দৃষ্টির আলাপন পর্ব-৪৪

0
213

#দৃষ্টির_আলাপন
#পর্বঃ৪৪
#আদওয়া_ইবশার

হাতে গুণা চারজন মানুষের পদচারনায় সর্বদা নিশ্চুপ থাকা শিকদার মঞ্জিল আজ নতুন করে আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নাস্তার পর পরই স্মৃতি,ইতি ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে ছুটে এসেছে। স্মৃতির দুই ছেলে-মেয়ে সামিরা-সাদি ইতির সাত মাসের ছোট্ট কন্যা মাইতা কে নিয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। ছোট ছোট তিন বাচ্চার মধুর কলরবে মুখরিত শিকদার বাড়ি। ড্রয়িং রুমে মেহেদী,শান্ত,জাবির, রাকিব,স্মৃতির স্বামী ফাইয়াজ,রক্তিমের সাথে বসে খুশগল্পে মেতেছে।রেহানা বেগম নাতি-নাতনিদের নিয়ে নিজের রুমে খেলতে ব্যস্ত।রান্না ঘরে ব্যস্ত দৃষ্টি। দুই ননদ হাতে হাতে সাহায্য করছে তাকে। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে তিন রমণী ড্রয়িং রুম থেকে হঠাৎ হঠাৎ উচ্চ হাসির শব্দ শুনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে,কি নিয়ে এতো হাসাহাসি করছে তারা। দৃষ্টি দ্রুত হাতে কাজ করতে করতে রক্তিমের প্রতি বিরক্ত হয়ে বিরবির করে বকে যাচ্ছে,

“বেশরম লোক একটা। ছোট বোন জামাই গুলোর সাথে বসে আল্লাহ জানে কি নিয়ে এভাবে হাসাহাসি করছে। সে সম্মন্ধি,ছোট বোনের জামাই গুলোর সামনে তো সে একটু রাখঢাক রাখবে! এমনিতে বোম ফাটালেও মুখ থেকে হাসি বের হয় না। আর আজ! দিন দিন আক্কেল, জ্ঞান সব মনে হয় হাঁটুর নিচে যাচ্ছে।”

দৃষ্টির অস্পষ্ট বিরবিরানি কথা কিছুটা শুনতে পেয়ে মুখ চেপে হাসে ইতি। স্বহাস্যে বলে,

“ভাবি! আমার ভাইয়ের বোন জামাই হবার আগেই ওরা একে অপরের প্রাণের বন্ধু। বন্ধুত্বে কোনো বাধা,দ্বিধা থাকেনা। এটা কি ভুলে গেছো?”

কড়াইয়ে ভাজি করার জন্য একটা একটা মাছ ছাড়তে ছাড়তে দৃষ্টি কপাল কুঁচকে জবাব দেয়,

“মেহেদী ভাই না হয় তার বন্ধু, তাই তার সাথে এমন দাঁত কেলিয়ে হি হি হা হা করে হাসে। কিন্তু ফাইয়াজ ভাই! ওনি তো আর তার বন্ধু না। ওনার সামনে তো অন্তত একটু সম্পর্ক বিবেচনা করে কথাবার্তা বলবে না কি?”

এবার জবাবটা স্মৃতিই দিয়ে দেয়,

“ফাইয়াজ নিজেই তো লাগামছাড়া মানুষ। ভাইয়া ওর সামনে কথাবার্তা মেপে মেপে বললেও ও ঠিকই বেফাঁস কথা বলতে দ্বিধা করবেনা। এমন এমন কথা বলবে,না হাসিয়ে ছাড়বেনা। লজ্জা-শরম আমার ভাইয়ের ঠিকই আছে। কিন্তু আমার আহাম্মক জামাইয়ের নাই।”

ওদের কথার মাঝ পথেই হুট করে ইতির মেয়ে মাইতার গগণ ফাটানো চিৎকারে চমকে ওঠে সকলেই।হাতের কাজ ফেলেই দৌড় লাগায় কি হয়েছে দেখার জন্য। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা ছেলেরাও ছুটে যায় তৎক্ষণাৎ। রেহানা বেগমের রুমে মেঝেতে বসে স্মৃতির ছেলে-মেয়ে দুটো একটা আরেকটার চুল ধরে টানছে। এইটুকু বাচ্চা দুটোর শক্তির কাছে রেহানা বেগম একদম পেরে উঠছেনা। কোনোভাবেই ছাড়াতে পারছেনা একজনকে আরেকজনের থেকে। উল্টো ছাড়াতে গেলেই দুটোই দাঁত খিঁচিয়ে অধিক বল প্রয়োগ করে আকড়ে ধরছে একজন আরেক জনের চুল। তা দেখেই বিছানায় খেলনা গাড়ি নিয়ে বসে থাকা মাইতা ভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে। বাচ্চাদের এমন পরিস্থিতি দেখে ভড়কে যায় প্রত্যেকেই। মেহেদী ছুটে এসে নিজের মেয়েকে কোলে তুলে শান্ত করার জন্য বাইরে চলে যায়। ফাইয়াজ,রাকিব সামিরা-সাদিকে টেনে আলাদা করে। দৃষ্টি বড় বড় চোখ করে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই বাচ্চা দুটোর রুষপূর্ণ মনোভাব দেখে যাচ্ছে। রাকিব সামিরাকে জোর করে কোলে নিতে গেলেই তার হাতে দাঁত বসিয়ে দেয় সামিরা। তৎক্ষণাৎ তীব্র ব্যাথায় কোঁকিয়ে উঠে সামিরাকে ছেড়ে দেয় রাকিব। তড়িৎ রুম থেকে ছুটে পালায় সামিরা। ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় উপস্থিত প্রত্যেকে। হাত ঝারতে ঝারতে রাকিব চোখ-মুখ কুঁচকে বলে,

” এতোটুকু একটা বাচ্চা মেয়ের দাঁতের কি শক্তি রে ভাই! বিচ্ছুর দল!”

নিজের ছেলে-মেয়েকে নিয়ে এমন বাক্য শুনে কিছুটা থমথম খেয়ে যায় স্মৃতি। কটমট দৃষ্টিতে ফাইয়াজের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট ভাবে বলে,

“শুধু তোমার জন্য আজ আমার বাচ্চা দুটোর এমন পরিণতি। ওদের আদরে আদরে এরকম বাঁদর বানানোর জন্য দায়ী একমাত্র তুমিই। এখন তো খুব আনন্দ লাগে বাচ্চাদের এরকম আচরণে। বড় হবার পরও যখন এমন করবে আর বাইরে থেকেও মানুষ ঘরে বিচার নিয়ে আসবে, তখন দেখব তোমার হাসি হাসি মুখ কোথায় যায়।”

বলেই হনহন পায়ে মেয়েকে খোঁজতে চলে যায় স্মৃতি। ইতি ছুটে গিয়ে বরফ এনে দেয় রাকিবের হাতে লাগানোর জন্য। দাঁত বসে যাওয়া জায়গা টুকু থেকে অল্প অল্প রক্তের ফোটা পরতে দেখে রক্তিম কিছুটা চিন্তিত স্বরে বলে,

“ডাক্তারের কাছে যা। রক্ত পরছে। ইনফেকশন হতে পারে।”

“আরেহ! কিছুই হবেনা।”

রাকিবের নিষেধ কেউ মান্য করেনা। বর্তমান সময়ে এমনিতেই রোগের অভাব নেই। ছোট্ট একটা আঘাতেও বড় ধরনের রোগ বেধে যায়। সব জানার পরও রিক্স নেওয়ার কোনো কথায় আসেনা। জোর করেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় রক্তিম।এমনিতে ঘরে বাচ্চা থাকলে সবসময় একটা সুন্দর অনুভূতি কাজ করে। তাদের দুষ্টু দুষ্টু কান্ড দেখলে শত মন খারাপও ভালো হয়ে যায়।কিন্তু বাচ্চা গুলো যদি হয় একরোখা,জেদি আর ইতর প্রকৃতির, তবে অশান্তির শেষ থাকেনা। তাদের পিছনে দৌড়ে, তাদের সামলাতে গিয়ে ঘরের অন্যান্য সদস্যদেরও মাঝে মাঝে আঘাতপ্রাপ্ত হতে হয়। দৃষ্টির ছোট থেকেই বাচ্চাদের প্রতি অন্যরকম একটা টান কাজ করে। দুষ্টু বাচ্চাদের সাথে অনেক সময় সে নিজেও বাচ্চাদের মতোই দুষ্টুমিতে মেতেছে। কিন্তু অতিরিক্ত দুষ্টুমিপণা বাচ্চা গুলো দৃষ্টির অপছন্দের তালিকায়। বড় ননদের কিউট কিউট ছেলে-মেয়ে দুটোকে প্রথম প্রথম তার খুব ভালো লাগলেও, তাদের সাথে মিশতে গেলেও আস্তে আস্তে তাদের এসব বাঁদরামি দেখে এখন সে নিজেই দূরত্ব বজায় রেখে চলে। সামিরা, সাদি দুজনেরই অন্তত বাজে একটা স্বভাব হলো, কারো সাথে নিজেদের মতের মিল না হলেও তারা হুট করে তাদের কামড়ে দিয়ে দৌড় লাগাবে। মূলত এই স্বভাবটা জানার পর থেকেই দৃষ্টি তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ঔদ্ধত্য দেখে মনে মনে বড় ননদকেও দোষারোপ করতে ভুলেনা। বাচ্চারা শিখে তো বড়দের থেকেই। তারা হয় কাঁদা মাটির মতো। বাবা-মা, আশেপাশের পরিবেশ তাদের যা শিখাবে তারা সেটাই শিখবে। স্মৃতি আপু কি একটুও ভদ্রতা শিখাতে পারেনা বাচ্চা দুটোকে?বয়স তো তাদের খুব কমও না। দুটোই ক্লাস টু তে পড়ছে। পিঠাপিঠি হওয়াই দুজনকে একই সাথে এক ক্লাসে ভর্তি করানো হয়েছে। এখনই তো সহবত শিখানোর সঠিক সময়। এই সময় চলে গেলে কি আর বাচ্চারা আচার-আচরণ পরিবর্তন করবে? অসন্তুষ্ট চিত্তে দৃষ্টি মাথা নেড়ে শাশুড়ির কাছে যায়। নম্র স্বরৈ জানতে চায়,

“আপনি কোনো ব্যাথা পাননি তো মা?”

নাতি-নাতনিকে সামলাতে গিয়ে ব্যাথা পেলেও কি আর পুত্রবধূর কাছে সেই কথা বলে নাতি-নাতনিদের বদনাম হতে দেওয়া যায়? তড়িৎ মাথা ঝাকিয়ে না জানায় রেহানা বেগম,

“আমি ঠিক আছি। তুমি যাও, কাজ গুলো গুছিয়ে নাও। দুপুর হয়ে আসছে। খেতে দিতে হবে তো ছেলে গুলোকে।”

উপর নিচ মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে আড়চোখে একবার ফাইয়াজের কোলে থাকা সাদির দিকে তাকিয়ে রুম ত্যাগ করে দৃষ্টি। নিচে গিয়ে দেখতে পায় ইতি, মেহেদী দুজন মেয়ের কান্না থামিয়ে খেলছে মেয়ের সাথে। ছোট্ট মাইতাও কি সুন্দর বাবা-মায়ের কথার তালে দন্তহীন মাড়ি বের করে মন শীতল করা হাসি হাসছে!ছোট্ট,পবিত্র প্রাণের ঠোঁটে এমন পবিত্র হাসি দেখলে কারো মন খারাপ কি অবশিষ্ট থাকতে পারে? বাচ্চা মেয়েটার খিলখিল হাসির শব্দে দৃষ্টির ঠোঁটের কোণেও এক চিলতে হাসির রেখে দেখা দেয়। প্রফুল্লচিত্তে পা বাড়ায় রান্না ঘরের দিকে।

***
দুপুরের খাওয়া শেষে ছেলেদের সাথে মেয়েরাও ড্রয়িং রুমে আড্ডায় বসেছে। রক্তিম এই অর্ধদিনেই বহুবার দলীয় কাজে বাইরে যাওয়ার পাইতারা করলেও বোন,বন্ধুদের নিষেধাজ্ঞা আর বউয়ের শাণিত দৃষ্টির কাছে হার মেনে আজকের পুরো দিনটা সব কাজ-কর্ম একপাশে রেখে পরিবারের সাথেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। গল্পগুজবের এক ফাঁকে হঠাৎ রক্তিম বলে উঠে,

“ভাবছি কোথাও থেকে ঘুরে আসব। মেহেদী সব ঠিকঠাক করিস তো।”

আকস্মিক রক্তিমের এমন কথায় অত্যধিক আশ্চর্য হয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয় প্রত্যেকে। ভূত দেখার মতো করে তাকিয়ে থাকে রক্তিমের দিকে। উপস্থিত প্রত্যেকের এমন হতবাক দৃষ্টি তার দিকে পরতে দেখে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায় রক্তিম। একটু নড়েচড়ে বসে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়,

“হোয়াট?তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন আমার দিকে?”

গালে হাত রেখে রক্তিমের দিকে অপলক তাকিয়ে রাকিব জবাব দেয়,

“দেখছি ভাই।”

এহেন কথায় রক্তিম কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় অত্যধিক বাজে ভাবে কুঁচকে নেয়। ভরাট কন্ঠে জানতে চায়,

“কি দেখছিস?”

আগের অবস্থানে থেকেই রাকিব জবাব দেয়,

“দেখছি আপনার পা দুটো উল্টো ঘুরে আছে কি না। না মানে, যদি আপনার পা উল্টো ঘুরে থাকে তাহলে ভেবে নিব এটা আপনি না, আপনার বেশ ধরে আসা কোনো এক জ্বিন। দাদুর মুখে শুনেছি জ্বিনদের পা না কি উল্টো হয়ে থাকে। আর যদি আপনার পা ঠিকঠাক থাকে, তবে ভেবে নিব জ্বরে আপনার মাথা গেছে পুরোপুরি।”

রাকিব কথা শেষ করতেই মেহেদী রক্তিমের পায়ের দিকে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে কিছু একটা পরখ করে ভাবুক স্বরে বলে,

“পা তো একদম ঠিকঠাক। কোনো জ্বিন-টিন না রে রাকিব। এটা ঠিকই আমাদের রক্তিম। তোর দ্বিতীয় কথায় মনে হয় ঠিক। একদিনের জ্বরেই একেবারে মাথা গেছে।”

মেহেদীর কথার প্রেক্ষিতে ফাইয়াজ বলে উঠে,

“আরে ভাইরা সাহেব, বিয়ে করেও এখনো আসল কাহিনী বুঝেন নি না কি? বিয়ের আগে ছেলেরা যেমন-তেমক থাকুক না কেন। বিয়ের পর ঠিকই নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে অনেক কিছুই করতে হয় তাদের। এই যেমন আমাদের ভাইজানের ইচ্ছে করছে বউকে নিয়ে হানিমুনে যেতে। কিন্তু ভাইজান তো আবার সরাসরি হানিমুনের কথা বলতে পারেনা পরিবারের কাছে। তাই আর কি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আমাদের কাছেই বলছে।”

কথা শেষ হতেই এক সুরে হেসে উঠে প্রত্যেকেই। দৃষ্টিও হাসে আড়ালে মুখ লুকিয়ে। সবার এমন কান্ডে রক্তিম মহা বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,

“ফ্যামিলি ট্রিপের কথা বলেছি আমি।”

মেহেদী টিপ্পনী কেটে জবাব দেয়,

“ঐ একই হলো। ফ্যামিলি ট্রিপের উছিলায় হানিমুনটাও সেড়ে ফেলা যাবে। কোনো টেনশন নিবেন না এমপি সাহেব।সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি শুধু নিজের মহা মূল্যবান সময়ের থেকে হানিমুনের জন্য কিছুটা সময় বের করে নিন।”

কি বেহায়া এক একটা! ভাই-বোন, বন্ধু,বউ সব একসাথে বসে এ কেমন মজা শুরু করেছে? দৃষ্টি আগে ভাবতো,আর যায় হোক,মেহেদী অন্তত একটু লাজুক প্রকৃতির হবে। তাকে সবসময় যেভাবে ছোট বোনের মতো ট্রিট করে, সেই বোন সমতুল্য বন্ধুর বউকে নিয়ে সে অন্তত কোনোদিন ঠাট্টা-মশকরা করবেনা।কিন্তু আজ যে স্বরুপ দেখালো!নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ জপতে জপতে দৃষ্টি তড়িৎ উঠে যায় সবার মাঝ থেকে। আড় চোখে তাকিয়ে দৃষ্টিকে লজ্জারাঙা মুখে প্রস্থান করতে দেখে অস্পষ্ট হাসে রক্তিম।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে