ধোয়ার-নেশা পর্ব (২৩+২৪) শেষ

0
1994

#ধোয়ার-নেশা

#রোকসানা-রাহমান

পর্ব (২৩+২৪) শেষ

আতিশ পালককে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে পাপড়ির গলা শুনতে পেলো।

“” ভাইয়া দেখতো,কাল আমি কোন শাড়ীটা পড়ে বউ সাজবো?””

আতিশ পেছনে ঘুরতেই পাপড়ির হাতে লাল আর খয়েরী কালারের পাথর আর সুতোর ভারী কাজ করা শাড়ী দেখতে পাচ্ছে। মুখে তার সেই মনভোলানো চিকচিক হাসি। তবে কি পালক সত্যি কথাই বলেছে? পাপড়ি অন্য কারো জন্য বউ সাজবে? ভাবতেই আতিশের অন্তরআত্মা কেঁপে উঠছে!

পাপড়ি দরজার কাছটা থেকে সরে এসে পালক আর আতিশের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে। পালকের মুখোমুখি হয়ে দাড়ানোর ফলে আতিশ পাপড়ির পেছন সাইড দেখতে পাচ্ছে। পাপড়ি আরো উৎসাহী ও আদুরী গলায় বললো,,

“” ভাইয়া দেখনা,উনি তো দুটো বেনারশী পাঠিয়েছে। এখন আমি কোনটা পড়বো বুঝতে পারছিনা। তুই বলে দেতো!””

পালক কিছুক্ষন দুটো শাড়ীর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,,

“” আমি বুঝতে পারছিনা। দুটোতেই তোকে অনেক সুন্দর লাগবে। তুই বরং আতিশকে জিজ্ঞেস কর!””

পাপড়ি তাৎক্ষনিক অনেকটা লাফানো ভঙ্গিমাই উল্টো ঘুরে গিয়েছে। আতিশের দিকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,,

“” আতিশ ভাইয়া,তুমি বলো তো কোনটাতে আমায় বেশি সুন্দর লাগবে?””

আতিশ ভেতরে ভেতরে রেগে ফেটে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে পাপড়িকে কষে দুটো চড় মারতে। এতো বড় সাহস আমার কাছে জিজ্ঞেস করে ও অন্যের জন্য কোন শাড়ী পড়ে বউ সাজবে? তোর বউ সাজা আমি ছুটাচ্ছি!

আতিশ অন্তরের রাগ অন্তরেই আটকে রেখে নরম সুরে বললো,,

“” পাপড়ি ভেতরে যাও। আমার পালকের সাথে কথা আছে!””
“” কিন্তু আমার শাড়ী!””

পেছন থেকে পালক বলে উঠলো,,,

“” যার জন্য বউ সাজবি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে নে।””
“” Good idea.””

পাপড়ি যেমন চিকচিক হাসি নিয়ে আতিশের সামনে এসেছিলো ঠিক তেমনি চিকচিক হাসি নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে,তবে এখনকার চিকচিকটার মধ্যে কিছুটা লাজুকতা মিশ্রিত!

পাপড়ি চলে যেতেই আতিশ পালককে উদ্দশ্যে করে বললো,,

“” আর ৯ দিন পর ওর এইচ.এস.সি পরীক্ষা আর তোরা এখন ওকে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দিচ্ছিস? ওর কি বিয়ের বয়স হয়েছে?””

পালক বিছানায় ধপাস করে বসে পড়েছে,সাইড থেকে একটা বালিশ নিয়ে ওটাতে কাধটা ভর দিয়ে আতিশকে বললো,,

“” আমি কেন ওকে বিয়ে দিতে যাবো? ও তো নিজেই বিয়ের জন্য নাচ্ছিলো।””
“” নিজে নাচ্ছিলো মানে?””

পালক এবার কাধের ভরটা ছেড়ে দিয়ে আরাম করে শুয়ে বললো,,

“” আরে,ওর নতুন টিউটরটা আসার পর থেকেই দেখি বোন আমার তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এমনি হাবুডুবু খাচ্ছে যে আমাকে স্ট্রেইট জানিয়ে দিলো,যদি এখনি ওদেরকে বিয়ে দিয়ে না দেই তাহলে নাকি পরীক্ষা দিবেনা। নাওয়া খাওয়াও বন্ধ। এখন তুই ই বল আমি একজন খাটি প্রেমিক হয়ে আমার বোনের প্রেমকে কি করে ফেলে দেই?””

আতিশ পালকের পাশে এসে বসে পড়েছে,কিছুটা অসস্থিরতা ও ধমকানির সুরে বললো,,

“” তাই বলে এখনি বিয়ে? পরীক্ষাটা শেষ হলে দেওয়া যেতোনা?””
“” আমার বোন আমার মতোই অধৈর্য্য রে আতিশ!””
“” ছেলে কি করে? কোথায় থাকে? নাম কি?””
“” আমার ঘুম পাচ্ছে,তুই পাপড়ির কাছ থেকে জেনে নে।””

আতিশের ইচ্ছে হচ্ছে শুধু পাপড়িকে না এই পালককেও কষে দুটো চড় মারতে। এইদিকে আমি অস্থিরতায় মরে যাচ্ছি আর ও ঘুম নিয়ে পড়ে আছে?? যাকে দেখার জন্য এতোটা আকুলতা নিয়ে আসলাম সেই কিনা বিয়ের জন্য টেই টেই করে নাচ্ছে??

আতিশকে অবাক করে দিয়ে পালক সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আতিশ পালকের রুম ছেড়ে পাপড়ির রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে। দরজাটা মনে হচ্ছে ভেতর থেকে বন্ধ। দরজা বন্ধ করে কি করছে ও? নতুন টিউটরের সাথে ফুসুরফুসুুর? ফোনে কথা বলতে হলে কি দরজা বন্ধ করে নিতে হয়?? আতিশ দরজায় নক দিতে গিয়েও দিলোনা। একটা চাপা অভিমান কাজ করছে। এতোটা দিন ধরে যে মেয়েটা এতোটা ভালোবেসে এসেছে,সে একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতো পাল্টে গেলো কি করে?? তাহলে কি ওগুলো সত্যিই অল্প বয়সের আবেগ ছিলো? আমার কি বুঝতে ভুল হয়েছিলো?? হয় তো তাই হবে,নাহলে ও কিভাবে অন্য কারোর বউ সাজার কথা ভাবতে পারে? ওর চোখে মুখে নতুন কারোর উপস্থিতির যে আলো জ্বলজ্বল করছে তা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছে ঐ মানুষটাকে পেয়ে ও কতটা খুশি!

আতিশের ব্যথা হচ্ছে,বুকের ভেতরে। যে ব্যথা অন্য কাউকে দেখানো যায় না,অন্য কাউকে বলাও যায় না। এটা হলো না বলতে পারার কথাগুলোর ব্যথা! এই ব্যথাগুলো কখনোই প্রকাশ করা যায়না। প্রকাশ করা উচিতও না। কেননা,যাকে বলার প্রয়োজন তাকেই যদি না বলা হয়ে থাকে,তাহলে অন্য কাউকে কেন বলবে? এটা বুঝানোর জন্য যে সে কতটা ব্যর্থ??

আতিশ না চাইতেও চোখের কোনে পানি জমে যাচ্ছে। এই পানিগুলোকে এই কোনেই আটকে রাখতে হবে,বাহিরে আসতে দেওয়া যাবেনা। কখনোই না।

অন্ত্রীশার ডাকেই পালকের ঘুম ভেঙেছে,ঘুমঘুম চোখে অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়ে আছে পালক।

জাম কালার সুতির শাড়ী পড়েছে ও। কানে সোনার দুল,হাতে চিকন সোনার চুড়ি আর নাকে নাকফুলে পুরো নতুন বউ। কিন্তু তার সাথে খালি গলাটা মানাচ্ছেনা। একটা সোনার চিকন চেইন হলে বেশ হতো!

অন্ত্রীশা পালকের পাশে বসে পড়েছে। উল্টো দিকে ঘুরেই ওর দিকে একটা চেইন এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” এটা পড়িয়ে দিনতো!””

পালক তখনো অন্ত্রীশার বউরুপে দেখায় মগ্ন। তার বউটা যে এতো সুন্দর তাতো আগে বুঝেনি। বউ তো সে অনেক আগে থেকেই কিন্তু তখন তো ওকে এমন বউ বউ লাগেনি,আজ কেন লাগছে?? ভালোবাসি বলে??

“” কি হলো? আপনি কি আবার ঘুমিয়ে পড়লেন?””

অন্ত্রীশার ডাকে পালক উঠে বসেছে। ওর হাত থেকে চেইনটা নিতেই বুঝতে পারলো এটাতে তারই দেওয়া সেই লকেটটাও ঝুলছে। ঠোটের কোনে হাসি নিয়ে অন্ত্রীশার চুলে হাত দিতেই ও বলে উঠলো,,

“” আমি আপনাকে চেইন পড়িয়ে দিতে বলেছি,আমাকে ছুতে নয়। আমার শরীরের কোনো অংশেই যেন আপনার টাচ না লাগে বুঝতে পেরেছেন?””

অন্ত্রীশার অমন কথায় পালকের মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে।

অন্ত্রীশা নিজের হাতে নিজের চুলগুলো উচু করে ধরে রাখতেই পালক খুব সাবধানে চেইনটা পড়িয়ে দিয়েছে।

অন্ত্রীশা বসা থেকে উঠে বললো,,

“” নো কথা,নো ছোয়া। অনলি কলঙ্কিত! ওকে?””

পালকের চুপসা মুখ দেখে অন্ত্রীশার খুব হাসি পাচ্ছে। সে তো নিজেও চেইনটা পড়তে পারতো,কিন্তু পালককে একটু জ্বলতে দেখার জন্যই ওর কাছাকাছি এসেছে। ভালোবাসায় একটু একটু না জ্বললে খাঁটি হবেটা কি করে???

এতো বছর পর নিজের পত্রীকন্যাকে এতো কাছে পেয়েও ছুয়ে দেখতে পারছেনা,একটু মনভরে ভালোবাসার কথা বলতে পারছেনা,একটু বুকে নিতে পারছেনা,এই কষ্ট পালক কোথায় রাখবে?? আজ সোফাটাকে মনে হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন,শক্ত,ধারালো বস্তু যা একটু পরপর খুচিয়ে বলছে পত্রীকন্যার কাছে গিয়ে শুতে। ঘুম আসছে তার,মনটা কেমন আনচান আনচান করছে,শরীরের মধ্যে এক নতুন উত্তেজনা উকি দিতে চাচ্ছে।

পালক শোয়া থেকে উঠে অন্ত্রীশার কাছে এসে দাড়িয়েছে। টুপ করে মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসেও পড়েছে। হাতদুটো খাটের ধারটাতে ভাজ করে তাতে থুতনি ঠেকিয়ে অন্ত্রীশার দিকে তাকিয়ে আছে। জাগ্রত অবস্থায় তো তোমার কাছেও ঘেষতে দাওনা। কিন্তু ঘুমন্ত অবস্থায় ঠিকই ঘেষবো। তোমাকে ছুতে না পারি,মন ভরে দেথতে তো পারবো?? আমার পত্রীকন্যাকে দেখে দেখেই আজ সারাটারাত পার করবো।

পালক অন্ত্রীশার ঘুমন্ত চেহারায় তাকিয়ে পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে। এ যেন কোনো রুপকথার ঘুমন্ত রাজকুমারী। কি মায়াবী আর নিষ্পাপ চেহারা! মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে,,,এতো অপেক্ষা,এতো রাগ,এতো অভিমান,এতো ভুল শেষে আজ যখন দুজনদুজনার হলাম তখনই তোমাকে এতো বড় শর্ত জুরে দিতে হলো পত্রীকন্যা?? আমি কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখবো?? আমিতো তোমার প্রেমের আগুনে পুড়ে কবেই কলঙ্কিত হয়ে গিয়েছি তা তুমি বুঝতে পারছোনা?? আবার নতুন করে কিভাবে কলঙ্কিত হবো?? আমারতো মন,প্রান,শরীর,মাথা কিছুই কাজ করছেনা। সারাক্ষন তোমাকে একটু দেখার জন্য উফালপাথাল হয়ে যাচ্ছে,এমন অবস্থায় কলঙ্কিত কিভাবে হবো তা খুজেই পাচ্ছিনা। আমার সব বুদ্ধী আমি যে তোমার মাঝে হারিয়ে ফেলেছি!

অন্ত্রীশার ঘুম ভাঙতেই পালককে নিজের পাশে আবিষ্কার করেছে। হাতের উপর ভর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে,মাথাটা এক সাইডে কাত হয়ে পড়ে আছে। অন্ত্রীশা ঠোটটিপে হেসে নিয়ে একটা বালিশ পালকের কাছটাতে রেখেছে। আলতো করে ওর মাথাটা উঠিয়ে বালিশটা নিচে গুজে দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

“” কিরে বাপ,তোর কি শরীর খারাপ? অপিসে যাবিনা?””

আতিশ চোখ না মেলেই শোয়াবস্থায় বললো,,

“” না।””
“” আজকে কি বন্ধ?””
“” জানিনা। আমার ঘুম পাচ্ছে ঘুমাতে দাওতো আম্মু!””

দিলরুবা বেগম ছেলের মাথার কাছটাতে বসে চুলে হাত বুলিয়ে বললেন,,

“” রাতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়েই পড়লি,এতোবেলা করে ঘুমাচ্ছিস,কিছু কি হয়েছে?””
“” না।””
“” তাহলে আমার সাথে পালকের বাসায় চল,আজতো পাপড়ির গায়ে হলুদ। ওখানে গেলেই মনটা ভালো হয়ে যাবে।””

পাপড়ির নামটা শুনতেই আতিশের চোখ খুলে গিয়েছে। চোখে একরাশ বিরক্ত নিয়ে উঠে বসলো,,,

“” আমি তো কোথায়ও যাবোনা আর তুমিও যাবোনা।””
“” ওমা কেন? পালক এতো বার করে বলে গেলো,না গেলে খারাপ দেখাবেনা??””
“” সে আমি দেখে নিবো। তুমি যাবা না মানে যাবা না। ক্ষুধা লাগছে যাও ভাত বারো।””

আতিশ টাওয়াল নিয়ে গোসল করতে চলে গেলো।

“” এসব কি শুনছি অনতি?””

অরিদ্রার হাতে মেহেদী পড়াতে পড়াতে অনিকশার কথার উত্তর দিচ্ছে অন্ত্রীশা,,,

“” কি আপু?””
“” তুই নাকি পালককে বলেছিস কলঙ্কিত পুরুষ হয়ে দেখাতে?””
“” হুম!””

অনিকশা এবার সিরিয়াসমুডে বললো,,

“” নিজের বরকে কেউ অন্য মেয়ের কাছে ছেড়ে দেয়?””
“” অন্য মেয়ের কাছে ছাড়তে যাবো কেন?””
“” অন্য মেয়েকে না ছুলে কলঙ্কিত হবে কিভাবে?””

অরিদ্রার হাত থেকে মনোযোগ সরিয়ে অনিকশার দিকে তাকিয়েছে অন্ত্রীশা।

“” শুধু অন্য মেয়েকে ছুলেই কলঙ্কিত হওয়া যায়? আর কোনোভাবে হওয়া যায় না?””
“” আর কিভাবে হবে?””

অনিকশার প্রশ্নের উত্তরে ছোট্ট করে হাসি উপহার দিয়েছে। ওর হাতটা টান দিয়ে নিজের কোলে রেখে অন্ত্রীশা বললো,,

“” তোমার হাতে মেহেদী পড়লে অনেক সুন্দর লাগবে আপু। অরিদ ভাইয়া কখন আসবে??””

পালক যতটা পারছে অন্ত্রীশার থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করছে। ওর আশেপাশে থাকলেই কেমন জানি চুম্বকের মতো টান অনুভব হয়। আর সেই টান অগ্রাহ্য করা কতটা কঠিন সেটা একমাত্র ও ছাড়া আর কেউ উপলব্ধী করতে পারবে না। তার মধ্যে কলঙ্কিত হওয়ার উপায়টাও এখনো খুজে পাচ্ছেনা। আর কত সে নিজেকে আটকে রাখবে,উফ! এতো সমস্যা আমাকেই কেন ফেইস করতে হয়??

পালক ভাবনার তালে রুমে ঢুকতেই একটা ছেটখাটো হার্টঅ্যাটাক হয়ে গেলো। অন্ত্রীশা ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে দাড়িয়ে আছে। এই মেয়েটা আমাকে জীবিত অবস্থায় মেরে ফেলবে,একবার ব্লাউজ ছাড়া শাড়ী পড়ছে তো আরেকবার শাড়ী ছাড়া ব্লাউজ পড়ছে। পালক চট করে ঘুরে বেড়িয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে ডাক পড়ে।

“” চলে যাচ্ছেন কেন? আমি তো আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। শাড়ী পড়ার আগেই মেহেদী পড়ে ফেলেছি। এখন শাড়ীটা কিভাবে পড়বো? ঐদিকে পাপড়িকে হলুদের স্টেজেও নিয়ে যেতে হবে আর মেহেদীও এখনো শুকায়নি। শাড়ীটা আপনি পড়িয়ে দিনতো!””

পালক যেমন চট করে ঘুরে গিয়েছিলো আবারও তেমন চট করেই অন্ত্রীশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুহুর্তে সে সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি!

“” এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনি শাড়ী পড়াবেন নাকি এভাবেই বেড়িয়ে যাবো?””

পালক বিছানা থেকে শাড়ীটা হাতে নিয়ে অন্ত্রীশার কোমড়ে গুজতে গিয়ে থমকে গিয়েছে। ধবধবে সাদা মেদহীন পেটটার মধ্যে গর্তহীন নাভী!

“”হাত দিয়ে ছুতে পারছেননা বলে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছেন?””

অন্ত্রীশার ধমকানিতে পালকের হুশ এসেছে। পালক অসহায় দৃষ্টিতে অন্ত্রীশার দিকে তাকাতেই ও বললো,,

“” নো কথা,নো ছোয়া। অনলি কলঙ্কিত! ওকে???””

সারাদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করে রুমের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছিলো আতিশ। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই বুকের ভেতর হারানোর ঝড় উঠেছে। যে ঝড়ে সে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা। বারবার শুধু পাপড়ির একটা কথায় মাথায় আসছে,আপনি তুমি করে বললে নিজেকে আপনার বউ বউ লাগে!

যে মেয়েটা শুধু তুমিতেই নিজেকে আমার বউ ভাবতো সে কিভাবে এখন এতো রঙঢঙ সেজে অন্যকারো বউ হবে? কেন? ও শুধু আমার বউ হবে,শুধু আমার। ওর হলুদ মাখা আমি ছুটিয়ে ছাড়বো। শুধু হলুদ কেন? সাথে মরিচ,ধনিয়া,জিরা,আদা,রসুন সব মাখাবো!

আতিশ রাগে গজগজ করতে করতে পালকের বাড়ি এসে হাজির। চারপাশে মানুষের চিল্লাচিল্লি,রঙঢঙ,লাইটের আলো,ফুলের গন্ধ সবকিছুই যেন আতিশের রাগকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে সব ভেঙে চুড়মার করে দিয়ে চিৎকার করে বলতে,পাপড়ি আমার বউ হবে। ওকে কোনো হলুদ লাগাতে হবেনা। আমি নিজেই হলুদ হয়ে ওর মধ্যে মেখে যাবো।

আতিশ বড় বড় পা ফেলে স্টেজের সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। স্টেজে হলুদ শাড়ী আর ফুলের গয়নায় সেজে বসে আছে পাপড়ি। ঠোটে তার খুশি আর লাজুকতার হাসি।

“” আতিশ ভাই,এতো দেরি করলেন যে? পাপড়িকে হলুদ দিবেননা?””

অন্ত্রীশা আতিশকে টেনে পাপড়ির সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে। হাতে একদলা হলুদ নিয়ে পাপড়ির গালে মাখতে মাখতে ভাবছে,এমন হলদে পাখিটার দিকে তাকিয়ে যে রাগ করতে পারবে তাকে শুলে চড়ানো উচিত!

গায়ে হলুদের পার্ট চুকিয়ে সবকিছু সামাল দিয়ে রুমে ফিরতে ফিরতে প্রায় মাঝরাত হয়ে এসেছে। চোখে,মুখে হাজারও ক্লান্তির ভিড় অন্ত্রীশার। বিছানায় শরীরটা মেলে দিতে না পারলে হয়তো এখনি ঢুলে পড়ে যাবে। অন্ত্রীশা ধীর পায়ে রুমের কাছে এসে থেমেছে। দরজাটা লাগানো। ভেতর থেকে কেমন একটা বাজে গন্ধ আসছে। অন্ত্রীশা কপাল কুচকে দরজা খুলতেই কাঁশি উঠে গিয়েছে। রুমে ড্রিমলাইটের আলো। তাও ধোয়ায় ঢেকে রয়েছে। চারপাশে ধোয়ারা উড়ে বেড়াচ্ছে। সিগারেটের এমন তীব্র গন্ধ অন্ত্রীশা সহ্য করতে পারছেনা। শুধু কেঁশেই যাচ্ছে। চোখে জ্বলাও ধরেছে।চোখ খুলতে পারছেনা। তবুও মেলার চেষ্টা করে ভেতরে তাকাতেই মেঝেতে পালককে বসে থাকতে দেখলো।

পালকের চারপাশে সিগারেটের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। অন্ত্রীশা ওগুলোতে চোখ বুলিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো,,,

“” এগুলো কি করেছেন আপনি? রুমের এ অবস্থা কেন? আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন?””
“” তুমি যে গেমটা শুরু করেছো সেটা আজ আমি শেষ করতে চলেছি!””
“” মানে?””

পালক বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,,

“”ভালোবাসার খেলায় দুজনেই পারটিসিপেট করেছি,তাহলে আমি একা কেন পারফর্ম করবো? তোমাকেও পারফর্ম করতে হবে,পত্রীকন্যা!

চলবে

#ধোয়ার-নেশা
#রোকসানা-রাহমান
#অন্তিম-পর্ব

পালকের চারপাশে সিগারেটের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। অন্ত্রীশা ওগুলোতে চোখ বুলিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো,,,

“” এগুলো কি করেছেন আপনি? রুমের এ অবস্থা কেন? আমাকে মেরে ফেলতে চাইছেন?””
“” তুমি যে গেমটা শুরু করেছো সেটা আজ আমি শেষ করতে চলেছি!””
“” মানে?””

পালক বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো,,

“”ভালোবাসার খেলায় দুজনেই পারটিসিপেট করেছি,তাহলে আমি একা কেন পারফর্ম করবো? তোমাকেও পারফর্ম করতে হবে,পত্রীকন্যা!””

পালক অন্ত্রীশার মুখোমুখি হয়ে দাড়িয়ে আছে। অন্ত্রীশার চোখে চোখ রেখে। ধোয়াগুলো তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে,এই ধোয়াগুলোতে এক মাতলতার সুবাস রয়েছে। যা দুজনকে হারিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে এক অদ্ভুত নেশায়। যে নেশাতে ধুকে ধুকে মরবেনা,এক ঝটকায় মরে যাবে।

পালক কি করছে আর কি বলতে চাচ্ছে অন্ত্রীশার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। বেশ বিস্ময় মিশ্রিত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পালকের চোখের দিকে। যেন এই চোখেই সে তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।

পালক অন্ত্রীশার আরেকটু কাছাকাছি,আরেকটু মুখোমুখি,আরেকটু চোখাচোখির ছলে বললো,,

“” একজন কলঙ্কিত আর অন্যজন শুদ্ধিত মিলে কখনোই একটি পবিত্র ফুল ফুটাতে পারেনা। হয় দুজনকেই কলঙ্কিত হতে হবে নাহয় দুজনকেই সুদ্ধিত হতে হবে। আর তুমি যেহেতু চাচ্ছো আমি কলঙ্কিত হয় তারমানে তোমাকেও কলঙ্কিত হতে হবে!””

পালক নিজের কথা শেষ করতেই অন্ত্রীশার কোমড় জড়িয়ে ধরেছে। অন্ত্রীশা তখনো পালকের চোখের মায়ায় ডুবে আছে। যেইনা অন্ত্রীশাকে কোলে উঠিয়ে নিয়েছে অমনি অন্ত্রীশা চিৎকার করে উঠলো,,,

“” আরে কি করছেন? আপনি কিন্তু রুলস ভঙ্গ করছেন,এটা ঠিক হচ্ছেনা পালক!””
“” উহু পত্র পুরুষ! তোমার মুখে পালকটা মানায় না,পত্রী!””

পালকের প্রতিটি কথাতে অন্ত্রীশা হারিয়ে যাচ্ছে,প্রতিটা পদক্ষেপে হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর কথার বুলিতে আজ হারিয়ে যাওয়ার ছন্দ মেখে নিয়েছে। আজ কি তবে তার হারিয়ে যাওয়ার দিন???

অন্ত্রীশাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে পালক ওর উপরে নিজের ভর ছেড়ে দিতেই অন্ত্রীশা আবার সম্ভিত ফিরে পেয়েছে,,,

“” ওমা গো,সরেন,কি হচ্ছেটা কি???””
“” বাসর!””

অন্ত্রীশা পালকের দুবাহু ধরে সরানোর চেষ্টা থামিয়ে চমকে বললো,,

“” কি!!!””
“” হুম,তোমার আমার কলঙ্কিত বাসর। তোমার আমার ধোয়াময় বাসর হবে আজকে। যে বাসরে আমিতো কলঙ্কিত হবোই সাথে তোমাকেও কলঙ্কিত করে দিবো। তবেই তো জন্ম নিবে একটি পবিত্র ফুল! শুনোনা,আমাদের ছেলর নাম হবে পবিত্র আর মেয়ের নাম হবে ফুল,,,তোমার আমার পবিত্র ফুল! কেমন বলেছি বলো??””

অন্ত্রীশা পালকের সাথে দস্তাদস্তি করতে করতে বললো,,

“” কোনো ফুল টুল হবেনা। আপনি রুলস ভঙ্গ করেছেন। আমি বলেছিলাম,নো কথা নো ছোয়া। অনলি কলঙ্কিত! কিন্তু আপনি…””
“” আমি আজ সব রুলস ভেঙে দিয়েছি। রুলস না ভাঙলে কলঙ্কিত কিভাবে হবো? তোমার ছোয়া না পেয়ে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। সে কি মরিয়া গো পত্রী! মনে হয়,মৃত্যুদেশ থেকে মরতে মরতে ফিরে এলাম!””

পালক এসব কি বলছে! ও কি পাগল হয়ে গেলো??? কিন্তু এই পাগলামীটা আমাকে কেন মরিয়া বানিয়ে ফেলছে?? আমার ও কেন ইচ্ছে হচ্ছে ওর সাথে মিলেমিশে কলঙ্কিত হতে???

“” আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারেননা। একজন উত্তম পুরুষ হয়ে কিভাবে একটা মেয়ের উপর অত্যাচার চালাতে পারেন??””

পালক অন্ত্রীশার ঠোটে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,,

“” অবশ্যই পারি। তুমি আমার বউ অন্য কোনো মেয়ে নও। আমরা কাগজে কলমে বিয়ে করেছি,চিঠিতে চিঠিতে বিয়ে করেছি,অপেক্ষায় অপেক্ষায় বিয়ে করেছি,অভিমানে অভিমানে বিয়ে করেছি,ধোয়ার চুমুতে চুমুতে বিয়ে করেছি,আর আজ ছোয়ায় ছোয়ায় বিয়ে করবো, নিশ্বাসে নিশ্বাসে বিয়ে করবো!

পালকের হাতের ছোয়া পড়তেই অন্ত্রীশা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। গলার স্বর মিলিয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতরে ধুকপুক ধুকপুক করছে। অজানা শিহরনে কেঁপে উঠছে তার শরীরের প্রতিটি পশম!

অন্ত্রীশা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,,,

“” ধোয়ার গন্ধে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শুদ্ধ পুরুষ। আমার যে একটু শুদ্ধ নিশ্বাসের প্রয়োজন!””

পালক আর কথা না বাড়িয়ে অন্ত্রীশার ঠোটে নিজের ঠোট মিলিয়ে নিয়েছে। পৃথিবীতে বউয়ের জন্য তার স্বামীর নিশ্বাসের চেয়ে আর কোন নিশ্বাসটা শুদ্ধ হতে পারে???

আতিশ সেই ভোরবেলাই পাপড়িদের বাসায় হাজির। সারারাত ছটফট করতে করতে কাটিয়েছে। একরাতেই চোখের নিচে ফুলে উঠেছে, ফযরের আযান কানে আসতেই বিছানা ছেড়ে পাপড়িদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিলো। সে যতই চাইছে পাপড়ির কথা ভাববেনা,ততই ভেতরের সবকিছু দুমড়েমুচরে তাকে শেষ করে দিচ্ছে। বারবার শুধু একটা জিনিস ভেবেই দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে পাপড়ি অন্য কারো বউ হবে। তাহলে তার বউ কে হবে?? তার ও তো বউ হিসেবে পাপড়িকেই চাই। কখনো মুখ ফুটে বলেনি বলে পাপড়িও বুঝার চেষ্টা করবেনা??? উফ! এই বাসাটাই আসলেই আমার সব অনুভূতিগুলো একসাথে আমার উপর ঝেকে বসে। আজ বুঝতে পারছি পালকের পাগলামীগুলো কতটা ভয়াবহ ছিলো!

একটু পরেই বর চলে আসবে অথচ পাপড়ির এখনো সাজগোজ শেষ হয়নি। ও কি আজকে সারাজীবনের সাজ একবারেই সেজে ফেলবে?? পালক পাপড়ির রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে করতে নিজের চুল টেনে ছিড়ে ফেলার উপক্রম। আর কত ধৈর্য্য ধরে সে বাইরে অপেক্ষা করবে?? তার যে পাপড়ির সাথে অনেক কথা আছে,যে কথাগুলো আজকে না বলতে পারলে হয়তো আর কোনোদিন বলতে পারবেনা। না বলা কথাগুলো তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিবে। আতিশ আর অপেক্ষা করতে পারছেনা। হুট করেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে!

পাপড়ি লাল কালারের বেনারশী পড়ে আছে,পুরো শরীরভর্তি সোনার গয়না। চোখে মুখে ভারী মেকাপ। এতো ভারী সাজে সে কখনো পাপড়িকে দেখেনি। পাপড়ি যে সাজেনি তা নয়,কিন্তু ইচ্ছে করেই তার দেখা হয়নি,যদি নিজেকে সামলাতে না পারতো সে ভয়ে।

পালকের হুট করে উপস্থিতে সকলে চমকে গেলেও পাপড়ি চমকায়নি। নিচুস্বরে সবাইকে চলে যেতে বলে ও হাতে চুড়ি পড়া শুরু করেছে। হাতে কতগুলো চুড়ি নিয়েই আতিশের কাছে এগিয়ে এসে দাড়িয়েছে। পুরো মনোযোগ তার চুড়ি পড়ায়। চুড়ির দিকে তাকিয়েই বললো,,,

“” কিছু বলবেন? আর এখন থেকে আর কখনো এরকম হুট করে আমার রুমে ঢুকে পড়বেননা। এখন তো আমি শুধু আপনার বন্ধুর বোন নই,আরেকজনের বউ হতে যাচ্ছি। একটু পরেই অন্যকারো দখলিনী হয়ে যাবো।””

শেষ চুড়িটা পড়া শেষ করে আতিশের দিকে তাকিয়েছে পাপড়ি। তার চোখের চাহনিটা কঠিন হয়ে এসেছে। এতোটাই কঠিন যে এখন চাইলে সে পাপড়িকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে পারবে।

পাপড়ি আতিশের চাহনিকে অগ্রাহ্য করেই বললো,,,

“” বউ সাজে আমাকে কেমন লাগছে? উনার পছন্দ হবে তো?? উনার বুকে আমার মাথাটা চেপে ধরবে তো? উনার হাতদুটো আমার শরীরের সবটা জায়গায় বিচর…..””

পাপড়ি কথা শেষ করার আগেই ওর গালে কষে একটা চড় মেরে বসেছে আতিশ। আতিশ হুট করে এমন চড় মেরে বসবে ভাবতে পারেনি পাপড়ি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি বেড়িয়ে পড়েছে সাথে সাথে।

আতিশ পাপড়ির দুই চিবুক নিজের দুহাতে চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। নিজের চোখের সাদা অংশটা লালরং ধারন করে ফেলেছে অনেক আগেই। কিন্তু সেই লাল রঙে এবার নোনাপানিও মিশে গিয়েছে। পাপড়ির চোখে চোখ রেখে বললো,,,

“” তুই,তুই শুধু…””

পাপড়ি ব্যথাতুর কন্ঠেই ক্ষীনস্বরে বললো,,

“” আমি কি?””

আতিশ তার পুরো কথাটা শেষ না করেই পাপড়িকে ঠেলে বিছানায় ফেলে দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে। পাপড়ির রুম থেকে বেড়িয়েই নিজের শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে। চোখের পানিগুলোকে সে আর চোখের কোনে বন্দী করে রাখতে পারছেনা। সবগুলো অবাধ্য হয়ে গেছে। আজ শুধু পাপড়ি না সবাই তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এতো কষ্টগুলো আমি কোথায় রাখবো পাপড়ি? আমার জন্যে কি আরেকটু অপেক্ষা করতে পারলেনা? আর একটু অপেক্ষা করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো?? এতোগুলো বছর তোমাকে চোখে চোখে রেখেছি,আর আজ দুইদিন চোখের আড়াল হতে না হতেই আমাকে ভুলে গেলে? আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা সব শেষ হয়ে গেলো? কি করে পারলে আমার সামনে অন্য পুরুষের স্পর্শ নেওয়ার কথা বলতে? অন্য পুরুষের বুকে নিজের মাথা রাখার কথা বলতে? এটা আমাকে কতটা যন্ত্রণা দিয়েছে তোমাকে আমি কোনোদিনও বুঝাতে পারবোনা,কোনোদিনও না।

আতিশ সব ভিড় ঠেলে পাপড়িদের বাসার গেটে আসতেই পেছন থেকে নিজের শার্টে টান অনুভব করে। পেছনে ঘুরতেই পাপড়িকে দেখে বুকটা ছ্যাত করে উঠেছে। একটু আগেও যে মেয়েকে কোনো রাজকুমারীর চেয়ে কম সুন্দর লাগেনি সেই মেয়েটার চেহারা একি অবস্থা? চোখের কাজল ল্যাপ্টে চারপাশটা মেখে আছে,এতো ভারী মেকাপেও আতিশের হাতের আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। থাপ্পড়টা কি খুব বেশি জোরে দিয়ে ফেলেছি? রাগের বশে এতোটুকু মেয়েকে এতো বড় থাপ্পড়টা আমি কিভাবে দিলাম??

আতিশের ভাবনার ঘোর কাটলো পাপড়ির পরপর দুটো থাপ্পড় খেয়ে। আতিশের কলার চেপে ধরে বললো,,

“” পালিয়ে যাচ্ছেন? বিয়ে না করেই পালানো হচ্ছে??””

আতিশ বিস্ময় নিয়ে পাপড়ির দিকে তাকিয়ে আছে,আমি কি অতি মনোঃকষ্টে কোনো ভ্রমে চলে এসেছি? আমার চেনা পাপড়িতো এমন হতে পারেনা। এই যে চোখটা এতো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, এটা কখনোই পাপড়ির হতে পারেনা,আর রাগ? ওর তো রাগ থাকতেই পারেনা। ও তো ফুপিয়ে কাঁদতে পারে,ছেচ্কান্দুনি! আর থাপ্পড়??

আতিশকে আরো অবাক করতেই পাপড়ি ওর কলার টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। পুরোবাড়ি ভর্তি মানুষ ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে,কেউ কেউ মুখ টিপে হাসছে তো,কেউ কেউ নানা মস্করাই মেতে উঠেছে। কাজীর সামনে গিয়ে আতিশকে ধাক্কা দিয়ে সোফাতে ফেলে দিয়েছে,,,

“” ভাইয়া কাজীকে বল এখনি বিয়ে পড়াতে!””

কাজীর পাশে পালককে দেখে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছে আতিশ। নিজেকে সামলিয়ে পালককে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অন্ত্রীশা পেছন থেকে হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো,,,

“” এমন সাজেই বিয়ে করবে আতিশ ভাইয়া? শেরওয়ানিটা পড়তে দিবেনা? তুমি বসো আমি নাহয় উনাকে রেডি করে আনি!””
“” কিছু পড়তে হবেনা উনাকে। উনি এমন সাজেই বিয়ে করবেন!””

আতিশ ভয়ে ভয়ে পাপড়ির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পালক আতিশকে উদ্দশ্য করে বললো,,

“” দিলিতো আমার নরম বোনটাকে রাগিয়ে? তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। নিশ্চয় তুই এখনো ভালোবাসি বলিস নি তাইনা??””

আতিশ পালকের কথায় তরতর করে ঘেমে যাচ্ছে। তাহলে কি পালকও সব জেনে গিয়েছে??

পালক আতিশের পাশে এসে ওর হাতটা ধরে বসলো।

“” তুই জানিসনা,এই পৃথিবীতে সব থেকে বিশ্বস্ত যদি কেউ থাকে সেটা তুই? আর এমন বিশ্বস্ত মানুষটার কাছে আমার বোনকে বিয়ে দিতে চাইবোনা কেন?? ভালবাসি তোকে আমি,আর যাকে আমি ভালোবাসি তাকে আমার বোন তো ভালোবাসবেই!””
“” তারমানে তুই সব…””

পালক আতিশের হাতটা ছেড়ে একটু ব্রু উচু করে বললো,,

“” তোর কি মনে হয়,তোর ব্যাপারে আমি কিছু জানিনা? তুই মনে মনে প্রেম করবি আর আমি জানবোনা? তাছাড়া তোর দিক নাহয় বাদই দিলাম বোনটাও তো আমার,আর ও কোন পুরুষের পাত্রে নিজের প্রেম নিবেদন করছে সেটার আমি খোজ রাখবোনা?? শুধু বন্ধর অধিকারেই তোকে আমার বোনের বেডরুমে ঢুকার পারমিশন দিবো???””

এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আতিশের রুমে পায়ের ছোয়া ফেলেছে পাপড়ি। তবে এইবার আগের বারের মতো বউ হওয়ার আকুলতায় নয় সত্যি সত্যি বউ হয়েই এসেছে। আতিশের বিছানার ঠিক মাঝখানটাই ঘোমটা টেনে বসে আছে। আগেরবারের মতো এবারও সে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে। ঘেমে নিজেকে নায়িয়ে ফেলেছে। ইশ! আমার তো সব সাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে উনি কখন আসবেন? আজও কি উনি আমার সাজটাকে ভালো করে দেখবেননা??

পাপড়ি ঘোমটার আড়ালেই খুব বিরক্ত নিয়ে বারবার ঘাম মুচছে। উফ! আজকেই আমাকে এতো ঘামতে হচ্ছে???

আতিশ রুমের ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে বললো,,

“” তুই কার সাথে বকবক করছিস?””

আতিশের কন্ঠ পেয়েই পাপড়ি বরফের মতো জমে যাচ্ছে। হাতদুটো শক্ত করে মুঠো করে নিশ্বাস আটকে রেখেছে। কন্ঠটা কেমন কেমন জানি লাগছে! আল্লাহ! আমি এই মানুষটাকেই থাপ্পড় মেরেছিলাম? আজকে আমার যে কি হবে আল্লাহই জানে! পাপড়ি মনে মনে সুরা পড়তে শুরু দিয়েছে!

আতিশ বেশ কিছু ক্ষন দাড়িয়ে থেকে পাপড়ি কি করছে বুঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ করেই গলার স্বরটা কঠিন করে বললো,,,

“” এভাবে বারোহাতি ঘোমটা দিয়ে বসে আছিস কেন? বাসর করবি বলে? তোর মতো বাচ্চার মেয়ের সাথে আমি বাসর করবো? পড়ে দেখা যাবে বাসরের দোহাই দিয়ে বিছানায় পড়ে আছিস!””

এবার একটু ধমকের সুরেই বললো,,

“” পড়া নাই? আর চারদিন পড় তোর পরীক্ষা,তাও ইংলিশ,তুই কি লাড্ডু কয়টা খাবি তা ভাবছিস? যা এইসব রঙঢঙ ফেলে পড়তে বোস!””

আতিশের কথায় পাপড়ি সাথে সাথে ঘোমটা খুলে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো।

“” তোকে হা করে তাকিয়ে থাকতে বলিনি। তোর কি মনে হয় জোর করে বিয়ে করেছিস বলেই বিয়ে হয়ে গেলো? তুই আমার বউ হয়ে গেলি? আগে পরীক্ষায় পাশ হয়ে দেখা পড়ে ভাবা যাবে তোকে বউ বানাবো কি না!””

পাপড়ির সব ভয় কেটে গিয়ে রাগে ক্ষেপে যাচ্ছে। কিন্তু রাগের জায়গায় একরাশ অভিমানি সুরে বললো,,

“” আমি আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছি?””

আতিশ বিছানায় বসতে বসতে বললো,,

“” হুম!””
“” আপনি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেননি?””
“” আমি কি তোকে কখনো বলেছি আমি তোকে ভালোবাসি?””

পাপড়ি ভারী শাড়ী গুটিয়ে নিয়ে আতিশের সামনে দাড়িয়ে বললো,,,

“” আমি এখানে আর এক মুহুর্তও থাকবোনা। আমাকে এখনি বাড়ি দিয়ে আসেন।””

আতিশ এবার বসা থেকে শুয়ে পড়েছে। পাপড়ির দিকে না তাকিয়েই বললো,,

“” তোকে কি আমি আসতে বলেছি যে আমি দিয়ে আসবো? তুই নিজের ইচ্ছায় এসেছিস,এখন ইচ্ছে হলে নিজেই চলে যেতে পারিস। বিরক্ত করিসনা তো আমার ঘুম পাচ্ছে!””
“” আমি বিরক্ত করছি আপনাকে?””
“” হুম!””

পাপড়ি এবার ফুপাতে ফুপাতে বললো,,

“” একাই যাবো আমি,থাকবোনা আপনার কাছে। আপনি আমাকে শুধু কষ্টই দিলেন। আমি এক্ষুনি চলে যাবো।””

আতিশ কাথার ভাজ খুলে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে বললো,,

“” ওকে,সাবধানে যাস। গুড নাইট!””

পাপড়ি তখনি রাগে ফুসতে ফুসতে হাটা ধরেছে। কিন্তু রুমের বাইরে পা ফেলার সাহস পাচ্ছেনা। এতো কষ্ট করে মানুষটার কাছে এলাম এভাবে চলে যাবো?? এমন কেন উনি? একটু ভালোবাসলে কি হয়? আমি কি এতোটাই অবহেলার যোগ্য??

বেশ কিছুক্ষন ভাবনায় ডুব দিয়েই চোখের পানি মুছতে মুছতে আবার ফিরে এসেছে আতিশের বিছানার কাছে। আতিশ কাথা গায়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে,উনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? কোথায় শুবো আমি??

পাপড়ি চুপচাপ আতিশের অপরপাশে গিয়ে আলতোভাবে বিছানায় শুয়েছে। বিছানার একদম ধারটাতে। যে মানুষটা তাকে ভালোইবাসেনা তার কাছাকাছি সে শুবেনা!

পাপড়ি আবার ফুপিয়ে উঠতেই আতিশ নিজের কাথাসহ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিয়েছে। পেটে চাপ প্রয়োগে নিজের কাছে টেনে নিয়ে ওর কানে ফিসফিস করে বললো,,

“” তোমার এই ফুপানিটাকে বড্ড ভালোবাসি,বউ!””

পালক অন্ত্রীশার ঠোটে ঠোট ডুবিয়ে দিতেই অন্ত্রীশা সাথে সাথে ওকে ছাড়িয়ে নেয়। পালক অবাক হয়ে অন্ত্রীশার দিকে তাকাতেই ও বলে উঠলো,,

“” আমার ভেতর কোনো অনুভূতি কাজ করছেনা!””
“” মানে?””
“” কেমনজানি নিরামিষ চুমু মনে হচ্ছে!””
“” চুমুতেও নিরামিষ?””
“” হুম,আমার মনে হয় নেশা হয়ে গেছে!””
“” কিসের?””
“” ধোয়ার নেশা। আপনার ধোয়ামাখানো চুমুর নেশা। যানতো সিগারেট খেয়ে আসুন!””

অন্ত্রীয়ার কথায় পালক হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে!

অনিকশার ঘুমেরঘোরেই মনে হচ্ছে কেউ তার দিকে খুব গভীরভাবে চেয়ে আছে। কোনো ভুতটুত নয়তো? অনিকশা টিপটিপ করে চোখ মেলতেই অরিদ ওর কপালে চুমু খেয়ে বললো,,

“”টিকেট কাটা শেষ অনি,আমরা কালই হানিমুনে যাচ্ছি!””

অনি বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” এই নিয়ে উনিশবার বলেছো! তুমি ঘুমোওনি কেন অরিদ?””
“” আমার হানিমুনের উত্তেজনায় ঘুম আসছেনা,অনি!”‘

#সমাপ্তি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে