দু মুঠো বিকেল পর্ব-২১+২২+২৩

0
1922

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_২১
Writer-Afnan Lara
.
কিরে স্পর্শ এদিকে আয়,রিহাব আঁখিকে রিং পরাচ্ছে,দেখবি না???
.
বাবার ডাকে স্পর্শ চোখের পানি মুছে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে,রিম যেটা চাইছে সে তাকে সেটাই দিবে,যতই হোক,যত কিছুই করতে হোক না কেন সে রিমকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবে
.
কারণ এবার রিম নিজেই আমার থেকে কিছু চাইছে আর তা আমি তাকে দেবোই
.
রিম উঠে দাঁড়ালো,একবার গিয়ে স্পর্শকে সরি বলবে তাই কিন্তু তার আগেই দেখলো স্পর্শ এসে গেছে
স্পর্শ ভুলেও তাকাচ্ছে না রিমের দিকে,,রিম ও বুঝলো স্পর্শ তার কথা রাখবে তাই কিছুটা খুশি হলো সে
রিহাব আঁখির আঙুলে রিং পরিয়ে দিয়েছে,আঁখিও পরিয়ে দিলো ওর পরে
অবশেষে আংটি বদলের অনুষ্ঠানটা শেষ হয়েছে
এবার সবাই খাবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত
রিম খেতে বসে একবার স্পর্শর রুমের দিকে তাকালো,স্পর্শ রুমে তার মায়ের আর বাবার সাথে কি যেন কথা নিয়ে কথা কাটাকাটি করছে
রিম চুপচাপ তামিমকে খাওয়ানোই মন দিলো

এসব কি স্পর্শ??হঠাৎ এই ডিসিশান কেন নিলি?
.
রোকসানা তুমি চুপ থাকো,স্পর্শ এতদিনে চাকরি করতে চেয়েছে যখন তখন তোমার কোনো অধিকার নেই ওকে আটকানোর
.
আমার ছেলেকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে??
.
ও কয়েক বছরের জন্যই তো যাচ্ছে,আর বিদেশে তো আর যাচ্ছে না,তাছাড়া ঢাকার বাহিরেও না,শুধু একটু দূরে থাকার চেষ্টা করছে,আমি আজ অনেক খুশি আমার ছেলে নিজের পায়ে দাঁড়াবে শুনে
.
রোকসানা বেগম মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়লেন,স্পর্শ উনার কাঁধ ধরে বললো”মা,এভাবে আমাকে বাধা দিলে আমি যাব কি করে বলো??আচ্ছা প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলবো,ঠিক আছো?”
.
তোকে তো আর ছুঁয়ে দেখতে পারবো না
.
এইটুকু সেক্রিপ্রাইস তো করতেই হবে
.
মা চোখ মুছে বললেন”আমিও খুশি বাবা,তুই যে ফিউচার নিয়ে ভাবতেছিস,অনেক অনেক খুশি”
.
তাহলে আজ রাতেই যাই?
.
কেন?আর তুই উত্তরায় কোথায় থাকবি??সেখানে তো আমাদের চেনাজানা কেউ নেই,আর কথা হলো এত রাতে গিয়ে থাকবিটা কোথায়?
.
সেসব বাবা দেখে নেবে,তবে আমি আজই যেতে চাই
আর চেনাজানা কেউ নাই মানে??মিজান চাচাকে ভুলে গেছো??
.
মা কিছু বললেন না আর,চুপচাপ চলে গেলেন রুম থেকে
.
রিমঝিমেরা সবাই চলে যাচ্ছে,বিদায় দিচ্ছেন রোকসানা বেগম আর আসাদুজ্জামান,পাশে নিহা আর তার আম্মু ও দাঁড়িয়ে আছে
.
রিম একটিবারের জন্য ও আর স্পর্শকে দেখলো না
বাসায় ফিরে চেঞ্জ করে বারান্দায় এসে বসলো সে,মনটা কেমন কুডাক দিচ্ছে,কিছুই ভাল্লাগছে না তার
.
রাত তখন দশটা বিশ বাজে,চেনাপরিচিত মানুষটা কাঁধে ব্যাগ আর হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে বাসার সামনে দিয়ে,রিম খেয়াল করেই নড়েচড়ে বসলো,দেখতে স্পর্শর মতই লাগছে,তবে স্পর্শ কেন হবে?
এই ভেবেই রিম আরেকদিকে ফিরে বসলো
স্পর্শ থেমে গিয়ে পিছন ফিরে রিমের দিকে তাকালো,রিম গালে হাত দিয়ে ওরই বারান্দার দিকে চেয়ে আছে
.
স্পর্য় মুচকি হেসে বললো”তোমাকে কাছে রেখেও দেখার লোভ আমি সামলাতে পারবো না রিম,কিন্তু তুমি আমার থেকে যা চেয়েছো তা যে আমাকে পূরন করতেই হবে,আর তাই চলে যাচ্ছি তোমার থেকে দূরে,যেখানে আমি চেয়েও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আশেপাশে তোমাকে দেখতে পাবো না
সমস্যা না আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে
.
রিম নিজের রুমে ফেরত এসে জানালার পর্দা সরিয়ে স্পর্শর রুমের দিকে তাকালো,রুমটা অন্ধকার হয়ে আছে,রিম পর্দা টেনে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো এবার
.
স্পর্শ উত্তরায় এসে গেছে,,এখানে ওর চাচা মিজানের বিরাট বড় একটা দালান আছে,৮তলার,,তো স্পর্শের বাবার সাথে কথা বলে তিনি প্রথমে চাইলেন তার সাথেই যেন স্পর্শ থাকে,কিন্তু স্পর্শ রাজি হলো না
সে আলাদা একটা ফ্ল্যাটেই থাকবে,তাই তিনি একটা ফ্ল্যাট স্পর্শকে দিয়ে দিলেন,এটা তিনি রেখেছিলেন স্পর্শর বিয়েতে উপহার দেবে বলে,আর এখন যখন প্রয়োজন তখন এসময়েই তিনি দিয়ে দিলেন,দ্বিদাবোধ করলেন না
.
স্পর্শ হাতে চাবি নিয়ে থার্ড ফ্লোরের বি ইউনিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে,তারপর বড় করে একটা নিশ্বাস ফেলে দরজা খুললো সে
পুরো ফ্ল্যাটটা খালি,স্পর্শ চায় সে তার চাকরির টাকায়
এক এক করে সব জিনিসপাতি কিনবে
ফাঁকা ফ্ল্যাটে ঢুকে একটা পছন্দের রুম বের করলো সে
এই রুমটা আজ থেকে তার
ট্রলি ব্যাগটা ফ্লোরে শুইয়ে তার চেইন খুলে ভেতর থেকে একটা মোড়ানো পোস্টার বের করলো সে
তারপর দেয়ালে চারিদিক খুঁজে একটা পেরেক লাগানো পেলো
পোস্টারটা খুলে সে পেরেকে লাগিয়ে দিলো
পোস্টারটা জুড়ে রিমের ছবি,বিরাট বড় একটা ছবি
এটা স্পর্শ বানিয়েছিলো রিমের জন্মদিনে দেবে বলে
কিন্তু তা তো আর হবে না তাই সে এটা নিজের জন্যই নিয়ে আসলো,প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সে রিমকে দেখবে যেমনটা আজ পর্যন্ত হয়ে এসেছে”””বাস্তবে না হোক ছবিতেই শ্রেয়””””
ছবিটার দিকে তাকায়েই রইলো সে,রিম গালে হাত দিয়ে তার বারান্দায় বসে আছে,ছবিটা ওরই অগোচরে তোলা
একটা ফটোগ্রাফার দিয়ে স্পর্শ গতবছর তুলিয়েছিলো,এবার রিমের জন্মদিনে দেবে বলে
.
ভাবতে ভাবতেই স্পর্শর ফোনে কল আসলো ওর চাচা মিজানের
উনি ফোন করলেন স্পর্শ যেন তার বাসায় আসে ডিনার করার জন্য
স্পর্শ ঠিক আছে বলে ফোনটা পকেটে ঢুকালো,তারপর রিমের দিকে তাকিয়ে সে চলে গেলো বাসা লক করে
একটু হাঁটলেই একটা দোতলা বাড়ি পড়ে,সেটাই মিজান চাচার,স্পর্শ উনাদের বাসায় এসে বসতেই চাচা এক গাদা জ্ঞান শুনিয়ে দিলেন যে হুট করে স্পর্শ এমন একটা ডিসিশান কেন নিলো
তারপর হাজার হাজার জ্ঞান দিয়ে শেষে তিনি বললেন”থাক যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো ভালোই নিয়েছো,আই এপ্রিসিয়েট ইউ”
.
স্পর্শ চাচির হাতের মোরগ পোলাও খেতে খেতে এতক্ষণ মাথা নাড়ছিলো
চাচার কোনো ছেলে নাই,একটাই মেয়ে আছে,তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন,আপাতত বাসায় একাই থাকেন চাচিকে নিয়ে
স্পর্শকে নিজের ছেলে মনে করেন তিনি,,অনেক জোর করার পরেও স্পর্শ থাকতে রাজি হলো না তার কাছে
শেষে স্পর্শ আর কথায় না পেরে বললো”আচ্ছা একটা তোষক, বিছানার চাদর,কম্বল আর একটা বালিশ দেন,তাতেই হবে”
.
চাচা আর কি করবে,স্পর্শর যা যা দরকার সব রিকশা ধরিয়ে পাঠিয়ে দিলেন
স্পর্শ আলাদা লোক ধরিয়ে সেগুলো তার ফ্ল্যাটে অবদি নিয়েও আসলো
এবার ঘুম দেবে,সকাল সকাল উঠে আবার চাকরি খুঁজবে সে
.
নিজের রুমে তোষকটা টেনে হিঁচড়ে এনে বিছানা বানিয়ে নিলো এক কোণায়
তারপর রিমের ছবিটার দিকে চেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে,ফ্লোরে শোয়ার অভ্যাস নেই কিন্তু কষ্ট তো করতেই হবে,,আমাকে সব নিজের পরিশ্রমে উপার্জন করতে হবে,কারোর দয়ায় না

পরেরদিন সকাল হতেই ঠিক সেসময়ে রিম জেগে গেলো যে সময়ে সে প্রতিদিন স্পর্শর সামনে গিয়ে দাঁড়াতো
কিন্তু সে বারান্দায় গেলো না,জানালার কাছে এসে পর্দাটা সরালো,স্পর্শের বারান্দা দিয়ে আলো এসে ওর রুমটা আলোকিত হয়ে আছে,বিছানাটাও গোছানো,বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটা নেই শুধু
রিম কৌতুহল নিয়ে পা টিপে টিপে বারান্দায় আসলো,বাসার সামনের সরু পথটা ফাঁকা,কাকপক্ষী ও নেই কোথাও
লোকটা কি আজ আসবে না?
ধুর আমিও বোকা,আমি তো তাকে কাল বলেছিলাম আমাকে মুক্তি দিতে,তার মানে আমার কথা রেখেছে,তাহলে তো ভালোই
.
রিম চুলে খোঁপা করতে করতে গেলো রান্নাঘরের দিকে,আজ সে সকালের নাস্তা বানাবে
ঠিক সাতটা দশ মিনিটে সব রেডি করে রিম টেবিলে এনে রাখলো,মা জেগে গিয়ে বাহিরে এসে এসব দেখে অবাক হয়ে বললেন “কিরে??এত সকাল সকাল এসব করলি কখন”
.
মন চাইলো,ভাইয়া জলদি অফিস যাবে তো
.
ভালো করেছিস,আমার শরীরটা ভালো লাগছিল না
.
রিহাব সাড়ে সাতটার দিকে রেডি হয়ে নিজের রুম থেকে বের হলো এক গাল হাসি নিয়ে
তারপর সোফার উপর বসে মোজা পরতে পরতে সে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো”মা এবার রিমকে আমরা শান্তি মতন বিয়ে দিতে পারবো,কোনো সমস্যা হবে না আর”
.
রিম প্লেটে রুটি রাখতে গিয়ে থমকে গেলো,তারপর চমকে রিহাবের মুখের দিকে তাকালো সে
.
রিহাব মুচকি হেসে বললো”আঁখি আমাকে ফোন করেছিল,স্পর্শ নাকি কাল রাতে চাকরি করবে বলে চলে গেছে তার চাচার কাছে,তাহলে আর রিমকে জ্বালাবে না সে,যা বুঝলাম”
.
মা খুশি হয়েও যেন হননি,তিনি সবার আগে রিমের দিকে তাকালেন
রিমের বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে,কিন্তু কেন জ্বলছে তা সে জানে না
রিহাবের জন্য প্লেট সাজিয়ে সে নিজের রুমে চলে আসলো,দরজা লাগিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে জানালার পর্দা সরিয়ে ফেললো সে
স্পর্শর রুমটা তাকে ডাকছে খুব করে,স্পর্শর প্রতি এত টান আজ পর্যন্ত তার হয়নি
প্রতিদিন তাকে এত কাছে দেখতে দেখতে আজ তার এতদূরে চলে যাওয়ার কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে,কেন এত কষ্ট হচ্ছে,কেন!!
.
স্পর্শ ফোনে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলো,জাস্ট আটটা বাজতেই সে উঠে পড়লো,,জলদি করে ব্যাগ থেকে নিজের সব সার্টিফিকেট নিয়ে বাহিরে রেখে শার্ট প্যান্ট পরে তৈরিও হয়ে নিলো সে
তারপর সব কাগজপত্রের ফাইল নিয়ে ছুটলো দরজায় লক করে
খাওয়া দাওয়া পরে হবে,আগে চাকরি খোঁজা হবে
খাওয়া দাওয়া নিয়ে চিন্তা নাই,চাচির হাতের মজার মজার ডিস তো আছেই
.
সকাল দশটায় একটা অফিসের ইন্টার্ভিউ,অফিসটা মূলত কাপড়ের ডিজাইন নিয়ে
স্পর্শ চুপ করে ওয়েটিং রুমে বসে আছে,একটু জলদিতেই এসে পড়েছে সে,পেট খিধায় শেষ,,কিছু খেলে ভালো হতো
.
পকেটে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শ চমকে গেলো,টাকার মনে হয় একটা গোটা বান্ডেল,কে দিলো?নিশ্চয় মায়ের কাজ এটা,উফ মা ও না!!
.
একশো টাকার একটা নোট নিয়ে স্পর্শ পাউরুটি কলা কিনে এনে খাওয়া শুরু করতেই রিমের কথা মনে আসলো
রিম কলা খায় না,মেয়েটাকে সকাল থেকে দেখিনি,অথচ এতদিনে এতক্ষণে কতবার যে দেখা হতো ওর সাথে,না জানি কি করছে,আমার জন্য কি খারাপ লাগবে ওর?
মিস করবে আমাকে??
হয়ত করবে না,কারন আমি ওকে মুক্তি দিয়েছি,ওর তো এখন আনন্দের সময়,থাক আনন্দই করুক,তাও সে ভালো থাকুক
.
পাউরুটি কলা খাওয়া শেষে পানি ও খেয়ে নিলো সে,তারপর নিজের কাগজপত্র সব ঠিক আছে কিনা সেসব দেখে নিলো
মিনিট পাঁচেক পর স্পর্শর ডাক পড়লো ইন্টার্ভিউ রুমে
অফিসের বস তিনজন,তারা স্পর্শর সব কাগজপত্র দেখে বেশ খুশি হলেন,কারণ এমন একটা ক্যান্ডিডেটই তারা খুঁজছিলেন
স্পর্শ কনফিডেন্ট নিয়েই এসেছিল এখানে
কারণ তার যে সার্টিফিকেট তাতে সে প্রাইভেট কোম্পানিতে অনায়াসেই ঢুকে যেতে পারবে,আর সেটাই হলো
স্পর্শ মুচকি হেসে বাড়ি ফিরলো,সবার আগে কল করলো বাবাকে
বাবা আজ স্পর্শের চাকরি পাবার কথা শুনে খুশিতে কেঁদে দিয়েছেন,মা ও কাঁদছেন,তাদের খুশি দেখে স্পর্শর ও খুশি লাগলো,কথা শেষ করে ভিডিও কল কেটে পাশে তাকাতেই রিমের ছবিটা নজরে আসলো তার
এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে সে বললো”রিম??আজ তোমার স্পর্শ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে,তুমি কিন্তু আর আমাকে বেকার বলে ক্ষেপাতে পারবে না
হয়ত আর কথাই বলবে না কোনোদিন!!

কলিংবেল বেজে উঠেছে,রিম সকালের নাস্তা খাওয়ার পর থেকে বিছানায় শোয়া ছিল,কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রিম উঠে আসলো দরজা খুলতে
তামিম বাসায় নেই,রিহাব ওকে স্কুলে দিয়ে এসেছে তাই
দরজার ওপাশে আঁখি দাঁড়িয়ে আছে,হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে
চলবে♥

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_২২
Writer-Afnan Lara
.
আঁখি আপু যে,,কেমন আছো?
.
খুব ভালো,নাও মিষ্টি খাও আগে
.
কিসের মিষ্টি?
.
স্পর্শ ভাইয়া চাকরি পেয়েছে সেই খুশিতে পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিলাচ্ছে বাবা
.
রিম চুপচাপ মিষ্টির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললো”আসো ভিতরে আসো”
.
রিহাব আছে?
.
ভাইয়া তো এখন অফিসে,বাসায় নেই
.
তাহলে পরে আসবো,এখন যাই বরং
.
আঁখি খুশি খুশি চলে গেলো,রিম মিষ্টির প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে আছে তারপর সেটা নিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়ে আবারও নিজের রুমে চলে আসলো
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে স্পর্শর রুমটার দিকে চেয়ে থাকলো সে
কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে টেরই পেলো না রিম,এতক্ষণ ধরে স্পর্শ কেমন করে জ্বালাতো এতদিন সেসবই মনে করছিল সে
.
সোফার রুম থেকে লোকজনের আওয়াজ পেয়ে রিম ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দরজা খুলে বের হওয়ার আগেই মা ওকে নিয়ে রুমে ঢুকে পড়লেন আবার
রিম কিছু বুঝতে না পেরে বললো”কি হয়েছে মা??সোফার রুমে কাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে?কে এসেছে?”
.
তোর ভাইয়া একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছে,ওরই অফিসের কলিগ,,আরিয়ান নাম
.
ওহ,তো আমাকে টেনে রুমে ঢুকালে কেন?
.
আরে পুরো কথা তো শুনবি,,রিহাব আরিয়ানকে বলছে তোর বিয়ে নিয়ে,তো আরিয়ান বললো তারও বিয়ের জন্য তার ফ্যামিলি মেয়ে খুঁজছে,রিহাব বললো তাহলে তো হয়েই গেলো,রিমকে কেমন লাগে জিজ্ঞেস করায় আরিয়ান বললো বেশ ভালো,আর সেই সূত্রেই সে আজ এসেছে তোকে দেখতে আবার
.
কিন্তু মা আমি তো এখন বিয়ে করতে চাই না
.
রিহাব আর তোর বাবা শুনবে এই কথা?
.
মা প্লিস ভাইয়াকে বুঝাও না!
.
রিহাব আরিয়ানকে সোফায় বসিয়ে রিমের কাছে এসে বললো”কি বুঝাবে???আমি যেটা বলবো সেটাই হবে
চুপচাপ তৈরি হয়ে আরিয়ানের সামনে চা দিয়ে আয়
আর মা ওকে তুমি বুঝাও পারলে,ওর ভালোর জন্যই আমরা এতসব করছি,খারাপ কিছু তো আর করছি না,ঐ স্পর্শ না জানি কদিন পর এসে কি ঝামেলা করে আবার তার চেয়ে বরং সব ঠিক থাকতে থাকতে আগে ভাগে বিয়েটা দিয়ে দিব ওর
.
রিম দৌড়ে তার বারান্দায় চলে গেলো,মা একটা সুন্দর ওড়না বেছে রিমের মাথায় ঘোমটা দিয়ে ওর হাত ধরে নিয়ে গেলেন সোফার রুমের দিকে

রিম আরিয়ানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে,আরিয়ান রিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে যেন বাজারের তরিতরকারি কিনতে এসেছে সে
দেখা শেষে মা আবার রিমকে নিয়ে গেলেন,রিমের এতটা খারাপ লাগছিল যখন আরিয়ান ওর দিকে তাকিয়ে ছিল,অথচ স্পর্শর চাহনিতে ওর কখনও এরকম খারাপ লাগতো না,কারণ স্পর্শের চাহনিতে লালসা ছিল না কখনও
কি জানি আমার জীবনের মোড় কোনদিকে যাচ্ছে,যা চেয়েছিলাম তাই তো পাচ্ছি তাহলে সবকিছু থেকে এভাবে মন উঠে যাচ্ছে কেন আমার
.
সোফার রুম থেকে শোনা যাচ্ছে আরিয়ান নাকি রিমকে পছন্দ করেছে,এবার তার বাবা মা এসে রিমকে দেখে কথা পাকা করবেন
.
রিহাব দাঁত কেলিয়ে আরিয়ানকে নিয়ে চলে গেছে,,
রিম নিজের বাটন ফোনটা খুঁজে বের করলো ড্রয়ার থেকে,সব ডায়াল চেক করেও স্পর্শর নাম্বার পেলো না সে,,আগে স্পর্শ ফোন করলে একবার এক নাম্বার থেকে করতো,আর রিম ওকে এতই ঘৃনা করতো যে জীবনে নাম সেভ করে রাখেনি
তারপর সে বিবেককে প্রশ্ন করলো সে কেন স্পর্শর নাম্বার খুঁজছিলো এতক্ষন
ক্ষোভে ফোনটা ছুঁড়ে মেরে দুহাত দিয়ে মাথার চুল টানছে রিম,অসহ্যকর এক মনের যন্ত্রনা তাকে খেয়ে যাচ্ছে,তার এখন কি করা উচিত,এতদিন মুক্তি মুক্তি বলে চেঁচাচ্ছিলো আর এখন মুক্তি পেয়ে কান্না পাচ্ছে তার

স্পর্শ তার ফ্ল্যাটের রুমগুলো দেখছে হেঁটে হেঁটে আর একটা গান শুনছে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে
গানটার কিছু লাইন হলো”দু মুঠো বিকেল”
গানটা রিমের গলায় গাওয়া,একদিন রিম ছাদে দাঁড়িয়ে আনমনে গানটা গাইছিলো স্পর্শ সেটা রেকর্ড করে নিয়েছিলো লুকিয়ে
এখন সেটাই শুনছে সে,হঠাৎ গানের মাঝে ডুবে থাকায় দেয়ালের সাথে দুম করে এক বাড়ি খেলো সে
হুস আসতেই গানটা অফ করে রিমের ফোন নাম্বারটা ডায়াল করে কল করলো
তারপর ফ্লোরে গোল হয়ে বসে চুপ করে থাকলো
রিম চুড়ির আলনাটা থেকে এক এক করে সব চুড়ি নিয়ে বিছানায় ফেলছে
ফোনটা বাজতেই ধরে দেখলো অচেনা একটা নাম্বার
রিসিভ করে হ্যালো বললো সে,স্পর্শ রিমের হ্যালো শুনে বুকে হাত দিয়ে চুপ করে আছে
রিম অনেকবার হ্যালো বলেও কারোর কেনো উত্তর না পেয়ে কল কেটে দিলো নিজ থেকে
.
কে এটা,এতক্ষণ চুপ করে থাকলো,একটাও কথা বললো না??
.
স্পর্শ মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে চললো চাচার বাসার দিকে
.
কাল থেকে অফিসের ডিউটি শুরু,প্রচুর ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে,যাতে একটিবারও মনে না হয় যে আমি রিমের থেকে দূরে,,ওকে দেখিনি অনেকদিন হলো
মানে রিমকে মনের মাঝে আনাই যাবে না

রিম ঠিকমত খাচ্ছে না,কথা বলছে না কারোর সাথে,ওর দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে
এরকম খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে সে রোগী হয়ে যাচ্ছে দিনদিন
আরিয়ান এসে দেখে যাওয়ার ঠিক তিনদিন পর ওর মা,বাবা আর দাদি আসলেন রিমকে অফিসিয়ালি দেখার জন্য
মা জোর করে রিমকে একটা শাড়ী পরিয়ে তৈরি করে রাখলেন তারপর ওকে নিয়ে ওদের সামনেও বসিয়ে দিলেন
রিমের মায়াবতী রুপ আর নিষ্পাপ চেহারা দেখে উনারা তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ
রিমকে কিছু প্রশ্ন করলেন তারা তারপর বললেন বাসায় গিয়ে ফোন করে জানাবেন পছন্দ হয়েছে কিনা
রিম নিজের রুমে এসে গায়ের থেকে শাড়ীটা খুলে ছুঁড়ে মারলো
সাথে সাথে ফোন আসলো,,সেই অচেনা নাম্বার থেকে কল
রিম ফোনটাও ছুঁড়ে মেরে ভেঙ্গে ফেললো
রিহাব দরজার ওপারে থেকে বললো”সব ভেঙ্গে চুরে কি প্রমাণ করতে চাস তুই রিম??
তুই এই বিয়ে করবি না?
তাহলে কি ধরে নিতাম যে তুই স্পর্শকে ভালোবাসিস?সেই ছেলেটাকে ভালোবাসিস যে কিনা আমার গায়ে হাত তুলেছিল??
না আর তোর কথা আমরা শুনবো না,তোর বিয়ে হলে আরিয়ানের সাথেই হবে,দ্যাটস ফাইনাল”
.
রিম শক্ত হয়ে বসে আছে ঠাণ্ডা ফ্লোরের উপর,,হাতের চুড়িগুলো ঝুনঝুন করছে বারবার
এই শব্দ নাকি স্পর্শর খুব ভালো লাগতো,তাই তো সে আমাকে চুড়ি উপহার দিতো সবসময়
আগে তো তেমন চুড়ি পরতাম না আমি,কিন্তু স্পর্শ আমাকে চুড়ি গিফট করে করে আমায় চুড়ি পরার অভ্যাস গড়তে বাধ্য করেছে
আর এখন সেই মানুষটাই নেই
.
পরেরদিন তামিম যখন আঁখির দেওয়া স্পর্শের চাকরি পাওয়ার খুশিতে কেনা মিষ্টি খাচ্ছিলো তখনি রিহাব আরেকটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির হয়েছে বাসায়,চিৎকার করে বললো”মা বাবা দেখে যাও,কি এনেছি”
.
মা রান্নাঘর থেকে এসে বললেন”কিরে মিষ্টি আনলি??তা কিসের জন্যে?”
.
আরিয়ানের পরিবার রিমকে তাদের পুত্রবধূ বানাতে চায়
.
আলহামদুলিল্লাহ,,
.
বাবা তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে হাসিমুখে একটা মিষ্টি নিয়ে রিহাবের মুখে পুরে দিয়ে নিজেও একটা খেয়ে নিলেন
তামিম মাথা উঁচু করে রিহাবের হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেটের ভেতর উঁকি মেরে দেখলো সব সাদা মিষ্টি
আর আঁখিদের দেওয়া মিষ্টির প্যাকেটে সব লাল মিষ্টি,আর লালগুলোই তামিমের প্রিয় তাই সে আর রিহাবের হাতের প্যাকেটের মিষ্টিগুলোর দিকে কোনো আগ্রহ দেখায়নি,গপাগপ তার হাতের প্যাকেটটা থেকে মিষ্টিগুলো সাবাড় করায় মন দিলো সে
.
রিম বারান্দায় বসে আনমনে সেই পথটার দিকে চেয়ে আছে যে পথটা দিয়ে স্পর্শ রোজ বাইক নিয়ে আসতো,বুকের ভেতরটা থম হয়ে যেতো যখন সে আসতো,কিন্তু এখন আর এই রোডটার দিকে তাকালে সেই ভালো লাগা আসে না
রিহাব ভাইয়া কি বলেছিল যেন??আমি স্পর্শকে ভালোবাসি??
আসলেই কি বাসি?
না বাসি না,বাসলে তাকে নিজে সজ্ঞানে থাকা অবস্থায় তার থেকে মুক্তি চাইতাম না,,
কিন্তু তার চলে যাওয়াটা আমাকে কেন এত কষ্ট দিচ্ছে?
.
আপু?
.
তামিমের ডাকে রিম চমকে পিছন ফিরে তাকালো,তামিম হাতে মিষ্টির বাটি নিয়ে এগিয়ে আসলো,তারপর সেটা রিমকে দিয়ে বললো”নাও ধরো খাও,এখানে লাল মিষ্টিটা স্পর্শ ভাইয়াদের,আর সাদা গুলা আমাদের”
.
আমাদের মানে?
.
মানে তোমার বিয়ে হবে সেই খুশিতে রিহাব ভাইয়া মিষ্টি এনেছে
.
কথাটা শুনে রিমের হাত থেকে বাটিটাই পড়ে গেলো
.
তামিম ভয় পেয়ে বুকে থুথু দিয়ে বললো”কি হলো আপু,ফেলে দিলে কেন?”
.
রিম নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো সাদা মিষ্টিগুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে আর লাল মিষ্টিটা এখনও বাটির ভেতর
রিম বাটিটা তুলে তার ভেতর থেকে মিষ্টিটা হাতে নিয়ে বললো”যাও,আমি পরিষ্কার করবো এসব”
.
তামিম চলে গেলো খেলতে,রিম বিছানায় বসে লাল মিষ্টিটা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে ফ্লোরে পড়ে থাকা তার বিয়ের মিষ্টিগুলোকে দেখায় মন দিয়েছে

আচ্ছা রিম ফোন ধরলো না কেন,একদিন ধরে ট্রাই করছি ফোন বারবার বন্ধ বলছে কেন সেটা বুঝছি না!
কিছু হয়নি তো,নাকি রিম বুঝে গেছে কল করে কোনো কথা না বলা লোকটি আমিই
নাহহহ,আমার মন বলছে অন্য কিছু একটা হয়েছে
.
স্পর্শ দেরি না করে রিপনকে ফোন করলো
.
হ্যাঁ স্পর্শ ভাই বলো,কি খবর,আমাদোর বিদায় না দিয়েই চলে গেলা,আমাদের কি মনে পড়ে না তোমার?
.
অনেক মিস করি তোদের,কেমন আছিস?মাথার চোট ভালো হয়েছে তো?
.
হুম ভালো,,তা তোমার কি খবর
.
আমার কথা বাদ দে,রিমদের খবর জানিস কিছু?
.
না তো,কি হয়েছে ওদের??
.
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে,আচ্ছা আশেপাশে খোঁজ তো,তামিম পাকনাটাকে পাস কিনা
.
কে?ঐ বিচ্ছুটা,রিমঝিম ভাবীর ছোট ভাই?
.
হুম সে
.
রিপন স্পর্শর কথা মতন এদিক ওদিক তাকালো,রিমের বারান্দার দিকেও তাকালো তাও দেখলো না কোথাও,শেষে ছাদের দিকে তাকাতেই দেখলো,কিনারায় ওর মাথা দেখা যাচ্ছে,সামনে রিনতির মাথা,দুজন মিলে ঝগড়া করে যাচ্ছে
.
ঐ তামিম!
.
তামিম নিজের নাম শুনতে পেয়ে নিচে তাকালো রেলিং ধরে
.
এদিকে আয় লেদু
.
তোমাকে না বললাম আমাকে লেদু ডাকবা না,আমার নাম তামিম
.
আইচ্ছা আইচ্ছা তামিম,এদিকে আয় তো,কথা আছে,আসলে তোকে ক্যাটবেরি কিনে দিব
.
তামিম রিনতির সাথে কথা শেষনা করেই ছুটলো
রিনতি ও পিছন পিছন আসতে আসতে বললো”আমাকে অর্ধেক চকলেট দিবা তো??”
.
তামিম কিছু বলছে না,তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে সে নিচে নেমে যাচ্ছে
.
শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে রিপনের কাছে এসে বললো”আগে চকলেট দাও তারপর কথা বলবো”
.
তামিমের কথা শুনতে পেয়ে স্পর্শ মুচকি হেসে বললো”রিপন ওর হাতে ফোনটা দিয়ে তুই যা চকলেট কিনতে,আমি ওর সাথে কথা বলছি”
.
ঠিক আছে,নে লেদু ধর ফোন,স্পর্শ ভাইয়া তোর সাথে কথা বলবে
.
তামিম ব্রু কুঁচকে তাকালো রিপনের দিকে,কারণ রিপন সেই আবারও ওকে লেদু বলে ডেকেছে
.
হ্যালো তামিম??
.
হুম,তামিম বলছি
.
তোমার বোন কেমন আছে?
.
ভালো,আবার ভালো না
.
সেটা কিরকম??
.
আপু সারাদিন কান্না করে
.
কেন??
.
মা বলেছে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তো তাই
.
কোথায় যাবে?
.
আঙ্কেলের বাড়ি
.
কোন আঙ্কেল?
.
যার সাথে আপুর বিয়ে হবে সেই আঙ্কেল
.
রিপন চকলেট নিয়ে এসে বললো”ওরে গাধা,তোর বোনের জামাই হলে তোর দুলাভাই কিংবা শুধু ভাই হবে,আঙ্কেল হবে না”
.
আঙ্কেলের মতো দেখতে বলে আমি আঙ্কেল ডাকি,দাও আমার চকলেট আমাকে দাও
.
স্পর্শ ফোনটা রেখে চুপ করে আছে,বুকের ভেতর আগুন জ্বলছে,এই আগুন ঠিক ততক্ষণ নিভবে না যতক্ষন না সে এই বিষয়টার কিছু বিহিত করে
চলবে♥

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_২৩
Writer-Afnan Lara
.
রিম একটা বেগুনি রঙের শাড়ী পরে সোফায় বসে আছে,তার পাশেই আরিয়ান ও বসে আছে নিচের দিকে তাকিয়ে
কারণ তার সামনেই তার মা বাবা দাদি,ফুফু এবং তার ১৪গুষ্টি বসে মিটমিট করে হাসছে,,এসময়ে রিমকে দেখতে গেলে দারুন লজ্জায় পড়তে হবে তাকে
.
আজ আংটি পরাতে এসেছে তারা
তারা সবাই বলে বলে শেষে যে ঐ আংটিতে কত খানি স্বর্ণ দিয়েছে তারা
রিমের মাথা ঘুরছে ভনভন করে
কারণ তার না এই বিয়েতে মন আছে না অন্যকিছুতে,আপাতত সে একটু ঘুমাতে চায়,কদিন ধরে ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি,খাওয়ার কথা তো বাদই গেছে
.
রিহাবের কেনা আংটিটা রিম হাতে নিয়ে ওলটপালট করছে আর ঘুমের কথা ভাবছে
হঠাৎ করে স্পর্শর বলা একটা কথা কানে বাজছে ক্রমশ
.
দু বছর আগে বসন্তের শুরুতে টিএসসিতে গিয়েছিল রিমঝিম
একলা একলা তাও স্পর্শকে না জানিয়ে,,একটু আলাদা সময় কাটাতে চেয়েছিল সে
শিউলি ফুল হাতে নিয়ে খেলছিল, উপরে তুলে আবার সেগুলো ক্যাচ নিচ্ছিলো আর একা একা খিলখিল করে হাসছিলো,হঠাৎ ফুলগুলো আবারও উপরের দিকে মারতেই সেগুলো আর তার হাতে ফেরত আসলো না উপরে কেউ একজন হাত দিয়ে সেগুলো নিয়ে নিলো
রিম অবাক হয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো স্পর্শকে
স্পর্শ রিমের মুখের ভাবগতি দেখায় একটুও নজর দেয়নি,তার নজর হাতে থাকে এক মুঠো শিউলি ফুলগুলোর দিকে
সে কপালটা একটু কুঁচকে একটা শিউলি ফুল আঙ্গুলের ডগায় এনে ধরে বললো”জানো রিম,তোমাকে আমি স্বর্নের কিংবা রুপার কিংবা ডায়মন্ডের রিং দিব না কখনও
দিব ওয়াইল্ড ফ্লাওয়ার্সের
যেমন ধরো শিউলি/কাঠগোলাপ ইত্যাদি
.
রিম বোকার মতন স্পর্শর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
স্পর্শ ঝুঁকে নিচ থেকে একটা লম্বা ঘাসের শেকড় টেনে ছিঁড়ে নিয়ে সেটাকে গোল আকৃতি করে দুপাশ থেকে দুমুখ নিয়ে একটা শিউলি ফুলের সাথে আটকে নিলো, হয়ে গেলো ফুলের আংটি,,তারপর রিমের হাতটা আলতো করে ধরে ওর অনামিকা আঙ্গুলটায় ঢুকিয়ে দিয়ে বললো”এবার বুঝলে খুকি??”
.
রিম অবাক হয়ে হাতের দিকে চেয়ে ছিল সেদিন
সোনা/রুপা কিংবা হিরামানিকও সেদিন ঐ ফুলের আংটিটার কাছে ফ্যাকাসে মনে হয়েছিলো
.
হঠাৎ মায়ের ঝাঁকুনিতে রিমের হুস ফিরে আসলো আবার
রিহাব চোখ বড় বড় করে বলছে রিং পরাতে
রিমঝিম চুপচাপ রিং পরাতে নিতেই আরিয়ানের মা একটু নড়েচড়ে বললেন”আগে মনে হয় ছেলেরা পরায় তাই না?”
.
রিমের বাবা ইতস্তত হয়ে বললেন”তা ঠিক,আসলে এত টেনসনে আমরা সব গুলিয়ে ফেলেছি,নাও বাবা আরিয়ান আগে তুমি পরাও”
.
আরিয়ান রিমের হাত ছুঁতে যাবে তার আগেই ওর একটা কল আসলো
আরিয়ানের বাবা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন”কাজের সময় ফোন অফ রাখতে হয় কতদিন শেখাবো তোমাকে?”
.
উনার ধমকে পুরো ১৪গুষ্টি চুপ হয়ে গেছে
আরিয়ান কলটা রিসিভ করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর হঠাৎ চোখ বড় করে দরজা খুলে দৌড় দিলো সে
সবাই থ হয়ে বসে আছে,কি হলো,কেনোই বা আরিয়ান দৌড় দিল তার কারণ কেউই জানে না
এদিকে রিমঝিম একটু নিস্তার পেয়ে পা টিপে টিপে নিজের রুমে ফেরত চলে এসেছে
হঠাৎ বাতাসে জানালার পর্দা সরে যেতেই স্পর্শর রুমটা ওর নজরে আসলো আর ঠিক সে সময়ে একটা কথা মনে পড়ে গেলো
স্পর্শ বলেছিল”তোমাকে যে বিয়ে করতে আসবে সে কবুল বলার আগেই উধাও হয়ে যাবে”
রিম হেসে ফেললো মুখে হাত দিয়ে তারপর ভাবলো এটা স্পর্শর কাজ হবে কেন,আরিয়ানের সাথে তো ওর কোনো যোগাযোগ নেই,আর ও তো জানেও না আমার যে আজ আংটি বদল
কি জানি,ঐ লোকটার হাবভাব আমি ঠিক বুঝতে পারি না
কখন কি করে ফেলে
তবে যা করেছে ঠিক করেছে,একটু শান্তি লাগছে,আল্লাহ করুক যেন আরিয়ান আর আমাকে বিয়ে করতে না আসে

মিনিট বিশেক পর তামিম একটা মাল্টার ৩পিস হাতে নিয়ে খেতে খেতে এদিকেই আসছে,,একটু চুষছে আর মুখটা ১৪ডিগ্রি এঙ্গেলে ব্যাকা করছে,যেন কেউ ওকে জোর করে খেতে বলেছে
রিমঝিম বিছানায় বসে হাতের চুড়ি গুনছিল,তামিম ওর পাশে বিছানায় উঠে বললো”ঐ আঙ্কেলটা তো তোমাকে বিয়ে করবে না আপু”
.
রিম যেন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে,দাঁত কেলিয়ে সে তামিমকে ধরে ওর গালে চুমু দিয়ে বললো”কেন রে??”
.
আমি তো জানি না,শুধু জানি ওদের ১৩গুষ্টি মুখটা ছোট করে চলে গেছে
.
ওটা ১৪গুষ্টি হবে
.
কিভাবে??আরিয়ান আঙ্কেল তো আগেই চলে গেছে,তাহলে তো ১৩হওয়ার কথা
.
তোর প্যাঁচ রিনতি ছাড়া আর কারোর বোঝার ক্ষমতা নাই
.
জানো ঐ চিকচিক করা রিংটাও নিয়ে গেছে
.
সে নিক,আমার কি,আমি তো খুশি অনেক!
.
রিহাব রুমে এসে বললো”খুশি হয়ে লাভ নেই,তোর জন্য ছেলেদের লাইন লেগে থাকে,আমি আরেকটা জুটিয়ে নেবো,একটা গেছে তো কি হয়েছে?
.
রিমের মুখটা আবারও ফ্যাকাসে হয়ে গেলো,রিহাব ও চলে গেছে,ওর প্রচুর রাগ হচ্ছে আরিয়ানের উপর
আরিয়ান নাকি তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ফিরে পেয়ে এই এঙ্গেজমেন্ট থেকে ভেগেছে
ওর তো শুনেছিলাম চার বছর আগে ছাড়াছাড়ি হয়েছিল মেয়েটার সাথে তাহলে হঠাৎ কোথা থেকে উঠে আসলো মেয়েটা??
ভাবতে পারি না এসব,যতই জলদি করতে যাই ততই কদিন পিছিয়ে যাই মনে হচ্ছে আগে আমার বিয়েটাই হয়ে যাবে
রিমের জন্য এখন আবার ছেলে খুঁজতে হবে,এভাবে একা রাখা যাবে না,ঐ স্পর্শ আবার কখন বাড়ি ফিরে আসবে কে জানে

স্পর্শ একটা সোফায় পা দিয়ে মাথা ফ্লোরে রেখে রিমের ছবির দিকে চেয়ে আছে
চাচার থেকে ৫হাজার টাকা ধার নিয়ে একটা সোফা কিনেছে সে, দেখতে সিঙ্গেল বেডের মতন
বেতন পেয়ে অবশ্যই টাকাটা ফেরত দেবে
ছোটকাল থেকেই সোফার প্রতি স্পর্শর এক আলাদা টান
খাবে সোফায়,শুবে সোফায়,বসবে সোফায়,খালি বাথরুমটা বাথরুমের জায়গায়
তো কদিন ধরে লোহার মত শক্ত,বরফের মতো ঠাণ্ডা ফ্লোরের উপর হাল্কা পাতলা তোষক বিছিয়ে কদিন শুয়ে তার পিঠের হাঁড়গোড় সব গেছে তাই আগে বিছানা না কিনে সোফাই কিনলো
বসাও যাবে,,শোয়াও যাবে,লম্বামতন একটা সোফা

তাতে ওলটপালট হয়ে শুয়ে সে রিমঝিমের ছবির দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে
কারণ কিছুক্ষণ আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাটার সম্পূর্ন দায়ভার স্পর্শর একান্তের
সে দুনিয়া খুঁজে আরিয়ানের প্রাক্তন এবং বর্তমান প্রেমিকাকে বের করেছিল
পরে ওদের দুজনের সাথে কথা বলে বুঝলো আরিয়ানের বর্তমান যে আছে মানে আয়েশা, সে আরিয়ানকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না,বাট প্রাক্তন যে আছে মানে জুঁই সে আরিয়ানকে এখনও ফিরে পেতে চায়
তো একে একে দুই হয়ে গেলো
স্পর্শর আর তার শার্টের হাতা ফোল্ড করে মাইরপিট ও করতে হলো না,বিনা মাইরপিটেই সমস্যা সমাধান!!!
আরিয়ানের এভাবে দৌড়ে যাওয়ার আবার অন্য প্রসঙ্গ আছে আর সেটা হলো আয়েশা আরিয়ানকে কল করে সবার আগে জিজ্ঞেস করলো”জুঁই কে?সামনা সামনি এসে পুরোটা ক্লিয়ারলি বলো নয়ত তোমার এঙ্গেজমেন্টের চাচা জেঠা করে দিব”
মূলত সেই কারণেই আরিয়ান দৌড় দিছিলো
কিন্তু কে জানে সে তার প্রাক্তনকে ফিরে পেয়ে যাবে,আবার আগের স্মৃতিতে মুগ্ধ হয়ে সে রিমকে বিয়ে করতে মানা করে দেবে
আয়েশাকে দিয়ে কথাগুলে স্পর্শ বলিয়েছিলো আরিয়ানকে অন দ্যা স্পটে আনানোর জন্যই,আর সেটাই হলো!!!
আর যাই হোক স্পর্শ এখন মহাখুশি,রিমকে আপাততর জন্য কুমারি তো রাখলাম এতেই আমার শান্তি

রিম শান্তিতে একটু বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলো,প্রচুর মাথা ধরেছিল তাই
হঠাৎ ওর নজর পড়লো স্পর্শের বারান্দার ফুলগুলোর দিকে
কেমন নির্জীব হয়ে আছে,অবশ্য এরকম হওয়ারই কথা কারণ যত্ন নেওয়ার মানুষটাই তো নেই
রিমের খুব মায়া হলো,সে রান্নাঘরে গিয়ে এক মগ পানি এনে দূর থেকেই ছুঁড়ে ছুঁড়ে পানি দিতে থাকলো গাছগুলোতে
ঠিক সেসময়ে হাজির হলো রোকসানা বেগম
উনি ব্রু কুঁচকে বারান্দায় পা রেখে অগ্নি দৃষ্টিতে রিমঝিমের দিকে তাকালেন তারপর গাছগুলোর দিকে
রিমঝিমের মনে হচ্ছে ওর কলিজা কাঁপতে কাঁপতে বেরই হয়ে আসবে ভেতর থেকে
সে মগটা সরিয়ে মাথার ঘোমটা টা ভালো করে টেনে নিলো
.
কি ব্যাপার??
.
আসলে আন্টি গাছগুলোতে পানি দেওয়া হয় না মনে হচ্ছিলো তাই দিচ্ছিলাম
.
তোমাকে এত ভালো কে করতে বলেছে?আমার বোনের মেয়ে নিহা আছে না??
ও কিছুদিন ধরে এই বাসায় বেড়াচ্ছে,ও পানি দিবে,তুমি কেন দিচ্ছো?
আচ্ছা আচ্ছা!!! স্পর্শকে মিস করছো বুঝি??এতদিন তো অনেক হালাফালা করেছিলা তা এখন দরদ উতলিয়ে পড়ছে বুঝি?
তাহলে শুনে রাখো এত দরদ দেখিয়ে লাভ নেই,কারণ বিয়ে হলে আমার নিহার আর স্পর্শেরই বিয়ে হবে
তোমার ভাইকে আমরা মেনে নিছি তার মানে এই নয় যে তোমাকেও মেনে নিব
.
নিহা এরকম হট্টগল শুনতে পেয়ে দৌড়ে আসলো স্পর্শর রুমে,তারপর রোকসানা বেগমের কথা সব দূর থকে শুনে যা বুঝলো তা হলো স্পর্শ যে রিম বলতে পাগল ছিল এই সেই রিম
নিহা তো যেন হাতের মোয়া পেয়েছে
সে কোমড়ে হাত দিয়ে এগিয়ে এসে বললো”স্পর্শর এডুকেটেড মেয়ে পছন্দ বলে আমি এতদূর পড়তেছি আর মাঝখান থেকে তুমি কই থেকে আসলে??ও শুধু আমার,তাই না খালামণি??”
.
হুম,,নিহাই আমার বাড়ির বউ হবে,বুঝছো?আর এদিকে ভুলেও তাকাবা না
যত্তসব!!!এই চল তো নিহা,ভাইবোন দুটো মিলে আমার বাসার ছেলেমেয়েকে ফাঁসানোর ধান্দায় আছে
.
রিমঝিম মন খারাপ করে রুমে ফেরত আসতেই শুনলো আরেক খবর যেটা শুনে ওর মন খারাপ এবার চরম পর্যায় চলে গেছে আর সেটা হলো রিহাব আরেকটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির
আর এবার ছেলেটার প্রাক্তন নাই,বর্তমানও নাই,পুরা সাদাসিধে,, একদম পারফেক্ট রিমের জন্য
রিমের খুব রাগ হচ্ছে,এতদিন ধরে যে সিদ্ধান্তটা সে নিয়েছিল সেটা পূরন করার সময় হয়ে গেছে মনে হয়
কথা হলো চাকরি কই পাবে?বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে তো আর সাথে সাথে চাকরি পাওয়া যাবে না
যাক গে,আমার কি,একটা না একটা চাকরি তো পেয়েই যাব,তাও এই বাসায় আর আর থাকব না
যাকে পাচ্ছে তার সাথে বিয়ে ঠিক করছে,একটা প্রতিশোধ পূরণ করার জন্য আমাকে বলি দেবে বলে ঠিক করেছে এরা
ভাবতে ভাবতে রিম ৪টে থ্রিপিস,৪টে শাড়ী,তোয়ালে গামছা সব ব্যাগে পুরে নিলো,তারপর একটা কালো বোরকা বের করলো এটা পরে বের হবে
পেটে একটা বালিশ বেঁধে নিলো
প্রেগন্যান্ট মহিলাদের তো আর মানুষ ধর্ষণ করবে না,বা করার চেষ্টা করলো সেটা ভাবতে ভাবতে ততক্ষণে আমি পালাবো
বিদ্যার একটা মুভিতে দেখছিলাম ও পুরো সময়ে প্রেগন্যান্ট হওয়ার নাটক করেছিলো
আমিও এমন করবো,হেহে রাস্তার চান্দুরা তোমরা আমাকে চেনো না,আমি মহাচালাক
রিম এবার নিজের পকেটমানি জমানোর ব্যাংকটা বের করলো
সেটাতে ২৩৪৩টাকা আছে বরাবর
এটা দিয়ে কি হবে??
সে যা হবে দেখা যাবে,বাট আমি আর এই বাসায় থাকবো না,ইম্পসিবল
তমার বাসায়ও যাওয়া যাবে না,ভাইয়া সবার আগে আমাকে সেখানেই খুঁজতে যাবে
চোখ যেদিকে যাবে ঠিজ সেদিকেই যাব
.
রাত সাড়ে দশটা বাজে!
রিমঝিম এতক্ষণ গাপটি মেরে বসেছিল তার রুমে,তাও দরজা লাগিয়ে
কারণ যে সাজ সে দিয়েছিল এটা যদি তামিমও দেখে ফেলে তাহলে তুলকালাম হয়ে যেতো
যাই হোক সবাই যে যার রুমে,ঘুমিয়েও পড়েছে
রিম এই সুযোগে দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে,,তার রুমে বিছানার উপর একটা চিঠি ফেলে এসেছে
তাতে লেখা”বহুত দমাইয়া রেখেছিলা,এবার আমি তোমাদের দমাবো”

নির্জন এলাকা,,পথে ঘাটে মানুষ আছে অবশ্য!
.
এর ভেতর রিম হেঁটে চলেছে মুরব্বী সেজে,আবার পেটটাও ইয়া বড়,ইয়া বড় পর্দা মুখের সামনে
কেউ কেউ ওর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে,তা দেখে রিম ভাবছে কুশন দুইটা লাগিয়ে কি ভুল করেছি??একটা লাগালে ভালো হতো হয়তবা
চলবে♥

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে