দূর আলাপন পর্ব-১৪+১৫

0
182

দূর আলাপন ~ ১৪
___________________________
কথা ছিল এই মাসের শেষে ফিরবে নিনাদ। এরই মধ্যে শিউলি নিনাদের বাড়ির তালা খুলে সেখানে উঠেছেন। আর দেরি নয়। মেয়ে পছন্দ করাই আছে। এদিকে সব গুছিয়ে রাখবেন তিনি। ছেলে দেশে ফিরলে কোনরকম বিলম্ব না করে তিন কবুল পড়িয়ে দেয়া হবে। শিউলির সঙ্গে আছে আফরিন। নিনাদ ভাইয়ের বিয়ে অথচ সে থাকবে না এমন হতে পারে কখনো?

ভাতিজিকে নিয়ে শহরে এসে একটু গুছিয়ে উঠতেই শিউলির মন উচাটন হয়ে ওঠে বিয়ের চিন্তায়। ঠিক করলেন যাবেন নিনাদের বন্ধুর বাড়ি। তিহা ও তার পরিবারের সঙ্গে নিনাদের নিখাত বোঝাপড়ার ব্যপারটা শিউলি যারপরনাই অবগত। তাছাড়া ওরা সব এ যুগের ছেলেমেয়ে। বিয়ের সাজপোশাকে কোন জিনিসটার চল এখন, ওরাই জানবে ভালো। নিনাদের বিয়ের ব্যাপারে তিহার পরামর্শ নেয়া শুধু সৌজন্যতা নয় জরুরিও বটে। এক বিকেলে তিহাকে খবর দিয়ে ভাতিজিকে সঙ্গে নিয়ে শিউলি বেড়িয়ে পরলেন ওদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

——————-

তখন মধ্যদুপুর। জোহরের সালাত শেষে তিতিক্ষা কুরআন তিলাওয়াতে বসেছে। বৈশাখের উত্তপ্ত দিনগুলো কেটে যাচ্ছে সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে। শিথিল সবকিছু, জীবন, জীবনের খেয়াল আর তার গতি। দুপুরের গাঢ় সোনালি রঙের রোদ হেলে পড়ে বারান্দায়। বারান্দার দোরের গা ঘেঁষে বসে তিতিক্ষা আনমনে গায়ে মাখে রোদ। রোদে আগুনের হলকা। যেন শুধু সোনালি আলো নয়, উত্তপ্ত অনলের কণা ছড়াচ্ছে দুপুরের বাতাস। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তিতিক্ষার কপালে। সে তবু নির্বিকার, একমনে আচ্ছন্ন সুরে পড়তে থাকে কুরআন। মাঝে মাঝে মুখ শুকিয়ে এলে দু’দন্ড থেমে তাকায় বাইরে। দায়সারা ভাবে দেখে বারান্দায় তিড়িংবিড়িং নেচে বেড়ানো, অনবরত কিচিরমিচির করতে থাকা একদল চড়ুইকে। তারপর মুখ ফেরায় আবারো। এই ভীষণ উপেক্ষা বোধহয় চড়ুই দলের পছন্দ হয় না। ওরা হাঁকডাক বাড়িয়ে তোলে। তিতিক্ষা অবশ্য আর ফিরেও তাকায় না। দুপুর রঙের পাখিরা বিস্ময় নিয়ে দেখে কি নির্দয় নিষ্ঠুর মন মেয়েটির!

একসময় পড়া থামিয়ে দেয়ালে কাঠের তাকে কুরআন তুলে রেখে, আবারো পূর্বের জায়গায় মেদুর পায়ে ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে পরে নিচে। ঠান্ডা মেঝেতে শরীর এলিয়ে খুব ধীরে ধীরে শ্রান্তির নিশ্বাস ছাড়ে তিতিক্ষা। চোখ বুজে পড়ে রয় অনেকক্ষণ। একসময় তিহা এসে বোনের অবিমিশ্র তন্দ্রায় ছেদ ঘটায়। পাশে বসে কোলের ওপর তিতিক্ষার মাথাটা তুলে নিয়ে আঙুল বুলোতেই ও চোখ মেলে। মাথার ওপর ঝুঁকে থাকা তিহার মলিন মুখে ম্লান হাসি। হাতে থাকা ক্রিমটা নিয়ে আস্তে আস্তে বোনের মুখের কাটা দাগ গুলোর ওপর মেখে দেয়। যন্ত্রণায় তিতিক্ষা একবার মুখ কোঁচকায়।
‘জ্বালা করছে?’
তিতিক্ষা নিরুত্তর।

‘একটু পর আর জ্বালা করবে না।’

‘ছেড়ে দাও বুবু।’

‘তা বললে কি হয়? ওষুধ না মাখলে যে ইনফেকশনের ভয়।’

কিয়ৎকাল নিরব থেকে তিহা পুনরায় বলে, ‘তিতি, একটা কথা বলব?’

‘বলো’

দু দন্ড ইতস্তত করে তিহা,’বাসায় দুজন মেহমান আসার কথা বিকেলে। আজ একটু বোনের বাধ্য হয়ে থাকতে হবে। কোনো এলোমেলো আচরণ করা যাবে না, কেমন?’

তিতিক্ষা এবার স্পষ্ট করে চোখ মেলে। সারা মুখে ছড়িয়ে যায় মৃদু সহজাত হাসির আভা, ‘আমি তোমাদের খুব জ্বালাই। তাই না বুবু?
কোন ভদ্র বাড়িতেই বোধহয় অতটা অনাচার কেউ সহ্য করতো না।’

তিহা কিঞ্চিৎ হতবাক হয়। আজকাল তিতিক্ষার মন মস্তিষ্ক প্রায় সারাক্ষণই উত্তপ্ত থাকে। আচার আচরণের অসংলগ্ন তো রয়েছেই, তাই ওর সামনে কথা বলার ব্যপারে অত সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বিষয় আজকাল তিহা খেয়াল রাখে না। কথা পছন্দসই না হলে তিতিক্ষা অভিমান করবে, এমন সম্ভবনা নেই বলে।
কিন্তু আজ…..

উত্তর না পেয়ে তিতিক্ষা আবারও বলে,’আচ্ছা বুবু, তোমার ক্লান্ত লাগে না? দিনরাত একটা পাগল মেয়ের সঙ্গে থাকো, নিরবে সমস্ত অত্যাচার সহ্য করো। আমি হলে কখনো পারতাম না জানো?’
তিহা এবারেও কথা বলল না। বোনের মুখপানে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে। অনেক অনেকদিন পর তিতিক্ষা নিজ থেকে কথা বলছে ওর সঙ্গে। এই তীক্ষ্ণ গহন চাহুনি, ধীর শান্ত মুখ কতকাল দেখেনি তিহা। আজ ও কথা বলুক, তিহা শুধু শুনবে।

‘বিকেলে কারা আসবে বুবু?’

‘তোর শিউলি ফুআম্মা আর আফরিন।’

‘আফরিনের কি বিয়ে হয়েছে?’ দেয়ালের পানে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করে তিতিক্ষা।

‘হ্যাঁ’

কিছুকাল স্তব্ধতা।

‘ইন শা আল্লাহ আমি কিছু করব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’

তিতিক্ষার কথায় কেন যেন হঠাৎ চোখে জল এলো তিহার। বাষ্পরূদ্ধ স্বরে বলল, ‘সবসময় কেন এমন থাকতে পারিস না বলতো?’

‘চাই তো। কিন্তু… পারি না যে…
মাথার ভেতর কি যেন হয় হঠাৎ হঠাৎ… বোধহয় একটা পাজি পোকা কামড় বসায় কুট করে। আর তারপর শত চেষ্টায়ও আমি আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারি না।
আমার সমস্যা টা তুমি, তোমরা কেউ কখনো বুঝবে না বুবু। যার জীবনে অমন বিষাক্ত কালো অধ্যায় নেই তারা কেউ কোনোদিন বুঝবে না। মাঝে মাঝে কি ইচ্ছে হয় জানো? শিরার রগটা কেটে সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাই। একা ঘরে আমি তন্দ্রার মতো সুখের মাঝে মরব। আশেপাশে বাধা দেয়ার মতো কেউ থাকবে না। কিন্তু… এরপরই মনে হয়, ইচ্ছে হলেই মরে যাওয়াটা আসলে একটা বোকা সিদ্ধান্ত। যারা স্ব ইচ্ছায় মরে তাদের না থাকে ইহকাল আর থাকে পরকাল বলে কিছু। আল্লাহ কে পাওয়ার শেষ আশাটুকুও সেই মৃত্যুর সাথে সাথে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এরচেয়ে বাজে আর কিছুই হয়না। তাই আমি কখনো আত্মহ ত্যা করবো না বুবু, বুঝলে?’

‘কিসব উল্টোপাল্টা কথা বলিস তুই! চুপ কর…
তোর কোনো অপরাধ নেই, একথা আমরা সবাই জানি। তবে তুই কেন মরার কথা বলিস?’ বলতে বলতে জল গড়ায় তিহার গাল বেয়ে।

‘অপরাধ হয়তো নেই কিন্তু অপবাদ ষোলোআনা আছে। তোমার হাজার প্রতিরোধের পরেও যা ঠিকই আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কষ্ট হয়। বছরের পর বছর ধরে অর্জিত সম্মান মানুষ হারিয়ে ফেলে কত অল্প সময়ে! একটা অভাবিত ঘটনা বদলে দিতে পারে কতকিছু। দুনিয়াটা যে কত ঠুকনো আজকাল বেশ ভালো বুঝতে পারি। মানুষ শুধু সেটুকুই বিশ্বাস করে যেটুকু তারা চোখে দেখে। এর বাইরে আর কিছুই যেন সত্যি হবার নয়। একসময় আমাকে তারা সমাজের আর দশটা মেয়ের আদর্শ বলে স্বীকার করত অনায়াসে। যখন সব আধুনিকার মাঝে একা আমি ছিলাম অন্তঃপুরবাসিনী। এখন আমাকে মেয়ে জাতের কলঙ্ক বলেও স্বীকার করে অনায়াসে। যখন তাদের সামনে অভিসারিণী বলে প্রমানিত হলাম আমি।’

‘কিন্তু তোর কোনো ভুল তো নেই… তবু কেন যে আল্লাহ এতবড় পরীক্ষায় ফেললেন…’তিহার গলায় বাজে আফসোসের সুর। তিতিক্ষা নির্বিকার।

সহিষ্ণু কণ্ঠে বলে,
‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতীত কিছু চাপিয়ে দেন না বুবু। সব কষ্টেরই দাওয়াই আছে আল্লাহর কালামে। সেজন্যই বিশ্বাসীরা কুরআন থেকে প্রশান্তি পায়। আজ আমার ওপর যে পরীক্ষা এসেছে কুরআনে তারও নিয়ামক নেই ভেবেছো? পূর্ববর্তী যুগে আল্লাহর এক প্রিয় বান্দিকেও তো এভাবেই সমাজের রোষানলে পড়তে হয়েছিল, কোনো অপরাধ ছাড়াই। একান্ত ভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন মারইয়াম যখন কোনো পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়া অলৌকিক ভাবে গর্ভবতী হলেন তখন তাকে সমাজ থেকে দূরে যেতে হলো নিজেকে আড়াল করার জন্য। একা একজন মেয়ে, জীবনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সময়ে যার পাশে কেউ নেই। বিরান স্থানে একা খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে তিনি তখন কষ্টে কি বলছিলেন জানো?
❝হায়, আমি যদি এর আগেই মরে যেতাম আর মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম❞

মারইয়াম আলাইহিসসালামের দুঃখের মাত্রাটা তুমি অনুভব করতে পারো বুবু? আল্লাহ চাইলেন তার মাধ্যমে এক অলৌকিক ঘটনার সৃষ্টি হবে। যুগে যুগে মানুষকে যা বিস্ময়াভিভূত করবে কিন্তু মারইয়াম যে সাধারণ এক মানুষ, তারও যে আছে মানবীয় দুঃখ কষ্ট। যা সইতে না পেরে তিনি উপরিউক্ত কথা বলেছিলেন।
তাছাড়া যে যন্ত্রণা তিনি ভোগ করছিলেন তা লাঘব হবারও কোনো পথ ছিল না কারণ সন্তান জন্মাবা মাত্র সেই সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কলঙ্কিত করা হবে মারইয়ামের চরিত্রকে। অথচ এই পুরো ঘটনায় তার কোনো হাত নেই!

মারইয়ামের এই মানবীয় দুর্বলতাকে কিন্তু মহান রব তিরস্কার করেননি। বরং ফেরেশতা জিবরিল আলাইহিসালাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে মারইয়ামকে জানিয়েছিলেন,
❝তুমি দুঃখ করো না❞

এবার তুমি বলো বুবু, আমার দুঃখ মারইয়ামের দুঃখের তুলনায় কতটুকু? তবু কি আমি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হবো না? আফসোস করবো আল্লাহ আমার ওপর পরীক্ষা আরোপ করেছেন বলে?

তিহা বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক। এত সুন্দর করে কথা বলা কোথা থেকে শিখল মেয়েটা? ছোট বেলা থেকেই তো ছিল ভীষণ গম্ভীর। কারো সঙ্গে বেশি মিশতো না… কথা বলতো না… দিনরাত নিজের মনে একা একা খেলতো। একটি প্রশ্নের উত্তর শুধু একটি শব্দেই দিত। তখনো মাঝে মাঝে ঠিক এভাবে গুছিয়ে খুব সুন্দর কিছু কথা সে বলতো। তার সেসব অল্প কিন্তু আকর্ষণীয় কথা শোনার জন্য বাবা চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে থাকতেন। তিতিক্ষার সব কথাই বাবা গভীর আবেগ নিয়ে শুনতেন। শুনতেন কারণ তিতিক্ষার মাঝে মায়ের ছায়া প্রবলতর ভাবে ছিল বলে। যখন ও কথা বলতো, হাসতো খিলখিল করে তখন যেন মায়েরই পূর্ণ প্রতিচ্ছবি দৃশ্যতঃ হতো ওর মাঝে।

কিন্তু মায়ের সব সৌখিন স্বভাব গুলো অমন নিখুঁত ভাবে তিতিক্ষা নিজের মধ্যে ধারণ করল কেমন করে? মা যখন মারা গেলেন, তখনো ও কেবল কোলের শিশু। তবুও মায়ের সেই দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা, সেই একগুঁয়ে স্বভাব আর রেগে যাওয়া কপালের বক্র কুঞ্চন… সব পেয়েছে তিতিক্ষা। পরিপূর্ণ ভাবেই পেয়েছে। তিতিক্ষা যখন রাগে, যখন ওর চোখে জলের আভাস দেখা দেয়, তিহার মনে পড়ে বহু বছরের পুরনো এক দৃশ্য। ঝাপসা হয়ে আসা মায়ের স্মৃতি। চলায়, বলায় তিতিক্ষা যেন আদতেই তাদের মা আয়েশা রেহনুমার প্রতিচ্ছবি।

গভীর মমতায় বিগলিত হয়ে বোনের মাথায় হাত রাখে তিহা। চোখ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়ায়, তিহা বলে, ‘এইতো মায়ের আদর্শ মেয়ের মতো কথা। এমন করে কতকাল তুই কথা বলিস না আপু। তোর বোকাসোকা অজ্ঞ বোন কত কি ভুলভাল কথা বলে ফেলে, তুই ই তো সবসময় তাকে ঠিক টা চিনিয়ে দিতি। তাওয়াক্কুল হারিয়ে ফেললে নতুন করে মনের আশার আলো সঞ্চার করতি। কেন আগের মতো হয়ে যাস না?’

_____________________

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শিউলি ফের একবার নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখলেন। বিরক্তিতে কপালে ভাজ পড়ল। বিকেলটা প্রায় গড়িয়েই গেল। আর কখন যাওয়া হবে? আফরিনের সাজগোছ মনে হচ্ছে অন্তত কাল ধরে চলবে। এবার একটা কড়া গলায় ধমক দেয়া দরকার। ঢাকা শহরের কতটুকুই আর তিনি চেনেন। যেটুকু চেনেন, সন্ধ্যা নামার পর সেটুকুও গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল। অথচ সব জেনেও ওই বিলাসী মেয়ে এখন বিয়ের বাড়ির সাজ সাজতে বসেছে। চরম বিরক্ত হয়ে শিউলি তীক্ষ্ণ তানে চেচালেন।

ভেবেছিলেন পুনরায় বাসার ভেতরেই যাবেন, কান ধরে টেনে নিয়ে আসবেন বদ মেয়েকে। তার আগেই দেখা গেল মেয়ে রিনঝিন শব্দ তুলে দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ মনোযোগ দিয়ে দরজায় তালা দিচ্ছে। শিউলি আড়চোখে তাকালেন। গাঢ় নীল জমিনের ওপর সাদা, গোলাপি নকশাদার শাড়ি, আচঁলের টার্সেলে ঝুনঝুনি জাতীয় কি যেন লাগানো। যখনি ও হেলছস দুলছে, মৃদু লহরে ঝনঝন শব্দ বাজছে। দুহাত ভর্তি রেশমি চুড়ি, পুরূ লম্বা বেণি পিঠের ওপর শান্ত ভাবে হেলে আছে। মেয়েটাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। তবে আজকের উপলক্ষের সঙ্গে এই সাজগোছ কিঞ্চিৎ বেমানান। গ্রামের মেয়ে, সাজপোশাক নিয়ে অত জ্ঞান থাকার কথা নয়। তবু মেয়েটাকে সাজলে ভালোই লাগে কিন্তু কোথায় কোন জিনিসটা মানানসই সে জ্ঞান একেবারে নেই।

আফরিন অবশ্য অনেকক্ষণ ধরে হাসছিল মিটিমিটি। একটা ছেলেমানুষী দুষ্টুমির ফন্দি এঁটেছে ও, তাই ভেবে এত হাসি। নিনাদকে নিষেধ করেছিল বিয়ের খবর টা ওবাড়িতে এখন জানাতে। আফরিনের ইচ্ছে নতুন বউদের সেজেগুজে তিতিক্ষাদের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে সবাইকে বিয়ের খবরটা দিয়ে চমকে দেবে।

শিউলি গম্ভীর হয়ে ভাতিজির পানে তাকালেন,’হইসে অত নিটকাইস না। বিয়াইত্তা মাইয়া। কোনো লাজ শরম নাই। নিজের বিয়ার খবর নিজে ঢাকঢোল পিটায়া কইবার খুশিতে নিটকাইতাসে কেমনে দেহো! পিড়িত কইরা তো মিনহাইজ্জার মাথাডা খাইসস। সাথে কি এহন নিজের লাজ শরমও গিলা খাইসস? চল!’

ফুআম্মার কাছে একটা রাম ধমক খেয়েও আফরিনের হাসি মুখ মলিন হল না। শিউলির পিছু পিছু রাস্তায় বেরিয়ে এমনকি মোহাম্মদপুর থেকে ঝিগাতলা আসবার সারা পথে সে তার নির্লজ্জ হাসি বহাল রাখল।

.

ঘরের বাইরে শিউলিকে দেখে বহুদিন পর হাসিতে ঝলমলিয়ে ওঠে তিহার মুখ।
‘এইতো এসে গেছে! আসসালামু আলাইকুম ফুআম্মা।’

-‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছোস তোরা? তোর বুড়াটা কই?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। বুড়া কই আবার! কাছেপিঠেই আছে। অনেকদিন পর এলেন তো। একটু লজ্জা পাচ্ছে বোধহয়। তাই ভদ্রতা দেখিয়ে আড়ালে আছে আরকি। দুটো মিনিট পার হতে দিন, কোথায় উড়ে যাবে ওর লজ্জাফজ্জা! দেখবেন কেমন মাথায় উঠে নাচে।’

বলতে বলতে শিউলির পেছনে আফরিনকে দেখে উচ্ছ্বাসে চেচিয়ে ওঠে তিহা,’ আরে আফরিন! ফুআম্মার আড়ালে কেন? এসো এসো সামনে এসো দেখি। বাহঃ কি মিষ্টি দেখাচ্ছে! ঠিক নতুন বউদের মতো। তা নতুন বউ বউ ঘোরটা বুঝি এখনো কাটেনি তোমার?’

আফরিন চমকে তাকাল। দপ করে নিভে গেল মুখের হাসি। তার এত বারণের পরও নিনাদ ভাই তাহলে এদেরকে সত্যিটা বলে ফেলেছে! বাচ্চাদের মত ভ্রুকুটি করে গোমড়া মুখে বলল,’ধ্যাৎ! আমি ভাবছিলাম সারপ্রাইজ দিমু। নিনাদ ভাই সমসময় এমন করে আমার সাথে। দেখছো চাচি, নিনাদ ভাই ঠিকি কয়া দিসে। দেশে আসুক শুধু, নিনাদ ভাইয়ের একদিন কি আমার একদিন…’

আফরিনের ছেলেমানুষী দেখে তিহা হেসে ফেলে, ‘রাগ করো না আফরিন। নিনাদটা কেমন মাথামোটা জানোই তো। ওর কি কিছু খেয়াল থাকে?’

নিনাদকে মাথা মোটা বলায় আফরিন অতন্ত্য আনন্দিত হল। ওপর নিচ মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক কইছেন। নিনাদ ভাইয়ের মাথা পুরাডাই গোবর পোড়া। আইচ্ছা থাউক, মাফই কইরা দিলাম।’

আফরিনের ভীষণ কথাটা শুনে শিউলি কটমট করে তাকালেন,’বেত্তমিজ মাইয়া চুপ কর। সামনে তো আমার নিনাইদ্দারে বাঘের মত ডরাস। আর পিছনে বয়া এমনে বেত্তমিজি করস? আয়ুক এইবারে নিনাইদ্দা। তোর বহুত বাড় বাড়ছে। বিয়া অইসে দেইখা কি হইছে? মাফ পাইবি ভাবসস?’

ফুআম্মার শাসানিতে বোধহয় একটু ভয় পেল আফরিন। ছটফটানি বন্ধ করে স্থির রইল খানিকক্ষণ। তারপরই ছোটনের সঙ্গে মিশে পুনরায় ফিরে গেল আগের রূপে।

ফুফু ভাতিজির মিষ্টি ঝগড়া উপভোগ করছিল তিহা। সহসাই হুশ হলো, অতিথিদের নাশতার ব্যবস্থাও একা হাতে ওকেই করতে হবে। হাসি থামিয়ে বিব্রত ভাবে তিহা বলল,’ফুআম্মা বসুন আমি একটু আসছি…’
আশেপাশে কৌতুহলী চোখ বুলিয়ে তখন কাউকে একটা খুঁজছিল আফরিন। না দেখে শাড়িতে আঙুল পেচাতে পেচাতে উঠে দাঁড়াল। পিছু ডাকল তিহাকে,’আপু… ছোট আপু কই? ওনারে যে দেখলাম না একবারো।’

চলতে চলতে তিহার পা জোড়া থামে। পেছন ফিরে একফালি কাষ্ঠ হাসি ছুড়ে দেয় চঞ্চলা মেয়েটির দিকে। তিহা জানতো আজ অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। উত্তর তৈরিই ছিল, ‘তুমি বসো আফরিন। খানিক পর তোমাকে নিয়ে যাব ওর কাছে। আসলে গত কয়েক মাস ধরে ও একটু অসুস্থ তো। এখন বোধহয় ঘুমোচ্ছে। আমি আসছি দাঁড়াও।’
দ্বিতীয় কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে তিহা চলে গেল।

সেবার খুব ভাব হয়েছিল আফরিন আর ছোটনের মাঝে। তার রেশ ধরে এবারেও ওদের আড্ডা জমলো বেশ। আফরিন বলতে শুরু করল গ্রামের উদ্ভট যতসব ভূতুড়ে গল্প। শ্রোতা হিশেবে ছোটন বরাবর ভালো। আজকাল আর মিমি তাকে গল্প শোনায় না, অনেকদিন পরে আফরিনের সংস্পর্শে এসে এই খামতিটুকু দূর হলো ছোটনের।

চায়ে চুমুক দিয়ে শিউলি তখন নিনাদের বিয়ে নিয়ে আলাপ জুড়েছেন তিহার সাথে। নিনাদের বিয়ের কথায় তিহারও প্রবল উৎসাহ। মারুফ মসজিদে গেছিলেন আসরের সলাত আদায়ের জন্য। নিজের ঘরে শুধু তিতিক্ষাই একা বসে। বাড়ির প্রতিটি কোণের সমস্ত কলরব এসে থমছে গেছে সেই ঘরের সম্মুখে। কিছুক্ষণের জন্য বাদবাকি সবাই ভুলে গেল বাড়িতে আরও একটি মানুষ রয়েছে। যে অহোরাত্র নিজ গৃহে স্বেচ্ছায় বন্দিনী। তিহার হুশ ফিরল তখন, যখন ভেতরের ঘরে থাকা ফোনের রিংটোন তার কানে এসে লাগল।
শিউলিকে বলে সেদিকে পা বাড়িয়েছিল তিহা। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে পুনরায় ফিরে যাচ্ছিল বসার ঘরে। সহসা নজর পরল তিতিক্ষার ঘরের দরজায়। দরজার ফাঁকে ওর পোশাকের একাংশ দেখা যাচ্ছে। ফোন কানে চেপেই তিহা সেদিকে এগোয়। কাছে গিয়ে দেখে দরজায় হেলান দিয়ে তিতিক্ষা বসে রয়েছে মেঝেতে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির, বহু দূরে বাইরের ওই উঠোনে, যেখানে আফরিন ছোটনের পাশে বসে জাদুময়ী ভঙ্গিমায় হাত নেড়ে নেড়ে কত কি বলে চলেছে। মুখের ভাজে ভাজে লেগে রয়েছে অনাবিল সুখের প্রচ্ছন্ন রেশ।
তিহার কথা থেমে যায়। ফোনের ওপাশে রওশান তখনো কি সব যেন বলছে। তিহা শুনতে পায়না। ফোন কানে নিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বোনের পাশে হাটু মুড়ে বসে পড়ে। তিতিক্ষার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে জিগ্যেস করে,’কি দেখছিস অমন করে?’
তিতিক্ষা নিশ্চল স্থির চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে সঙ্গিন স্বরে বলে,’ওর দেহে এত প্রাণ, আমি একটু ধার নেব।’
চলবে………

★অদ্রিজা আশয়ারি

দূর আলাপন ~ ১৫
___________________________
নির্জন ঘরটার সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আফরিন। এই অসময়ে ঘরের কপাট ভিড়ানো। অন্ধকার চুইয়ে আসছে ভিড়ানো কপাটের ফাঁক গলে। হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারে না সে। ইতস্তত করে একবার কড়া নাড়ে। কোনো সারা নেই। খানিক্ষন অপেক্ষমান থেকে একসময় নিরুপায় হয়ে বেশ একটু শব্দ করে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে পা বাড়ায় ভেতরে।

খানিকটা তন্দ্রার মতো পেয়েছিল তিতিক্ষাকে। সন্ধ্যায় সলাত ও মাসনুন আমল শেষের এই সময়টা রোজ বুবু ছেলেকে নিয়ে আসে। হালকা কিছু খাবার আর চায়ের সরঞ্জাম থাকে তার সঙ্গে। আজ কেউ এলো না। মাঝে মাঝেই বাইরে থেকে মিহি সুরে ভেসে আসছে কথার অনুরণন। আজ হয়তো বুবু আসবে না। ভীষণ ব্যস্ত নিশ্চয়ই। হওয়ারই কথা। এবাড়িতে তার নিজের মতো অকর্মা তো আর কেউ নেই। ভেবে মুসল্লা ভাজ করে উঠে বাতি নিভিয়ে দেয় তিতিক্ষা। আচ্ছন্নের মতন শুয়ে পড়ে বিছানায়। বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুতেই গায়ের উত্তাপটা আবারো টের পায়। একটা জ্বর জ্বর গন্ধে যেন ওর আশেপাশের বাতাসটা ভারি হয়ে ওঠে ক্রমশ। ঈষৎ শীত শীত লাগে। পায়ের কাছে ভাজ করা পাতলা কাঁথাটা টেনে দেয় গায়ের ওপর। ঝুম অন্ধকার ঘরে জ্বরের রিমঝিম ঘোরে, মৃদু শীতল আমেজে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুতেই আরামে তার চোখ মুদে আসে। কিন্তু ঘুম যেন বহু দূরের বস্তু। তন্দ্রার মাঝে তিতিক্ষা টের পায় জ্বরের বেড়ে যাওয়া। সব মিলিয়ে অবশ্য খারাপ নয়। ঝিমঝিমে অবশ এক অনুভূতির মাঝে পড়ে থাকা।

কতক্ষণ কেটেছিল কে জানে! হঠাৎ সে কপালের ওপর টের পায় একটা নরম ঠান্ডা হাতের স্পর্শ। চোখ মেলতেই মৃদু আলোর রেখা ছুটে এসে ওর চোখের কোলজুড়ে লুটিয়ে পড়ে। সম্মুখে একটা মুখ, অস্পষ্ট অবয়ব। একরকম অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তিতিক্ষা। যেন মনে করার চেষ্টা করে মানুষটি কে? ক্রমে সে বুঝতে পারে, মেয়েটা দূরের কেউ না। একসময় বেশ সখ্য গড়েছিল ওদের মধ্যে। যদিও তার স্থিতিকাল অল্প…
তিতিক্ষার কপালে তখনো আফরিনের হাত। জ্বরাচ্ছন্ন অসুখী মেয়েটার আকস্মিক চাহুনিতে আফরিন স্তব্ধতার হতশ্বাসে স্বাভাবিক কান্ডজ্ঞান অল্পকালের জন্য খুইয়ে ফেলেছে। তখন আস্তে আস্তে তিতিক্ষা তার হাতটা ধরল। মুহুর্তের জন্য একটু তরঙ্গ বয়ে গেল আফরিনের শরীরে। জ্বরে সমাচ্ছন্ন তিতিক্ষার হাত অস্বাভাবিক শীতল।
‘কেমন আছো আফরিন?’

আফরিন প্রশ্নটা শুনলো। শুনেও চেয়ে রইল তিতিক্ষার ঠান্ডা অভিব্যক্তিহীন মুখের পানে। না পরিতোষ, না অহং… কিছুরই ছাপ নেই। পরম শান্ত আর সম্ভ্রমের একটা প্রচ্ছন্ন প্রলেপ শুধু লেগে আছে ওই মুখে। ওটুকুই আফরিনের স্বস্তি। আর যা হোক, মেয়েটা অহংকারী ছিল না কোনোকালে।

আফরিন আরো কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে তিতিক্ষার শিয়রে এসে বসে। মাথার কাছে নিবিড় হয়ে বসে সে মেয়েটার বিচিত্র অসুখ নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে। ঠিক কি হয়েছে তিতিক্ষার? তিহার মুখেই শুনেছিল ওর অসুস্থতার কথা কিন্তু অসুস্থতাটা আদতে কি, সে তার জানা ছিল না।
অথচ এখন তিতিক্ষাকে দেখার পর একটা বিশাল ঝড়ের আভাস পেল ও। একটা অবশ্যম্ভাবী তান্ডবের রেশেই যেন লণ্ডভণ্ড হয়েছে সব। অনিবার্য এক যাতনার অভিঘাতে বদলে গেছে তিতিক্ষার পৃথিবী…

বর্ণিল রঙে ভরা জীবনে আজ শুধু সাদাকালো দিন। তিতিক্ষার এই ঘরে অন্যরকম সুখের সন্ধান পেয়েছিল, প্রথমবার যখন এসেছিল আফরিন। হাজার রঙের সমাহার, অনুক্ষণ আনন্দঘন এক আবেশ। বইয়ের তাকে থরে থরে সাজানো বাহারি প্রচ্ছদে মোড়া বই, এককোণে জ্বলছে নিভছে পীতাভ ফেইরি লাইট, ঘরজুড়ে ছোট ছোট ইনডোর প্ল্যান্টের ছড়াছড়ি…
সুন্দর মন, সুন্দর মানুষ আর সুন্দর ঘর… সে বার সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিল আফরিন।

আর আজ… মনে হচ্ছে যেন তিতিক্ষার অসুস্থ বিষাদীত মনের ছায়া পড়েছে এই ঘরেও। আগেকার রঙ, বাহারি আসবাব কিছুই আর নেই। শুধু হাল আমলের পুরনো উঁচু পালঙ্কটা জায়গাতেই আছে। আর একটা আলমিরা। তার গা ঘেঁষে প্লাস্টিকের বইয়ের তাক।

আফরিনের মনে হলো এইঘরে যেন সদাসর্বদা মৃত্যুগন্ধি বাতাস আসা যাওয়া আছে। এখানে দুর্বিনীত আতঙ্ক বিরাজ করে সবসময়। সত্যিই কি আফরিন যা ভাবছে তাই ঠিল? মানুষের সাথে সাথে এত বদলে যেতে পারে একটা ঘরও? নাকি অত রঙ, অত আলো একসঙ্গে দেখেছিল বলে আজকের এই আড়ম্বর হীনতা আফরিনের অত চোখে লাগছে?

আফরিনের সম্বিৎ ফেরে একটা মৃদু তানে। চমকিত হয়ে দেখে তার রেশমি চুড়ি পড়া রাঙা হাতে নিজের ফ্যাকাসে আঙুল ছুঁইয়ে তিতিক্ষা চুড়িগুলো নাড়ছে। মিষ্টি রিমঝিম শব্দের ফোয়ারা তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।
মৃদু হাসে আফরিন। খেয়াল হয় কয়েক মুহুর্ত আগে তিতিক্ষা ওকে কুশল জিজ্ঞেস করেছে।
অস্বস্তি নিয়ে বলে ‘আমি ভালো আছি। আর আপনে?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালোই…’

‘সেইটা আপনেরে দেইখা মনে হইতাসে না একদম। গায়ে জ্বর, মুখেও যেন রক্ত নাই…’ বলতে বলতে তিতিক্ষার গালের রক্তিম আঁচড় গুলোর দিকে অবধারিত ভাবে দৃষ্টি চলে যায় আফরিনের। স্বাভাবিক বোধ থেকেই সে বোঝে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা ভদ্রতার খেলাফ। কিন্তু স্বরে মন খারাপি টা আর ঢাকতে পারে না।
বিষন্ন গলায় বলে, ‘আপনে তো অনেক অসুস্থ আপু। আমি বুঝতে পারি নাই। ভাবছিলাম হয়তো…. আফরিন থামে। নত মুখ তুলে দেখে শান্ত চোখে ওর পানে তাকিয়ে আছে তিতিক্ষা। দৃষ্টিতে ভাস্বরতা নেই। যেন কিঞ্চিৎ অসংলগ্ন ওই চাহুনি। বোধহয় ওর কোনো কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনেনি মেয়েটা। আফরিনের মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা। আগের তিতিক্ষার এমন গা ছাড়া ভাব ছিল না কখনো।

‘তোমায় খুব সুন্দর দেখাচ্ছে আফরিন।’
ঈষৎ লজ্জার আঁচড় লাগে আফরিনের মুখে। মৃদু কণ্ঠে বলে, ‘আপনি তো সাজসরঞ্জাম ছাড়াই আমার চেয়ে সুন্দর।’

চুড়ি নাড়াচাড়া থামিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইল তিতিক্ষা। প্রতুত্তর করল না। তারপর হঠাৎ কোনোরূপ পূর্বাভাস না দিয়ে উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল।
আফরিন কিঞ্চিৎ বিস্মিত। সহসাই ওর মনে হলো শারিরীক অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গে তিতিক্ষার যেন কিছু মানসিক অসুস্থতাও শুরু হয়েছে। কথাবার্তার তাল ঠিক রাখতে পারছিল না। আর এখন এমন অদ্ভুত ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল….

ঘরজুড়ে নেমে আসে প্রগাঢ় স্থবিরতা। কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে আফরিন। এই ধরনের গাঢ় নৈশব্দের সাথে আফরিন ঠিক অভস্ত্য নয়। অস্থির চাহুনিতে বিধ্বস্ত ঘর আর ঘরের মালকিনকে পরখ করতে থাকল সে। যে আশা নিয়ে এখানে এসেছিল তার সবটাই পণ্ড হয়েছে। ঔৎসুক্যে ভরপুর মনটা সমস্ত উদ্বেলতা হারিয়েছে তিতিক্ষাকে দেখে।

অথচ এর উল্টোটাই কি হবার কথা ছিল না? নিজের আশ্চর্য বিয়ের গল্পটা শোনাবার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে নিয়ে এঘরে পা রেখেছিল আফরিন। ধারণা ছিল তিতিক্ষা হয়তো খুব আগ্রহ নিয়েই গল্পটা শুনতে চাইবে। ভাবতে ভাবতে আফরিন আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তিতিক্ষাকে। তার কিশোরী মন ছটফট করে কথা বলার জন্য। পড়ালেখার পাট চুকেবুকে গেছে সেই কবে। তারপর থেকে আফরিন কোনো সমবয়সীকে বন্ধু হিসেবে পায়নি। প্রতিটি বয়সের আলাদা কিছু বিশেষণ থাকে, গল্প থাকে। আফরিনের এমন কেউ নেই যার সঙ্গে নিজের ছাপোষা জীবনের ছোট ছোট সুখ দুঃখ নিয়ে গল্প করে।

তিতিক্ষা বলেছিল তারও কোনো বন্ধু নেই। সুতরাং তারা সাচ্ছন্দ্যে একে অন্যের বন্ধুত্বের স্থানটা নিতে পারে। তবে হয়তো আফরিনের ধারণা ভুল। তিতিক্ষার সম্মন্ধে মিথ্যে মোহ পুষে রেখেছিল সে বুকে। ভেবেছিল এতদিন পর দেখা হলে তিতিক্ষা সাদরে ওকে নিজ জগতে অভ্যর্থনা জানাবে।
আর আফরিন বলবে ওর আকস্মিক হওয়া বিয়ের গল্পটা। মিনহাজের সাথে তার বিয়েটা যে বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে গোটা গ্রাম জুড়ে সে খবর জানিয়ে চমকিত করবে তিতিক্ষাকে।

আফরিনের সৎ মায়ের বদ্ধ ছিল শেষ অবধি কোনো এক দিনমজুরের ঘাড়ে ঝুলতে হবে আফরিনকে। গ্রাম বাসির ধারণাও কিছু ভিন্ন ছিল না। কিন্তু সৎ মায়ের এবং পুরো গ্রাম বাসির আশার মুখে ছাই দিয়ে আফরিন শেষে বিয়ে করল এক বিদেশ ফেরত শহুরে ছেলেকে। মিনহাজের জন্ম গ্রামে হলেও ছেলেবেলা থেকে সে শহরেই মানুষ। সিঙ্গাপুরে গিয়েও ছিল সেখানে বেশ কিছুদিন। তারপর আবার দেশে ফিরে ব্যাবসায় ঢুকেছে।
গ্রামের অনেক ছেলের সাথেই মিথ্যে প্রেমের উপাখ্যান গড়েছিল আফরিন। সৎমায়ের অবর্ণিত অত্যাচার আর সবার কাছে পাওয়া মাত্রাতিত অবহেলার মাঝে এভাবেই নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছিল সে। তার মায়াবী মুখশ্রী আর মোহনীয় চোখের কটাক্ষ দেখে বহু ছেলেই পাগলপারা হত। আফরিনও ওদের দূর্বলতা টের পেয়ে সুযোগের সৎ ব্যাবহার করতো। তার যাবতীয় প্রসাধন, বিলাসিতার খরচ যোগাতো প্রেমিকেরা।
এমনি কিছু একটা অভিসন্ধি থেকে মিনহাজকে জালে ফাসিয়েছিল। কিন্তু একসময় দেখা গেল মিনহাজের চেয়েও মস্ত ফাঁদে সে নিজে আটক হয়েছে। মিনহাজ ভালো ছেলে, তবে সম্মোহিত হবার মতো সুন্দর নয়। মা মারা গেছেন কৈশোরে, বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন। তার পর থেকে সংসারটা দ্বিতীয় পক্ষের ইশারায় চলে। অবিলম্বে মিনজান টের পেয়েছিল গ্রামে থাকা তার আর চলে না। শহরে মামার বাড়িতে এসে উঠল। অল্প বয়সে মামার ব্যবসায় নামল। ইতোমধ্যে নিজের আলাদা ক’টি ব্যাবসা দাড় করিয়েছে। উন্নতিও হচ্ছে বেশ। ঢাকায় নিজের থাকার মতো একখানা বাড়ি করেছে। সামনে হয়তো আরো কিছু হবে। ঠিক এই সময়ে পুরো গ্রামকে অবাক করে দিয়ে বিয়ে হল মিনহাজ বিয়ে করল আফরিনকে। বাজ পড়ল গ্রামের অনেক মেয়ের বাবার মাথায়।

আফরিন ভেবেছিল বিয়ের সমস্ত ইতিহাসটা শোনাবে তিতিক্ষাকে। শুনতে শুনতে কখনো হয়তো বিস্ময়ের আঁচড় পড়বে তিতিক্ষার মুখে, হয়তো কখনো হেসে উঠবে খিলখিলিয়ে। কিন্তু… কিছুই হলো না যে। ভাবতে ভাবতে তিতিক্ষার ওপর কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়ে আফরিন। ধীর নিশ্বাস পড়ছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে মেয়েটা। শ্রান্তিচ্ছন্ন দুচোখ ডুবে আছে নিদ্রার কোলে।

অচিরাৎ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নির্বাপিত হয় আফরিনের ভেতর থেকে। উপলব্ধি করে কোনো এক বিপর্যয় এসে আমূল বদলে দিয়েছে তিতিক্ষার জীবন যাপনের ধরন। ওর ঘুমোনোর ভঙ্গিমাতে পর্যন্ত কত মায়া মেশানো। গালের নিচে হাত রেখে ঘুমোচ্ছে সে। মুখের উজ্জ্বল রঙটা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফ্যাকাসে সাদা মুখ, এখানে সেখানে আঁচড়ের দাগ। একগাছি চুল ছিল মেয়েটার। এখন যেন ওর চুল আগের চেয়ে অনেক পাতলা। যেটুকু আছে তাতেও অযত্নের ছাপ বড় স্পষ্ট।
চোখের ওপর খয়েরি রেখা, পড়নে হালকা ধূসর রঙা একটা সুতির কুর্তি। জামার রঙ মিশে গেছে তার রঙে। যেন এক আসমানী পরী ঘুমিয়ে আছে আকাশসম দুঃখের পাহাড় নিয়ে। ভীষণ যাতনায় ক্লান্ত যার মন, মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় উদাস যার দৃষ্টি। আফরিনের চোখ ধাধিয়ে যায় সেই বন্দিনী অভিশপ্ত আসমানী পরীর দিকে চেয়ে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে