নয়নতারা পর্ব-০১

0
750

নয়নতারা
#আরুশা_নূর

আকদের দিন নয়নের হাতে আংটি পড়ানোর সময়ই বুঝেছিলাম, নয়ন কতো আদরে বড় হয়েছে। কি ভীষন নরম হাত। জীবনে একগ্লাস পানি ঢেলে খেয়েছে কি না সন্দেহ। ফাতিমাহ জামান নয়নতারা। নাম শুনলেই বুঝা যায় কতো আদরের সন্তান সে। নয়নের দামী চাকুরী,নয়নের রূপ, নয়নের বাবার টাকা, নয়নের বড় ভাইয়ের ক্ষমতা, নয়নের বড় বোনের প্রতিপত্তি সব দেখেই আমি নয়নকে বিয়ে করতে চরম অনাগ্রহ প্রকাশ করি। আমার বড় ভাই ভাবীরাও চাচ্ছিল না আমি নয়নকে বিয়ে করি। শুধুমাত্র আমার ক্যান্সারে আক্রান্ত মায়ের কথায় আমি নয়নকে বিয়ে করি। আমার সাথে বিয়েতে নয়নের পরিবারের সবাই যে রাজি ছিল তাও না। নয়নের বাবা রাজি তো মা রাজি না। বোন রাজি তো দুলাভাই রাজি না। ভাবী রাজি তো ভাই রাজি না। কিন্তু তাও নয়নের সাথে আমার বিয়েটা হয়েছে আমার দুটো বিদেশি ডিগ্রীর জোরে, আমার বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকুরীর জোরে।

আমি বিয়েতে মোটেও আগ্রহী ছিলাম না। আমার জীবনে আমার মায়ের পরে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছিলাম সেই তিথি যখন আমাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায়, তাও শুধুমাত্র আমার মা আমার সাথে থাকবে বলে, আমার অসুস্থ মায়ের সেবা তাকে করতে হবে বলে, তখন মনে হয়েছিল পুরো জীবন কাটিয়ে দিবো একা একা। লাগবে না কাউকে। কিন্তু মায়ের জন্য আমাকে বিয়ে করতে হল।

বিদেশ থেকে ফিরে আমার মাকে আমি গাজীপুরের এক বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আসি। আমার মা নিজের বিয়ের গয়না বিক্রি করে আমাকে বিদেশে পাঠয়েছিলেন। বিদেশে যাওয়ার পর শুনি মায়ের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সেকেন্ড স্টেজে। চিকিৎসার জন্য টাকার দরকার ছিল। আমার ভাই ভাবিরা টাকা খরচ করে আমার মায়ের চিকিৎসা করাতে চাননি। তাই বৃদ্ধাশ্রম রেখে এসেছিলেন।
আমাকে কেউই কিছু জানায়নি। আমি মায়ের চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে যা পারতাম অল্প স্বল্প আমার ভাইদের কাছে পাঠাতাম। কিন্তু তার সিংহভাগ তারা নিজেরাই ভোগ করতো। বাকিটুকু বৃদ্ধাশ্রমে দিতো মায়ের ঔষধের জন্য। একটাবারের জন্য মা আমাকে কিছুই জানায়নি।

আমি বিদেশ থেকে ফিরে সব জানতে পারি আমার মামার থেকে। তিনি আর আমিই গিয়ে মাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে আসি। আমার মামা গ্রাম থেকে আমার মায়ের এক দূর সম্পর্কে বোনকে নিয়ে আসেন। যিনি আমার মায়ের খেয়াল রাখতেন। আমি মাকে নিয়ে মাদ্রাজ, বেনারাস সব জায়গায় গিয়েছি। সবাই আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। আর কিছুই করার নেই। পুরো শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পরেছে। আর কিছুই করার নেই। তাই যতদিন বাঁচে যেন আরামে বাঁচে, তাই অপারেশন, কেমো রেডিয়েশন এর চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে বলেছেন। যতটুকু কেমো দেয়া হয়েছে তাতেই আমার মায়ের কোমর সমান চুল ঝরে পড়েছে। মা ও ভীষন ক্লান্ত। তার একটাই ইচ্ছা আমার বউ দেখে যেতে চান। তাই নয়নকে বিয়ে করা।

বনানীতে একটা ফ্ল্যাটে আমি মাকে নিয়ে থাকি। সঙ্গে মায়ের সেই দূর সম্পর্কের বোন, যাকে আমি খালা বলে ডাকি। খালা নিঃসন্তান। স্বামী মারা যাবার পর থেকে অভাব অনটনে আছেন। তাই মামা উনাকে মায়ের কাছে দিয়ে যায়। আমি ও খালা থাকায় বেশ নিশ্চিন্ত থাকি। খালাই সব করেন। আমার ভাই ভাবীরা আমার সাথে ভাল সম্পর্ক রাখার জন্য মাঝে মাঝে ফলমূল নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে আসে। কিন্তু আমি বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকে গত একবছরে একটা কথাও বলিনি তাদের সাথে। আমার বড় ভাবী চেয়েছিলেন আমি তার বোনকে বিয়ে করি। ছোট ভাবী চেয়েছিলেন তার কাজিনকে বিয়ে করি। এজন্য অবশ্য প্রত্যেকে এসে মাকে পটানোর অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মা কেন জানি নয়নকে বউ করে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।

বিয়ে করে যেদিন নয়নকে নিয়ে বাসায় এসেছিলাম, সেদিন মা ভীষণ অসুস্থ। খালাও। খালার ভীষণ জ্বর। মা ভীষণ দূর্বল থাকায় বিছানাতেই বমি করে দিয়েছেন।
খালা জ্বর নিয়ে তা পরিষ্কার করতে করতে আমরা চলে এলাম। মায়ের এমন বমি প্রস্রাব পায়খানা আমি প্রায়ই পরিষ্কার করি। মায়ের শরীর ভীষণ দূর্বল। উঠে চলা ফেরায় কষ্ট হয় তার। বেশিরভাগ সময়ে বুঝতে পারেন না যে তার প্রস্রাব বা পায়খানার বেগ পেয়েছে। না বুঝেই বিছানায় করে ফেলেন। আমি খালা মিলে পরিষ্কার করি।
আমি নয়নকে নিয়ে মায়ের রুমে ঢুকতেই দেখি খালা জ্বর নিয়ে মায়ের বিছানা উঠাচ্ছে। মা বিছানায় তখন শুয়ে। আমাদের দেখে মা খুবই লজ্জিত হলেন। বারবার বললেন, “আমি বুঝতে পারিনি যে বমি হয়ে যাবে। শানু অসুস্থ তো তাই ওকে ডাকিনি।”
নয়নকে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল আমার দুই ভাবী। যাদের আমি বিয়েতে আমন্ত্রণ ও জানাইনি। স্বআমন্ত্রিত যাকে বলে। তারা বমির গন্ধে নাক কুঁচকে নয়নকে বললেন, “ইশ! নতুন বিয়ে হয়ে এসেই এসব দেখতে হল। কি কপাল তোমার। ইয়াক!
আমার মামা বললেন, “আসলে মা, তোমার শাশুড়ী একটু অসুস্থ তো। ঠিক হয়ে যাবে।”
মা ও যেন ভীষন অপরাধবোধে ভুগছে। আমি দৌড়ে গিয়ে মাকে ধরলাম।
আমার দুই ভাবী নয়নকে নিয়ে অন্য রুমে যেতে চাইলেন। বললেন, “চলো ভাই। এই রুমে থেকে আর কাজ নেই।”
নয়ন গেলো না। খালা পারছিল না একা বিছানা উঠাতে। নয়ন এসে খালার সাথে বিছানা ধরতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। খালা বলে উঠলেন, “করো কি নতুন বউ। আমি পারুম। তুমি ছাড়ো। ” নয়ন কিছু না বলে খালার সাথে বিছানা ধরে টানতে লাগলো।
আমি নয়নকে বললাম, “তুমি মাকে ধরো। আমি দেখছি। ”
নয়ন দৌড়ে এসে মাকে ধরল। আমি আর খালা মিলে বিছানা উঠিয়ে নতুন বিছানা বিছালাম। তারপর মাকে নিয়ে আমি আর খালা বাথরুম গিয়ে সব পরিষ্কার করলাম। এসে দেখি নয়ন বিছানার চাদর আলমারি থেকে বের করে বিছানায় বিছিয়ে দিচ্ছে। বিয়ের ভারী শাড়ী সামলে নয়ন মায়ের খাটে বিছানার চাদর বিছাচ্ছে। সবাই মুগ্ধ। আমার ভাবীরা টিপ্পনী কাটছে। মুখ বাকাচ্ছে। আমার ভীষন বিরক্ত লাগছে,। আমার দুই ভাইয়ের বউ ও ঠিক এইভাবে মায়ের সেবা করতে চেয়েছিল। তখন যদিও মায়ের ক্যান্সার ছিল না। কিন্তু তখন মায়ের সামান্য সর্দি হোলেও তারা এমন আলগা পিরিত দেখাতো। সেই তারাই আমার মাকে এতো অত্যাচার করেছে যা ভাষায় অবর্ননীয়।
মাকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে যখন আমি রুমে আসি তখন দেখি নয়ন বিয়ের পোষাকে বসে আছে আমার জন্য। আমার কেন জানি নয়ঙ্কে অসহ্য লাগছিল। তিথিকে নিয়ে আমি সারাজীবন এই রাতের স্বপ্ন দেখেছি। সেখানে এই মেয়ে। কিছু না বলেই পোশাক পালটে আমি শুয়ে পড়েছিলাম। কিছুই বলিনি। নয়নের হতভম্ব চেহারা আমি না দেখেও অনুভব করতে পারছিলাম।

এরপরের দিনগুলো খুবই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো নেই। আমার মা সবসময় বলতো, আমার বউ এসে এই ঘরকে পালটে দিবে। সত্যিই তাই হলো। ঘরকে পালটে দিল নয়ন। সব পরিবর্তন সুন্দর হলেও, কেন জানি আমার ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা ভীষন রকম অসুন্দর হলো। আগে আমি ডাইনিং টেবিলে খেতাম, আমার পাশে খালা খাবার বেড়ে দিয়ে বসে থাকতো। এখন নয়ন খাবার বেড়ে দিয়ে চলে যায়। আমি একা একা খাই। আগে আমি অফিস থেকে এসে মায়ের রুমে বসে মায়ের সাথে সময়্ কাটাতাম। এখন মায়ের রুমে চাঁদের হাট বসে। মা খালা আর নয়ন মিলে কি আড্ডাটাই না দেয়। সেখানে আমার জায়গা নেই। মা আমাকে ডাকে। কিন্তু আড্ডার কতৃত্ব থাকে নয়নের কন্ঠে। আমার কেনা জানি ভাল লাগে না সেটা। হিংসে হয় নয়নকে। আগে মা অসুস্থ থাকলে মায়ের পাশে ঘুমাতাম। এখন মা সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ, নয়ন মায়ের সাথেই ঘুমায়। প্রতিরাত। নয়ন নাকি মাকে বলেছে, আমাকে ওর ভয় লাগে। নয়নের গম্ভীর মানুষজন ভাললাগে না। মা নাকি অনেকবার অনুরোধ করেছে নয়নকে আমার সাথে ঘুমাতে। নয়ন কোনো না কোনো না ছুতোয়, মায়ের সাথে ঘুমায়। মহারানীর জিনিসপত্র সব আমার রুমে। আমার আলমারীর অর্ধেক জায়গা দখল করে রেখেছে তার শাড়ি। কিন্তু মহারানী আমার রুমে ঘুমায় না।

কেন জানি খুব করে মনে হয়, মা আর আমার নাই। নয়নের হয়ে গেছে। মা নয়নের হাত ধরে ধরে ছাদে যায়। অনলাইনে খাবার অর্ডার করে খায়। লুকিয়ে লুকিয়ে দুজনে অনেক কিছু করে যার কিঞ্চিৎ ভাগই আমার কানে আসে খালার মাধ্যমে।

কিছুদিন আগে আমার খালাত ভাইয়ের বিয়েতে আমি, মা আর নয়ন গেলাম। মাকে দেখে মনেই হয় না মা অসুস্থ। কি ফুরফুরে থাকে মা। মা আর নয়ন ম্যাচিং শাড়ী পড়েছে। একইরকম শাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে মা মেয়ে। আমি মেয়ের জামাই। না না বাইরের লোক। দুজনে কতো ছবি যে তুলেছে ইয়ত্তা নেই। মা কাঁপাকাঁপা হাতে আবার সেলফিও তোলে নয়নের সাথে। আমার বড় ভাইয়ের বউ মাকে দেখে বলেছিল, “এক পা ক/ব/রে, কোথায় ঘরে বসে আল্লাহ বিল্লাহ করবেন তা না, রঙ চং মেখে মানুষকে দেখাতে চলে এসেছেন।” আমার নরম মনের মায়ের চোখে পানি চলে এসেছিল এই কথা শুনে। আমি খুব কঠিন কিছু বলতে নিবো তার আগেই দেখি নয়নের হাতে থাকা ফুচকার প্লেটে থাকা তেতুলের টক বড় ভাবীর শাড়িতে গড়িয়ে পড়ছে। আর নয়ন সর‍্যি বলে মাকে নিয়ে সেখান থেকে সরে এলো।

আমার মা কলেজে পড়াকালীন সময়ে আমার মায়ের বিয়ে হয়। তার প্রানের বান্ধবী মিতা আন্টি বিয়ের পর ও মায়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। অনার্সে পড়াকালীন সময়ে মিতা আন্টির বিয়ে হয়ে বিদেশে চলে যান। দেশে আসলেই মিতা আন্টি মায়ের সাথে এসে দেখা করে যান। এবার ও দেশে এলেন। কিন্তু সাথে সাথেই মায়ের সাথে দেখা করতে এলেন না। বললেন শেষ দুইসপ্তাহ তিনি মায়ের সাথে কাটাবেন। মিতা আন্টি স্বামী বছর দুই হলো মা/রা গেছেন। স্বামী ছাড়া এই প্রথম দেশে। তাই মায়ের কাছে বেশি সময় থাকবেন।

মিতা আন্টি আসবে শুনে মায়ের কতো আয়োজন। নয়নকে নিয়ে কতো বাজার সদাই করেছে। যথাসময়ে মিতা আন্টি এলেন আমাদের বাসায়। মায়ের রুমকে চাঁদের হাট না বলে অন্য কিছু বললে ভাল হতো। হাসির আওয়াজে ঘরে টেকা দায়। সমস্যা হলো রাতে। যখন মিতা আন্টি আর মা জানালেন তারা একসাথে ঘুমাবেন। সেই ছোটবেলার মতো। নয়ন ঘুমাবে কই?
নয়ন মাথা নিচু করে, কালো মুখে করে রাত সাড়ে এগারটায় আমার রুম এলো। আমি রাজ্যের হাসি মুখে নিয়ে বলেছিলাম, “কি? ভয় লাগে বলে আমাকে, এখন আসছো যে? ভয় লাগতেছে না? ”
নয়ন কপাল কুঁচকে বলছিল, ” নিজের সাইজ দেখছেন, আমার গায়ের উপর পড়লে আমি আর বাঁচবো?”
আমি যারপরনাই অবাক হলাম। কি বেয়াদব মেয়ে। আমি নয়নের চেয়ে ভীষন লম্বা। নয়নের হাইট পাঁচ ফিট এক ইঞ্চি। আমার হাইট ছয় ফিট দুই ইঞ্চি। নয়নের এইটুকু ইঁদুরের মতো শরীর। হালকা পাতলা গড়নের। আমার শরীর চ্যাপ্টা , বিশাল বুকের ছাতি। এই কারনে সে আমাকে ভয় পাবে? নিজের এইটুকু শরীর। আমাকে এমনভাবে বলল যেন আমি অনেক মোটা। কিছু না বলে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে