দিন বদলের কাব্য

0
579

কালো জমিনে সোনালী জরির জামদানীটা উল্টেপাল্টে কয়েকবার দেখেও কেন যেন মন ভরেনা আমার। আমার মেয়ে কিনে এনেছে আজ আমার জন্য। গতমাসে মেয়ের সাথে বসুন্ধরা সিটিতে শাড়ীটা দেখেছিলাম। পনের হাজার টাকা দাম চেয়েছিল জিজ্ঞেস করাতে। এমন না যে এই টাকা দিয়ে আমি শাড়ীটা কিনতে পারতামনা। কিন্তু নিজের জন্য এতোগুলো টাকা খরচ করতে কেন যেন হাতে ওঠেনি।

– এই সুমি, কত দিয়ে কিনলি রে শাড়ীটা?

মা, তোমাকে কতবার বলেছি উপহারের দাম জিজ্ঞেস করতে নেই।

– তবুও বল না। ঠকে গেলি কিনা কে জানে।

ঠকে গেলে গেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা সেটা বলো।

– তুই কিভাবে বুঝলি আমি এমন একটা শাড়ী কিনতে চাই?

আমি দেখেছি তুমি সেদিন মার্কেটে এই শাড়ীটা উল্টেপাল্টে দেখছিলে। হাতে টাকা ছিলনা দেখে সেদিন কিনতে পারিনি। শোন আমি যাই। বাচ্চাদের স্কুল থেকে তুলে বাসায় ফিরতে হবে। রাতে কথা হবে ফোনে।

দরজা বন্ধ করে এসে আবার শাড়ীটা হাতে নিয়ে বসি। কত হাজারো অতীত স্মৃতি যে মেয়েটা মনে করে দিল এরকম একটা শাড়ী উপহার দিয়ে তা বুঝি শুধু আমার মনই জানে। কালো শাড়ীর প্রতি আমার দূর্বলতা সেই কিশোরীবেলা থেকে।

আট ভাইবোনের সংসারে আমার অবস্থান ছিল পঞ্চম। আমাদের যুগে যার ঘরে বেশী ছেলেমেয়ে ছিল না তাদের বলা হতো নির্বংশ। অথচ এতোগুলো মানুষের ভরনপোষণ করতে গিয়ে যে বাসার রোজগার করে আনা বাবার বা ঘরের হেঁসেল ঠেলা মায়ের নাভিশ্বাস উঠে যেতো তা বুঝতো আদতে কয়জনে? আমার বাবা পাকিস্তান সরকারের বেশ ভালো পদের চাকুরী করতেন। চট্টগ্রামেই আমাদের সব ভাইবোনের জন্ম, পড়ালেখা, বেড়ে ওঠা। অনেক ভালো চাকুরী করলেও এতোগুলো মুখের খাবার আর বেড়ে ওঠার খরচ দিতে যেয়ে হিমশিম খেয়ে যেতেন তারা সবসময়ই। আর তাই মা বাবার কাছে শখ বলে একটা ব্যাপার থাকতে পারে বাচ্চাদের সেই ফুরসতই আমাদের ছিল না। আমার মায়ের এরকম একটা কালো সোনালী শাড়ী ছিল যেটা আমি খুব পছন্দ করতাম। খুব করে চাইতাম বড় হলে ঐ শাড়ী আমার হবে। কিন্তু বোনদের মধ্যে আমার অবস্থান নিচের দিকে থাকায়, আর মেজো বোনেরও ঐ শাড়ী পছন্দের হওয়াতে আমার হাত ফস্কে যায় সেটা অন্য আর কোন কারণ ছাড়াই।

ভেবেছিলাম আমার যখন বিয়ে হবে, নিজের সংসার হবে আমি অবশ্যই ওরকম অনেকগুলো শাড়ী কিনবো, যেন আমার মনে কোন আফসোস না থাকে। ভাবতাম আমার ছেলেমেয়েদের আমি অবশ্যই তাদের শখ পূরণ করতে দেব যতটুকুই সাধ্য থাকে। সময়ের পরিক্রমায় কলেজের গন্ডি পেরোতেই বিয়ে হয়ে যায়। চলে আসি চট্টগ্রাম ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থল বরিশালে। আমার স্বামী মানুষ হিসেবে বেশ ভালো ছিলেন। সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিভাগে কাজ করতেন। কিন্তু এখনকার মত সেকালে সরকারী চাকুরীজীবিদের বেতন এতো ভালো ছিলনা। ঘুষ না খেলে নিতান্তই পেটে ভাতে চলার মত অবস্থা যাকে বলে। বিয়েতে দেয়া লাল বেনারসি আর একটা ভালো শাড়ী ছাড়া ঘরে পরার দুটো সুতির শাড়ীই ছিল আমার পরবর্তী এক বছরের কাপড়। স্বামী যা বেতন পেতো তা থেকে নিজের বাবা মাকে দিয়ে যা থাকতো তা দিয়ে সংসার চালানো যেন এক কঠিন অংক পরীক্ষার মত ছিল। যে অংকের কোন সামাধান নেই শুধু যোগ বিয়োগ করে পাতার পর পাতা টেনে যাওয়া।

দিনে দিনে সংসার বড় হলো। ছেলেমেয়েদের খরচ বাড়লো। আর পাশাপাশি মনের গভীরে লুকিয়ে যেতে থাকলো নিজের শখ পূরণের ইচ্ছেগুলো। এমন না যে ছেলেমেয়েদের শখও পূরণ করতে পারতাম। কোনরকমে ওদের পড়ার খরচটুকু শুধু চালিয়ে নেয়া। হয়তো মেয়েটা আবদার করতো একটা কাঠি আইসক্রিম নয়তো একটা চুলের ফিতা। কখনো হয়তো ছেলেটা আবদার করতো এক জোড়া ভালো জুতার। একটা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতাম প্রায়শই। আর তারপর মনের ভেতর জমে ওঠা কান্নার বিষবাষ্পকে তড়িৎগতিতে শুকিয়ে নিতাম চুলার গনগনে আঁচে যেন ছেলেমেয়েরা বুঝতে না পারে তাদের মায়ের চোখে সন্তানকে না বলার অপারগতার কষ্ট। পাছে সংসারের ভাবনায় ওদের পড়ার ক্ষতি হয়।

বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম আসা অনেক খরচান্ত ব্যাপার দেখে বছরে হয়তো একবার মায়ের বাড়ি আসার সুযোগ মিলতো। আমার বাকী বোনেরা বেশ ভালোই ছিল, অন্তত আমার চেয়ে স্বচ্ছল জীবনযাপন করতো। একবার ছোটভাইয়ের বিয়েতে সে বছর দুবার চট্টগ্রাম আসতে হলো। হিসেবের টাকার টানাটানির কারণে না পারলাম ভাইকে ভালো কিছু উপহার দিতে না পেরেছি নিজেদের জন্য কোন ভালো কাপড় কিনতে। বাকী ভাইবোনদের ছেলেমেয়েদের ঝকমকে পোশাকের পাশে আমার ছেলেমেয়েদের আমার হাতে বানানো পোশাক যেন উপহাসের সুরে হাসছিল। আপ্যায়ন কতটা পেয়েছিলাম সে কথা মনে হলে এখনো আমার চোখ ভিজে আসে। স্বচ্ছলতা না থাকলে বুঝি পর কেন আপন লোকেও ভালো চোখে তাকায়না। তিনদিনের অনুষ্ঠানে পরার মত এতোগুলো শাড়ীই যে আমার ছিলনা তা বুঝি আমার ভাইবোনেরা কেউ দেখেও দেখেনি।

নিজেকে সবসময় প্রবোধ দিতাম, ছেলেমেয়েদের এতো বড় মানুষ করব যেন ওরাই আমার অলংকার হয়। ছেলেমেয়েরা কেউই হতাশ করেনি। তিনজনই দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে ভর্তির সুযোগ পায়। মনের ভেতর আনন্দের বান ডাকলেও তিনজনের খরচ যোগাতে সেসময় বড় কষ্ট হয়ে যেতো। তবু আমি চেষ্টা করতাম রোজদিনের টাকা থেকে একটু একটু করে জমিয়ে রাখতে। একবার হলো কি মেয়ে হোস্টেলে যাবে, তার সাথে কেনাকাটা করতে গিয়ে আজকেরটার মতো কাছাকাছি একটা শাড়ী এতো পছন্দ হয়ে যায়। দাম শুনি আটশো টাকা। মনে মনে হিসেব করি যে টাকা জমাচ্ছি হয়তো আর কিছু হলেই কিনতে পারবো সেটা। মেয়ের হোস্টেলের খরচ দিয়ে বাসায় এসে গুনে দেখি একশো টাকা কম আছে। আর দুটো সপ্তাহ একটু চিপেচুপে খরচ করলেই হবে ভেবে দোকানদারকে যেয়ে বলেও এলাম শাড়ীটা রেখে দেবেন আমার জন্যে।

মেয়েকে সেবার হোস্টেলে যাওয়ার পথে হাতে কিছু বাড়তি টাকা দেই তার ভাইয়ের জন্য। পইপই করে বলি গুছিয়ে রাখিস, সাবধানে রাখিস। তখন একটু একটু বাহির চেনা মেয়ে আমাকে একটু জোরেই বলে, ‘বলেছি তো সাবধানে রাখবো। কয়টা মোটে টাকা এতোবার সাবধান করছো যে বিরক্তই লাগছে।’ আমি কিছু বলিনা মেয়েকে। শুধু দোয়া করি ওর যেন আমার মতো এমন হিসেব কষা জীবন না হয়। দুদিন পরেই মেয়ের ফোন আসে ও ভাইয়ের জন্য দেয়া টাকাটা হারিয়ে ফেলেছে। ফোনের ওপারে মেয়েটা হাপুস নয়নে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘মা আমার ভুল হয়েছে, আমিই সাবধান ছিলাম না। আর কখনো এমন হবেনা, মা।’ ফোনের এপাশে মেয়েকে তখন সান্ত্বনা দিলেও মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা যোগ বিয়োগের হিসেব যেন আমায় এলোমেলো করে দিচ্ছিলো। মাসের মাঝখানে আমি কোথায় পাবো ছেলের হাতখরচের পনেরশো টাকা?

দিন দিন করে জমানো শাড়ীর সাতশো টাকার সাথে বাকী আটশো টাকা যোগাড় করতে কতজনের কাছে যে ধর্না দিতে হয়েছে তা বুঝি শুধু আমিই জানি। ওদের বাবাকে বলিনি কিছু কারণ সংসার খরচের টাকা যে বেতন পাওয়ার সাথে সাথেই আমার হাতেই তুলে দিতেন তিনি। পরের বেতনের টাকা পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় রোজদিন শুধু শাক আর ডাল ছিল আমাদের দুজনের খাবারের মেনু।

দিন বদলেছে। সময়ের পরিক্রমায় ছেলেমেয়েরা সবাই এখন ভালো চাকুরী করে। আমার স্বামীর অবসর নেয়ার পর সরকার থেকে পাওয়া মোটা অংকের টাকা থেকে ঢাকায় একটা বসার জায়গা করতে পেরেছি। সব ছেলেমেয়ে প্রতিমাসে আলাদা করে হাত খরচের টাকা দেয়। বলা চলে সেই হিসেবের জীবন থেকে সৃষ্টিকর্তা মুক্তি দিয়েছেন।

অতীত ভাবনায় ডুবে থেকে কখন যে শাড়ীটা গায়ে জড়িয়েছি টেরই পাইনি। চমক ভাঙ্গে ছেলের ডাকে।

– নতুন শাড়ী মা? কবে কিনলে?

তোর বোন দিয়েছে। আমার মোবাইলে একটা ছবি তুলে দে তো। তোর বোনকে পাঠাবো।

ছেলেকে বলতে লজ্জা লাগছিল আমি আসলে ছবিটা ফেসবুকে আমার প্রোফাইল পিকচার দেবো বলে ভেবেছি। ক্যাপশন দেবো, দিন বদলের কাব্য।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে