি থেকে আপনি ডাকটা সুন্দর।কেমন যেন একটা রাজকীয় ভাব থাকে!

দিয়া আর কিছু বলে না।হৃদি মন্দ বলে নি।আজ কালকার বেশিরভাগ লাভ মেরেজেই স্বামী স্ত্রী একে অপরকে তুই বলে সম্বন্ধ করে।সেখানে হৃদির বিভোরকে আপনি করে ডাকা নেহাৎই খারাপ শোনাচ্ছে না।সম্পর্কের মুল জিনিসটা হচ্ছে একেঅপরকে বিশ্বাস করা আর সম্মান দেওয়া।যেটা বিভোর আর হৃদির মধ্যে অনেকটাই আছে।খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক!হয়তো হৃদির বিশ্বাসই ঠিক!ওপরওয়ালা হৃদির কপালে নিশ্চয়ই ভালো কিছু লিখে রেখেছেন।কেমন যেন দিয়ার মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই হৃদি সুখের মুখ দেখবে।

দিয়া ফেসবুকিংয়ে ব্যস্ত আর হৃদি আনমনে বসে কি যেন ভাবছে।বিভোরের হর্ণের আওয়াজে হৃদির ভাবনাচ্ছেদ ঘটে।কোনো এক কাজের জন্য আজ বিভোরের দেরি হয়ে গেছে।
হৃদি বিভোরের কাছে যেতেই মিন্টের গন্ধ পায়।নিশ্চয়ই বেটা আবার সিগারেট খেয়েছে!পাব্লিক প্লেসে সিনক্রিয়েট না করাটাই বেটার।হৃদি আর কিছু না বলে চুপচাপ বাইকে উঠে।রাস্তায় সে বলে,,

-কি খান?
-চুইংগাম।খাবা?বা পাশের পকেটে আছে।বের করে নেও।

হৃদির কেমন যেন অসস্থি লাগছে।বিভোর আয়নায় হৃদির প্রতিচ্ছবি দেখেই তা বুঝে ফেলে।মুচকী হাসি দিয়ে বলে,,

-আরেহ নেও ই না!এত লজ্জা পেতে হবে না।তোমার অধিকার আছে।

হৃদি কাঁপা হাতে বা পাশের পকেট থেকে চুইংগাম বের করে নেয়।মুখে দিয়ে খেতে খেতে বলে,,

-আপনি আবার সিগারেট খাইছেন তাই না?

এই রে এই মেয়ে বুঝলো কিভাবে বিভোর সিগারেট খেয়েছে!বিভোর কথাটাকে অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলে,,

-চুইংগাম নেওয়ার সময় কিছু ফিল করলা?
-কি ফিল করবো?
-হার্ট বিট ফিল করো নাই?
-অহ। ওটা স্বাভাবিক।
-জানো বিটগুলা কি বলে?
-কি?
-হৃদি,হৃদি,হৃদি।
-ফাইজলামি কমায় করেন
-আমার সব কিছুই তোমার কাছে ফাইজলামি লাগে।বুঝলানা আমায়।বুঝলানা আমার ভালোবাসা।
-ভালোবাসা প্রকাশ করলে কেমন যেন কম কম লাগে।তাই প্রকাশ করতে চাই না।আপনি ফিল করলে করেন নইলে নাই।

একটা মলের সামনে বিভোর বাইক থামায়।হঠাৎ মলে কেন হৃদি বুঝে উঠতে পারে না।হয়তো বিভোরের কোনো কেনাকাটা আছে।
ছেলেদের ড্রেসের শো রুমে গিয়ে বিভোর কালো কাওয়ালী সেট কিনে।তারপর যায় জুয়েলারির দোকানে।বেশ ভারী গয়নার সেট কেনে।হৃদি কিছু বুঝে উঠতে পারে না।সে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে আর বিভোর নিজের কাজ করে যায়।শাড়ির দোকানে গিয়ে কালো রঙের একটা কাতান কেনে।হৃদিকে শাড়িটা দিয়ে ঘোমটা দিয়ে বলে,,,

-পার্ফেক্ট।

হৃদি পুরোই বোকা বনে যায়।এই লোক সব কিছু কালো জিনিস কিনছে কেন?ভাইরে ভাই এই লোক তো বেলুনও কালো কিনলো!কেমনে কী?কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না হৃদির।

শপিং করা জিনিস গুলো বাসায় ঢুকে সোজা মিসেস ছায়ার হাতে দেয় বিভোর।মিসেস ছায়া দুজনকে খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে বলেন।হৃদি আবার মিসেস ছায়ার কথা অমান্য করে না।লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে শুয়ে পড়ে।খাওয়ার আগে ফোন চালাচ্ছিলো হৃদি।খাওয়ার সময় পাশেই রাখে ফোন।শুতে যাওয়ার সময় আর ফোন নিতে মনে থাকেনি হৃদির। টেবিলেই রেখে যায়।বিভোর সেখান থেকে দিয়ার নাম্বার নেয়।দুষ্টুমির ছলে মাঝ রাতে ফোন দেয়।আননোওন নাম্বার থাকায় দিয়া কলটা রিসিভ করে না দিয়া।কিন্তু একটানা কল দেওয়ায় সে বিরক্ত হয়ে যায়।কলটা রিসিভ করে ঝাঁঝালো গলায় বলে,,

-এই মিয়া আপনার প্রবলেম কী?মাঝরাতে কল দিয়ে ডিস্টার্ব করতেছেন!
-আমি পুলিশ অফিসার বলছি।আপনার নামে ছেলেদের টিজ করার অভিযোগ আছে।

অ্যাহ!ছেলেদের টিজ।করতেই পারে।ছেলেরা মেয়েদের টিজ করবে আর মেয়েরা ছেলেদের টিজ করলেই দোষ?কে জানতো ছোট খাটো ব্যাপারটা এত বড় হবে!দিয়া নিজেকে সামলে বলে,,,

-তো দিনে ফোন করতেন। রাত্রে একটা মেয়েকে ফোন দিয়ে এমন কথা বার্তা বলা কোন আইনে আছে?
-কালকে সকালে অফিসার বিভোরের বাসায় যাবেন
-কে..কে..কেন?
-আপনাকে দিয়ে কাজ করানো হবে!কতদিন শুধু ছেলেদের টিজ করলে তো হবে না!একটু কাজের কাজ করেন
-আপনি বিভোর ভাইয়া তাই না?
-এই যাহ!ধরে ফেলছো?
-কালকে আপনার বাসায় কেন?
-সারপ্রাইজ আছে।আর অনেক দায়িত্বও পালন করতে হবে কালকে!বাই দ্যা ওয়ে বউ সাজাইতে পারো?
-অহ বুঝছি।হ্যা টুকটাক সাজাইতে পারি।
-চুপ।হৃদি যেন জানে না।
-আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
-হৃদির ফোন থেকে নিছি
-ভয় পাওয়ায় দিছেন।মাঝরাতে এমন করে কেউ?
-এক্টু দুষ্টুমি করলাম!

-এই হৃদি ওঠ।

দিয়ার ডাকে ঘুম ভাঙে হৃদির। চোখ কচলাতে কচলাতে দিয়ার দিকে তাকায়।মনে হয়েছিলো মনের ভুল।কিন্তু না!এ যে সত্যি দিয়া!

-তুই?
-চইলা আসলাম
-কেন?আজ তো ক্লাস নাই।
-তাই ই তো আসলাম।এখন আর কথা বলে সময় নষ্ট করিস না।যা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হ।

হৃদি ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যায়।বের হয়ে দেখে সালাম সাহেব,বিলকিস বেগম,সাম্য, সিঁথি আর কোলে সাবা।ড্রয়িংরুমে বসে আছে।পুরো বাড়িটায় কেমন যেন সাজ সাজ রব।মিসেস ছায়া হৃদির হাতে হলুদ রঙের একটা শাড়ি দিয়ে বলেব,,

-যাও শাড়িটা পরে এসো।
-কিন্তু কে…
-যা বলছি তাই করো।

দিয়া হৃদির ঘরের দরজার পাশে হেলান দিয়ে ইউটিউবে মেকাপের টিউটোরিয়াল দেখছিলো।হৃদি হ্যাঁচকা টানে ওকে ঘরের ভেতর নেয়।

-এমনে টান দেয় কেউ?আর একটু হলেই আত্মা খাঁচা ছাড়া হতো।
-শাড়ি পরায় দে।ছায়া আন্টি হাতে দিয়ে বলে পরে এসো।কিন্তু আমি তো শাড়ি পড়তে পাই না।
-এজন্যই মহারানী ক্যাম্পাসের ফাংশনে সেলোয়ার-কামিজ পরে আসতো?
-জ্বী।এখন পরায় দেন মেডাম।

দিয়ার আবার একটা গুণ আছে।সে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরাতে পারে।হৃদিকে শাড়ি পরানো হলে দিয়া হৃদিকে হালকা সাজিয়ে দেয়।গাঢ় লিপস্টিক আর মোটা করে কাজল পরিয়ে দেয়।সব মিলে হৃদিকে পুরো বাঙালি বধুর মতো লাগছে।ড্রয়িংরুমে গিয়ে হৃদি কোণায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে।মিসেস বিলকিস আর ছায়া ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে বিভিন্ন ধরণের খাবার সাজান।কোনো অনুষ্ঠান আছে হয়তো।এরই মধ্যে বিভোর হলুদ পাঞ্জাবি পরে হাতা ফোল্ডার করতে করতে বের হয়।হৃদি তো দেখে পুরোই অবাক।এই মুহুর্তে অসম্ভব সুন্দর লাগছে বিভোরকে। ঠিক যেন হুমায়ুন আহমেদের অমর সৃষ্টি হিমুর মতো!আসলে হলুদ পাঞ্জাবিতে সব ছেলেকেই হিমুর মতো লাগে।এটা নতুন কিছু নয়।

-কি হৃদি দাঁড়ায় আছো কেন?বসো

মিসেস ছায়ার ডাকে হৃদির ধ্যান ভাঙে। সে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টান দিয়ে বসতে নিলে মিসেস ছায়া বলেন,,

-আরেহ পাগলী!পাটিতে বসতে বলছি।

হৃদি গিয়ে পাটিতে বসে।কিছুক্ষণ বিভোরও এসে পাটিতে বসে।সালাম সাহেবকে দিয়ে শুরু হয় হলুদের পর্ব।যেহেতু তিনি উপস্থিতিদের মধ্যে বয়সে বড়।মিষ্টি মুখ করানোর পর হৃদি মামাকে জিজ্ঞেস করে,,,

-মামা হলুদ!বুঝলাম না!
-ঘটনা হইতেছে আমি আর মিসেস ছায়া তোর সাথে বিভোরের বিয়ে ঠিক করি।কিন্তু পরে জানতে পারি তোরাও একেঅপরকে পছন্দ করিস।তাই আর কী হুট করে!ছোটখাটো ভাবে ফরজ কাজটা সেরে ফেলবো

হৃদি কি বলবে ভেবে পায় না।লজ্জায় মাথা নীচু করে।মামাকে সালাম করে আশীর্বাদ নেয় হৃদি বিভোর।একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ায় হৃদি বিভোরকে। তবে সাম্য যখন হৃদিকে হলুদ ছোঁয়ায় তখন সাম্য যেন কেমন করে হৃদির দিকে তাকিয়ে থাকে।চোখে মুখে কেমন যেন অপরাধীর ছাপ দেখা যাচ্ছে।কোনো রকমে হলুদ ছুঁয়ে সাম্য চলে যায়।গোসল করে হৃদি যখন ছাদে যায় রোদে কাপড় দিতে তখন সাম্যও হৃদির পেছন পেছন আসে।সাম্যের মনে হচ্ছে হৃদিকে সবটা বলে দেওয়া উচিৎ।

-হৃদি!
-হুম বলো সাম্যদা।
-তোকে একটা কথা বলতাম।
-হুম বলো।
-আসলে আমি তোকে ঠকাইছি।তুই ছাড়াও আমার সিঁথির সাথে….
-জানি।তাও ভালো দুজনের কাছে তুমি কাপুরুষ হও নাই।
-কাপুরুষ?
-এক্টা মেয়ের বিশ্বাসের সব টুকু অর্জন করে যখন কোনো ছেলে সে বিশ্বাসের ভার বহন করতে না পেরে তা হারিয়ে ফেলে তখন সে ছেলেটি মেয়েটির কাছে কাপুরুষ হয়ে যায়।

কথাটা বলেই হৃদি চলে আসে।সাম্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে হৃদির যাওয়ার পানের দিকে চেয়ে থাকে।


-আলহামদুলিল্লাহ কবুল

কবুল বলে একেঅপরের হাতে নিজেকে তুলে দেয় বিভোর হৃদি।কথা ছিলো লাভ মেরেজের কিন্তু হয়ে গেলো এরেঞ্জ।বর কনে ও তাদের পরিবার সবাই খুশী। এটাই সার্থকতা।যুগ পাল্টেছে।মেনে নেওয়া হয় প্রেমের মতো পবিত্র সম্পর্ককে।যদিও এখনকার প্রেম কে পবিত্র বললে ভুল হবে!অধিকাংশ গুলোই নষ্টামিতে ভরা।তাছাড়াও আজকাল কার প্রেমের সম্পর্কটা খুবই ঠুনকো।অথচ আগেকার দিনে প্রেমের সম্পর্ক গুলো ছিলো অনেক মজবুত।কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকারা অধিকাংশ সময় এক হতে পারেনি। যেসব মানুষরা ভালোবাসার মানুষের সাথে পরিবারের সম্মতিতে এক হতে পেরেছে আমি বলবো তাদের পৃথিবীর সবচে ভাগ্যবান ব্যক্তি।কারণ তারা যা সম্ভব করেছে মানুষ তা পায় না।

হৃদি কখনো পায় নি সে বিভোরকে এভাবে পাবে।আসলে আল্লাহ তায়ালা কখনো মানুষকে নিরাশ করেন না।আল্লাহ সব সময় সঠিক সময়ে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে দেন।সে কখনো তাড়াতাড়িও কিছু করেন না আবার দেরিতেও কিছু করেন না।সে সবসময় সঠিক সময়ে আসেন।আমরা মানুষরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের ভুলকে আল্লাহ তায়ালার ওপর চাপিয়ে দেই। “ইশ এই কাজটা করতে পারলাম না!সবই কপাল।”
কেন?আমরা কী একটু ধৈর্য ধরতে পারি না?আল্লাহ তায়ালার সারপ্রাইজের জন্য হৃদির মতো একটু ওয়েট করতে পারি না?আল্লাহর ওপর ভরসা থাকলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা চাওয়ার থেকে অনেকটাই বেশি দেবেন।ঠিক যেমনটা হয়েছে হৃদির ক্ষেত্রে!নিয়তি আজ হৃদিকে এক সমুদ্র দুঃখ পাড়ি দিয়ে সুখের চুড়ায় এনে পৌঁছিয়েছে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে