দর্পহরন পর্ব-১৩+১৪+১৫

0
161

#দর্পহরন
#পর্ব-১৩

নদী থেকে বালু উত্তোলনের কাজ নিয়ে বিশাল একটা ক্যাওয়াজ বেঁধে গেছে। এতোদিন এই কাজ এককভাবে ইব্রাহিম পরিবার দখল করে রেখেছিল। ভেতর ভেতর রুষ্ঠ থাকলেও নিজের জীবনের মায়া করে কেউ মুখ খোলেনি। এবার দলেরই আরেকপক্ষ এসে বাঁধা দিলো। প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর হাতাহাতি। খবর পেয়ে সোহেল ছুটে গেলো। মাথাগরম সোহেলের পিস্তলের গুলিতে একজনার লা/শ পড়ে গেলো। এবং একজন দূর থেকে পুরো ঘটনা অবলোকন রেকর্ড করে নিল। থানায় খবর গেছিল আগেই। যা আগে হয়নি তা হলো ইব্রাহিম পরিবারের কাউকে গ্রেফতার করা। সেটাও হয়ে গেলো থানায় আসা নতুন ওসির কল্যানে।

খবরটা ইব্রাহিম সালিম সাহেবের কানে যেতেই তিনি নড়েচড়ে বসলেন। ইদানীং তিনি বাড়ি থেকে কম বের হন। ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার পর চারপাশে পুরো পরিস্থিতি অবলোকন করে সেই অনুযায়ী নিজেকে প্রস্ততু করছেন। হুট করে খবরটা পেয়ে তাই থমকে গেছে। মোর্শেদ ছুটে এলো-“সালিম, চল থানায় যাই। সোহেলরে গ্রেপতার করছে, আমাগো সোহেলরে। ওরা জানে না কার পোলা সোহেল? এইরকম ঘটনা তো আমগোর লগে আগে ঘটে নাই। কি হইলো এইসব? বারবার এইরকম হইতে শুরু করলে তো সমস্যা। আমাগো কামকাজ নিয়া ঝামেলায় পড়ুম।”
থম ধরে বসে থাকা সালিম সাহেব মুখ তুললেন-“থানায় নতুন ওসি আইছে। সে আমাদের চিনে না এইজন্যই মনেহয় ভুল কইরা সোহেলরে তুলছে।”
“আচ্ছা, যাইহোক তুই চল।”
“চলেন ভাইজান। আপনি নামেন আমি পাঞ্জাবি পইড়া আসতেছি।”
তুহিন নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। সালিম সাহেব পাঞ্জাবি পরে চিন্তিত মুখে নিচে নামে। গাড়িতে বসেও চুপচাপ থাকে। মোর্শেদ ভাইকে ডাকলো-“কি ভাবতেছোস সালিম? বালু উত্তোলনের জায়গা পুলিশ সিল করছে। কাম বন্ধ কইরা দিছে। কি করুম এখন?”
“কথা কই আগে তারপর না পরিস্থিতি বুঝুম।”

ওসি সাহেব মিটিং করছিস। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেছিল সালিম সাহেবকে। তাতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে সরাসরি ওসির কেবিনে ঢুকে গেলো সালিম। ওসি সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন-“কি চাই?”
সালিম থতমত খেল, এই ওসি কি তাকে চেনে নাই নাকি ইচ্ছা করে এমন না চেনার ভাব করতেছে?
সে দরাজ গলায় বলে উঠলো-“আমি ইব্রাহিম সালিম। প্রাক্তন সাংসদ ও স্হানীয় সরকার মন্ত্রী। আমার ছেলেকে নাকি গ্রেফতার করেছেন?”
ওসি বাকীদের ইশারা করতেই তারা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওসির জামায় ঝুলে থাকা স্টিকারে নাম দেখে নিলেন সালিম, দিলশাদ। ওসি দিলশাদ চেয়ারে হেলান দিলো-“আপনার ছেলে একজনকে গুলি করে মে/রে ফেলেছে।”
কিছু বলতে যাচ্ছিল সালিম তাকে থামিয়ে দিলো ওসি-“চাক্ষুষ প্রমান আছে কাজেই তাকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। হ/ত্যা মামলা হয়েছে। নি/হ/তে/র স্ত্রী মামলা করেছে। এই মামলা কোর্টে উঠবে, কোর্ট ডিসিশন নিবে।”
সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। এই ওসিটা বেশ ঘোড়েল বলে মনেহচ্ছে। মোর্শেদ সালিমের হাত ধরে চাপ দিলো। শান্ত থাকার ইশারা করে বললো-“ওসি সাহেব, আপনার বুঝতে ভুল হইছে। সোহেলের এমন কিছু করার কথা না।”
ওসি তখনও ওভাবেই বসে আছে। মুচকি হেঁসে জবাব দিলো-“কোন ভুল হয়নি। রেকর্ড আছে আমাদের কাছে। এই আপনারা আসার কিছুক্ষণ আগেই নি/হ/তে/র স্ত্রী মামলা দায়ের করেছে।”
“কে মা/রা গেছে?”
সালিমের কন্ঠ নরম। দিলশাদ কলম নাড়াচাড়া করছিল। থেমে বললো-“সে আপনি একটু কষ্ট করে খুঁজে নিন।”
সালিম উঠে দাঁড়ায়-“আমার ছেলের সাথে দেখা করবো।”
“সম্ভব হবে না। যেদিন কোর্টে তুলবো দেখা করবেন। আজ না।”
এবার আর সহ্য করতে পারলেন না সালিম, হুঙ্কার দিলেন-“ওই তুই জানোস আমি কে? দুইদিন হইলো আইছোস এই এলাকায় তাই এতো ভাব? ভাব ছুটায়া দিমু।”
দিলশাদের মুচকি হাসি চওড়া হলো-“ওসব আমি জানি। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না আমি এসবে ভয় পাই না। আপনার যা করার করতে পারেন।”
“দেখতেছি তোর এই তেজ কয়দিন থাকে।”
মোর্শেদ ভাইকে থামাতে চায়, দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো-“ওসি সাহেব, কিছু মনে করিয়েন না। ছেলের চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে।”
দিলশাদ জবাব দিলো না। মোর্শেদ ভাইকে টেনে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন। মৃদুস্বরে ধমকে বললেন,-“সালিম, কি করতেছোস কি? এইরকম পাগলামির মানে হয়?”
“আপনি দেখছেন ভাইজান, দুইদিনের আসা ওসি কেমনে কথা কইতেছিল? মেজাজ ঠিক থাকবো?”
মোর্শেদ ঠান্ডা গলায় বললো-“সব ঠিক আছে কিন্তু নিজে প্যাচে পইড়া থাকলে মাথাগরম করা যাইবো না। ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হইবো। এইগুলা কি তোরে বইলা দেওয়া লাগবে?”
সালিম জবাব দিলো না। তার গা কাঁপছে এখনো। কি করবে কি করবে না ভেবে পেলো না। গাড়িতে উঠে তুহিনকে ডাকে-“তুহিন, নাহিদ কই আছে দেখতো। ওর কাছ থিকা সব খবর বাইর কর। কে মা/রা গেছে আমাকে জানা।”
“আচ্ছা।”
তুহিন নেমে গেল মাঝপথে।

সোহেলের খবরে বাড়িতে আরেকবার শোকের ছায়া নেমে এলেও তুলতুল কেন যেন ভীষণ খুশি হলো। ওই লোকটাকে ক’দিন এ বাড়িতে দেখতে পাবে না এই ভেবে শান্তি পাচ্ছে। তাছাড়া ওর সাথে যা করেছে তাতে জেলে যাওয়াটা কম সাজা। ওর জেলেই পঁচে ম/রা উচিত। ভাবতে ভাবতে তুলতুল কেঁদে দিলো। মা, ভাইয়া, চাচা চাচিকে দেখেনা হিমিটাকে কোলে তুলে আদর করে না কতদিন। ওর খুব ইচ্ছে করে মায়ের কোলে যেতে। কতদিন মায়ের আদর পায় না মেয়েটা। এমনকি কথা বলার ব্যাপারেও কত মানা। অনেক কাকুতি মিনতি করে কথা বলতে হয়। আর মাতো ভয়ে ফোনই দেয় না। তুলতুলের নিঃশব্দ কান্নায় ঘরের বাতাস ভারী হয়ে যায়।

★★★

রণ ঠিক করেছে যত ব্যস্ততাই থাক প্রতি সপ্তাহে একদিন এলাকায় থাকবে। যেখানকার মানুষের ভালোবাসা পেয়ে সে আজ মন্ত্রী হয়েছে তাদের সুবিধার দিকে নজর রাখবে। নিজেকে দেওয়া কথা রাখতেই প্রতিসপ্তাহে রণর পিতৃভুমে আগমন। আজও এসেছে। কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে মিটিং করতে করতেই দিলশাদের ফোন এলো-“ভাই, খারাপ একটা খবর আছে।”
“কি হয়েছে দিলশাদ? বলো তাড়াতাড়ি।”
“ভাই একটা মা/র্ডা/র হয়ে গেছে। ইব্রাহিম সালিমের ছেলে সোহেলের হাতে। কি করবো ভাই?”
রণর চোয়াল শক্ত হলো। এরা বাবা ছেলে আবারও শুরু করে দিয়েছে। দৃঢ় স্বরে জানতে চাইলো-“পুরো ঘটনা বলো আমাকে।”
দিলশাদ পুরো ঘটনার বিস্তারিত জানালো। রণ বললো-“সোহেলকে গ্রেফতার করে যা করার করো। নি/হ/তের স্ত্রীকে বলো মামলা করতে। ওর প্রটেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করছি। সোহেলকে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়ে নিজের এলাকার মানুষের নিরাপত্তা না দিতে পারলে তো ব্যর্থ।”
দিলশাদ নরম কন্ঠে বললো-“ভাই, সালিম সাহেব থানায় এসে খুব ঝামেলা করেছে। আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে।”
রণ হাসলো-“তুমি কি ভয় পেয়েছ?”
দিলশাদ পাল্টা হাসলো-“একদমই না ভাই।”
“গুড। আপাতত সে নখদন্তহীন বাঘ, তোমার কিছু করতে পারবে না। আমি আছি দেখবো তোমাকে। তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করো।”
“ঠিক আছে ভাই।”
ফোন রাখতেই মিহির তাকালো-“নিচে ওরা এসেছে বিচার চাইতে।”
রণ অবাক হলো-“কারা?”
“যাদের সাথে সালিমের ঝামেলা হইছে। ওদের দাবী সালিমের একছত্র অধিপত্যে কমাতে হবে। গত কয়েকবছর তারা বঞ্চিত ছিল এখন হক চায়।”
রণ চিন্তিত হয়ে গেলো-“সে তো ঠিক আছে কিন্তু এতো তাড়াহুড়ো কেন? এতোদিন পারেনি আর কিছুদিন ধৈর্য্য ধরুক। ধীরে ধীরে সব ঠিক করবো।”
“গত কয়েকদিনে আপনার কমপ্লেন বক্সে একশোর উপরে কমপ্লেন জমা হয়েছে। কারো জমি দখল, কারো বাড়ি দখল, কারো ব্যবসা বন্ধ এরকম অভিযোগ। আমি অভিযোগের সংখ্যা দেখে অবাক ভাই। এরা কি মানুষ না হায়েনা। কত টাকা লাগে এদের?”
রণর চেহারা গম্ভীর-“ওদেরই তো টাকা লাগবে। ছেলেমেয়ে সবার প্রায় থাকে বিদেশে। খোঁজ নিয়ে দেখ বেশিরভাগই দেশ থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে ফুর্তি করে। পড়ালেখা, আলিশান ভাবে থাকা খরচ আছে না? এইগুলা করে টাকা কামায়।”
“তাই বলে এতো মানুষের ক্ষতি করে?”
“এই কয়টা দেখেই এমন লাগছে তোর? আরও আসবে দেখিস। অদ্ভুত অদ্ভুত অভিযোগ পাবি।”
চুপ করে কিছু একটা ভাবলো রণ-“চল দেখি ওরা কি বলে শুনি। আর ওই যে কে মা/রা গেছে তার বউ আর ছোট বাচ্চা আছে একটা। ওদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা কর। সালিম সাহেব যেন ওদের খবর না পায়।”
মিহির মাথা দুলালো। সালিম সাহেবকে বোঝাতে হবে তার দিন ফুরিয়ে গেছে।

মিটিং শেষ করে মাত্রই ফ্রি হয়ে এককাপ কফি নিয়ে বসেছে রণ খবর এলো সালিম সাহেব স্বয়ং তার বাসার নিচে। দেখা করতে চায়। রণ এবার সত্যিই অবাক। লোকটা তার দ্বারে এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে এটা সে ভাবেনি কখনোই। রণ ধীরে সুস্থে ড্রয়িংরুমে এলো-“আসসালামু আলাইকুম চাচা। হঠাৎ আপনি এলেন?”
সালিম সাহেবকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে তবুও গলায় তেজ নিয়ে বললো-“রণ, কাজটা ভালো করতেছ না। তুমি ভুলে যাইতেছ বাঘ কখনো বিড়াল হয় না। আর বিড়াল কখনো বাঘ।”
রণ নিরীহ মানুষের মতো মুখ করলো-“এসব কি বলছেন চাচা? আমি কি করেছি তাই তো জানলাম না?”
“আমার সোহেলকে পুলিশ গ্রেফতার করছে। আমি জানি এর পেছনে তোমার হাত আছে। তুমি থানার অফিসারকে সাহস দিতেছ।”
রণ দারুণ এক হাসি দিলো-“চাচা, খুব অন্যায় কথা বললেন। কেউ অপরাধ না করলে পুলিশ কেন তাকে গ্রেফতার করবে? আপনার ছেলে খু/নি, তার মতো অপরাধীকে ছাড়া যায়? আমি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আমার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটলে আমার কি করা উচিত আপনি বলেন।”
“আমি এতো কিছু জানি না রণ। তুমি আমার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি চাই না আমি স্বরুপে আসি তাহলে এলাকায় র/ক্তে/র বন্যা বয়ে যাবে।”
রণর চেহারা গম্ভীর হলো-“এসব হুমকি ধমকি দিয়ে কাজ হবে না চাচা। এতোদিন যা হয়েছে তা আর হবে না। আমি কোন অন্যায়কারীর পক্ষ নিতে পারবোনা। এমন অনুরোধ আমাকে করবেন না।”
সালিম সাহেব মেজাজ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছেন-“তাহলে তো তুমিও অপরাধী রণ।”
“আমি! আমি কি করেছি?”
সালিম সাহেব হাসলো-“কি করেছ তা তুমি ভালোই জানো। তুমি একজন অপহরণ কারী। আমার মেয়েকে গুম করেছিলে। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছু টের পাবো না?”
বলতে বলতে চোয়াল শক্ত হলো ইব্রাহিম সালিমের। রণর চেহারায় চোরা হাসি-“আপনার কাছে কোন প্রমান আছে চাচা?”
জবাব দিলো না সালিম। ধারালো দৃষ্টি হেনে রণকে কুপোকাত করার চেষ্টা করছে। রণ সেই দৃষ্টিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায়-“প্রমান ছাড়া কাউকে অপরাধী বলা ঠিক না চাচা। এটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে। এতোদিন এভাবেই প্রমান ছাড়া অপরাধ করেই তো টিকে আছেন। যাইহোক, আপনি মুরব্বি মানুষ আপনাকে অসম্মান করবো না। আমাকে মাফ করবেন আপনার অন্যায় কাজে সাহায্য করতে পারছি না।”
রণ করজোড়ে ক্ষমা চাইতেই সালিম উঠে দাঁড়ায়, দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“এক মাঘে শীত যায় না রণ। একদিন আমার পায়ে আসতে হবে তোমাকে। সালিমকে হারায় এমন কেউ দুনিয়ায় পয়দা হয়নি এখনো। মনে রেখ কথাটা।”

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৪

সবাই ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো। ছিলো তুলতুল আর শুভ্রাও। সালিম সাহেবকে ঢুকতে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসলো। রিমা ছুটে এলো স্বামীর দিকে-“কি হইলো? কি কইলো প্রতিমন্ত্রী? সোহেলরে ছাড়ান দিব?”
সালিম সাহেব জবাব না দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসলো দপ করে। চোখের উপর হাত রেখে হেলান দিয়ে সোফায় গড়িয়ে গেল। রিমা কি বুঝে চুপ করে গেলো। মোর্শেদ, শরীফ, তাহের দৃষ্টি বিনিময় করলো নিজেদের মধ্যে। গলা খাকরানি দিয়ে মোর্শেদ বললো-“সালিম, চুপ থাকলে কি সমাধান আইবো? কি কইলো ক আমাদের।”
“ভাইজান, কি বললো বলেন না কেন?”
তাহেরের কথায় রেগে গেল সালিম-“কি কইতে পারে বুঝস নাই? সোহেল খু/নি ওরে ছাড়ন যাইব না-এইটা কইলো। মানা কইরা দিলো আমারে। দুইদিনের পোলা এই সালিমরে মানা করলো। চিন্তা করছোস কিছু? ভাবছে আমার ক্ষমতা নাই কোন। হাহাহা।”
শরীফ এগিয়ে এলো-“আব্বা, এতো উত্তেজিত হয়েন না। আপনার শরীর খারাপ করবে।”
“কি কস তুই? আমার পোলা জেলের মধ্যে রইসে আর আমি শান্ত থাকমু? আমি বাপ হয়ে আরামে বসে থাকমু?”
শুভ্রা এগিয়ে এলো-“আব্বা, আপনে শান্ত হন। সোহেল ভাইয়ার কিছু হবে না। আমরা এতোগুলো মানুষ আছি কোন না কোন ব্যবস্থা হবেই আব্বা।”
সালিম জবাব দিলো না। চেচিয়ে তুহিনকে ডাকলো। তুহিন এসে দাঁড়াতেই জানতে চাইলো-“মাইয়াডার খবর বাইর করতে পারছোস?”
তুহিন আড়চোখে তুলতুলকে দেখে নিলো। তুলতুল কাঠের তৈরি পুতুলের মতো বসে আছে।
“খোঁজ পাই নাই। কোথাও নাই, মামলা দিয়া গায়েব হইয়া গেছে।”
সালিম ঘুষি মারলো সোফায়-“ওই রণই ওরে লুকাইয়া রাখছে যাতে আমরা খোঁজ না পাই। তুহিন, আমি কিছু জানি না। তুই ওই মাইয়ারে খুঁইজা বাইর কর। এই কামে কে কে আছে দেখ। একজন একজন কইরা সাইজ করুম।”
তুহিন শুনে মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। শরীফ বললো-“আব্বা, মাথা গরম কইরেন না। এইসময় মা/রা/মা/রি কা/টা/কা/টির চিন্তা বাদ দেন। যুগ বদলায়ে গেছে। এখন মানুষের হাতে হাতে মোবাইল। আপনি কিছু করবেন কেউ না কেউ ছবি তুলে নিবে। এরচেয়ে আমরা বরং এইটা ভাবি সোহেলকে কেমনে ছাড়ানো যায়। আপনে উকিলকে খবর দেন।”
সালিম রক্তলাল চোখে ছেলের দিকে তাকালেন-“আমার চেয়ে বেশি জানোস তুই? উকিল ধইরা কোন বা/লডাও হইবো না যদি প্রমান না মুছি। যারা সাক্ষ্য দিব তাগোর গায়েব করা লাগবো।”
শরীফ রেগে গেলো হঠাৎ-“এইজন্যই ভালো লাগে দেশে। খালি খু /ন/খা/রা/বির আলাপ। ভদ্র কোন আলাপ জানেই না এরা। বারবার বলতেছি এইসব কইরেন না, শুনবে না। যা খুশি করেন আপনি।”
শরীফ রেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তাহের ছুটলো ওর পিছনে। মোর্শেদ শুকনো কন্ঠে বললো-“শরীফ একদম খারাপ কথা কয় নাই রে সালিম। তুই যদি ক্ষমতায় থাকতি তাইলে এক কথা আছিল। এখন নতুন নতুন পোলাপান রাজনীতি করে ওদের ভাবসাব আলাদা। একটু বুইঝা চলতে হইবো। তারপরও দেখ তুই যা ভালো বোঝছ কর আর কি।”
সালিম সাহেবের মেজাজ আরও খারাপ হলো। তার বাড়ির মানুষ তাকে বিশ্বাস করতেছে না। তাহলে বাইরের মানুষ কি বলবে? সেকি তার ছেলের জন্য খারাপ চাইবে? ছেলের ভালোর জন্য সব করবে সে।

তুলতুল চুপচাপ বসে ছিলো শুভ্রার বিছানায়। ওকে দেখে শুভ্রার খুব খারাপ লাগছে। গত দুই মাস ধরে মেয়েটা ওর সাথে ছায়ার মতো লেগে থেকেছে, গল্প করেছে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর চেষ্টা করেছে। এখন ওর নিজেরই বিপদ। অল্পবয়সী মেয়ে, স্বামীর এরকম ঘটনা শুনে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে হয়তো। কষ্ট তো শুভ্রারও হচ্ছে। সোহেল একটু বদরাগী হলেও তাকে ভীষণ ভালোবাসতো। বোনের ইচ্ছেপূরনে সদা তৎপর থাকতো। এখন এসব শুনে কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে। শুভ্রা তুলতুলের পাশে বসলো, নরম কন্ঠে জানতে চাইলো-“ভাইয়া চলে আসবে ভাবী। তুমি কিছু চিন্তা করো না। বাবা নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে।”
তুলতুল মাথা নাড়ে-“আমি চিন্তা করছি না তো।”
শুভ্রা অবাক হলো-“তাহলে? মন খারাপ করছো কেন?”
“এমনিতেই। আপনাদের মন খারাপ দেখে আমারও মন খারাপ হচ্ছে।”
শুভ্রা হেসে দিলো-“তুমি ভাইয়াকে পছন্দ করো না তাই না? তোমাদের কখনো সেভাবে কথা বলতে দেখিনি।”
তুলতুল জবাব দিলো না। শুভ্রা তুলতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বোঝার চেষ্টা করছে তুলতুলের মনে কি চলছে।

★★★

সোহেল হাজতে থেকে ভীষণ হইচই করছিল। এর আগে তাকে কখনোই হাজতে বন্দী থাকতে হয়নি। এবার হুট করে যখন হাতে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে এলো সোহেল বোকা বনে গেলো। ভেবে পাচ্ছিল না কি বলবে কি করবে। তবুও আশায় ছিলো বাবা হয়তো তাকে কোনভাবে ছাড়িয়ে নেবে। কিন্তু রাত হয়ে যাওয়ার পরেও কেউ এলোনা দেখে সে হম্বিতম্বি শুরু করে দিলো। থানার এসআই এলে তাকে গালিগালাজ করলো, দেখে নেওয়ার হুমকি দিলো। ফলাফল হিসেবে তাকে জেলের মধ্যে উত্তম মধ্যম দেওয়া হলো।

একদিন পরে তাকে কোর্টে তোলা হলো। বাবাকে দেখে সোহেল চিৎকার করে-“আব্বা, আমাকে এইখান থিকা বাইর করেন।”
সালিম ছেলেকে আস্বস্ত করলো-“তুই চিন্তা করিস না। আমি ব্যবস্থা করতেছি।”
কিন্তু সালিম সাহেবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সোহেলের জামিনের আবেদন নাকচ করে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হলে তার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা হয়ে গেলো। কারো কাছ থেকে সহযোগিতা না পেয়ে সালিম সাহেব কিছুই করতে পারলেন না। তুহিন দু’জনকে ধরে এনেছিল বটে, তাদেরকে প্রচুর মারাও হলো কিন্তু তারা কিছুই বলতে পারলোনা। অক্ষম আক্রোশে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়ে ফেলার অবস্থা সালিমের। অতি উত্তেজনায় প্রেসার বাড়িয়ে বমি করে ঘর ভাসিয়ে ফেললে তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হলো।

পরদিন ঘুম ভাঙার পরেও নিশ্চুপ শুয়ে থাকে সালিম সাহেব। ছেলের জন্য তার বুকের ভিতর ভাঙচুর হয়। সেই দুঃখে তার চোখ থেকে অবিরাম জল বর্ষন হয়। এতোটা অসহায় এর আগে নিজেকে মনে হয়নি তার। কোনদিন দিয়েই কোন সাহায্য পাচ্ছেন না। কেউ সাহায্য করতে চাইছে না। রাতারাতি পরিস্থিতি এতোটা বদলে যাবে ভাবেননি একদমই।

শুভ্রা বাবার কাছে বসবে বলে এসেছিল। কিন্তু বাবা কাঁদছে এটা টের পেয়ে পর্দার ওপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল পাঁচ মিনিট। বাবার অসহায় অবস্থা দেখে তারও কান্না পাচ্ছে। তার জীবনে কোনদিন বাবাকে এরকম অসহায় দেখেনি সে। পরক্ষণেই চোখ মুছে নেয় শুভ্রা। বাবাকে এরকম ভেঙে পড়তে দেবে না সে কিছুতেই। সাহস দেবে বাবাকে, কিছু একটা করবেই বাবা আর ভাইয়ের জন্য, করতেই হবে।
“বাবা, ঘুম ভেঙেছে?”
সালিম সাহেব নিজের চোখের জল মুছে নিলে হাসার চেষ্টা করলো-“আম্মা, আসেন আমার কাছে আসেন।”
সালিম সাহেব মেয়েকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন। শুভ্রা বাবার মাথার কাছে বসলো। বাবার চুলগুলো হাল্কা টেনে দেয়-“মন কি বেশি খারাপ আব্বা?”
সালিম সাহেব চোখ বুঁজে রইলো, জবাব দিলো না। শুভ্রা ডাকলো-“আব্বা, একটা কাজ করতে তোমার অনুমতি চাই।”
এবার চোখ মেলে তাকিয়ে মেয়েকে দেখলেন। শুভ্রা উশখুশ করে চোখ লুকায়। সালিম সাহেব সন্দেহ নিয়ে বললো-“আম্মা, কি করতে চাইতেছেন বলেন তো?”
“আমাদের সব সমস্যার সমাধান চাইতেছি। যে আমাদের জন্য এতো এতো সমস্যা তৈরি করতেছে তাকে শায়েস্তা করতে চাইতেছি। তুমি শুধু আমাকে একজনার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও।”
শুভ্রা সংকোচের সাথে মিনমিন করলো। সালিম সাহেব জানতে চাইলো-“কার সাথে দেখা করবেন আম্মা?”
শুভ্রা ফিসফিস করে একটা নাম বললে সালিম সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকায়, তার চোখে অবিশ্বাস-“তার সাথে দেখা কইরা কি করবেন?”
শুভ্রা হাসলো-“প্রানভোমরার জীবন চাবি তারই কাছে আব্বা। তাকে হাত করতে পারলেই আমাদের কাজ হবে।”

★★★

সোহেলের ঘটনা ম্যানেজ করতে রণকে দুটো দিন বেশি থাকতে হলো এলাকায়। সোহেলের রিমান্ড মঞ্জুর হওয়ায় খানিকটা সস্তি আসলেও সে জানে সালিম সাহেব চুপ করে থাকার মানুষ না। কিছু না কিছু সে করবেই। আর কি করবে সেটা জানে না বলেই চিন্তা হচ্ছে। সে চায় না তার কারণে কোন নিরীহ মানুষ ভুগুক। এইজন্য সারাক্ষণ ভাবনার মাঝে ডুবে থাকতে হচ্ছে তাকে।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরি মিটিং শেষ করে ফোন হাতে নিতে দিলশাদের ফোন-“ভাই, সোহেল তো কোন কথাই বলে না। চুপ করে থাকে।”
“যেভাবেই হোক ওর কাছ থেকে সীকারোক্তি নিতে হবে দিলশাদ। না হলে সব চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যাবে। কি করবে এখন দেখো।”
“ও কঠিন ছেলে ভাই। মারধোর করে লাভ হবে বলে মনেহয় না।”
“তাহলে অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করো। যেটাতে কাজ হবে সেটা।”
চাপা স্বরে আদেশ করলো রণ। দিলশাদ দ্বিধা নিয়ে বললো-“আচ্ছা দেখি। জানাব আপনাকে।”

বাসায় ফিরে সব সুনসান দেখে অবাক হলো রণ। সাধারণত সে বাসায় আসবে জানলে মা আর বোনেরা তার অপেক্ষায় থাকে। আজ মাকে না দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলো। হাসিখুশি গম্ভীর মুখে বসে আছে তাদের কামরায়। রণ ওদের মাথায় গাট্টা মারে-“কি খবর হাসিখুশি? আজ তোদের মুখে ঘোর আমাবস্যা কেন? আর মায়ের কি হয়েছে? তাকে দেখছি না যে?”
“মা তার রুমে আছে ভাইয়া। জানি না কি হয়েছে, সন্ধ্যা থেকে দরজা দিয়ে শুয়ে আছে। দুপুরে খাবার খায়নি।”
খুশি জবাব দিলো। রণ চিন্তিত হলো কিন্তু বোনদের বুঝতে দিলো না-“আচ্ছা, তোরা ভাবিস না আমি দেখছি মায়ের কি হয়েছে।”

মায়ের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো রণ-“মা, আসবো?”
“তুই ফ্রেশ হয়ে টেবিলে আয় রণ। আমি আসছি।”
জলি ঘরের ভেতর থেকে জবাব দিলো। সে এসেছে আর মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছে মানেই বিরাট ঘাপলা। ভ্রু কুঁচকে গেল রণর। মায়ের গলা অনেক ভারী লাগছে। মা কি কোন কারণে কান্না করছে? রণর চিন্তা বাড়ে। সে তড়িঘড়ি করে শাওয়ার নিয়ে টেবিলে আসতেই মাকে দেখলো। মুখটা ভীষণ গম্ভীর। রণর বুক কাঁপতে লাগলো। কিছু কি হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে নাকি সে কোন ভুল করেছে? কোনভাবে মাকে কষ্ট দিয়েছে? এতে গম্ভীর এর আগে মাকে দেখেনি সে। জলি চুপচাপ ভাত বেড়ে দিলো রণর প্লেটে। রণর খেতে ইচ্ছে না করলেও ভাত মাখিয়ে মুখে তুললো। মায়ের মুখ দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু জলি সরাসরি তাকাচ্ছে না। রণ হঠাৎ নরম স্বরে মাকে ডাকলো-“মা, কি হয়েছে বলবে? তোমার এমন মুখ দেখে আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না।”
রণর ডাকে জলি যে দৃষ্টি মেলে রণকে দেখলো তাতে রণ একটা ধাক্কা মতো খেল। মায়ের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস নাকি ঘৃনা বুঝে পেলো না। তবে এটুকু পরিস্কার বুঝতে পারছে সেই দৃষ্টিতে তার জন্য ভালোবাসাটা আর নেই।

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৫

“মা, আমি কি করেছি? এভাবে দেখছো কেন আমাকে?”
রণর অসহায় কন্ঠ শোনা গেলো। জলি ছেলের মুখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিলো তীব্র বিতৃষ্ণায়-“তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি রণ? আজ তোমার বাবা থাকলে ভীষণ লজ্জা পেতেন যেমন আমি পাচ্ছি। তোমাকে নিয়ে গর্ব ছিলো আমার, সেই গর্ব চূর্ন করে দিলে। মাথা উঁচু করে ছেলেকে নিয়ে গর্ব করার অধিকার কেঁড়ে নিলে আমার কাছ থেকে।”
রণ খাবার প্লেট দূরে ঠেলে হাত ধুয়ে এলো। জলির সামনে দাঁড়িয়ে বললো-“এবার বলে কি বলছিলে? আমি কি এমন করেছি যে এতবড় কথা বলে ফেললে?”
“এখনো বুঝতে পারছো না কি করেছ?”
জলির কথায় এবার ভীষণ বিরক্ত রণ-“মা প্লিজ, এতো ভনিতা না করে বলো না কি করেছি? আমি সত্যি বুঝতে পারছি না।”
জলি তীব্র চোখে ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন-“এ কথা কি সত্য যে তুমি নির্বাচনে জেতার জন্য ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে অপহরণ করেছিলে? মেয়েটাকে দুই মাস আঁটকে রেখেছিলে কোথাও?”
রণর মাথাটা ঘুরে উঠলো তীব্র বেগে। শ্বাস আঁটকে এলো। মা এসব কিভাবে জানলো! কে জানালো মাকে? কেউ কি এসেছিল? রণর মাথাটা হুট করে শুন্য মনে হলো। সে চেয়ারে বসে পড়লো ধপ করে।
“কি কথা নেই কেন মুখে? আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এই কাজ করেছ। সত্যি তুমি এমন করেছ রণ? শুধু নির্বাচন করার জন্য একটা মেয়ের সম্ভ্রম নিয়ে খেলেছ এ কথাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? তুমি কি আমার সেই ছেলে রণ?”
রণ ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। কিছু বলবে সেই সাহসই করতে পারছেনা। জলি ধমকে উঠলো-“কথা বলছো না কেন? আমি সত্যি জানতে চাই। সত্যটা বলো আমাকে রণ।”
রণর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। জলি হাত বাড়িয়ে দিলো-“আমাকে ছুঁয়ে বলো রণ। মাকে ছুঁয়ে বল সত্যি তুই এমন কিছু করেছিস।”
রণ জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলো। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। গ্লাস থেকে পানি শেষ করলো। জলি একদৃষ্টিতে তাকে দেখছে। রণ শান্ত গলায় ডাকলো-“মা, এখানে বসো আমার সামনে।”
জলি তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তার গা জ্বলছে। ছেলের এই অধপতন মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই। রণ অনুরোধ করলো-“মা প্লিজ বসো। না বসলে তোমাকে সব গুছিয়ে বলতে পারবোনা।”
জলি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসলো চেয়ারে। রণ বারবার ঢোক গিললো। লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো-“এসব কে বলেছে তোমাকে?”
“কে বলেছে সেটা কি জরুরি? তুমি আমাকে সত্যিটা বলো।”
“তুমি যা শুনেছে সেটা সত্যি মা। তবে আমি মেয়েটাকে কোন ধরনের অসম্মান করিনি। শুধু আঁটকে রেখেছিলাম।”
“মিথ্যে, মিথ্যে, মিথ্যে। তুমি তোমার মায়ের সাথে মিথ্যে বলছো। তুমি কি ভেবেছ আমি কখনো জানবোনা তোমার কাজ? তুমি মেয়েটাকে আঁটকে রেখে নানা ধরনের মানসিক অত্যাচার করনি? ওকে অন্ধকার ঘরে আঁটকে রেখে খাবার খেতে দাওনি। বলো সত্যি কিনা?”
রণ নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করলো। জলির মুখ ছিটকে বেরিয়ে এলো-“ছিহ! ছিহ! তুমি আমার ছেলে? তোমাকে পেটে ধরেছি আমি? নিজেকেই এখন ঘেন্না ধরছে। যাদেরকে আমি অপরাধী ভাবতাম, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাদের মাফ করবোনা ভাবতাম, তুমি আমার সন্তান হয়ে নিজেকে তাদের পর্যায়ে নিয়ে গেলে? কেন? একটা পদ পাওয়ার জন্য!”
মায়ের ছিহ শব্দ রণর বুকে তোলপাড় তুলে দিয়েছে। প্রতিটা বাক্য ওর বুক থেকে রক্ত শোষণ করে নিচ্ছে। মাথা তুলে মায়ের চোখে চোখ রাখার সাহস আজ হারিয়ে ফেললো বুঝি। জলি একটু থেমে আবারও মুখ খুললো-“তুমি ভাবো তোমার বোনদের সাথে কেউ এমন করছে। তাদের কি মাফ করতে পারবে?”
রণ আঁতকে উঠে মুখ তুললো-“মা প্লিজ!”
জলি ফুঁসে উঠলো-“আমাকে মা বলে ডেকোনা তুমি। তোমার মত ছেলের মা হতে চাই না আমি। যে ছেলেকে মেয়েদের সন্মান করা শেখাতে পারিনি আমি তার মা না।”
“মা আমি যদি ইব্রাহিম সালিমের মেয়েকে অপহরণ না করতাম তাহলে আজকে আমি হয়তো কবরে থাকতাম। তোমাকে কি নতুন করে বলতে হবে উনি কি? কতটা নৃশংস?”
রণ নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। জলি মাথা নাড়ে-“আমি চাইনি তুমি রাজনীতিতে আসো। কারণটা এখন বুঝতে পারছো? শুরুতেই তুমি নিজেকে নোংরামিতে জড়িয়ে ফেললে বাকী পথ কি হবে। কেন তুমি রাজনীতিতে এলে রণ?”
জলির কন্ঠে হাহাকার ফুটে উঠলো। রণ দৃঢ় স্বরে বললো-“যা বাবা করতে পারেনি তা করতে। তুমি চেয়েছ আমি শিক্ষাদিক্ষা নেই, নিয়েছি। বাবা চেয়েছে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে, তার ইচ্ছে পূরণ করাও আমার কর্তব্য।”
জলি পুনরায় রেগে গেল-“তা বলে অন্যায় পথে? তাহলে ইব্রাহিম সালিম আর তোমার মধ্যে পার্থ্যক্য কোথায়?”
“পার্থক্য কোথায়? ওদের সাথে তুমি আমাকে তুলনা করছো?”
জলি হাসলো-“করা উচিত না? ওরাও মেয়ে তোলে তুমিও তোল৷ তো তোমরা দু’জনই এক। যে মেয়েটা দেশেই থাকে না, বাবার কাজের কিছুই জানে না সেই মেয়েটাকে আঁটকে রেখে তুমি কি প্রমান করেছ আমি জানি না। আমি শুধু জানি তুমি একজন নির্দোষকে সাজা দিয়েছ। আর ওই মেয়েটার এই ঘটনা লোকে জানলে কে বিয়ে করবে ওকে? আমার দু’টো মেয়ে আছে কাজেই আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি এরকম ঘটনায় মা বাবার কেমন লাগে।”
“কেউ জানবে না মা। কেউ জানেনি। তুমি বেশি বেশি ভাবছো।”
রণ দূর্বল গলায় বলে। জলি অবাক হয়ে ছেলেকে দেখলো-“তোমাকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি রণ। এতটুকু অনুশোচনা নেই তোমার মধ্যে। শেম অন মি, আমি ব্যর্থ মা।”
“মা! কেন ছোট বিষয়কে বাড়িয়ে বড় করছো?”
রণর কন্ঠে আঁকুতি।
“এটা ছোট বিষয়ে লাগছে তোমার কাছে?”
জলি ভীষণ জোরে চেচিয়ে উঠলো। হাসিখুশি হাসিখুশি ভয় পেয়ে ছুটে এলো-“কি হয়েছে? তোমরা চেচাচ্ছ কেন?”
জলি রাগমিশ্রিত নজরে মেয়েদের ধমক দিলো-“নিজেদের কাজে যা।”
দু’জনেই ভয়ে পালিয়ে এলো। রণ মাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো-“মা প্লিজ ঠান্ডা হও।”
জলি ছিটকে সরে গেলো-“কাল ইব্রাহিম সালিমের বাড়ি যাব আমরা।”
রণর এবার অবাক হওয়ার পালা-“কেন?”
“কথা পাকা করতে। ওর মেয়েকে বিয়ে করবে তুমি।”
রণ আর্তনাদ করে উঠলো-“মা! এসব কি ধরনের পাগলামি?”
জলি অনড়ভাবে বললো-“আমি একজন শিক্ষিকা। তোমার অন্যায় জেনেও যদি প্রতিকার না করি তাহলে বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে আমার জন্য। যা নিজের মেয়ের বেলায় সহ্য হবে না তা অন্যের বেলায় হতে দেই কি করে?”
“আমি বারবার বলছি মা, ওর ঘটনা কেউ জানেনা জানবে না। ওই মেয়ের বিয়ে দিতে কোন সমস্যা হবে না। ওর বাপের টাকা কম নেই ছেলের অভাব হবে না।”
রণর কন্ঠে অসন্তোষ। জলি পাত্তা দিলো না-“আর বিয়ের পর পাত্র জেনে গেলে? মেয়ে দুই মাস গায়েব ছিল এটা জানার পর কোন পুরুষ মেনে নেবে? তখন কিছু হলে সে দায় কে নেবে?”
“তোমার এই অন্যায় আবদার আমি মানতে পারছি না মা। ওদের সাথে আত্মীয়তা কখনো সম্ভব হবে না। ওরা বাবার সাথে কি করেছে তা কি তুমি জানো না?”
“এতো কিছু জানি না আমি। যা বলেছি তুমি তা করবে।”
রণ হতবাক হয়ে মাকে দেখছে। যেন চিনতে পারছে না এই মাকে-“আমি পারবো না মা, কিছুতেই পারবোনা।”
জলি অটল গলায় বললো-“পারতে হবে। তোমার বাবাকে আজও খুঁজে পেলাম না। আমি চাই না তুমিও তার মতো নিরুদ্দেশ হয়ে যাও। তুমি যা করেছ এরপর তোমাকে এভাবে ছেড়ে রাখতে ভরসা নেই আমার। আমি জানি সালিম সুযোগ পেলেই তোমার ক্ষতি করবে। তাছাড়া কোন বাপ মেয়ের এরকম অসম্মান মেনে নেবে?”
রণ কি বলবে ভেবে পেল না। কোন মাকে দেখছে সে? এরকম ভীতু তার মা কবে ছিল?
“তুমি কাল আমার সাথে যাবে। যত খারাপই হোক নিজের মেয়ে জামাইকে নিশ্চয়ই মে/রে ফেলবে না?”
রণ মাথা নাড়লো-“আমি কাল কোথাও যাব না। তোমার এসব পাগলামির সাথে আমি নেই। আমি কিছুতেই ইব্রাহিম সালিমের কাছে ছোট হবো না।”
“যেতে হবে তোমাকে। আমি কথা দিয়েছি ওদের। আমি স্বামী হারিয়েছি সন্তান হারানোর শক্তি নেই আমার।”
“তাই বলে অন্যায়কারীর সাথে এতবড় কম্প্রোমাইজ করবে?”
রণ সবকিছু এলোমেলো লাগছে। জলি ছলছল চোখে তাকালো-“সন্তানের জীবনের জন্য এর চাইতে বড় কম্প্রোমাইজ করা যায়। এটাতো কিছুই না।”
“সরি মা, আমি মানতে পারছি না তোমার সিদ্ধান্ত। আমাকে মাফ করো।”
রণ নিজের ঘরে চলে এলো। জলি ওর দিকে তাকিয়ে রইলো একপলকে। বিরবির করে বললো-“তোমাকে মানতে হবে। আমি ব্যবস্থা করবো।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে