দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৪+৫

0
188

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪ ( প্রথমাংশ )
#আদওয়া_ইবশার

“আপনাদের মাঝে রক্তিম শিকদার কে?”

প্রতিদিনের মতো আজও নিজের দলবল নিয়ে রাস্তায় বাইকে হেলাল দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রক্তিম। টুকটাক দলের ছেলেদের সাথে কথা হচ্ছিলো লিয়াকত বিল্লাকে নিয়ে। এর মাঝেই হঠাৎ এক মেয়ে কন্ঠের রিনরিনে স্বরে রক্তিমের নাম শুনে কথা থামিয়ে ফিরে তাকায় সকলেই। দেখতে পায় ঐদিন রাস্তায় গলা ছেড়ে গান গাওয়া মেয়েটাই খোঁজ করছে রক্তিমের। এই মেয়ের রক্তিমের সাথে আবার কি কাজ! যেখানে আজ পযর্ন্ত কোনো মেয়ে রক্তিমের আশেপাশে ঘেষার সাহস পায়নি সেখানে এই মেয়ে রক্তিমের খোঁজ করার সাহস কিভাবে পেল! কথাটা ভেবেই একটু অবাক হয় সকলেই। তবে রক্তিম নিরুত্তাপ। একটা মেয়ের মুখে নিজের নাম শুনেই তার কোনো হেলদুল নেই। নির্বিকার ভাবে আয়েশী ভঙ্গিতে হাতে থাকা সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। রক্তিমের দিকে এক পলক তাকিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে মেহেদী,

“রক্তিম শিকদারের কাছে কি দরকার তোমার?”

এমন প্রশ্নে একটু বিরক্ত হয় দৃষ্টি। এমনিতেই এতোদূর দৌড়ে এসে হাপিয়ে গেছে। হাতে খুবই অল্প সময়। এই অল্প সময় টুকুর মাঝেই যা করার করে চলে যেতে হবে তাকে। এমতাবস্থায় মেহেদীর প্রশ্নটা তার কাছে মনে হচ্ছে অযথা তার সময় নষ্ট করার ফন্দি। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতেই দৃষ্টি জবাব দেয়,

“সেটা আপনাকে বলব কেন? যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।”

কথাটা বলে আড়চোখে এক পলক রক্তিমের দিকে তাকিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে। এইটুকু একটা মেয়ের মুখে এমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথার জবাব শুনে একটু বুঝি থমকায় রক্তিম। রোদ চশমার আড়ালে লুকিয়ে থাকা তিক্ষ্ণ চোখ দুটো ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নেয় মেয়েটাকে। সেটাও সকলের অগোচরে। দৃষ্টির মুখে এমন জবাব শুনে যারপরনাই অবাক উপস্থিত প্রতিটা ছেলে। চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফের তাকায় দৃষ্টির দিকে। হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের কাছে এভাবে অপদস্থ হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে রক্তিম শিকদারের দলবল। এটা কি মানা যায়! মেহেদী বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলার আগেই খ্যাঁকিয়ে ওঠে রাকিব,

“অ্যাই মেয়ে! কার সামনে দাঁড়িয়ে এমন বেয়াদবের মতো কথা বলছো জানো তুমি? এক রত্তি একটা মেয়ে এক আঙুলে তুলে আছাড় মারলেই চেপ্টা হয়ে যাবে। এই মেয়ের আবার এতো পাওয়ার!”

উত্তরে দৃষ্টি কিছু বলতে যাবে এর মাঝেই রক্তিম হাত উচিয়ে সকলকেই এক ইশারায় থামিয়ে দেয়। ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে গম্ভীর কন্ঠে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

“আমি রক্তিম শিকদার। কি দরকার?”

জবাব পেয়ে খুশিতে আত্মহারা দৃষ্টি। সে তো আগে থেকেই জানতো কোনটা রক্তিম। এতোক্ষন অহেতুক এই প্রশ্নপর্ব চালিয়ে যাবার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল রক্তিমের থেকে একটা জবাব পাওয়া। অবশেষ সেটা পেয়ে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই আনন্দ হচ্ছে দৃষ্টির। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ চেহারায় ধরে রাখেনা। টুপ করে সবটুকু আনন্দ গিলে নিয়ে মুখে দুঃখি দুঃখি ভাব এনে রক্তিমের দিকে এগিয়ে যায় এক কদম। কাঁদো কাঁদো মুখ ভঙ্গিতে বলে,

“আমি খুব অসহায় হয়ে আপনার খোঁজ করতে এসেছি ভাই। সবার কাছে শুনেছি কেউ যদি কোনো মেয়েকে উত্তক্ত করে তবে আপনি না কি তার বিচার করেন! গত তিনটা দিন যাবৎ এক ছেলে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে ভাইয়া। আমি খেতে পারিনা, ঘুমাতে পারিনা। শান্তিতে কোথাও একটু বসতেও পারিনা। সবসময় ঐ ছেলের চিন্তা মাথায় ঘুরে। আপনি দয়া করে এর একটা বিহিত করুন। নইলে এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে আমি মরে যাব একেবারে।”

এমন এক অভিযোগে একটু থমকায় সকলেই। চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে ওটা রক্তিমের। অত্যন্ত শীতল স্বরে জানতে চায়,

“ছেলেটা কে?”

“আমি তো জানিনা ভাইয়া।”

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দেয় দৃষ্টি।তার এহেন জবাবে বিরক্ত হয় দলের সবগুলো ছেলে। তিরিক্ষি মেজাজে রাকিব আবারও থমকে বলে ওঠে,

“এই মেয়ে ফাজলামি পাইছো? জানোনা তো এতোক্ষন কুমিরে কান্না করে কি বলেছো ঐসব? একটা ছেলে তোমাকে বিরক্ত করে, অথচ ছেলেটা কে সেটাই তুমি জানোনা! অদ্ভূত সব কথাবার্তা।”

পাশ থেকে জাবির রাকিবের কথার তালে বলে,

“আমি আগেই বুঝতে পেরেছি এই মেয়ে পাগল। না হলে ঐদিন মাঝ রাস্তায় ঐভাবে গলা ছেড়ে গান গাইতো না। আর না আজ এমন অহেতুক কথাবার্তা বলতো।”

নিজেকে পাগল বলায় দৃষ্টির রাগ হয় খুব। কিন্তু প্রকাশ করেনা তা। একবার শুধু কটমট দৃষ্টিতে রাকিব, জাবিরের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তে মুখটা অসহায় করে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বলে,

“গান হলো মনের খোরাক। গান গাইলে মন ভালো থাকে। আপনিই বলুন ভাইয়া, গলা ছেড়ে গান গেয়ে নিজের মন ভালো করার ব্যক্তিস্বাধীনতা কি আমার নেই? আর যে ছেলেটা আমাকে বিরক্ত করে তার নাম জানিনা। তবে দেখলে ঠিকই চিনবো। এখন আমি কিভাবে নাম না জেনে বলব কে সেই ছেলে? এই যুক্তিসঙ্গত কারণ গুলো না বুঝেই ওনারা আমাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করে ফেলল। এটা কি ঠিক করল? আজকে আমি অসহায় ভুক্তভোগী দেখেই তো আপনাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসলাম। সেই আপনারাই যদি এখন আমাকে সাহায্য না করে উল্টাপাল্টা কথা বলেন তবে আমার মতো অসহায় মেয়েরা যাবে কোথায়?”

দৃষ্টির এতোগুলো কথা শুনে একটু নরম হয় সকলেই। প্রথমে কিছুটা থমথম খেলেও নিজেদের সামলে নিয়ে মেহেদী বলে,

“কষ্ট পেয়ো না ছোট আপু। আসলে আমরা বুঝতে পারিনি। আচ্ছা! ঐ ছেলেকে আবার দেখলে তো চিনতে পারবে তাই না!”

উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায় দৃষ্টি। সাথে সাথেই মেহেদী চড়াও হয়ে বলে,

“ঠিক আছে। তবে চলো আমার সাথে। পুরো এলাকায় চিরুনি তল্লাশি করে হলেও আজকে দিনে দিনে ঐ ছেলেকে খোঁজে বের করব আমি। এরপর রক্তিম শিকদার নিজের হাতে ঐ স্কাউন্ড্রেল এর বিচার করবে। চলো চলো।”

সহসা আতকে ওঠে দৃষ্টি। তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে বলতে থাকে,

“না না। আপনাদের সাথে যাওয়া যাবেনা।”

তার এমন কথায় চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় সকলেই। নিরবতা ভেঙে আবারও রক্তিমই জানতে চায়,

“কেন?”

“ওনাদের সাথে গেলে এলাকার লোক আমার নামে বদনাম রটাবে। বলবে এক দল গুন্ডার সাথে আমি মেয়ে হয়ে দিন দুপুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আরও বিভিন্ন কথা বলবে।ঐসব আমি মুখেও আনতে চাইনা।”

ফুস একটা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে রাকিব। হতাশ ভঙ্গিতে বলে,

“তাহলে এখন কি করবে? এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে কথা বললেও মানুষ দেখে বদনাম রটাবে। তার থেকে বরং এক কাজ করো। বাসায় গিয়ে চোখে সরিষা তেল লাগিয়ে ইচ্ছমতো কতক্ষণ কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পরো। পরে যদি আবার কখনও ঐ ছেলে বিরক্ত করতে আসে তখন তার থেকে জেনে নিয়ো এভাবে, ” ওহে আমার রাতের ঘুম হারাম করা জনাব! আপনার নামটা কি একটু জানতে পারি? অনুগ্রহ করে আপনার নামটা বললে রক্তিম শিকদারকে বলে আপনাকে সিন্নি খাওয়াতাম।”

রাকিবের কথার ধরনে হু হু করে হেসে ওঠে উপস্থিত সকলেই। ব্যতিক্রম শুধু রক্তিম আর দৃষ্টি। চোখ-মুখ শক্ত করে রাকিবকে ধমকে ওঠে দৃষ্টি,

“একদম চুপ করুন আপনি। মাথা ভর্তি গোবর নিয়ে কিভাবে রক্তিম শিকদারের দলে কাজ করেন আপনি? আপনার থেকে তো আমার আট বছরের ছোট ভাইয়ের মাথায় আরও বেশি বুদ্ধি।”

তরতজা এমন এক অপমানে থমথম খেয়ে যায় রাকিব। কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দৃষ্টির দিকে। রাকিবের এমন অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে সকলেই। সেদিকে আর পাত্তা দেয়না দৃষ্টি। হঠাৎ কিছু একটা মনে হয়েছে এমন একটা ভাব করে রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,

“একটা বুদ্ধি পেয়েছি।”

“কি বুদ্ধি?”

জানতে চায় জাবির। সেদিকে এক পল তাকিয়ে দৃষ্টি আবারও রক্তিমের দিকে ফিরে তাকায়। ফট করে বলে ফেলে,

“আপনার নাম্বারটা দিন।”

চলবে…..

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪ ( দ্বিতীয়াংশ)
#আদওয়া_ইবশার

এমন নির্দ্বিধায় অকপটে রক্তিমের নাম্বার চাওয়ায় উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত। গোলগোল নয়নে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থাকে দৃষ্টর মুখের দিকে। রক্তিম শিকদার’ও কিন্চিৎ অবাক হয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেনা। গম্ভীরচিত্তে জানতে চায়,

“আমার নাম্বার দিয়ে কি করবে?”

“আবার কখনো যদি ঐ ছেলেটা বিরক্ত করতে আসে তখন সাথে সাথে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দিব। আপনি দলবল নিয়ে গিয়ে ঐ ছেলেকে কেলিয়ে আসবেন।”

নিঃসংকোচে জবাব দৃষ্টির। পাশ থেকে ফুরন কেটে রাকিব বলে,

“এর জন্য ভাইয়ের নাম্বার নিতে হবে কেন তোমার? আমাদের যে কারো একজনের নাম্বার নিলেই তো হয়। ভাই কি সবসময় ফ্রি হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকে না কি? যে তুমি ফোন করলে ওমনি ভাই রিসিভ করে তোমার কথা শুনে দৌড়ে চলে যাবে!”

কটমট দৃষ্টিতে রাকিবের দিকে তাকায় দৃষ্টি। ঝাঝালো স্বরে বলে,

“হ্যা আপনাদের নাম্বার নিয়ে বিপদে পরে কল দেই।এরপর উপকারের নাম করে আপনারাই প্রতিদিন ফোন করে আমাকে ডিসটার্ব করুন। কি ভেবেছেন চিনিনা আমি আপনাদের? এক একটা বদের হাড্ডি, মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক করা স্বভাবের ধামড়া বেটা-ছেলে!”

এমন তরতজা একটা মনগড়া মিথ্যা অপবাদে প্রত্যেকের কুঠোর ছেড়ে চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম। এক জায়গায় ঠাই দাঁড়িয়ে রক্তিম শিকদারের ছেলেদের বারবার এভাবে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে অপমান করার মতো দুঃসাহস পায় কোথায় এই মেয়ে? অত্যাধিক রাগ হয় উপস্থিত প্রতিটা ছেলের। দৃষ্টির দিকে তেড়ে আসে রাকিব। আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে বলে,

“সাহস কত বড়! আর একটা উল্টাপাল্টা কথা বললে জ্বিভ টেনে ছিড়ে দেখিয়ে দিব আমরা কি জিনিস।”

মুখ বাঁকায় দৃষ্টি। আড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলে,

“অ্যাহ্! দুই টাকার মুরোদ নেই আবার কোটি টাকার বিছানায় ঘুমানোর স্বপ্ন দেখে। চামচিকা চামচিকার মতোই থাকুন। এতো পাওয়ার দেখাতে আসবেন না বলে দিলাম। নইলে আমিও এক একটার মেইন পয়েন্টে মেরে দেখিয়ে দিব দৃষ্টি কি জিনিস।”

এতোক্ষন পর্যন্ত সব কিছু চুপচাপ সহ্য করে গেলেও এবার আর চুপ থাকেনা রক্তিম। স্ব-স্বরে ধমকে ওঠে দৃষ্টিকে,

“এই মেয়ে চুপ!”

ব্যাস! দৃষ্টি নামক বাচাল কন্যার মুখ বন্ধ করার জন্য রক্তিম শিকদারের জোরালো কন্ঠের এক ধমকই যথেষ্ট। হুট করে এমন একটা ধমক খেয়ে চুপসে যায় দৃষ্টি। ভয়ে লাফিয়ে উঠে অন্তরাত্বা। বুকে থুথু দিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে ঘনঘন চোখের পলক ঝাপটায়। ভিতু চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রক্তিম দু-পা এগিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ কয়েক কদম পিছিয়ে যায় দৃষ্টি। রক্তিম বুঝতে পারে তার ধমক কাজে দিয়েছে। ভয় পেয়েছে মেয়েটা। মেহেদীর পকেট থেকে এক প্রকার ছু মেরে কলম নিয়ে খাঁবলে ধরে দৃষ্টির হাত। আবারও কেঁপে ওঠে দৃষ্টি। ভয়ে মুখ দিয়ে অস্পষ্ট আওয়াজ বের হয়। তাদের থেকে একটু দূরে মোটা মেহগনি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তুসীও কাঁপে রক্তিম শিকদারকে দৃষ্টর কাছাকাছি দেখে। সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে আর্জি জানায়,

“আল্লাহ! আল্লাহ প্লিজ এবারের মতো মাথা মোটাটাকে বাঁচিয়ে দাও।”

সকলকে অবাক করে দিয়ে দৃষ্টির হাতের মুষ্টি খুলে কলমের খচখচ খোঁচাতে লিখে দেয় রক্তিম নিজের নাম্বারটা। মুহুর্তেই ঝলমলিয়ে হাসি ফোটে দৃষ্টির ওষ্ঠপুটে। কাজটুকু কয়েক সেকেন্ডে শেষ করে আবারও পিছিয়ে যায় রক্তিম। দুজনের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে হুমকি ছুড়ে দৃষ্টির দিকে,

“যা চেয়েছো দিয়েছি। জানের মায়া থাকলে আশা করি এই নাম্বারে অপ্রয়োজনীয় কোনো কল আসবেনা। আর একটা কথা। আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছেলেদের যা নই তাই বলে অপমান করলে। আজকে কিছুই বললাম না। দ্বিতীয়বার যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চিরতরে জবান বন্ধ করে দিব।”

ঠান্ডা মাথার এমন ভয়ংকর হুমকিতে একটু ভয় ডুকে যায় দৃষ্টির মনে। পরপর কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে মনে মনে ভাবে, “এ কোন জল্লাদের প্রেমে পরলি রে তুই দৃষ্টি? দুনিয়াতে এতো এতো ভালো মানুষ থাকতে সাক্ষাৎ জমের দোয়ারে এসে ভীড়লি! না জানি এই গুন্ডা হিরো কবে তোর প্রাণপাখিটা উড়িয়ে দেয়।”

জোর করে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় দৃষ্টি। কাওকে আর কিছু বলতে না দিয়ে যেমন দৌড়ে এসেছিল তেমন গতিতেই দৌড় লাগায়। চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে দৃষ্টির প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে দলের ছেলেরা। কপাল কুঁচকে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মেহেদী জানতে চায়,

“এতো সহজে মেয়েটাকে নিজের নাম্বার দিয়ে দিলি তুই!”

“তো কি করতাম! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐসব ফালতু কথাবার্তা শুনে মাথার পোকা মারতাম?”

কাটকাট স্বরে জবাব রক্তিমের। জবাবটা একটুও মনঃপুত হয়না কারো। অসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের মুখের দিকে। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায়না।

দৃষ্টিকে দৌড়ে আসতে দেখে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তুসী।কাছাকাছি দাঁড়িয়ে উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়,

“ঠিক আছিস তো তুই? ঐ গুন্ডাটা কিছু করেনি তো! এতো কাছে এসে কি করছিল তোর?”

তুসীর মুখে গুন্ডা ডাকটা শুনে কপাল কুঁচকায় দৃষ্টি। নিচের ঠোট দাঁত দিয়ে কামড়ে চোখ পাকিয়ে বলে,

“তুই কাকে গুন্ডা ডাকছিস? দুদিন পর সম্পর্কে যে তোর দুলাভাই হবে সেই সম্মানীয় মানুষটাকে কোন মুখে গুন্ডা ডাকিস তুই? বেয়াদব মেয়ে!”

তাজ্জব বনে যায় তুসী। ঘনঘন দুপাশে মাথা নাড়ে। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

“পাগল কখনো পুরোপুরি সুস্থ্য হয় না কথাটা ভুলে গেছিলাম আমি। তুই আবার মনে করিয়ে দিলি। মরবি তুই। খুব শিগ্রই মরবি। যেদিন ঐ রক্তিম শিকদারের চোখের আনলে ভস্ম হবি সেদিন গিয়ে এসব পাগলামি বন্ধ করবি। এর আগে না।”

তুসীর কথা পাত্তা দেয়না দৃষ্টি। সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আপন খুশিতে মত্ত হয়। নিজের হাতটা তুসীর চোখের সামনে তুলে ধরে বলে,

“এটা কি বল তো?”

“কি?” জানতে চায় তুসী। তৎক্ষণাৎ ছোটখাট এক চিৎকারে নিজের উল্লাস প্রকাশ করে বলে,

“রক্তিম শিকদারের নাম্বার। বুঝতে পারছিস আমি কতটা জিনিয়াস! তুড়ি বাজিয়ে নাম্বার জোগাড় করে ফেললাম। তাও আবার সয়ং রক্তিম শিকদার নিজে লিখে দিয়েছে। এবার তো আমার প্রেম জমে ক্ষীর হবে। কেউ আটকাতে পারবেনা আমাদের প্রেম।”

অত্যাধিক বিস্ময়ে তুসীর আঁখিযুগল ছানাবড়া।,

“ফাজলামি করছিস আমার সাথে! তুই বললি আর ওমনি রক্তিম শিকদার নিজের নাম্বার দিয়ে দিল? কেমনে কি করেছিস তুই?”

মিটিমিটি হেসে জবাব দেয় দৃষ্টি,

“বলা যাবেনা। সিক্রেট।”

****
একসময় মানুষের পদচারনায়,উৎসবমোখর আনন্দে, খিলখিল হাসির শব্দে সর্বদা মুখোরিত থাকা শিকদার মঞ্জিল গত পাঁচ বছর যাবৎ নিশ্চুপ। বাইরে থেকে দেখলে কখনো মনেও হয়না রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে এই বাড়িতে কোনো মানুষ বসবাস করে। ভিতরে ডুকলে মনে হয় প্রতিটা দেয়াল, আসবাবপত্র নিজের দুঃখবিলাসে ব্যস্ত। হাতে গুণা কয়েকটা মানবপ্রাণ যেন কোনো অনুভূতি শূণ্য কাঠের পুতুল। অথচ একটা সময় এই বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও মনে মনে ভাবতো, “ইশ! যদি কখনো আমি এই বাড়ির মানুষ গুলোর মতো সুখী হতে পারতাম।” সেই বাড়ির পাশ দিয়েই বর্তমানে মানুষ হেঁটে গেলে হয়তো সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা জানায়, “হে প্রভু! আর কারো জীবনে তুমি এমন কালো অধ্যায় দিয়োনা। যে অধ্যায় মানুষের জীবন থেকে সম্পূর্ণ সুখ চুষে নিয়ে পুরো বাড়িময় শোকের ছায়ায় আবৃত করে নেয়।” আজীজ শিকদার বলতে গেলে দিনের পুরোটা সময় নিজের সমাজসেবা মূলক কাজে বাইরে থাকেন। সবসময়ের মতো বাড়িতে থেকে যায় শুধু তিনটা প্রাণ। শিকদার মঞ্জিলের কর্তৃ রেহানা বেগম, সর্ব কনিষ্ঠ কন্যা ইতি আর একমাত্র বাড়ির কাজে সাহায্য করা কাকলির মা। তিনজন তিনজনের মতো করেই পরে থাকে বিশাল বাড়ির তিন কোণায়। রেহানা বেগম এক ছেলেকে হারিয়ে জগত সংসারের সব কিছু থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। রক্তিম, সংগ্রাম দুটো ছেলেই নিজের পেটের সন্তান। সমান আদর-যত্নে দুজনকেই ছোট থেকে বড় করে তুলেছে। সেই আদরের দুই সন্তানের একজনও তার কাছে নেই। ছোট সন্তানের খুনের দায়ে বড় সন্তানকে দূরে সরিয়েছে নিজেই। গুটা দুনিয়ার কাছে রক্তিম শিকদার নির্দোষ প্রমাণিত হলেও নিজের মায়ের কাছে এখানো সে দোষী। ছোট ভাইয়ের খুনি। সেই খুনি ছেলেকে রেহানা বেগমের কাছে টেনে নেবার প্রশ্নই আসেনা। বরং সামনে পরলে ছেলেকে যতটা কথার আঘাতে জর্জরিত করতে পারে ততই যেন নিজের মনে শান্তি মিলে।

নিজের রুমে বসেই কিছু একটা ভাবনায় মশগুল ছিলেন রেহানা বেগম। নিঃশব্দে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় ইতি। কতক্ষণ চুপচাপ মা’কে দেখে নিয়ে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে,

“মা।” হঠাৎ ডাকে খানিক চমকায় রেহানা বেগম। ভাবনার সুতা ছিড়ে বেরিয়ে আসে। অনুভূতি শূণ্য চোখ দুটো ঘুরে তাকায়। মাসটপে ধরা দেয় ছোট মেয়ের মলিন মুখের আদল।দৃষ্টিজোড়া চঞ্চল হয়। বুকের ভিতর সৃষ্টি হয় অদম্য এক ঝড়। হাসফাস করে মাতৃমন আরেকটা বার মা ডাক শোনার জন্য। গত পাঁচটা বছর যাবৎ মধুর এই মা ডাকটাও খুব একটা শুনতে পাননা তিনি। অথচ পাঁচ বছর আগের স্মৃতি ঘাটলেই দেখা যায় মা ডাক শুনতে শুনতে রাত শেষে নতুন ভোর আসত রেহানা বেগমের জীবনে। আবার সেই মা ডাক শুনতে শুনতেই দিন শেষে রাত্রি গভীর হতো। ছোট ছেলে সংগ্রাম দুই মেয়ে স্মৃতি, ইতি, পুত্রবধূ জেরিন প্রতিটা কথার আগে তাদের মা না ডাকলে যেন শান্তি লাগতনা। রক্তিম অফ ডিউটিতে যতটা সময় পেতো পুরোটা সময় কিছুক্ষণ পরপর ফোনকলে মায়ের সাথে মন খুলে কথা বলত। সেও অন্যদের মতোই প্রতিটা কথার শুরুতে এবং শেষে মা শব্দটা উচ্চারণ করতোই। সেই দিন গুলো এখন শুধু জমে আছে স্মৃতির খাতায়। মাঝখানে কতশত দিন গেল। রেহানা বেগমের মাতৃ হৃদয়টা মা ডাক শুনে তৃষ্ণা মিটাতে ব্যর্থ। বড় মেয়ে স্মৃতির বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার বাড়ির শোক ভুলে স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত সে। সারাদিনে একবারও সময় হয়না মা’কে ফোন করে মা বলে একটু ডাকার। আর ছোট মেয়ে বড় ভাই বাড়িতে না থাকার জন্য মা’কে দায়ী করে কাছে থেকেও সারাক্ষণ দূরে সরে থাকে। রেহানা বেগমের মাঝে মাঝেই মনে হয় অনর্থক বেঁচে থেকে শ্বাস নিয়ে শুধু শুধু বিশুদ্ধ অক্সিজেন নষ্ট করছেন। তার বেঁচে থাকা আর না থাকাই কিছুই হবেনা এ পৃথিবীর কারো। যে নারীর সন্তান থেকেও নেই। সুখের সংসার পূর্ণ হয় অসুখে। স্বামী নামক আস্থাভাজন মানুষটাও সর্বক্ষণ দেখিয়ে যায় শুধু নির্লিপ্ততা। সে নারীর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়না। কিন্তু মরতেও পারেনা। আত্মহত্যা যে মহাপাপ। বুক ভরা বেদনা, হাহাকার, তৃষ্ণা নিয়েই কাটাতে হবে বাকীটা জীবন।

ইতি এখনো তাকিয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে জবাবের আশায়। কন্ঠ কাঁপে রেহানা বেগমের। গলার কাছে কথারা এসে গিট পাকিয়ে থাকে। বহুকষ্টে ভাঙ্গাস্বরে তীব্র চেষ্টার পর বলতে পারেন,

“হু!”

সাথে সাথে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ইতির। মায়ের দুঃখ গুলো সে বুঝে।এতোটা কাছে থেকে মেয়ে হয়ে মায়ের দুঃখ বুঝবেনা এতোটা পাষাণ মেয়ে তো আর ইতি না। কিন্তু সবটা বুঝেও তার কিছুই করার থাকেনা। তার কাছে সবসময় মনে হয় মায়ের এই কষ্ট পাওয়াটা পুরোটাই মায়ের স্বভাবের জন্যই হচ্ছে। যে বা যারা চলে যাবার কোনো না কোনো উছিলায় তারা তো চলেই গেছে। সেই চলে যাবার দায়ে কাছে থাকা সন্তানকে দায়ী করে দূরে ঠেলে দেওয়াটা পা দিয়ে ঠেলে লক্ষি বিদায় করার মতো হয়ে গেল না! যেখানে পুরো শহর জানে রক্তিম নির্দোষ। নিজের ভাই, স্ত্রী খুনের পিছনে রক্তিমের কোনো হাত নেই। সেখানে মা হয়ে রেহানা বেগম কেন এটা বিশ্বাস করতে পারেনা? কেন এভাবে দূরে ঠেলে দিল রক্তিমকে? ইতির বরাবরই মনে হয়, শুধুমাত্র তার মা ভাইকে দূরে ঠেলে দেবার কারণেই ভাইটা তার একজন আদর্শবান মানুষ থেকে গুন্ডা মাস্তানে পরিণত হয়েছে। ঠিক এই জায়গাটা থেকেই মায়ের প্রতি ইতির অভিমান।এ বিষয়ে যতবার মা’কে বুঝানোর চেষ্টা করেছে ঠিক ততবার মা তাকেও কথার আঘাতে জর্জরিত করে দূরে সরে যেতে বাধ্য করেছে। তবুও ইতি কিছুদিন যেতেই বেহায়ার মতো বারবার আসে বুঝাতে। যেমনটা এসেছে আজকে।

নিঃশব্দে মায়ের পাশে বসে কাধে মাথা রাখে ইতি। সহসা এক টুকরো প্রশান্তিতে চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় রেহানা বেগম। বুক ভরে টেনে নেয় শান্তির নিশ্বাস।করেছেন
“কাল যখন ভাইয়া বাড়িতে এসেছিল এক ধ্যানে কিভাবে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল! একটু কথা বললে কি এমন হতো মা?”

সহসা বন্ধ চোখ জোড়া খুলে তাকায় রেহানা বেগম। তড়িৎ নিজের কাধ থেকে মেয়ের মাথাটা নামিয়ে দেয়। শক্ত চোখে তাকিয়ে বলেন,

“আবারও ঐ খুনির সাফাই গাইতে এসেছিস আমার কাছে?”

ইতির চিত্ত বিগলিত হয়। মায়ের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে অশ্রুস্বজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“আর কত মা? আর কত! আর কত এভাবে কষ্ট দিবে ভাইয়াকে? শুধু যে ভাইয়া একাই কষ্ট পাচ্ছে এমনটাও না। তার মতো সমান কষ্ট তুমিও পাচ্ছো। তবে কেন এতো রাগ তোমার? কেন তুমিও কষ্ট পাচ্ছো ভাইয়াকেও কষ্ট দিচ্ছো। তুমি চাইলেই কিন্তু আমাদের বাড়িটা একটু হলেও আগের মতো হতে পারে মা। ভাইয়া জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজাতে পারে। ও তোমার ছেলে মা। তোমার প্রথম সন্তান। যার মুখ থেকে তুমি প্রথম মা ডাক শুনেছিলে। তোমার সেই ছেলে রাজপ্রাসাদের মতো নিজের বাড়ি রেখে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। নিজের পরিচয় নিজের বাবার পরিচয় সব দূরে ছুড়ে গুন্ডা পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছে মানুষের কাছে। তোমার কি একটুও কষ্ট হয়না তার জন্য? এখনো সময় আছে মা। তুমি চাইলেই আবারও ভাইয়ার জীবনটা নতুন মোড় নিতে পারে। আমাদের সবার জীবনে আবারও শান্তির বর্ষণ নামতে পারে। প্লিজ মা সময় থাকতে থাকতে সব ঠিক করে নাও। আর নষ্ট হতে দিওনা ভাইয়াকে। প্লিজ!”

ইতির আহাজারিতে থমকে থাকে রেহানা বেগম। অপলকে তাকিয়ে থাকে মেয়ের কান্নারত মুখের দিকে। একসময় জড়বস্তুর মতোই অসাঢ় কন্ঠে বলে ওঠে,

“আচ্ছা! সব ঠিক করে দিব। কাছে টেনে নিব তোর গুন্ডা ভাইকে। বিনিময়ে আমি কি পাব? ফিরে আসবে আমার মরে যাওয়া ছোট ছেলেট সংগ্রাম শিকদার? ফিরে পাব আমার আদর্শবান বড় ছেলে আর্মি ক্যাপ্টেন রক্তিম শিকদারকে? যে রাতে নিজের বড় ছেলের হাতে ছোট ছেলে খুন হয়েছে সেই রাতের স্মৃতিটুকু মুছে যাবে আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে? উত্তর দে। পাব আমি আমার হারিয়ে ফেলা সুখ গুলো?”

শেষের কথা গুলো বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যান রেহানা বেগম।দু-হাতে ইতির কাধ ঝাকিয়ে একই প্রশ্ন করতে থাকেন বারবার। উত্তর দেবার মতো ইতি কোনো শব্দ খোঁজে পায়না। মায়ের চিৎকারের সাথে সাথে সে নিজেও চিৎকার করে কাঁদে। একসময় মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বেরিয়ে যায় রুম থেকে। এসেছিল সব ঠিক হয়ে যাবে এমন একটা আশা নিয়ে। অথচ যেতে হলো বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে।

চলবে…….

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৫
#আদওয়া_ইবশার

অলস দুপুর। সূর্যটা একেবারে মাথার উপর। অসহ্য রকম গরম পরেছে। দুই ক্লাস বাদ রেখেই গরমে টিকতে না পেরে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে ইতি। রাস্তায় আসতেই দেখতে পায় দূরে মেহেদী দাঁড়িয়ে আছে। ইতিকে বেরোতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে তার দিকে। একদম ইতির সোজাসুজি দাঁড়িয়ে ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। গরমে ছেলেটার ফর্সা মুখের আদল লাল হয়ে আছে। কপালের পাশ দিয়ে চিকন ঘামের রেখা নামছে। এক পলক সেদিকে তাকিয়ে উল্টো পথে হাটা ধরে ইতি। হতবম্ভ হয় মেহেদী। কয়েক পল ইতির গমনপথে তাকিয়ে থেকে তড়িৎ এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে। সাথে সাথেই শুনতে পায় ইতির ঝাঝালো স্বর,

“মাঝ রাস্তায় একটা মেয়ের হাত ধরতে লজ্জা করেনা? অসভ্য পুরুষ কোথাকার!”

ইতির এহেন আচরণে ব্যথিত হয় মেহেদী। অসহায় মুখে তাকিয়ে জানতে চায়,

“এমন করছো কেন আমার সাথে? কি করেছি বলবে তো একবার!”

“আগে হাত ছাড়ুন।”

শক্ত কন্ঠে বলে ইতি। অধৈর্য্য হয় মেহেদী। হাতের বাঁধন আরও জোরালো করে নাছোড়বান্দা হয়ে বলে,

“আগে আমার কথার জবাব দাও। পরে হাত ছাড়ব কি না ভেবে দেখব।”

চোখ পাকায় ইতি। বলে,

“আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করব। গণপিটুনি খাওয়ার আগে হাত ছাড়ুন”

“করো। আমিও দেখি রক্তিম শিকদারের বন্ধুর গায়ে টাচ করার মতো কলিজা কার আছে।”

ভাবলেসহীন জবাব মেহেদীর। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে কতক্ষণ মেহেদীকে দেখে ইতি জবাবে বলে,

“রক্তিম শিকদারের বন্ধুর গায়ে টাচ করার কলিজা নেই কারো। অথচ রক্তিম শিকদারের বোনের হাত ধরার কলিজা ঠিকই আপনার আছে তাই না! খবরটা তো রক্তিম শিকদারের কানে পৌঁছেতে হয়। সে না হয় এসে মেপে দেখল তার বন্ধুর কলিজাটা কত বড়।”

কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যেতে দেখে একটু বিরক্ত হয় মেহেদী। পরপরই বিরক্তি ভাবটা ঝেড়ে ফেলে হাতের জোড়ালো টানে ইতিকে আরো একটু কাছে টেনে নেই। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে দুজনের। প্রগাঢ় অনুভূতির মিশেলে ডাকে মেহেদী,

“এই ইতু!”

ছোট্ট একটা ডাকেই জমে যায় ইতি। মনে জমে থাকা অভিমানটুকু গলতে শুরু করে একটু একটু করে। এই ছেলে আস্ত এক জাদুকর। যখনই ইতি ভাবে একটু রেগে কিছুদিন দূরে থেকে শাস্তি দিবে, ঠিক তখনই এমন করে নিজের জাদুবলে সব ভেস্তে দেয়। কিন্তু এবার তো তাকে গলে গেলে চলবেনা। শক্ত রাখতে হবে নিজেকে। পর পর কয়েকটা ঢোক গিলে শান্ত রাখার প্রয়াস চালায় নিজেকে। চোখ ফিরিয়ে নেয় মেহেদীর থেকে। তৎক্ষণাৎ দুহাতের আজলায় ইতির মুখটা ধরে নিজের দিকে ফিরায় মেহেদী। ব্যকুল হয়ে জানতে চায়,

” এতো নিষ্ঠুর কেন তুমি? আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছো!কি করেছি? আমার অপরাধ কি? কেন এভাবে ইগনোর করছো একবার বলো আমাকে। প্রয়োজনে শাস্তি দাও, মারো। তবুও এভাবে অবহেলা করোনা জান প্লিজ!”

“ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে। তাই এভাবে অবহেলা করছি। উত্তর পেয়েছেন? এবার দয়া করে ছাড়ুন আমাকে। নইলে কিন্তু এখন সত্যি সত্যি চিৎকার করে লোক জড়ো করব।”

বহুকষ্টে নিজের অনুভূতি গুলোকে দমিয়ে শক্ত কন্ঠে জবাব দেয় ইতি। একটু থমকায় মেহেদী। পরোক্ষণে ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটিয়ে বলে,

“মজা করছো না! আরে বাবা তোমার এই মজা যে আমাকে শান্তিতে নিঃশ্বাস টুকুও নিতে দিচ্ছেনা বুঝতে পারছো তুমি? অনেক হয়েছে মজা। এবার এসব থামাও। একটু স্বাভাবিক হয়ে দুটো কথা বলে আমার মনটা শান্ত করো।”

এক ঝটকায় মেহেদীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে পিছিয়ে যায় ইতি। ঝাঝালো স্বরে মৃদু চিৎকারের সাথে বলে,

“আমি তো সবসময় মজা করি। কখনও আমার কোনো কথা তোমার কাছে সিরিয়াস মনে হয়েছে? এক বিন্দু পরিমাণ মূল্য কখনো আমাকে বা এই সম্পর্কটাকে দিয়েছো? যদি দিতে তাহলে আমার কথা একবার হলেও ভেবে দেখতে। এভাবে আমার ভাইয়ের পিছু নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় গুন্ডামি না করে নিজেও ভালো হতে আমার ভাইকেও ভালো হওয়ার পরামর্শ দিতে। কিন্তু কি করছো তুমি? সেই আমি যা নিষেধ করি তাই। একই ভাবে গুন্ডামি আর মাস্তানি। তোমার না আছে নিজেকে নিয়ে ভাবনা না আমাকে আর না আমার ভাইকে নিয়ে। তুমি শুধু মুখেই ভাইয়াকে নিজের প্রাণের বন্ধ বলো। প্রকৃত পক্ষে বন্ধু হলে এভাবে তাকে খারাপ কাজে এপ্রিশিয়েট করতে না। আমাকেও তো ভালোবাসো না। ভালোবাসলে অন্তত আমাকে পাওয়ার চিন্তা তোমার মাথায় থাকত। কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে আমার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই চিন্তা থাকত। কিন্তু কয়? কিছুই তো নেই তোমার মাঝে। তবে কেন শুধু শুধু ভালোবাসতে যাব তোমাকে? যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে না পাওয়ার যন্ত্রণায় নিঃশেষ হতে পারি?”

উত্তরে নিরবতাকেই বেছে নেয় মেহেদী। কিছুই বলেনা। শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তমার অশান্ত রূপ। প্রায় মিনিট পাঁচেক সময় পর ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বলে,

“কোনটাকে খারাপ কাজ বলছো তুমি? রাস্তা-ঘাটে মেয়েদের উত্তক্ত করা বখাটেদের শায়েস্তা করাটা খারাপ কাজ? না কি অসহায় মানুষের গলায় পারা দিয়ে তাদের রক্ত চুষে খাওয়া পিশাচদের শায়েস্তা করাটা খারাপ কাজ? অন্যায়ের প্রতি সোচ্চার হওয়া যদি খারাপ হয় তবে ভালো কি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া?”

“এসবের জন্য দেশে আইন আছে। তোমাদের তো কেউ বিচার করার দায়িত্ব দেয়নি। আইনের লোক না হয়েও অপরাধির শাস্তি দেওয়াটা এক প্রকার অপরাধ।”

তাচ্ছিল্য হাসে মেহেদী। শ্লেষাত্মক স্বরে বলে,

“আইন! হাহ্! কোন আইনের কথা বলছো তুমি? যে আইন সর্বদা টাকার কাছে বিক্রি সেই আইন? যে আইন একটা মেয়ে ধর্ষিত হবার পর এসে তদন্ত করার নামে হাজারটা নোংরা কথা বলে মেয়েটাকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে সে আইন?”

ইতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়না মেহেদী। একটা রিকশা ডেকে ইতির সামনে দাড় করিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় প্রিয়তমার রাগ ভাঙ্গানোর কথা ভুলে। অসহায় নয়নে ইতি শুধু তাকিয়ে দেখে মেহেদীর প্রস্থান। ব্যর্থতার নিঃশ্বাস ছাড়ে বুক ফুলিয়ে।

****

আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেছে দৃষ্টি ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহ নিজের বাড়িতে এসেছে। সাময়িক ছুটি কাটিয়ে আবারও শুরু হয়ে গেছে পড়াশোনা। লেগে গেছে ভর্তি যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার কাজে। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ মন টিকছেনা তার বইয়ের মাঝে। মাথায় কতক্ষণ পর পর কিলবিলিয়ে উঠছে রক্তিম শিকদার নামক প্রেম পোকা। কিছু একটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে সর্বক্ষণ বলছে, “রক্তিম শিকদারের নাম্বার নিজের কাছে থাকতেও এখনো বোকার মতো কিসের জন্য বসে আছিস তুই? যাতে অন্য কোনো মেয়ে এসে তোর আগেই ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে এজন্য?”

দৃষ্টি বিরক্ত। নিজেই নিজের প্রতি চরম ভাবে বিরক্ত। তার এক মন বলে,পড়াই মন দে। ঢাকায় কোনো একটা ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলে কপাল খুলবে তোর। সবসময় তোর হিরোর কাছাকাছি থাকতে পারবি। আরেক মন বলে, দেরি করে লাভ নেই। এখনই মনের কথা বলে দে। এই এক মনের দুই ভাবনা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা তার। না হচ্ছে পড়া আর না হচ্ছে প্রেম। কি করবে সে! বইয়ের মাঝে মাথা ঠেকিয়ে ভাবে কিছুক্ষণ। পর পর ওঠে গিয়ে বিছানায় অবহেলায় পরে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। কল লিস্টে ঢুকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে “My real hero” নামে সেইভ করে রাখা নাম্বারটার দিকে। যে নাম্বারে অসংখ্যবার কল দিতে গিয়েও আবার কেটে দিয়েছে। অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়িয়ে তুসীর নাম্বারে ডায়াল করে। অপরপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই তুসীকে কিছু বলতে না দিয়ে দৃষ্টি হাহাকার করে ওঠে,

“তুসুরে! আমি মরে যাচ্ছি। প্লিজ বাঁচা আমাকে।”

তুসী নিজেও বইয়ের মাঝে ডুবে ছিল। হঠাৎ দৃষ্টির ফোন পেয়ে যতটা না বিরক্ত হয়েছে তার থেকেও বেশি ত্যক্ত তার কথা শুনে। বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত প্রকাশ করে বলে,

“আচ্ছা! তো মর। কখন মরছিস একটু বলে দে এখন। তাহলে আগেভাগেই রওনা দিব আমরা। নইলে ঢাকার যে জ্যাম। দেখা যাবে তোর মুখটা এক পলক আমাদের না দেখিয়েই কবর দিয়ে দিবে। শেষ দেখা দেখতে না পেয়ে পরে আফসোস করতে হবে।”

এহেন জবাবে ফুসে ওঠে দৃষ্টি। রাগ-দুঃখ দুটোর মাঝে পরে দোলাচলে ভেসে বলে,

” হা’রা’মি কু’ত্তা কষে একটা লাথি খাবি তুই। আমি মরে যাচ্ছি আমার যন্ত্রণায়। কোথায় একটু আমাকে শান্তনা দিবে, বুদ্ধি দিবে। তা না করে কখন মরব সেটা জানতে চায়! আমার খালা তোর মতো এমন নিমক হা’রা’মি কিভাবে পেটে ধরল।”

“সেটা তোর খালাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। অযথা আমার কানের কাছে কাও কাও করে মেজাজ নষ্ট করবিনা। পড়ছি। ফোন রাখ।”

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথা গুলো বলে তুসী নিজেই ফোন কেটে দেয়। আশাহত হয়ে তাজ্জব বনে কতক্ষণ বসে থাকে দৃষ্টি। মনে মনে ফুসে ওঠে তুসীকে যা মনে এসেছে তাই বলে বকে ধমকে নিজেকে একটু শান্ত করে। এরপর আবারও মনোনিবেশ করে ফোনে। আগে পরে কোনো কিছু না ভেবেই গানের দুটো লাইন টাইপ করে পাঠিয়ে দেয় নাহিদের নাম্বারে,

প্রেমে পরেছে মন প্রেমে পরেছে,
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে।

ছোট্ট বার্তাটা পাঠিয়ে অদম্য এক আনন্দ হয় দৃষ্টির মনে। প্রাণখোলা হেসে ফুরফুরে মনে আবারও বইয়ে নজর দেয়। জটিল একটা অংকের সমাধান করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। একদম শেষ পর্যায় আসতেই টুং করে নোটিফিকেশন বেজে ওঠে ফোনের। সাথে সাথেই ধরফরিয়ে ওঠে দৃষ্টি। মন ছুটে যায় অংক থেকে। কাজটা নিশ্চয়ই সীম কোম্পানির। এছাড়া আর কারো না। বুকে থুথু দিয়ে সীম কোম্পানিকে বকতে বকতে ফোন হাতে তুলে নেয়। লক খুলে ম্যাসেজ অপশনে ঢুকতেই ছানাবড়া হয়ে যায় চোখ দুটো। রক্তিমের নাম্বার থেকে ফিরতি ম্যাসেজ এসেছে! এ ও সম্ভব! দ্যা গ্রেট গুন্ডা রক্তিম শিকদার নিজের ব্যক্তিত্বের বাইরে গিয়ে দৃষ্টির ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়েছে! বিশ্বাস হয়না দৃষ্টির। নিজেকে সামলে ঝটপট হাতে টাচ করে ম্যাসেজটা পুরোপুরি সো করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অপ্রত্যাশিত এক গানের কিছু লাইন,

‘কীবা তোমার নাম গো কন্যা বাড়ি কোন গেরাম?
গ্রাম ঠিকানা যদি জানিতাম,
আমি তোমার বাড়ি ঘটক পাঠাইতাম।
আমি তোমারে বউ বানাইতাম।’

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে