নয়নতারা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0
615

নয়নতারা
পর্ব-০২

মিতা আন্টি ঠিক দুই সপ্তাহ পর চলে গেলেন। যেদিন মিতা আন্টি চলে গেলেন। সেদিন আমার খুব ইচ্ছা করছিল, মিতা আন্টির পা জড়িয়ে ধরে বলতে, “আন্টি যাবেন না। আপনি গেলে এই পা/জি ন/চ্ছা/র মেয়ে আর আমার পাশে ঘুমাবে না। আর মাতাল করা চুলের সুবাসে পাগল হয়ে নয়নকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো হবে না।”

কিছুই বলতে পারিনি মুখে।

নিজে গিয়ে আন্টিকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম।

সেদিন রাতেই নয়ন মায়ের কাছে ঘুমাতে চলে গিয়েছিল। আমি পাগলের মতো নয়নের বালিশ জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। যেনো আমার বউ ম/রে গিয়েছে। দুই সপ্তাহে নয়ন আমার এতোই খারাপ অবস্থা করেছিল যে আমি মাঝরাতে উঠে উঠে মায়ের রুমে উঁকি দিতাম শুধু নয়নকে একবার দেখবো বলে।

নয়নের ও কোনো উপায় নেই। নয়ন ই আমাকে বলেছিল। মাঝরাতে কখনো কখনো মায়ের হাঁপানির মতো হয়। নিঃশ্বাস নিতে নাকি মায়ের ভীষন কষ্ট হয়। তখন নয়ন উঠে বুকে তেল মালিশ করে দেয়। খালার বয়স হওয়ার কারনে খালা গভীর ঘুমে থাকে। মায়ের ডাক তেমন একটা শুনতে পেতো না। মায়ের এমন আরো অনেক অযাচিত সমস্যা হতো। মূলত মা ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। শুধু মনের জোরে আর আমাদের কারনে হাসিখুশি থাকতেন। নয়ন মাকে হাসিখুশি রাখার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি রাখতো না। অনেক কিছু করতো শুধু মাকে খুশি রাখার জন্য।

যেমন, গল্পে গল্পে মা নয়নকে বলেছিল মায়ের দোলনায় চড়তে ভীষন ভাল লাগতো। নয়ন মায়ের রুমে সত্যি সত্যি দোলনা কিনে এনেছিলো। মা ও দেখতাম দোলনায় বসে বসে মিটিমিটি হাসতো। বেশ বুঝা যেতো মা কতো খুশি। মায়ের মুখের এই হাসি আমাকে যে কি আনন্দ দিতো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো উপায় আমার জানা নেই। আমি নয়নকে জড়িয়ে ধরে মাঝে মাঝেই বলতাম, “নয়ন মাকে ঠিক এভাবেই ভালবেসো। আমার মা সারাটা জীবন এতো ভালবেসেও, এতো করেও কারোর ভালবাসা পায়নি। কারোর মন পায়নি। আমি মরে গেলেও মাকে ঠিক এভাবেই ভালবেসো। এভাবেই দেখো।”

নয়ন কিছু বলতো না। কিছুই না। বুঝতাম ওর অভিমান হতো। ও মনে করতো আমি ওকে বুঝি এখনো পর ভাবি। কিন্তু কি ভয় থেকে যে আমি অমন কথা বলতাম তা বোধ করি আজ ও নয়ন বোঝে না।

কিন্তু মায়ের এই খুশি আমি বেশিদিন চোখে দেখলাম না। আমার কপালে ছিল না। একদিন হঠাৎই খালা আমাকে ফোন করে বলল মা কেমন জানি করছে। নয়নকে ফোন দিলাম। নয়ন বলল অফিস থেকে বের হয়েছে মাত্র। আমি খুব দ্রুত পৌঁছালাম বাসায়। গিয়ে দেখি আমার অচেতন মায়ের মাথা কোলে নিয়ে নয়ন বসে আছে। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই এম্বুলেন্স এলো। মাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। ডাক্তার জানালো স্ট্রোক করেছে মা। সারাদিন রাত নাওয়া খাওয়া ভুলে আমি নয়ন হাসপাতালেই পড়েছিলাম। আমার ভাই ভাবীরা ও আসা যাওয়ার মধ্যে ছিল। দুইদিন পর মায়ের শরীরের অবস্থার উন্নতির খবর পেলাম। দুদিন পর মায়ের চেহারাটা দেখার পর বুঝেছিলাম মা কি জিনিস। কি এক শান্তি বুকের মধ্যে অনুভব হচ্ছিল তা কাউকে বুঝানোর ক্ষমতা আমার নাই। নয়ন মাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য মায়ের পাশে বসে গল্প শুরু করে দিল। প্ল্যান করছিল, মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলে মাকে নিয়ে কি কি করবে। কোথায় কোথায় যাবে। কি কি খাবে। আমি নীরব সাক্ষী। নয়ন মায়ের গাল ধরে বলেছিল মাকে নয়ন একটা সুন্দর সারপ্রাইজ দিবে। মা নাকি খুশিতে পাগল হয়ে যাবে।

আমি বাসায় ফিরে এসেছিলাম। রাতে নয়ন মায়ের কাছে ছিল। রাত তিনটায় নয়ন ফোন দিয়ে অস্থির কন্ঠে বলল যেন আমি একটু হাসপাতালে যাই। মাকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে ওরা। আমি কিভাবে হাসপাতালে পৌঁছেছিলাম মনে নেই। গিয়ে দেখি নয়ন আইসিইউর সামনে বসে কাঁদছে। নয়ন খুবই শক্ত মনের মেয়ে। আমি নয়ণকে কাঁদতে দেখিনি সচরাচর। যা কিছুই হোক। আমি নয়নের কাছে ছুটে গিয়েছিলাম। নয়ন কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলল মাকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। আর কিছুই নয়ন বলল না। বা বলতে পারল না। সকালে ডাক্তার জানাল। মায়ের অবস্থা ভাল না। অরগ্যান ফেইলিওর শুরু হয়েছে। কিডনি কাজ করছে না। ডায়ালাইসিস করতে হবে। লাংস ও কাজ করছে না। কি হবে কেউই কিছু বলতে পারছে না। নয়নের মা বাবা, আমার ভাই ভাবী। মামা খালা ফুফু সবাই হাসপাতালে হাজির। আমি আর নয়ন শুধু যেন এই দুনিয়ায় নেই। বিকেলে ডাক্তার ঘোষনা দিল। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। আমি আর কখনো আমার মায়ের সুন্দর চেহারাটা দেখতে পাবো না। আমার মা আর কখনো আমাকে ডেকে বলবে না , “বাবা, সুস্থ হয়েই তোকে গাজরের হালুয়া বানিয়ে খাওয়াবো। তোর সব পছন্দের খাবার বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখবো।” আর বলবে না। আর কখনো আমার মা কাঁপাকাঁপা হাতে আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিবে না।

আমার মাকে কবরে রাখার পর ভেতরের সব রাগ দুঃখ মুছে গিয়ে যন্ত্রনা হয়ে ধরা দিল। বড় ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। বহু বছর পর। অথচ মা জীবিত থাকতে খুব করে চাইতো আমরা সব ভাইরা মিলেমিশে থাকি। কতোদিন বলেছিল আমাদের তিন ভাইকে একসাথে বসিয়ে মা ভাত খাওয়া দেখতে চায়। আমরা শুনিনি। অথচ মায়ের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা তিনভাই পাগলের মতো কেঁদেছিলাম একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

বাসায় আসার পর মনে হয়েছিল জাহান্নামে এসেছি। বড় দুই ভাবী ঝগড়া করছে। মায়ের রেখে যাওয়া গয়না শাড়ী নিয়ে। মায়ের কাছে ছিল একটা মোটা গলার চেইন, এক জোড়া পাতলা ঝুমকো, হাতের কিছু সরুসরু চুড়ী। সবই সোনার। বাবা বিদেশ থেকে এনে দিয়েছিল। শত অভাবেও মা এগুলো বেচেনি। বাবার শেষ স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছিল। আমি ও মাকে কিছু গড়িয়ে দিয়েছিলাম। হাতের আংটি, কানের দুল। যখন যেমন সামর্থ্য হতো। তবে বেশ অল্প দিতে পেরেছিলাম মাকে। সবই মায়ের চিকিৎসার পেছনে খরচ করতে চেয়েছি বরাবর। কিন্তু নয়ন দিয়েছিল মাকে অনেক কিছু। হীরের নাকফুল, আংটি, দুল, লকেট। রুপোর হার। দামী দামী শাড়ী। জামদানী, কাতান। আমার দুই ভাবী সেসব নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলেন। মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে উনারা এসব নিতে চাইছেন। বড় ভাবী বলছিলেন উনি বড় বউ, উনি সবাইকে ভাগ করে দিবেন। উনি বলবেন কে কোনটা নিবে। আর মেঝো ভাবী বলছিলেন, উনি বড় ভাবীকে গুনেন না। উনাকে মা বেশি পছন্দ করতেন। তাই উনি মায়ের হীরের আর সোনার জিনিস আর শাড়ি নিবেন। বড় ভাবী যেন রুপোর গয়না নেন। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশিরা সব তামাশা দেখছিল। আমার মনে হচ্ছিল, আমার মায়ের সাথে যদি আমিও কবরে শুয়ে পরতে পারতাম তো ভাল হতো। নয়ন মায়ের রুমে শুয়ে ছিল। তেমন একটা কাঁদেনি নয়ন। ভীষন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল নয়ন।

পরদিন সকালে মহাখালীর এক প্রসিদ্ধ মাদ্রাসা থেকে কিছু হুজুর এলেন। জানালেন, মাদ্রাসাটা মিতা আন্টির ভাইয়ের। মা মৃত্যুর আগে মিতা আন্টির মাধ্যমে মাদ্রাসার ক্যাশিয়ারকে ডেকে বলে গিয়েছিলেন, মায়ের যত গয়না ও দামী শাড়ি আছে তা যেন মায়ের মৃত্যুর পর মাদ্রাসার লোকেরা এসে নিয়ে যায়। তা বেঁচে যেন হেফজিয়া এতিমখানায় দান করে। আমার দুই ভাবীরা উনাদের মিথ্যেবাদী বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, প্রমান কি। উনার কাগজের সইসাবুদ দেখালেন। তারপর সব জিনিস নিয়ে গেলেন। জানালেন পরে উনারা আমাদের আয় ব্যায়ের হিসাব জানিয়ে দিবেন।

কেউই আপত্তি করলেন না আমার দুই ভাবী ছাড়া। বিকেলের মধ্যেই উনারা চলে গেলেন। ধীরে দীরে আত্মীয় স্বজন কমে গেলো। বিশাল ফাঁকা মায়ের স্মৃতি ঘেরা এই বাড়িতে রয়ে গেলাম শুধু আমি, নয়ন আর খালা।

নয়ন মায়ের রুমে ঘুমাতো। জোর করে আমার রুমে শোয়ালেও মাঝরাতে উঠে দেখতাম নয়ন মায়ের রুমে ঘুমিয়ে আছে। ঠিক সেভাবে যেভাবে মা থাকতে ঘুমাতো। এক পাশে। মায়ের পাশটায় মায়ের কোনো ম্যাক্সি বা শাড়ি থাকত।

মায়ের মৃত্যুর নয়দিন পর এক তারা ভরা রাতে নয়ন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে আমার সন্তান আসার খবরটা জানাল। তারার দিকে তাকিয়ে বলছিল, নয়নের কতো শখ ছিল মাকে সারপ্রাইজটা দেয়ার। নয়ন কতো পরিকল্পনা করে রেখেছিল মাকে সারপ্রাইজটা দেবে বলে। তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে নয়ন কি ভীষন কেঁদেছিল সে রাতে। আমি থামাই নি নয়নকে। থামানোর ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি নয়নের মাথাটা বুকে চেপে ধরে স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু তারা দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল, মা আমাকে দেখছে।

আমি, খালা, নয়নের পরিবার মিলে নয়নের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখিনি। তবুও মনে মনে কি ভীষন এক ভয় কাজ করতো আমার। নয়ন ও যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়।

সাতটা মাস কোন দিকে দিয়ে চলে গিয়েছিল টের পাইনি। আমি নয়ন দুজনেই খুব করে চেয়েছিলাম যেন আমাদের মেয়ে হয়। আলট্রাতে দেখে জানা গেলো না আগে থেকে। বাবু অন্যদিকে ঘুরে আছে। তবে সত্যি সত্যিই আমাদের মেয়ে হলো। আশ্চর্য্যের বিষয় হল আমার মেয়ে অবিকল দেখতে আমার মায়ের মতো হল। এমনকি গলার কাছের তিলটাই বলে দেয় আমার মেয়ে আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি। নয়ন হাসপাতালের বেডে শুয়েই ঘোষনা দিল তার মেয়ের নাম হবে রাবেয়া। আমার মায়ের নামে। নয়নের ভাবী বোন একটু গাইগুই করেছিল। কিন্তু মেনে নিল।

আজ রাবেয়ার প্রথম জন্মদিন। কি সুন্দর আমার মুখে হাত বুলিয়ে দেয় আমার রাবেয়া। ঠিক যেভাবে আমার মা আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিতো। সেভাবে। আমার চোখ জ্বলে উঠে। ভীষন সুখে।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে