দূর আলাপন পর্ব-১৬+১৭

0
195

দূর আলাপন ~ ১৬
____________________________
কথায় কথায় শিউলি তার একটা আশংকার কথাও একফাঁকে বললেন। নিনাদটা কিছুদিন যাবৎ অদ্ভুত গা ছাড়া আচরণ করছে। নিজে থেকে তো কল দেয়ই না। শিউলি যেচে যোগাযোগ করতে চাইলেও বেশিরভাগ সময় কল রিসিভ করে না। একা বিদেশবিভুঁইয়ে বাস। কি হতে কি হয়… শিউলির বড় চিন্তা হয়। এদিকে ছেলের বিয়ের কথাটাও বেশ অনেকটা এগিয়ে রেখেছেন। শেষ সময়ে এসে যদি নিনাদ বিগড়ে যায় তবে মস্ত কেলেঙ্কারি হবে।

তিহা নিঃশব্দে সমস্তটা শুনলো। তার মুখে রেখাপাত ঘটালো কালো ছায়া। বলতে কি, বোনের জীবনের বিপর্যস্ত দিনগুলোর কথা নিনাদকে জানানোর অভিপ্রায় তিহারও ছিল না। ছিল না কারণ এর ফলে হয়তো চিরকালের মতো তিতিক্ষাকে ছোট করার একটা উপলক্ষ জুটে যাবে নিনাদের। কিন্তু কথার পিঠে কথা এসে যায়। যখন কথায় কথায় দুর্ঘটনার খানিক আভাস পেয়ে গেল নিনাদ, তখন গোপন রাখা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ল ওর কাছ থেকে।

তিহার মনে আছে, সেদিন নিঃশব্দে তার সমস্ত কথা শুনেছিল নিনাদ। মাঝখানে কোনো মন্তব্য করেনি, একবারের জন্য ওকে থামায়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর প্রতিক্রিয়া কেমন হয়েছিল সেটা তিহার কাছে অজানাই থেকে গেছে। সেই মুহুর্তে ওর বোন পাগলামো করছিল, কোনোরকম বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই কল কেটে ছুটে যেতে হয়েছিল তিহাকে।

হয়তো কষ্টই পেয়েছিল নিনাদ। সে সম্ভাবনাই প্রবল। যত যাই হোক, তিতিক্ষার প্রতি ওর একটা দূর্বলতা তো ছিলই। কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়া কি সাজে? তারিখ মিলিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয়না সেদিনের পর থেকেই নিনাদ শিউলি ফুআম্মার সাথে দূরত্ব রেখে চলছে। কষ্ট? সত্যিই কি তাই? একপাক্ষিক ভালো লাগায় এতটাও কি হয়?

ফুআম্মা কেমন মানুষ সে তো নিনাদের অজানা নয়। তিনি অস্থির হবেন, দুচিন্তায় পড়েবেন জেনেও তবে কেন এই ছেলেমানুষী?
আচ্ছা, তিহা যা ভাবছে ব্যাপার টা তার থেকেও গভীর নয়তো? দূরদেশে একা ভালো আছে তো নিনাদ? তিহার সম্বিত ফেরে আফরিনের ডাকে। মেয়েটা মলিন স্বরে কাছে এসে জানায়, ‘ছোট আপুর খুব জ্বর’
ব্যস্ত হয়ে তিহা ছুটে যায় অন্দরে। পেছন পেছন ছোটেন শিউলি আর আফরিন।

বোনের অবস্থা দেখে অচিরেই তিহা অতিথিদের কথা বিস্মৃত হল। গা ঘেঁষে বসামাত্র মেয়েটার গায়ের উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। জ্বরটা বোধহয় মাথায় চড়ে গেছে। দিশেহারা হয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে বোতলের পানিতে ওড়না ভিজিয়ে বোনের কপালে দিতে থাকল তিহা। শিউলি মৃদু পায়ে এসে তিতিক্ষার হাত আর পায়ের তাপমাত্রা দেখলেন। মেয়েটার হাত পা বরফের মতো শীতল। শুনলে তিহা আরো বিচলিত হবে ভেবে নিচুকণ্ঠে আফরিনকে বললেন রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল নিয়ে আসতে। আফরিন ছুটে গেল। বিছানার দুদিকে দুজন দাঁড়িয়ে। তিহা ব্যস্ত হয়ে বোনের কপালে সেঁক দিচ্ছে। আর উল্টো পাশে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকে দেখছেন শিউলি। কেবল জ্বরই হয়েছে, হয়তো একটু বেশি তবে এতেই তিহার মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা অবাক করার মতন। আচমকা শিউলির চোখ সরে যায় তিতিক্ষার নিস্পন্দ মুখের ওপর।

রাত নেমেছে। শিউলি চোখেও আজকাল অত ভালো দেখেন না। নয়তো আরো আগেই ব্যাপার টা তার চোখে পড়ার কথা। কয়েক মাস আগে দেখা তিতিক্ষার সঙ্গে এই তিতিক্ষার তফাৎ টা আকাশপাতাল। যদিও মেয়েটা এখন ঘুমিয়ে আছে। তবু ওর গাঢ় কালিমালিপ্ত চোখের কোল, মুখের ক্ষতিচিহ্ন গুলো নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছে না! তিহা বলেছিল তিতিক্ষার অসুখ। কিন্তু এ কি ধরনের অসুখ! স্বাস্থ্য কমে গেছে, কণ্ঠার হাড় বেড়িয়ে পড়েছে আর গায়ের রঙ হয়েছে এমনই ফ্যাকাসে যে মনে হয় রক্তশূন্যতায় ভুগছে।
শিউলির মন যখন এই রকমের অসংখ্য ভাবনার দোলাচালে দুলছিল তখন প্রথমবারের মতো চোখ মেললো তিতিক্ষা। আফরিনও তেলের কৌটো নিয়ে ফিরে এলো সেই মুহুর্তে।

.

বোনের ভেজা চুল মুছে দিচ্ছে তিহা। জ্বরের বাড়বাড়ন্ত দেখে শেষ পর্যন্ত শিউলি পরামর্শ দিয়েছিলেন মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালার জন্য। বিছানার পাশে চেয়ারে বসে শিউলি শুধালেন,’এখন কেমন লাগতাসে আম্মাজান?’

বোনের কাঁধে দূর্বল মাথা ঠেকিয়ে তিতিক্ষা একদৃষ্টে চেয়ে রইল আফরিনের বর্ণিল সাজসজ্জায় পূর্ণ দেহাবরণের দিকে। শিউলির প্রশ্ন ওর কর্ণগোচর হয়েছে বলে মনে হলো না। বিব্রত পরিস্থিতি এড়াতে তিহা হাসল,’তিতি, ফুআম্মা কি জিজ্ঞেস করছেন বল? এখন একটু ভালো লাগছে তো?’

তিতিক্ষা এবারেও নিরুত্তর। ভাষাহীন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্মুখে।

‘থাউক, মাত্র জ্বরটা নামতাসে। আম্মাজান এহন একটু বিশ্রাম নেক।’ কথা শেষ করে শিউলি গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবতে শুরু করলেন। এতক্ষণে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, তিতিক্ষা মেয়েটা সত্যিই খুব অসুস্থ। তবে তার কতটা শরীরি আর কতটা মনের সেটুকুই ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ওকে দেখে শিউলি যতদূর বুঝেছেন, মেয়েটা মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ নয়। তিহা বলেছিল বিয়ে ভাঙার পর থেকে তিতিক্ষা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। সারাক্ষণ একা একা থাকে। কারো সঙ্গে কথাটথা তেমন বলে না। ইচ্ছে থাকলেও সবটা বিশ্বাস করতে পারলেন না শিউলি। শুধু বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় কোনো মেয়ে এতটা প্রভাবিত হয়? প্রেমের বিয়ে হলেও নাহয় একটা কথা ছিল! তবে এদের ব্যাপারখানা কি? খুব বড় কিছু কি ওরা লুকোচ্ছে শিউলির থেকে? তাই বা কেন হবে? তিহা তেমন মেয়ে তো নয়। তবে কি এমন ঘটতে পারে এই কয়েক মাসের ভেতর, যা শিউলিকে বলতেও তিহার মুখে বাধছে?

.

নিনাদের কথা সেদিনের মতো চাপা পড়ে গেল। রাত বাড়ছে। শিউলি ব্যস্ত হলেন আফরিনকে নিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য।
বাইরে তখন বৈশাখী ঝড়ের তান্ডব পুরো রাতের আকাশ জুড়ে। অবসন্ন মুখে শিউলি ফেরার জন্য প্রস্তুত হলেন। যাওয়ার আগে একবার শেষ বারের মতো দেখতে এলেন তিতিক্ষা কে। একটা সময় এই রমণীর সৌন্দর্যের সামনে আফরিন কে বড় মলিন দেখাতো। অথচ আজ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন আফরিনের বর্তমান রূপগুণের কাছে তিতিক্ষা কতই না ম্লান! যেন সুন্দর একটি ফুলের জীবন দুমড়েমুচড়ে বিধস্ত করে দিয়েছে কেউ। পরিতোষ বদনে এবাড়িতে এলেও শিউলিকে ফিরতে হলো ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। আফরিনও যেন অনেকটা নিভে গেছে। ওর সমস্ত হাসি, রিমঝিম কথার ফুলঝুরি সব থমকে গেছে ওই একাকিনী ঘরবন্দী অসুখী মেয়েটিকে দেখে।

.

বাইরে গহন তমসার চাঁদোয়া বিছানো রাত। বাড়ির ভেতরের তমসা যেন আরো প্রখর। খানিক আগে যে হলঘরে ভাসছিল কলরব, নেমেছিল কথার ফোয়ারা, এখন সেখানে নিবিড় হয়ে বসে আছেন একজন বিষন্ন প্রৌঢ়। মারুফের সামনে ধীর পায়ে তিহা এসে দাঁড়ায়।
‘বাবা, ঘরে যাও। রাত অনেক হলো। ঘুমোবে না?’

প্রলম্বিত নিশ্বাস ফেললেন মারুফ, ‘আর ঘুম…’

‘তুমি জেগে বসে থাকলেই বা কি হবে বলো তো? উল্টো চিন্তায় চিন্তায় তোমারই প্রেসার বেড়ে যাবে। তারচেয়ে ঘরে গিয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো। তিতির পাশে আমি তো আছি। কোনো দরকার হলে তোমায় জানাব।’

মেয়ের কথায় বৃদ্ধ বাবা খানিকটা ভরসা পেয়ে উঠলেন। তিহা ফিরে গেল বোনের ঘরে। বিছানার একপাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ওর পাঁচ বছরের বাচ্চা ছেলেটা। অন্যপাশে তিতিক্ষার জ্বরের ঘোরে ফেলা জোরালো শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরজুড়ে আধো আলো আধারির অন্তর্জাল। বাইরে অশনি গজরাচ্ছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির নিক্কণে বাতাস ভারি। জানালার একটা অর্ধখোলা কপাট দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল। তিহা ছুটে গিয়ে জানালা বন্ধ করল। তারপর ক্লান্ত পায়ে এসে বসল বোনের শিয়রে।

একে একে মনে পড়তে লাগলো নানান কথা।
শিউলি ও আফরিন দুজনের মুখই আজ ঝলকাচ্ছিলো। এতিম দুটো ছেলে মেয়েকে মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করেছিলেন শিউলি। নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর ওরা মাতৃসম শিউলিকে মনে রেখেছে। নিনাদের ঘরের কর্তৃত্ব চিরকাল শিউলির হাতে। এখন আফরিনের নতুন সংসারেও শিউলির অবাধ বিচরণ। এখানেই শিউলি স্বার্থকতা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে, সামনে ছেলেটারও বিয়ে হবে। শিউলির এখন সুখের দিন। নিনাদের বিয়েতে আরো কত আলো জ্বলবে… কত মুখ হাসবে…

আর এই বাড়ি? হাহ্! বরাবরের মতো নিভে গেছে এই বাড়ির সমস্ত আলো। তিহার বোনের একটা ভালো বিয়ে হবে না। অনেক আত্মীয়স্বজন, অনেক উজ্জ্বল মুখ, হাসি আনন্দ কিছুই হবে না। সেসব সম্ভাবনা চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে সেই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে…

এতো গেলো বাইরের মানুষের সঙ্গে তুলনা। বিষাদভারাতুর মন নিয়ে তিহা এবার হিসেব কষতে বসে একান্ত নিজের সমস্ত পাওয়া না পাওয়ার। জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই তার ভাগ্যটা ভারি গোছানো। প্রথম সন্তান বলে ছেলেবেলায় বাবা মায়ের অফুরন্ত স্নেহের একা ভাগিদার ছিল। তারপর অনেক দিন পরে একটা ছোট্ট মিষ্টি বোন এলো। সঙ্গে এলো মায়ের দেহে হাজার রকমের অসুখ। সারাটাক্ষন মাকে নিজের অসুস্থতা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হতো। তিতিক্ষা বড় হচ্ছিল বেশ একটু অযত্নে, অবহেলায়। তারপর মাও মারা গেলেন তিতিক্ষার অল্প বয়সে। তিহা ততদিনে কৈশোরে পদার্পণ করেছে। তখন আর মায়ের স্নেহ মমতায় ডুবে থাকার বয়স নয়। সুতরাং তিহার তেমন কোনো অসুবিধে হল না মাকে ছাড়া।

কষ্ট যা পোহাবার পোহাচ্ছিল ওই কোলের বোনটা। মা বেচে থাকতে যেটুকু যত্ন পেত, মারা যাবার পর সেটুকুও ওর ভাগ্য থেকে মুছে গেল। কাজের জন্য বাবাকে বেশিরভাগ সময় থাকতে হতো বাড়ির বাইরে। বাড়ি এলেও স্কুলের পরীক্ষার খাতা, একপাল ছাত্রছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের আনাগোনা থাকতই। সবটা সময় বঞ্চিত হয়ে, অবহেলা পেয়ে, একাকীত্বে ডুবে কষ্ট পেয়েছে তিতিক্ষা। তিহার ভাগ্য জন্ম থেকেই যেমন প্রসন্ন বিপরীতে তিতিক্ষার ভাগ্য জীবনের প্রারম্ভকাল থেকেই তেমনি যেন ওর সুখের ঘোর বিরোধী। কষ্টে, একাকীত্বে বড় হওয়া তিতিক্ষা আজও দিয়ে চলেছে জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা। অথচ তারই সহোদরা বোন হয়ে স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখে পূর্ণ একটা জীবন তিহা কাটাচ্ছে।

একে কি নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস বলা যায়? নাহলে একই ছাদের নিচে বসবাস করা দুটো মানুষের নিয়তি এত ভিন্ন কি করে হয়?
স্কুলে কলেজে সবসময় ক্লাসমেটদের দ্বারা নির্মম তাচ্ছিল্যের স্বীকার হতে হতো তিতিক্ষাকে। কখনো নিজের বিরল গম্ভীর ব্যক্তিত্বের জন্য কখনো আবার অকারণেই।
অন্যদিকে তিহা ছিল বন্ধুমহলের প্রাণ। ওকে ছাড়া কোনো ট্যুর প্ল্যান হয় না, পিকনিক করার প্রশ্নই ওঠে না, ওকে ছাড়া কোনো আড্ডাও ভালো করে জমে না। মাঝে মাঝে করুন চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে থাকতো তিতিক্ষা। যখন বান্ধুবিরা তিহাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতো।
সব ভালোবাসার রিয্ক কি শুধু তিহার জন্যই বরাদ্দ ছিল? আর রাজ্যের যত অবহেলা, অপমান শুধু তিতিক্ষার জন্য?

অথচ এতকিছু প্রাপ্তির পরেও যে প্রাপ্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়াবার সামান্য প্রেরণা টুকু তিহা পায়নি। বিপরীতে অপ্রাপ্তির যাতনা ভুলতে তার বোনই প্রতিবার রবের সামনে সিজদায় ঝুকেছে। যতবার কোনো দুনিয়াবি আঘাত এসে ওকে টলিয়ে দিতে চেয়েছে ততবার আরো বেশি রবের কৃতজ্ঞ বান্দা হবার চেষ্টায় রত হয়েছে তিতিক্ষা।

মাঝে মাঝে তিহার ভয় হয় সত্যি। আল্লাহ কেন তাকে এতটা ছাড় দিচ্ছেন? নাকি তাকে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হবার সুযোগ দিয়ে যাচ্ছেন এখনো? কিন্তু প্রতি মুহুর্তে যে সেই সুযোগ কে ধূলিসাৎ করে তিহা আরো বেশি করে দুনিয়াবি মোহের প্রতি ঝুকছে, শেষ পর্যন্ত আদৌও রবের অনুগ্রহ তার ভাগ্যে জুটবে তো? অত কাছে থেকে তার বোন জীবনের কঠিনতম পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে তবুও কি তিহা বুঝবে না? ফিরবে না আলোর পথে?

কত অসহিষ্ণু ছিল তিতিক্ষার পর্দার ধরন। কারো কোনো অনুরোধের খাতিরেই নিজের পর্দার লাগামকে এক মুহুর্তের জন্য আলগা করেনি সে। অথচ তারই বোন হয়ে তিহা হাজারটা ছেলের সঙ্গে মিশেছে। এমনকি এখনো তার কাছের বন্ধুদের অর্ধেকই ছেলে….
কতবার তিতিক্ষা বুঝিয়েছে তাকে এই পথ ভ্রান্তির, এই পথ আল্লাহর অবাধ্যতার…. কিন্তু তিহা যেন বিক্রি হয়ে গেছে জাগতিক মোহের কাছে।
আজ কেন এত মনে পড়ছে তিতিক্ষার দেয়া সেইসকল নসিহাহ গুলো? কেন নিজের ভুলের কথা ভেবে এত কষ্ট হচ্ছে? আর কতদিন অবাধ্যতার অন্ধ স্রোতে ভাসতে ভাসতে বাচবে তিহা? শেষ পর্যন্ত কি আলোর পথে ফেরা হবে না? এভাবেই আল্লাহর অবাধ্যতায় অবগাহনরত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে সে?

তিহা সমাচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে অনেকক্ষণ। বাইরে তখন ঝড় প্রবল। লোডশেডিং হয়েছে। বাতি জ্বালানোর কথা তিহার খেয়াল থাকে না। নিঝুম অন্ধকার ঘরে একা জেগে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে তিহা আল্লাহর দরবারে দুআ ধরে। চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে অনুতাপের জল।
তিহা কাতর গলায় বলে,’ইয়া আল্লাহ, পরম করুনাময়। না চাইতেও সারাজীবন আপনি আমার ও আমার পরিবারের ওপর অপার রহমাহ বর্ষন করেছেন। আপনার দেয়া নিয়ামতে ডুবে থেকেও আমি অবাধ্য হয়েছি বারবার। তবু আপনি আমাকে শাস্তি দেননি, প্রতিবার সুযোগ দিয়েছেন নিজেকে শুধরে নেবার। আর প্রতিবারই এই গাফেল বান্দা আপনার অনুগ্রহ সম্পর্কে উদাসীন থেকেছে। ইয়া রব, আসমান জমিনের মালিক, আপনি আমাকে সর্বাত্মক ভাবে ক্ষমা করুন। আপনার সৎকর্মশীল বান্দা হিসেবে কবুল করুন। আর জাগতিক সমস্ত কষ্ট আসান করে দিন আমার ও আমার পরিবারের জন্য। আমিন ইয়া রব।’

চলবে….

দূর আলাপন ~ ১৭
___________________________
সলাতের পাটি ভাজ করে শুয়ে পড়ল তিহা। সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর গোটা একটা রাত জেগে থেকে শরীর এইবার ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। নিঝুম প্রায়ান্ধকার ঘরে একা বিছানায় শুতেই ঘুমে জড়িয়ে এলো দুচোখ। ছোটন আজ তার মিমির সঙ্গে মিমির ঘরে ঘুমিয়েছে। ছোট পরিসরের খাটে জায়গা অপ্রতুল বলে ফজরের সলাতের জন্য বোনকে জাগিয়ে তিহা ফিরে এসেছিল আপনার ঘরে। সলাত শেষ করে শোয়ার পর বোধহয় দশ মিনিটের মতো ঘুমিয়েছিল। শেষ রাতের নিরবতা ভেঙে অতর্কিতে বেজে উঠল ফোন। অবসন্ন দেহে আর একবিন্দু নড়ার শক্তিও নেই। তবু একটা নিশ্বাস ফেলে ঘুমের ঘোরে উঠে হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজে বের করল তিহা।

আধো চোখে ফোন হাতে নিয়ে দেখে অপরিচিত এক বিদেশি নাম্বার। একরকম আচ্ছন্নতার মাঝে ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকালো।
‘হ্যালো…’ তিহার দায়সারা স্বর।

‘আসসালামু আলাইকুম আপু। আপনি কি তিহা বলছেন?’
‘হ্যাঁ… ওয়া আলাইকুমুস সালাম…. কে আপনি?’ ঘুম জড়ানো স্বরে থেমে থেমে তিহা বলে।

‘আমি হাসনাত। নিনাদের বন্ধু। গুড স্ট্রিটে আমরা একই বাড়িতে থাকি। বড় অসময়ে ফোন করে ফেললাম বোধহয়। তার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখীত। বাংলাদেশে এখন মধ্যরাত। তাইনা?’

‘মধ্যরাতও নয়। শেষরাত এখন। ভোর হতে আর খানিক সময় বাকি… কিন্তু… হঠাৎ আপনি কল দিলেন যে? নিদু কোথায়? এত কল করা হচ্ছে ও রিসিভ করছে না কেন?’

‘আসলে… কিভাবে যে বলি… দূরদেশে থাকা কাছের মানুষের প্রতি মানুষের আবেগটা হয় অন্যরকম। ভালোবাসার সঙ্গে মিশে থাকে তীব্র ভয়। ব্যাপার টা হয়তো নিনাদের ফুফুকেই প্রথম জানানো উচিত ছিল। কিন্তু অতটা সাহস আমার হলো না।’

‘কিসব বলছেন আপনি? নিনাদের কি হয়েছে?’

‘আপনি শান্ত হোন। বলছি। আপনি ব্যাপার টা স্থির ভাবে নেবেন বলেই আমার বিশ্বাস। নিনাদের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। একটু মেজর। প্রেসার ফল করেছে, সেদিন দুপুরে চেয়ার থেকে হঠাৎ পড়ে গেল। জ্ঞান নেই। কাছাকাছি একটা নার্সিং হোমে নিয়ে জানলাম নার্ভাস ব্রেকডাউন। পড়ে হাতে পায়ের দু একটা জায়গায় অল্প আঘাত পেয়েছে। আসলে আমরা বুঝতে পারছি না হঠাৎ কেন আর কিভাবে এমন হলো। তবে নিনাদটা মানসিক ভাবে খুবই বিধস্ত অবস্থায় আছে।’

‘কিহ! ইন্না-লিল্লাহ… এ…এসব কবে হলো? এখন কেমন আছে ও? অবস্থা বেশি খারাপ নয়তো?’

‘ঘটনা টা কদিনের পুরনো। আপনাদের জানাবো কি-না, এই দ্বিধা দ্বন্দ্বে দুটো দিন এমনিতেই কেটে গেল। আলহামদুলিল্লাহ, আপাতত ভালোই আছে বলা যায়।
শিউলি ফুফু ওর মা স্থানীয়। ছেলের অসুস্থতার খবর জানার অধিকার ওনার আছে। তাছাড়া এই কদিন তিনি লাগাতার কল দিয়ে গেছেন। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই আমরা কেউ রিসিভ করিনি৷ আপনি এবার প্লিজ ব্যাপার টা যতটা সম্ভব হালকা ভাবে ওনাকে জানান। এই সময়ে মায়ের মতো কারো দুআ নিনাদের ভীষণ প্রয়োজন।’

‘হ্যাঁ… বলবো… বলবো আমি।’ তিহার গলার স্বর খাদে নেমে আসে। কাটার মতো কিছু একটা যন্ত্রণা হয়ে গলায় বিঁধতে থাকে।

‘আপু, আর একটা কথা…. ইয়ে… তিতিক্ষা কে আপনি জানেন?’

‘কেন?’ সন্দিগ্ধ তিহার নিশ্বাস আটকে এলো।

‘নিনাদ বেশ কয়েকবার ওই মানুষটার খোঁজ করেছিল। আর বলছিল ওকে দ্রুত বাংলাদেশে ফিরতে হবে।’

‘এখনি… সময় ফুড়াবার এত আগেই ও দেশে ফিরতে চাইছে?’

‘হ্যাঁ, এই অবস্থাতেও চেষ্টা করছে ফ্লাইটের তারিখ এগোনোর। সামনের মাসের টিকিট ক্যান্সেল করে কিছুদিনের মধ্যে যেন বাংলাদেশে যাওয়া যায়।’

উত্তরে কি বলবে খুঁজে পেল না তিহা। স্তব্ধতা থামিয়ে একসময় শুধু বলল,’হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র কবে পাবে? আর ভাই আপনারা ওর একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ…’

‘তা তো অবশ্যই। ডক্টর অবশ্য বলেছেন ঝুকিটা এড়ানো গেছে। আসলে ক্ষতটা তো অধিকাংশেই মানসিক। কোনো একটা ঘটনার নিমিত্তে ও চূড়ান্ত ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শীগ্রই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ।’

‘তাই যেন হয়…’

‘শুধু বুঝতে পারছি না এসবের পেছনে কারণ টা ঠিক কি! নিনাদের কোনো প্রেম ঘটিত ব্যপার স্যপার আছে বলে তো জানা ছিল না। সরল শান্ত ছেলে, হৈ-হুল্লোড় এড়িয়ে চুপচাপ নিজের মতো থাকে। আগে যদিও বেশ প্রাণোচ্ছল ছিল, এখানে এসে যেন বেশ নিবিড় হয়ে গেছে।’

উত্তরে নিঃশব্দ তিহা।

‘আচ্ছা আপু এখনকার মতো ফোন ছাড়ছি। ভালো থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম।’

‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম… ‘ওপাশে কল কেটে যাবার পরও কিছুক্ষণ কানে ফোন নিয়ে বসে থাকে তিহা।

দীর্ঘ দিবসের ক্লান্তিতে কাতর চোখজোড়া থেকে ঘুম উধাও। তিহা লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবে নিনাদের দিকের অনুভূতি গুলো কি তবে নির্ভেজাল? অথচ অত কাছের বন্ধু হয়েও তিহা বোঝেনি! কি অনায়েসে বোনকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলো অন্যত্র। সব ঠিক থাকলে এতদিনে তিতিক্ষা অন্যকারো ঘরনি হতো!
আর তিতিক্ষা… তার মনের গহনেও কি অনুভূতি নামক চারাগাছের কোনো ডালপালাই বিস্তার লাভ করেনি? না, তা কি করে হয়? হলে কি আর অত সহজে সেই প্রভাষকের সঙ্গে বিয়েতে সম্মত হতো তিতিক্ষা? নিনাদের ভালোবাসা কি তবে চিরকাল একপাক্ষিকই ছিল?
চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়ালো। নিনাদটা অত দুর্ভাগা কেন? কেন ভালোবাসা নামক রিযকের এত সল্পতা তার জীবনে? তিতিক্ষা কি কোনোদিন নিনাদের জীবনের শূন্যতা একটুও বুঝেছে? বোঝার চেষ্টা করেছে?
না করার সম্ভাবনাই প্রবল অথচ তিতিক্ষার জীবন বিপর্যয়ের গল্প মুঠোফোনে শুনেও কেমন করে নিনাদ ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল সেটা তিহা টের পেয়েছিল অল্পস্বল্প। বাক্যবাগীশ নিনাদ, যার কথার মাঝে সদাসর্বদা একটা দুরন্তপনার অভিসন্ধি প্রচ্ছন্ন থাকে, সে ভয়ংকররকম নিস্তব্ধ হয়ে গেছিল সেসব শুনতে শুনতে।

.

স্যুপের বাটি নিয়ে তিহা দরজায় দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলে,’আসব?’

‘এসো’ তিতিক্ষার শান্ত প্রত্যুত্তর।

চিরন্তন অধিকারবোধ থেকে কাছে গিয়ে বোনের কপালে হাত রাখে তিহা,’ জ্বর তো কমেছে মনে হচ্ছে। অন্যকোনো অসুবিধে নেই তো?’

‘না আলহামদুলিল্লাহ এখন ঠিক আছি।’ বলতে বলতে তিতিক্ষা বিস্ময়ের চিহ্নখচিত মুখখানা ওপর তুলে স্থির হয়ে যায়, ‘মা শা আল্লাহ বুবু। এই পোশাকে তোমায় আরো পবিত্র দেখায়।’

ঈষৎ লজ্জা পেল তিহা। সেটা দ্রুত ঢাকতেই কণ্ঠে আবারো জড়িয়ে নিল গম্ভীরতার চাদর।
‘আমি বেরোচ্ছি। আজ তো বৃহস্পতিবার। ছোটনের হাফডে। দ্রুত ফিরব ইন শা আল্লাহ। খালা রইলো, কিছু লাগলে ওনাকেই বলিস।’

‘আচ্ছা বুবু। আসসালামু আলাইকুম।’

নিম্ন স্বরে সালামের জবাব করে আরো কিছুকাল দাঁড়িয়ে থাকে তিহা। মাথায় জড়ানো হিজাব, গায়ে বোরকা। একটা প্রচ্ছন্ন অস্বস্তি। ছোটনের বন্ধুর মায়েরা তিহাকে আধুনিকা বলে বেশ সমীহ করে। শাড়ি, অলংকার কেনার আগে পর্যন্ত তিহার পরামর্শ না পেলেই না। আজ তিহাকে নতুন বেশে দেখে ওদের অভিব্যক্তি গুলো কেমন হবে? তাচ্ছিল্য, তিরস্কার, নাকি উৎসাহ?

যদিও রাতের সেই অসহায়, অবর্ণিত আতঙ্কের আবেশটা এই দিনের আলোতে বেশ সুদূর বলে মনে হয়। সমস্ত ভয় ভীতির চিন্তারা যেন রাতের জমাট অন্ধকারের সাথে সাথে মনের বিশুদ্ধ কোন ছেড়ে গায়েব হয়েছে। তবু কিছু একটা তিহাকে নিজের এই নতুন সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকতে বারবার উৎসাহিত করে। এটাই কি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবার প্রতিক্রিয়া? তিনিই কি তবে তাকে এই পথে অবিচল থাকার শক্তি দিচ্ছেন?

ভেবে আনমনে তিহার দৃষ্টি একাই নিপাতিত হয় বোনের নিষ্প্রভ মুখের পানে। নিমীলিত চোখের ফ্যাকাসে মুখটা যেন শরতের সবুজ দীঘিতে ফোঁটা শ্বেতপদ্মের মতই নির্মল। অবচেতন ভাবে তিহা সেই ক্লেশ জড়িত স্থির কান্তিতে কিছু একটা খোঁজে। হয়তো সামান্য একফালি ভালোবাসার চিহ্ন… হ্যাঁ, নিনাদের জন্য ওই মায়াময় মুখের কোথাও কি সামান্যতম অনুভূতির স্ফুরণ নেই?
কিন্তু কই, কিছুই তো নজরে আসছে না। ভালোবাসার যে স্বতন্ত্র ভাষা থাকে। ঐচ্ছিকতা তাকে যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক, অবচেতনে তার সামান্য প্রকাশ যে অবধারিত। তিহা খুঁটিয়ে দেখে বোনের মুখ, অতল দুখানা চোখ, ভ্রুলেখার ঋজুতা…. সব জুড়ে কেবল মায়া আর মায়া। অথচ… যা খুঁজে বেরাচ্ছে তার সন্ধান যেন কোথাও নেই! এত বছরেও কিছু জন্মায়নি যখন তবে আর কবে জন্মাবে?

.

আজকাল তিহার দিনগুলো কাটছে একটু ভিন্নরকম ব্যস্ততায়। সলাতে সে আগে থেকেই নিয়মিত ছিল। এই অভ্যেস ছোট কালের। বাবা শিখিয়েছিলেন জীবনে যত ঝড়-ঝঞ্ঝা আসুক, এক ওয়াক্ত সলাত কখনো যেন বাদ না পড়ে। মানুষের দেহের খোরাক যেমন খাদ্য, তেমনি রূহের খোরাকী হলোর প্রভুর একান্ত ইবাদাত। দেহের খোরাক ছাড়া যেমন কোনো মানুষ সুস্থ হয়ে বাঁচে না তেমনি রূহের খোরাকী ছাড়াও তার মৃত্যু অবধারিত।
তবে এই সলাতকে তিহা তার জীবনের একটা দায়সারা অংশ ভেবে নিয়েছিল। মুসল্লায় দাঁড়িয়ে কলের পুতুলের মতো একের পর এক সূরা আবৃত্তি করে যাওয়া। যেথায় কোনো প্রাণ নেই, রবের সান্নিধ্যে অন্তরে তীব্র ভাবাবেগের জোয়ার নেই।

এখন সে এই সলাতটাকে ঠিক করার প্রয়াস চালাচ্ছে। হাশরের ময়দানে সবার আগে নাকি হিসেব নেয়া হবে বান্দার সলাতের। তাছাড়া কোথায় যেন শুনেছিল, সহিহ ভাবে সলাত আদায় বাকি সব পাপকাজ থেকেও বান্দাকে দূরে রাখে। তিহা ভেতরে প্রবল এক তাড়না অনুভব করে আজকাল। তাকে এই জীবন ধারা বদলাতে হবে। যার জন্য সবার আগে প্রয়োজন করুণাময়ের প্রতি একান্ত প্রার্থনা সঠিক উপায়ে করা।
চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে