দ্বিতীয় ফাগুন পর্ব-৪+৫

0
523

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্ব_সংখ্যা_৪
#লেখিকা_Esrat_Ety

“আমি রোদেলা। রোদেলা আমিন। বাবার নাম রুহুল আমিন, মায়ের নাম………..যাই হোক বাদ দিন। আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে আমি যখন দশ বছর বয়সী তখন। তারা এখন দুজনেই আলাদা আলাদা সংসার পেতে সুখী জীবন যাপন করছে। আমার বয়স সাতাশ বছর কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেটে‌ ছাব্বিশ। আমার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা,কখনো কখনো ফরসা,আবার কখনো কালো। কোনো নির্দিষ্ট রং নেই। আমার অনেক গুলো বাবা মায়ের মতো আমার গাঁয়ের রঙও অনেক গুলো। আমি একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে একাউন্টস ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র একাউন্টস অফিসার পদে সার্ভিস দিচ্ছি। স্যালারি যা পাই তাতে আমাদের মধ্যবিত্ত সংসার বেশ ভালো ভাবে চলে যাচ্ছে।‌ আমি একজন অবিবাহিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওম্যান। একটা তিন বছরের রিলেশন ছিলো, কিছুদিন হয় সেটা শেষ হয়ে গিয়েছে। তার কারন……….যাই হোক এটাও বাদ দিন। আমি এখন নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছি। তার কারন বাড়িতে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে আমার ডলি খালা। আমার মায়ের একমাত্র বোন। পেশায় তিনি একজন “পাশের বাসার আন্টি”। অবশ্য আমার নানাবাড়ির দিকের সব লোকজনই এরকম, শুধুমাত্র আমার নানাভাই বাদে। ডলি খালার মুখোমুখি আমি হতে চাই না এজন্যই আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছি।”

এই পর্যন্ত লিখে রোদেলা লেখাটা কলম দিয়ে কাটতে থাকে। কাগজটাকে দলা পাকিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে মারে। তার ভীষণ মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। দরজা বন্ধ করার পরেও বসার ঘর থেকে ওই মহিলার গলা শোনা যাচ্ছে। এই মহিলার গলা নয় যেন আস্ত একটা মাইক। রোদেলা অপেক্ষা করতে থাকে কখন এই মহিলা ঘর থেকে বের হবে,এই মহিলা বের হয়ে গেলে সে একটু ছাদে যাবে। অনেকদিন হয় বিকেলে ছাদে গিয়ে হাওয়া খায়না সে।

বসার ঘরে দুইসিটের একটি সোফা পুরোটাই দখল করে বসে শামসুন্নাহার ডলি। অত্যন্ত স্বাস্থবতী একজন মহিলা। শরীরে বিশ্রী ভাবে মেদ জমে তাকে মোটামুটি বড় সাইজের একটা পেঙ্গুইনের মতো লাগে দেখতে। তিনি আজ রোদেলাদের বাড়িতে রোদেলার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। পাত্র তার ননদের ছেলে। ছেলে ইতালি প্রবাসী,বিয়ে করে বৌ নিয়ে যাবে সাথে। তার মতে রোদেলার রাজ কপাল হবে যদি এইখানে রোদেলাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তার সামনে বসে থাকা তার ছোটো বোনের প্রাক্তন স্বামী রুহুল আমিনের দিকে তাকিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে বলে,”তুমি আর তোমার মেয়েরা আমাদের আপন নাই ভাবতে পারো কিন্তু ওরা তো চাইলেও অস্বীকার করতে পারবে না যে আমরা ওদের আপনজন।”

ডলির কথায় রুহুল আমিন শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে,”দেখেন আপা। আমি কখনোই আমার মেয়েদের ওপর আমার কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিইনি। এই দেখেন মেঘলা যাকে পছন্দ করেছে তার কাছে বিয়ে দিয়েছি। রোদেলার বেলাতেও তাই, ওর পছন্দ অনুযায়ীই হবে সব। আপনি ওর সাথে কথা বলেন আগে।”

_কথা কিভাবে বলবো? আমাকে দেখলেই তোমার মেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে তা কি আমি জানি না? সে কি ভাবছে! বয়স তো কম হলো না। এরকম করলে পরে ভালো পাত্র জুটবে? আমার ভাসুর ঝি ছিলো এরকম। সময় মতো বিয়ে করেনি,বয়স যেই তিরিশের কোঠায় পৌঁছেছে , মুখের চামড়া কুঁচকে যেতে শুরু করেছে অমনি তাদের টনক নড়েছে, কিন্তু তখন আর লাভ কি হলো, মন মতো কোনো পাত্র পেলামই না, প্রস্তাব যা আসতো তা সব ডিভোর্সী নয়তো এক বাচ্চার বাপ। কিছু মনে করো না ভাই রুহুল, রোদেলার সাথে যদি সেরকম কিছু হয়? বাপ হয়ে দেখতে পারবে সেটা?

রুহুল আমিন চুপ থাকে। ডলি বলতে থাকে,”মেঘলার তো একটা ব্যাবস্থা হলো,এখন রোদেলাকে বিয়ে দিয়ে দাও। বাকি থাকলো বৃষ্টি,ও তো আগুন সুন্দরী। তুড়ি মারলেই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার জুটে যাবে ওর জন্য। তোমার শরীরের যে অবস্থা,একবার তো স্ট্রোক করে ফেলেছো।”

রোদেলা নিজের ঘর থেকে সবটা শুনছে। রাগে তার গা কাঁপছে। নিশ্চয়ই নাজমুন্নাহার মলি নামের ভদ্রমহিলা ওনাকে পাঠিয়েছেন এসব করার জন্য। সে চোখ মুখ শক্ত করে বসে থাকে।

রান্নাঘর থেকে উঁকি মারে আয়েশা সিদ্দিকা। রোদেলা তাকে কড়া করে বলে দিয়েছে রোদেলার নানা বাড়ির কেউ আসলে যেনো সে সামনে না যায়। তাই সে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে।

“এই নে দেখ। আরে একবার তাকা তো।”

তাশরিফ কপাল কুঁচকে তার মায়ের দিকে তাকায়। তাশরিফের মা তাহমিনা রহমান একটা ছবি তাশরিফের দিকে বাড়িয়ে ধরে রেখেছে।

_আরে আমাকে দেখছিস কি। ছবি দেখ।

_মা আমাকে বিরক্ত করবে না এখন যাও। পরে দেখবো। দেখছো না কাজ করছি।

তাহমিনা মুখ ভার করে তাশরিফের পাশে বসে পরে। তাশরিফ বাধ্য ছেলের মতো বলে,”ঠিকাছে দাও। দেখে দিচ্ছি।”
তাহমিনা খুশি খুশি ছেলের দিকে ছবিটা বাড়িয়ে দেয়। তাশরিফ ছবিটা দেখে। খুবই কম বয়সী একটি মেয়ে। স্কুল ড্রেস পরে আছে। চেহারা থেকে বাচ্চা ভাবটাই এখনো যায়নি। মা বেছে বেছে আবারো একটা নাবালিকা ঠিক করেছে তার জন্য। পাশ থেকে তাহমিনা আহ্লাদী গলায় বলে,”মেয়ে এই বছর এইচ.এস.সি পরিক্ষা দিয়েছে। বাবার সিমেন্টের ব্যবসা। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। সব চেয়ে ভালো দিক কি জানিস,মেয়ের দেশের বাড়িও বরিশাল।”

তাশরিফ অবাক হয়ে বলে,”বরিশাল হলে লাভ?”
তাহমিনা নাক মুখ কুঁচকে বলে,”বরিশাইলারা ছাড়া বরিশাইলাদের মর্ম কেউ বুঝতে পারবে না বুঝলি। এতো বছর ঢাকায় থাকি। সবই তো দেখছি। বরিশালের মেয়েরা বর পাগল হয় বেশি। অন্য কোনো বিভাগের মেয়েকে নিয়ে আমি অন্তত সংসার করতে পারবো না!”

_তুমি যেমন অন্য বিভাগের মেয়ে দেখে নাক সিটকাচ্ছো মা,তেমনি অন্য বিভাগের মেয়ের মায়েরাও আমাকে দেখে নাক সিঁটকায় গিয়ে দেখো, সবাই তো জানে বরিশাইলা মানে বাটপার,চালবাজ।
হো হো করে হাসতে থাকে তাশরিফ কথাটি বলে।
তাহমিনা বিরক্ত হয়ে বলে,”নাক সিঁটকাবো কেনো,আমি বলতে চাচ্ছি তারা তো রুটি পিঠা, নারিকেলের ঝোলই চিনবে না তোকে বানিয়ে কিভাবে খাওয়াবে? তুই রুটি পিঠা আর নারিকেলের ঝোল কত পছন্দ করিস।”
তাশরিফ মায়ের কথায় উচ্চস্বরে হেসে ফেলে।
তাহমিনা অবাক হয়ে বলে হাসছিস কেনো?
তাশরিফ হাসতে হাসতেই জবাব দেয়,”মা বিয়ে কি মানুষ রুটি পিঠা আর নারিকেলের ঝোল খাওয়ার জন্য করে?”

_তোর বাপ তো তাই করেছিলো। আমি ভালো রান্না বান্না জানি,তাই দেখেই তো করেছিলো।

_মা,বাবার পছন্দ আর আমার পছন্দ আলাদা। আমি তো রান্না করার বাবুর্চি খুজছি না।
_তাহলে কি খুজছিস তুই? শহুরে মডার্ন কোনো মেয়ে? গাঁয়ে ওড়না থাকে না, চাকরি করবে। কথায় কথায় টাকার গরম দেখাবে। এমন মেয়ে?

তাশরিফ হাসে,”আমি এমন কাউকেই খুঁজছি না মা। আমি খুঁজছি অতি সাধারণ একটা বুঝদার মেয়ে, বেশি রুপবতী হবার দরকার নেই তবে মনটা খুবই ভালো হতে হবে। তুমি বেছে বেছে এসব বাচ্চা মেয়ে গুলোকে ধরে এনো নাতো,আমার আনইজি লাগে মা। কত ছোটো একটা মেয়ে। এর তো বোধহয় ভোটার আইডি কার্ডও হয়নি। তুমি ছবিটার দিকে ভালো করে দেখো,আমার মনে হচ্ছে নিজের সর্দিই মুছতে পারে না এই মেয়েটা।
তাহমিনা বলে,”মেয়েরা নিজের সর্দি না মুছতে জানলেও বিয়ে হতে না হতে বাচ্চার সর্দি কিভাবে মুছতে হয় তা শিখে ফেলে । এই মেয়েও পারবে।
তাশরিফ মায়ের কথায় বিরক্ত হয়ে চোখ মুখ কুঁচকে তার দিকে তাকায়।

_ঠিকাছে। তুই খুজে বের কর তোর পছন্দ মতো মেয়ে।
তাহমিনা গটগট করতে করতে চলে যায়। তাশরিফ হাসতে থাকে মনে মনে, সে যেমন মেয়ে চায় আজকাল এমন মেয়ের পৃথিবীতে অস্তিত্ব তো রয়েছে, তবে খুব কম। খুজে পাওয়া মুশকিল। সে কিভাবে খুজে বের করবে!

ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। এমনিতেই মেজাজ টা প্রচুর গরম হয়ে আছে,এখন এই ফোনটা রিসিভ করে মেজাজের রফা-দফা করতে চায়না সে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে অবশেষে ফোনটা রিসিভ করে রোদেলা। ওপাশ থেকে তার দুলাভাই মাইনুল ইসলামের কন্ঠ,”হ্যা হালো।”
রোদেলা গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলে,”জ্বী বলুন দুলাভাই। সব ভালো?”
_আরে রাখো তো সব ভালো। আগে বলো তোমার আপার ফোন বন্ধ কেনো?
মাইনুলের কন্ঠে ধমকের সুর।
_আপুর ফোন আমি বন্ধ করে আলমারিতে তালা দিয়ে রেখেছি। ফোনটার একটু রেস্ট দরকার।
_মানে? কি সব বলছো তুমি। তোমরা কি আমার সাথে ফাজলামি করছো রোদেলা?
_জ্বী আপনার সাথে তো আমার ফাজলামিরই সম্পর্ক দুলাভাই।
_শোনো রোদেলা, তোমার আপুকে বলবে কালকের মধ্যে যদি বাড়িতে গিয়ে আমার মায়ের কাছে ক্ষমা না চায় তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।
_কি খারাপ হবে শুনি একটু।
রোদেলার পাল্টা প্রশ্নে মাইনুলের মেজাজ বিগড়ে যায়।
_তোমাদের সব বোনদের তেজ টা একটু বেশি রোদেলা।
_জ্বী। তা তো একটু বেশি। এখন বলুন খারাপ কি করবেন? আপুকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন? শুনুন দুলাভাই বাচ্চাটা একবার পৃথিবীতে আসুক। তারপর আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আপনার আর আপুর ডিভোর্স করিয়ে দেবো।

_এই মেয়ে ! বেয়াদবের মতো কথা কেনো বলছো।

_কারন আমি বেয়াদব। শুনুন, বাচ্চাটাকে জন্মাতে দিন। আপনাদের বাড়ীর বংশধর আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে আমি আপুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। এমনিতেও ওই বাচ্চা আপনার আর আপার ভালোবাসায় জন্ম নিচ্ছে না। ও হচ্ছে আপনার মতো একটা ইতরের কামনা আর আপুর মতো নির্বোধ মেয়ের বোকামির ফসল।

কথাটি বলেই রোদেলা ফোন কেটে দেয়। ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মৃদু বাতাসে রোদেলার কপালের কাছে চুলগুলো উড়ছে। সেগুলো আঙ্গুল দিয়ে কানের পাশে সরিয়ে রেলিং-এ হাত রাখে। বিষন্ন দুটি চোখের দৃষ্টি শূন্যে রেখে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর নিচের দিকে তাকায়। আচ্ছা সে যদি এখান থেকে,এই ছয়তলার উপর এখন হঠাৎ করে নিচে পরে যায় তাহলে কি হবে?

কথাটা মনে আসতেই রোদেলা রেলিং টাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। তারপর আবারো নিচে তাকায়। নিচের দিকে তাকাতেই রোদেলার চোখে পরে সেদিনের সেই ছেলেটি। এই ছেলে এখানে কি করছে ! হাত নাড়িয়ে কাকে ডাকছে! কি সাংঘাতিক ছেলে। রোদেলা দুমিনিট ছেলেটাকে দেখে সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যায়। এই ছেলেকে আজ উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে সে !

এখন তার হাতে দুটো অপশন। এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া নয়তো এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আসামীর মতো পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ সহ্য করা। প্রথমটা করা যেতে পারে, কিন্তু এতে সে ভবিষ্যতে কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হবে। তাই পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে বীরপুরুষের মতো টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখানে কেনো এসেছে এই প্রশ্নের কিছু ভুলভাল উত্তর দিয়েই সটকে পড়বে এখান থেকে।
রোদেলা দ্রুতপায়ে আদিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। রোদেলার বাজপাখির ন্যায় আগমন আদিলকে কিছুটা ভীত করে। বন্ধু বান্ধবের কাছে থেকে যা শুনেছে বৃষ্টির এই বোনটা খুবই সাংঘাতিক। এখন যদি দু একটা থাপ্পর মেরে দেয়?
রোদেলা আদিলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে নেয়। ফর্সা মুখ, সুন্দর চোখ, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, উচ্চতায় বেশ লম্বা। সেদিন রাতে ভালো করে দেখেনি সে ছেলেটাকে, চেহারা মোটেও চাপা ভাঙ্গা নয়। হঠাৎ তার মনে হলো চেহারাটা কেমন চেনা চেনা লাগছে। কার সাথে যেন মিলছে খুব চেহারাটা। কয়েক মুহূর্ত পরে ধমকে ওঠে,”এই ছেলে! তোমার নাম কি?”
আদিল একবার ঢোক গিলে নেয়। এই মহিলার গলার স্বরও এই মহিলার আচরণের মতো ভয়ংকর। অথচ বৃষ্টি কি মিষ্টি একটা মেয়ে। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে ভদ্রভাবে বলে সে,”আমার নাম আদিল হাসান আপু।”
_কিসে পড়ো তুমি?
_আমি একজন এডমিশন ক্যান্ডিডেট আপু।
_এডমিশন ক্যান্ডিডেট পড়ার টেবিলে থাকবে। মহিলা মাদ্রাসার নিচে কি করছো? জানো এই বিল্ডিং-এর চার তলায় মহিলা মাদ্রাসা আছে?

আদিল মাথা ঝাঁকিয়ে বলে ,”না আপু জানতাম না। আমি আসলে এখানে বন্ধুদের সাথে এসেছি।”

_বন্ধুদের সাথে এসেছো, তোমার বন্ধুরা কই? আর তোমরা এই চাপা গলির ভেতর কি করছো? এটাতো বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়ার মতো জায়গা না। পাশেই একটা বড় মাঠ আছে। ওখানে যাও।

_জ্বি আপু। এক্ষুনি যাচ্ছি।
বলেই আদিল মাথা ঘুরিয়ে দুই পা ফেলে। পেছন থেকে রোদেলা ডেকে ওঠে,”শোনো।”
আদিল ঘুরে তাকায়।
_বৃষ্টিকে চেনো?
_কোন বৃষ্টি আপু? আমি কোনো বৃষ্টিকে চিনি না।

রোদেলার এক মূহুর্ত মনে হলো ধমকা ধমকি করে ছেলেটাকে শাসিয়ে দেবে পরক্ষনেই মনে হলো বখাটে টাইপের ছেলে,যদি আক্রোশ টা বৃষ্টির উপর গিয়ে পরে। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”কিছু না তুমি যাও,আর যেনো এই রোডে না দেখি।”
রোদেলার মুখ থেকে কথাটা বের হতে যেটুকু দেড়ি হলো,আদিলের ওই স্থান থেকে গায়েব হয়ে যেতে সেটুকু দেড়ি হলো না।

ছয়তলা থেকে বৃষ্টির রুমের বেলকোনী দিয়ে সবটা দেখছিলো বৃষ্টি। সে আতংকে জমে গিয়েছে। এই মেজো আপু থাকতে এ জীবনে বোধ হয় তাদের প্রেম সফল হবে না। আপাতত এই কথাটাই মাথায় আসছে তার।

“এই,এই রোদেলা।”
মাথা ঘুরিয়ে মেহরিনের দিকে চায় সে।
“কি মেহরিন আপা? কিছু বলবেন?”
মেহরিন চেয়ার টেনে বসে। রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি ব্যাপার বলো তো। আজকাল অফিসে সারাক্ষণ কাজ নিয়েই ডুবে থাকছো। প্রমোশন তো নাচতে নাচতে এলো বলে।”
রোদেলা হেসে ফেলে,”কি যে বলেন আপা।”

_তুমি অবশ্য প্রমোশন ডিজার্ভ করো। এই অফিসে,আমার দেখা দ্বিতীয় পরিশ্রমী এম্প্লয়ি হচ্ছো তুমি।

_প্রথম জন কে?
কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোদেলা মেহরিনের দিকে।

_আরে কে আবার। তাশরিফ হাসান। যেমনি পরিশ্রমী,তেমনি একজন ভদ্রলোক।
তাশরিফের নাম শুনতেই রোদেলা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। মেহরিন উৎফুল্লের সাথে বলতে থাকে,”আচ্ছা তাশরিফ হাসানকে তোমার কেমন লাগে রোদেলা?”
মেহরিনের কথায় রোদেলা চমকে উঠে বলে,”আমার কেমন লাগে মানে?”
_কেমন লাগে মানে কেমন লাগে? ছেলেটা সুন্দর না বলো ! আমার তো বেশ লাগে।

রোদেলা এক পলক তাশরিফের দিকে চায়। একমনে ডেক্সটপে কি যেনো করছে সে।
_হু তথাকথিত সুন্দর। তবে পারসোনালি আমার ভাল্লাগে না।
রোদেলা জবাব দেয়।
মেহরিন অবাক হয়ে বলে,”কেনো? ভাল্লাগে না কেনো?”
_সুন্দর ছেলেদের দেখলে আমার রবীন্দ্রনাথের অপরাজিতা গল্পের অনুপমের কথা মনে পরে যায়। মাকাল ফল।
রোদেলা কথাটি বলে আরো একবার তাশরিফের দিকে চায়।
মেহরিন বলে,”ওমা। কি কথা বলো তুমি রোদেলা। তাশরিফ আর অনুপম কি এক হলো? তাশরিফ কতো ব্যক্তিত্ববান একজন পুরুষ। আমি তো ঠিক করেছি আমার ননদের জন্য ওর কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবো। ”
রোদেলা চোখ বড় বড় করে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“সত্যিই নাকি আপা?”
_হু।
_বেশ। তাহলে আমি আমার বক্তব্য ফিরিয়ে নিলাম। তাশরিফ হাসান কোনো মাকাল ফল নয়। তিন হচ্ছেন হাই-ভাইটামিনস সমৃদ্ধ একটি অতি সুস্বাদু ফল।
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,”যাই বলো। ওর মতো ছেলে হয় না। আমি তিন বছর ধরে দেখছি। হি ইজ আ ট্রু জেন্টেলম্যান।”

“রোদেলা আপনাকে জিএম স্যার ডাকছে।”
শিরিন আক্তারের কাছ থেকে আবারো সেই ভয়ংকর লাইনটি শুনতে পেলো রোদেলা। তার শমন এসে গিয়েছে। তাশরিফ নিজের ডেস্ক থেকে রোদেলার আতংকিত মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
রোদেলা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। আজ ভেবেছিলো একটু কাজের চাপ কম থাকবে,কিন্তু না। এই রাশেদুজ্জামান তার পেছনে হাত ধুয়ে নেমেছে।

বাইরে থেকে জিএম রাশেদুজ্জামানের রাশভারী পুরুষালি গলার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিনি রোদেলাকে কড়া গলায় কথা শুনিয়ে যাচ্ছে, ধমকাচ্ছে। কেবিনের বাইরে অনেকগুলো কৌতুহলী চোখ। তাদের মধ্যে কারো কারো চোখে রোদেলা নামের চুপচাপ মেয়েটির জন্য দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবে বেশিরভাগ লোকজনের চোখেই চাপা আনন্দ। কারন তারা রোদেলাকে হিংসা করে, রোদেলা নামের মেয়েটি তাদের কাছে কেবলই দেমাগী একটি মেয়ে, এর সাথে এমনটাই হওয়া উচিত।
তাশরিফ কিছুক্ষণ নিজের ডেস্কে থম মেরে বসে থাকে। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত সে ভাবতে থাকে। সে আজ চাইলে রোদেলা নামের খিটখিটে মেজাজের মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। এজন্য হয়তো তাকে কিছু কথা শুনতে হতে পারে। এখন তার কি করা উচিৎ? রোদেলাকে বাঁচাবে নাকি এখানে বসে বসে অন্যসবার মতো মজা দেখবে?

চলমান….

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্ব_সংখ্যা_৫
#লেখিকা_Esrat_Ety

“হ্যালো”
_এই তুই ফোন দিয়েছিস কেনো আমাকে? ফোন রাখ !

মাইনুলের ধমকে কেঁপে ওঠে মেঘলা। তার সমস্ত শরীর কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো আমার সাথে? ”
_কিভাবে কথা বলবো তোর সাথে? বেয়াদব কোথাকার। তুই আমাকে আর ফোন দিবি না।
_আমি করেছি টা কি একটু বলবে তো ! তোমরা সবাই কেনো আমার সাথে এমন করছো। মাইনুল আমি তোমার বাচ্চার মা হতে যাচ্ছি,একটুও মায়া কি হচ্ছে না আমার উপর তোমার?
_হ্যা সেজন্যই তো তোকে এখনো রেখেছি নয়তো কবে তিন তালাক দিয়ে তোকে….
_মাইনুল…. এসব কি বলছো তুমি?
কান্নায় ভেঙে পরে মেঘলা।
মাইনুল বলে,”কেনো তোর বোন ও তো বললো বাচ্চাটা বের হলে তোকে আমার থেকে ছাড়িয়ে নেবে। আর তুই এখনো আমার মায়ের কাছে ক্ষমা চাসনি কেনো? এত্তো তেজ কেনো তোদের? ভালো শিক্ষা তো তোদের নেই। অবশ্য তোদের তো দোষ নেই,দোষ তোদের বাপ-মায়ের!”
মাইনুলের কথার পিঠে কোনো কথা বলে না মেঘলা, অঝোর ধারায় তার চোখ দিয়ে যন্ত্রনা ঝরে পরছে। হঠাৎ করেই পেটের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হয় তার। পেটে হাত দিয়ে বসে থাকে সে। মাইনুল আরো কিছুক্ষণ মেঘলাকে কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দেয় । অশ্রুসিক্ত দুটি চোখ নিয়ে ঘরের এককোণে চুপ করে বসে থাকে মেঘলা।
আয়েশা সিদ্দিকা ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়। তার ইচ্ছা করছে মেয়েটির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু মেঘলা কখনোই সেই অধিকার তাকে দেয়নি। এই মেয়েটির জন্য তার আলাদা রকমের মায়া। প্রথম জীবনে,প্রথম স্বামীর সংসারে আয়েশা সিদ্দিকা ঠিক এভাবেই নিগৃহীত হতো। কোথাও যেনো তার সেই ফেলে আসা জীবনের সাথে সে মেঘলার বর্তমান জীবনের বেশ মিল খুঁজে পায়।

রাশেদুজ্জামান একবার তাশরিফের দিকে তাকাচ্ছে, একবার রোদেলাকে দেখছে। দুজনেই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর তাশরিফের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,”আপনি বলতে চাইছেন আপনি ইচ্ছা করে তাকে সাহায্য করেন নি? এর পেছনে কারন?”
_তেমন কিছুই না স্যার। একটু বিজি ছিলাম আমি, ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড গুলোর ভাউচার দেখছিলাম। উনি আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে সেটা আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিলো। নেক্সট টাইম থেকে এরকম হবে না। আই প্রমিস।

রোদেলা তাশরিফের দিকে তাকায়। মনে মনে সে বলতে থাকে,”আমাকে হেনস্থা করে এখন তার ভরপাই করতে এসেছে ! নাটকবাজ পুরুষ মানুষ।”

রাশেদুজ্জামান নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলে,”এটা কেমন কথা তাশরিফ হাসান। আপনি তো এতোটা আন প্রফেশনাল না। জুনিয়র কলিগদের শিখিয়ে পড়িয়ে না নিলে কোম্পানির কাজ এগোবে কি করে? ”
_সরি স্যার। আমাকে আমার ভুল শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ দিন
প্রমিজ করছি। নিজের বেস্ট দেবো।

রাশেদুজ্জামান একবার রোদেলাকে দেখে। তারপর বলে,”ঠিকাছে। কালকের মধ্যে কাজটা কম্প্লিট করে দিন দু’জনে মিলে। তারপর দেখছি।”

_ইয়েস স্যার!
বলেই তাশরিফ রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলা একপলক তার দিকে তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তাশরিফ মনে মনে হাসে,” মিস মেজাজি এখন কি না আপনার সাথে কাজ করতে হবে আমার ! কি আশ্চর্য ব্যাপার।”

কেবিন থেকে আগে তাশরিফ বের হয়। তার হাতে কিছু ফাইল। তার পেছনে গুটি গুটি পায়ে বের হয় রোদেলা। কেবিনের বাইরে যারা মজা দেখবে বলে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা ওদের আসতে দেখে দ্রুত নিজের ডেস্কে ফিরে যায়। রোদেলার ডেস্কের কাছে এসে দাড়িয়ে পরে তাশরিফ। তারপর মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দাঁড়ানো রোদেলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার ডেস্কে না বসে চলুন আমার ডেস্কে গিয়ে বসি। আমার ডেস্কটপে সুনামগঞ্জের পুরনো সব ডিটেইলস রয়েছে। সুবিধা হবে আমাদের।”
কথাটি বলে তাশরিফ নিজের ডেস্কে ফিরে যায়। রোদেলা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তাশরিফের পিছু পিছু তার ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তাশরিফ একটা চেয়ার টেনে দিয়ে রোদেলাকে বলে,”বসুন।”

“এই জিএম স্যারের সাথে আপনার শত্রুতা আছে নাকি কোনো? এই অফিসের সব কাজ আপনাকে দিয়ে করাতে চাইছে আজকাল।”

রোদেলা ফাইল থেকে মাথা তুলে তাশরিফের দিকে তাকায়। তাশরিফ আগে থেকেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলা মাথা নামিয়ে নেয়। নিচু স্বরে বলে,”আমি জানি না।”

তাশরিফ আর কোনো কথা বাড়ায় না। রোদেলাকে হিসাব গুলো ভালো করে বুঝিয়ে দিতে থাকে। রোদেলা মাথা নিচু করে শুনছে। তাশরিফ একপলক রোদেলার দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে যায় রোদেলার গালের একটা তিলে। কাঠিন্যে ভরা চেহারায় ওই গালের তিলটা যেন একটা সরলতার চিহ্ন‌। চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারো কথা বলতে থাকে সে। ডিটেইলস বোঝানো হয়ে গেলে তাশরিফ একটা ফাইল এগিয়ে দেয় রোদেলার দিকে,”এটা এখন দেখুন। আমি বাকি গুলো দেখছি। বিকেলের মধ্যেই হয়ে যাবে আশা করি।”

রোদেলা ফাইলটা দেখতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে তাশরিফ বলে ওঠে,”একটা কথা বলবো?”
_বলুন।
_আপনি সবসময় এরকম মেজাজ নিয়েই থাকেন? মানে সবসময়ই?

রোদেলা ফাইল থেকে মাথা উঠিয়ে তাকায়। তাশরিফ বলতে থাকে,”রাগী মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধ হয়ে যায় জানেন তো ? নিয়মিত একটু হাসবেন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কিংবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। কারো সামনে হাসতে অসুবিধা হলে একা একা বাথরুমে ঢুকে একবার হেসে নিবেন। তবুও হাসবেন।”

কলিং বেল টেপার দুমিনিট পরে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ হয়। রোদেলা মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,”সে যেনো না আসে,সে যেনো না আসে আল্লাহ। আমি তাকে দেখতে চাই না।”

কিন্তু রোদেলার প্রত্যাশা পূরণ হয়না। দরজা খুলে দেয় স্বয়ং নাজমুন্নেছা মলি। রোদেলা চমকে উঠে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার ইচ্ছা করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে।
মলি রোদেলার দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”ভেতরে এসো রোদেলা। বৃষ্টি খাচ্ছে। ওর দেড়ি হবে।”
রোদেলা কোনো কথা বলে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
মলি বলে,” ঠিকাছে, আসতে হবে না। বাগানে চেয়ার পাতা আছে। ওখানে গিয়ে বসে থাকো। বৃষ্টির খাওয়া হলে ওকে পাঠিয়ে দেবো আমি।”
রোদেলা দ্রুত পায়ে বাগানের দিকে যায়। মলি তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো হঠাৎ ভিজে ওঠে। কত ছোটো মেয়েটা কত বড় হয়ে গিয়েছে। কি সুন্দর করে শাড়ি পরে আছে। তিনটা মেয়েই চমৎকার দেখতে হয়েছে তার। অথচ এই মেয়েগুলোর বড় হওয়াটা সে উপভোগ করতে পারলো না, স্বেচ্ছায় সে নিজেকে বঞ্চিত করেছে।

বৃষ্টি টের পাচ্ছে তার পাশে বসে থাকা মেজো আপুর কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে। আড়চোখে তাকিয়ে সে বোঝার চেষ্টা করলো। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তার মেজো আপুকে এখন কোনো প্রশ্ন করার সাহস তার নেই। আজ তার জন্য মেজো আপু একঘন্টা ওই বাড়ির বাইরে বাগানে বসে তার জন্য অপেক্ষা করেছে। মেজো আপু এমনিতেই চটে আছে তার ওপর। বৃষ্টি সাথে থাকলে রোদেলা কখনোই বাসে ওঠে না। সিএনজি নেয়। তারা বাসায় ফিরছে। সিএনজি তে উঠেই আপু ড্রাইভারকে বলে দিয়েছে বাতি নিভিয়ে দিতে,তার মাথা ধরেছে। তাই আপুর মুখটা ভালো করে দেখতে পারছে না বৃষ্টি।
আচ্ছা মেজো আপু এমন নড়ছে কেনো ! মুখে রুমাল চেপে রেখেছে। আপুর কি বমি পাচ্ছে! কিন্তু আপুর তো বমি পাবার কথা নয়। তবে কি আপু কাঁদছে! বৃষ্টি চমকে উঠে রোদেলাকে ভালো করে লক্ষ্য করে, হ্যা তার মেজো আপু সত্যিই কাঁদছে।

“তুই তোর দুলাভাইয়ের সাথে বেয়াদবি করেছিস ! ওকে বলেছিস তুই আমাকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিবি?”
চেঁচিয়ে বলে মেঘলা। রোদেলা ব্যাগটা নামিয়ে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,”এতো চেচিও না। এই অবস্থায় একটা দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। আর হ্যা,আমি দুলাভাইকে বলেছি ওই কথা।”
_কেনো বলেছিস? তোর মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? তুই কি আমাকে সংসার টা করতে দিবি না রোদেলা?

_দেবো না বলেই তো তাকে ওই কথা বলেছি।

মেঘলা আহত চোখে বোনের দিকে তাকায়। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে,”সব যায়গায় এতো প্রতিবাদী হয়ে পারা যায় না রোদেলা। আমার জীবন,আমি যেভাবে পারি মানিয়ে নেবো। আমার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে মানিয়ে নেবো। তুই এসবের মধ্যে ঢুকবি না।”

_ঠিকাছে, মানিয়ে নে যা। এখানে আসিস কেনো তবে? কাল সকালে শশুর বাড়ি চলে যাবি। ভালো করে মানিয়ে চল ওখানে গিয়ে। আমি দেখতে যাবো না।
কথাটি বলে রোদেলা ওয়াশ রুমে ঢোকে, মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরে যায়, তারপর সে তার জিনিসপত্র সব গোছাতে থাকে। কাল সকালেই সে তার শশুর বাড়ি চলে যাবে।

দরজার বাইরে থেকে দুইবোনের কথাবার্তা শুনছিলো রুহুল আমিন। জীবনের কঠিন বাস্তবতা গুলো তাকে ক্ষনে ক্ষনে বুঝিয়ে দিচ্ছে সে শুধু একজন ব্যর্থ স্বামীই নয় বরং একজন ব্যর্থ পিতাও।

“তোমার মন খারাপ কেনো বৃষ্টি?”

আদিলের প্রশ্নের কোনো উত্তর বৃষ্টি দেয়না। বিক্ষিপ্ত হৃদয়ে সে খানিকটা শান্তনা পায় এটা দেখে যে আদিল কিভাবে যেনো তার মন খারাপ খুব সহজেই ধরে ফেলে। সে না বুঝতে দিলেও। আদিল বৃষ্টির নীরবতা আবারো প্রশ্ন করে,”আজ তোমার মায়ের কাছে গেছিলে?”
আদিল ঠিক বুঝতে পেরেছে। বৃষ্টি ডুকরে কেঁদে ওঠে।
_কষ্ট পাও, তবু কেনো যাও‌ বুঝি না।
_যাই মাকে দেখতে, মা ডাকতে।
আদিল বলে,”কেঁদো না বৃষ্টি। তুমি কাঁদছো আর আমার খুব খারাপ লাগছে। কেঁদো না।”
_আদিল…
_কি বলো বৃষ্টি।
_তুমি কখনো আমায় ছেড়ে যেও না। আমার মায়ের মতো আমাকে তুমি ছুড়ে ফেলো না কখনো। আমার জন্য আজীবন থেকো তুমি..
আদিল চুপ করে শোনে। বৃষ্টি কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে নিঃশ্বাস আটকে যাবার উপক্রম। আদিল স্বাভাবিক গলায় বলে,”ঘুমাও বৃষ্টি এখন। তুমি অসুস্থ হয়ে পরবে।”

ফোন কেটে দিয়ে ফোনটাকে বুকের কাছে কিছুক্ষণ শক্ত করে ধরে রাখে আদিল। তার খুব ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বৃষ্টি নামের মেয়েটিকে গিয়ে তুলে এনে বিয়ে করে ফেলতে। খুব আদরে রাখবে সে সেই মেয়েটিকে। কিন্তু সময় তাকে সেই অনুমতি দিচ্ছে না। সময়কে বুড়ো আঙুল দেখানোর মতো সাহস তার মতো একটি বেকার ছেলের নেই !

বাস থেকে নেমে পরতেই মেইনরোডের অপজিটে তাদের অফিস দেখা যাচ্ছে। বারো তলা ভবনের পুরোটাই তাদের কোম্পানির অফিস। রোদেলা দ্রুত পায়ে ফ্লাইওভারে উঠতে থাকে। আজ রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকার কারনে তার অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আজ থেকে অফিসে অডিট শুরু হবে। এমতাবস্থায় যদি অফিসে যেতে দেড়ি হয় তাহলে তাদের ডিপার্টমেন্টের হেড স্বয়ং জিএম এর কানে কথাটি তুলে তাকে হেনস্থা ঠিকই করবে। রোদেলা বুঝতে পারে না,সে তো কখনো কারো পাকা ধানে মই দিতে যায়না,কারো সাথে তার কোনো দেনা পাওনা নেই। সে শুধু নিজের আশেপাশে শক্ত প্রাচীর তুলে রাখতে পছন্দ করে,অফিসে সবার সাথে একটু কম বন্ধুসুলভ সে সেজন্য সবাই তার সাথে এরকম আচরণ করবে? যেন সে একজন রিফিউজি।
রাস্তা পার হয়ে মেইন গেট দিয়ে অফিস এরিয়ায় ঢুকে পরে। দ্রুত হেঁটে সে লিফটের কাছে যায়। এমন সময় তার ফোন বাজতে শুরু করে,ফোন দিয়েছেন রুহুল আমিন। রোদেলা ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সে বলে,”রোদেলা মেঘলা চলে গেছে।”

রোদেলা কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থাকে। হঠাৎ করে তার মনে হচ্ছে তার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে,কাল রাতে সেই তো আপুকে চলে যেতে বলেছিল।
ওপাশ থেকে রুহুল আমিন বলে,”মেয়েটা একটু অসুস্থ ছিলো। যাওয়ার পরে একটাও ফোন দেয়নি। আমি দিলেও ধরছে না,তুই একটু দেখবি?”
_আচ্ছা দেখবো, আমি এখন অফিসে ঢুকবো। পরে দেখি বাবা?

রোদেলা ফোন কেটে দিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর বাটন টিপে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। লিফটের দরজা খুলে গেলে সে দ্রুত লিফটে পা রাখে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে তার পিছু পিছু লিফটে ঢুকে পরেছে তাশরিফ হাসান নামের লোকটি। তাশরিফ ঢুকতেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। লিফটে আপাতত তারা দুজন ব্যাতীত অন্য কেউ নেই। রোদেলা এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাশরিফ মাথা ঘুরিয়ে তাকে একবার দেখে নেয়, তারপর মনে মনে বলে,”এমনিতেই তো মুখটাকে সারাদিন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার বানিয়ে ঘোরেন। আজ তো পুরো মুখটা পেঁচার মতো লাগছে। আপনাকে আমি মিস মেজাজী না ডেকে পেঁচা মুখী ডাকবো এখন থেকে।”
কথাটি ভেবেই তাশরিফ হেসে ফেলে। তারপর নিজেই নিজেকে মনে মনে শাসায়,” তাশরিফ হাসান! এসব কি হচ্ছে! তুমি শুধু শুধু একজন ভদ্রমহিলার পেছনে লেগেছো, এটা তো কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয় !!”

মেঘলার শাশুড়ি জোবাইদা রহমান কটমট দৃষ্টি দিয়ে তার ছেলে মাইনুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মাইনুল মাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে আস্বস্ত করে। সে ব্যাপারটা দেখবে। মেঘলা তাদের মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে। মাইনুল কড়া গলায় তাকে বলে,”কি ব্যাপার! মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে বললাম,কথাটা কানে যায়নি?”

_আমি কোনো অন্যায় করিনি যে ক্ষমা চাইবো।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় মেঘলা। জোবাইদা বলে ওঠে,” কত বিষ দেখছিস মাইনুল? এই সাপের সাথে আমি সংসার করি। তুই তো থাকিস তোর চাকরির যায়গায়। দেখিস না তো কিছু।”
মাইনুল মাকে থামিয়ে দিয়ে মেঘলাকে বলে,”তোকে আর একবার সুযোগ দেবো। মায়ের কাছে ক্ষমা চাইবি । নয়তো এক্ষুনি এই বাসা থেকে বের করে দেবো।”
মাইনুলের কথায় রোদেলা তার দিকে চায়। যদিও জানে সে মাইনুল বাসা থেকে কখনোই তাকে বের করে দেবে না, মেঘলাকে বাসা থেকে বের করে দিলে যে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। কিন্তু মেঘলার বুক ফেটে কান্না আসে মাইনুলের হুমকিতে। একদিন এই মানুষটার হাত ধরে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিলো সে। আজ সেই মানুষটা তাকে জীবন থেকেই ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মেঘলা নিজের পেটে হাত দেয়,মনে মনে বলে,”তোকে এনেছিলাম নিজের জীবনটা ঠিকঠাক করে নিতে। ভেবেছিলাম তুই আসলে তোর বাবা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তোকে এনে আমি সবথেকে বড় ভুলটা করে ফেললাম জীবনের। তোকে এনে আমি তোকেও বিপদে ফেলে দিলাম। এখন আমরা একসাথে দুজনেই জ্বলবো। আমাকে ক্ষমা করিস তুই।”

“বাসা থেকে বের করে দিলে ওর কত যায়গায় যাওয়ার যায়গা আছে! ওকি তোর হুমকির ধার ধারে নাকি!”

জোবাইদার কথায় মেঘলা চমকে উঠে তার দিকে তাকায়। মাইনুল তার মাকে বলে,”মানে !”
_মানে আবার কি, এই পাড়ায় কত বান্ধব আছে তোর বৌয়ের তুই জানিস? তাদের সাথে কত ভাব তোর বৌয়ের!

_আপনি কি আসিফের কথা বলছেন মা?
রেগেমেগে বলে মেঘলা।
_আমিতো কারো নাম বলিনি। এতো দেখছি চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।
মেঘলা চেঁচিয়ে ওঠে,”মা আমার কোনো ভাই নেই। আসিফকে আমি ভাইয়ের মতো দেখি। ও আমাকে কত সাহায্য করে, আমার ওষুধ এনে দেয়,আমাকে বোন ভেবেই করে এসব।’

_হ্যা হ্যা, এই পাড়ায় তুমি একাই মেয়ে ওর বোন। আর তো কেউ না। তাই শুধু তোমারই ফরমায়েশ খাটে সে।
মেঘলা ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে। মাইনুলের মাথায় চট করে বুদ্ধি চলে আসে। সে মেঘলাকে শায়েস্তা করার আরো একটি উপায় পেয়ে যায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠে,
_ওর চরিত্র ভালো হবে না তা তো জানাই ছিলো,ভালো কিভাবে হবে। ওর মা কি ছিলো জানো না? তিন তিনটা বাচ্চা হবার পরে নষ্টামি করেছিলো, আর ও তো পেটে বাচ্চা নিয়েই শুরু করেছে। মায়ের রক্ত তো পেয়েছে।

মেঘলার মনে হলো তার গলাটা কেউ চেপে ধরেছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু সে স্বাভাবিক থাকে। তারপর মাইনুলের চোখে চোখ রেখে বলে,”চরিত্র তো তোমারও ভালো না। তা তো বারবার প্রমানিত,তবে তুমিও কি তোমার মায়ের রক্ত পেয়েছো? তোমার মায়েরও কি চরিত্রের ঠিক নেই?”

জোবাইদা উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠে। মাইনুল মেঘলার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘলা তার দিকেই তাকিয়ে আছে শীতল চোখে।

চলমান….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে