দর্পহরন পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
164

#দর্পহরন
#পর্ব-১৬

পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় জলি রণর সামনে এলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো এমন হলো যে রণ বাইরে যাচ্ছে আর জলি তাকে বিদায় দিতে আসেনি। রণ সারাটাদিন অফিসে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবল মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। রণর মনটা ভীষণ ভার হয়ে রইলো। মা কেন এরকম অন্যায় জেদ করছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মা কি জানে না ওরা কেমন? কতটা নির্দয় হতে পারে। ভেবে ভেবে মনটা অশান্ত হয়ে গেলো রণর। ওর সহকারী রাজিবকে ডেকে পাঠালো।
“ভাই, ডেকেছেন?”
রাজিব এসে দাঁড়ায়। রণকে ভীষণ গম্ভীর দেখা গেলো-“গতকাল মায়ের সাথে দেখা করতে বাসায় কেউ এসেছিল?”
রাজিব অবাক হলো-“হ্যা এসেছিল একজন মহিলা বোরকা পরে।”
“চেহারা দেখেছিস?”
“নাহ ভাই। মুখে নেকাব ছিল। আম্মা বলে রাখছিল, কোন মহিলা আসলে যেন তাকে বাসায় পাঠায় দেই।”
রণ চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো-“কখন এসেছিল?”
রাজীব ভীত গলায় জানতে চাইলো-“দুপুরের দিকে। কেন ভাই কোন সমস্যা হইছে?”
রণ বিরবির করলো-“সমস্যা মানে বিরাট সমস্যা হইছে।”
“ভাই কিছু বলতেছেন?”
রণ চমকে উঠলো-“নাহ কিছু না। শোন, আমি এখন উঠবো। সন্ধ্যার পর কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল ওটা মানা করে দে। বলবি আমি অসুস্থ।”
রাজীব বিস্মিত হয়ে বললো-“আচ্ছা। কিন্তু হইছে কি?”
“পরে বলবো। এখন চল আগে বাসায় যাই।”
রাজীব ঘাড় হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বাসায় ফিরে সেই সুনসান নিরবতা। রণ মায়ের ঘরের সামনে এসে কয়েকবার মাকে ডাকলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়ে বোনদের রুমে এলো। হইচই করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা হাসিখুশিও আজ নিরব। রণ মনখারাপ করে এসে ওদের বিছানায় বসলো। দুইবোন চুপচাপ পড়ার টেবিলের সামনে বসে ছিলো। ভাইকে দেখে বললো-“ভাইয়া, মা আজ সারাদিন খায়নি। রুম থেকেও বেরোয়নি। এরকম করলে তো মা অসুস্থ হয়ে যাবে।”
রণ চমকে গেলো-“সারাদিন খায়নি?”
“উহু। অনেকবার ডেকেছি বলেছে খাবে না।”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না। তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনেহচ্ছে। কিন্তু মায়ের অন্যায় আবদার মেনে নেওয়াও অসম্ভব তার পক্ষে। সে চুপ করে বসে রইলো। হাসিখুশি উসখুস করছে ভাইকে কিছু বলবে বলে। রণ সেটা বুঝে তাকায় ওদের দিকে-“কিছু বলবি তোরা?”
দু’জনই মাথা দুলায়-“কাল একটা মেয়ে এসেছিল বাসায়। মায়ের সাথে চুপিচুপি কি সব আলাপ করলো। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকেই মা গম্ভীর।”
রণ কি মনে করে হুট করে নিজের মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো-“এই মেয়েটা নাকি দেখতো?”
দুই বোন মন দিয়ে ছবিটা দেখলো। তারপর চেচিয়ে উঠে বললো-“হ্যা ভাইয়া, উনিই এসেছিল। কে বলো তো?”
“তোরা চিনবি না।” রণ ভীষণ চিন্তিত হলো।
“ভাইয়া, মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী। তাই না হাসি?”
রণ অন্যমনস্ত হয়ে বোনদের দেখলো। তার মাথায় তখন শুভ্রার চিন্তা। এই মেয়ে কি উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিল? মাকে পটিয়ে কোনভাবে তার বউ হতে? তারপর তাকে ব্যবহার করে ভাইকে জেল থেকে মুক্ত করা? পুরো চাল নিশ্চয়ই ইব্রাহিম সালিমের মাথা থেকে এসেছে? এই লোক এতেটাই নিচু মনের যে নিজের স্বার্থে মেয়েকে ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হবে না। রণর চোয়াল শক্ত হলো, হাত মুষ্টিবদ্ধ। শুভ্রা কতোটা ঘাড়ত্যাড়া সেটা তার মা জানে না। দু’টো মাস রণকে জ্বালানোর হেন চেষ্টা নাই করেনি। শুধু মেয়েটার জেদের কারণে রণকে তার সাথে অভদ্রতা করতে হয়েছে। জেনেবুঝে এই মেয়েকে বিয়ে করা মানে নিজের মৃত্যুসনদে সাক্ষ্য দেওয়া। মা কেন বুঝতে পারছে না এসব ওদের চাল? রণ ছটফটিয়ে উঠলো। যে কোন ভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। মাকে বোঝাতে হবে এসব কথা। রণ পুনরায় মায়ের ঘরের সামনে এলো। নরম গলায় মাকে ডাকলো-“মা, বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো তোমার সাথে। দরজাটা খুলবে? মা প্লিজ দরজাটা খোল।”
পাঁচ মিনিট পরে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো।
“ভেতরে এসো রণ।”
রণর বুকটা হুহু করে উঠলো। মা কাল থেকে তাকে তুমি সম্বোধন করেই যাচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য মা তাকে কত দূরের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের বিছানায় এসে বসলো রণ। জলি একটু দূরত্বে বসেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখ ঘুরিয়ে রাখা টের পেয়ে খারাপ লাগা বাড়লো রণর। সে বলেই ফেললো-“মা, আমি কি এতই খারাপ যে আমার মুখ দেখতে চাও না এখন?”
জলি জবাব দিলো না। রণ অপেক্ষা করলো এবার হয়তো মা তাকাবে তার দিকে।
“মা, তুমি সারাদিন খাওনি কেন? শরীর খারাপ করবে তো?”
জলি এবার মেজাজ দেখিয়ে বললো-“সে চিন্তা কি তোমার আছে? মাকে নিয়ে কতটা ভাবো তা দেখা হয়েছে আমার।”
“মা! এভাবে বলতে পারলে? আমি কবে তোমার চাওয়ার বিপরীতে কাজ করেছি মা?” রণ আর্তনাদ করে উঠলো।
“চাওয়া!” জলি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“তুমি আমার ভাবনার অনেক বাইরে কাজ করেছ। যদি একটাবার মায়ের কথা ভাবতে তাহলে কোনদিন এমন কিছু করতে না যাতে তোমার মায়ের মাথা হেট হয়। কেউ তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। কেউ এটা বলার সাহস পেতো না যে আমার ছেলের কারণে তার জীবন নষ্ট হয়েছে। ”
রণর হাসফাস লাগে। মাকে আর কতবার বুঝিয়ে বললে মা বুঝবে? সে অসহায় চাহুনি দিয়ে বললো-“তুমি কি একটুও বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন করেছি?”
জলি এবার ছেলের দিকে তাকালো-“তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন বলছি?তুমি ভাবছো আমি খুব শখ করে তোমাকে এই কাজ করতে বলছি? আমি শুধু ওই মেয়েটার জায়গায় নিজের সন্তানকে দেখছি। আর তোমাকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না। আমি জীবনে কোনদিন ভাবিনি আমার রণর দিকে কেউ আঙুল তুলবে। কেউ বলবে, এই ছেলেটা মেয়েদের সন্মান করে না।”
“তুমি অন্যায় জেদ করছো মা। ওই মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনলে আমাদের সবার জীবন নরক হয়ে যাবে। ও যেনতেন কোন মেয়ে নয় মা। প্লিজ তুমি তোমার জেদ থেকে সরে এসো। চলো খেতে যাই।”
রণ উঠে জলির হাত ধরতে গেলে সে ঝাঁটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো-“আমাকে বুঝ দিতে হবে না রণ। আমি কোন বাচ্চা মেয়ে নই। সব বুঝে ভেবে ডিসিশন নিয়েছি। তুমি হয় আমার সিদ্ধান্ত মানো নয়তো আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হোক।”
রণ এবার মেজাজ হারালো-“মা তুমি কেন বুঝতে পারছো না এটা ইব্রাহিম সালিমের চাল। ওর ছেলেকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সেইজন্য আমার পেছনে লেগেছে। এখন ওনার সাথে আত্মীয়তা করা মানে নিজের ক্যারিয়ারে কুড়াল মারা। দলের প্রান্তিক শ্রেনী, এলাকার লোকজন সবাই আমাকে বিশ্বাস করে মা। ওদের বিশ্বাসের খেলাপ করা হবে। ওরা আর ভরসা করবে না আমাকে। তাছাড়া ফুপি কি বলবে?”
জলির ভ্রু কুঁচকে এলো-“ফুপি! ফুপি কি বলবে? তার বলা না বলায় কি এসে যায়। তোমার বাবা এতো গুলো বছর হয় নিখোঁজ সে কি কোন খবর বের করতে পেরেছে? নাকি আমাদের দু’বেলা ভাত খাইয়েছে? আর রইলো এলাকার লোকের কথা। আমি তোমাকে ইব্রাহিম সালিমের পা চাটা গোলাম হতে বলিনি। মেয়ে জামাই হওয়ার পর ওরাই বরং তোমার কাছে ঠেকে থাকবে মেয়ের সুখের কথা ভেবে।”
রণ হাসলো-“এরকম কিছুই হবে না। না তুমি ইব্রাহিম সালিমকে চিনেছ না ওর মেয়েকে। ওরা বরং আমাকে গোলাম হতে বাধ্য করবে।”
“আমার আর চেনার দরকার নেই। শোন রণ, আমার চুলগুলো এমনি এমনি পাকেনি। অবশ্যই তোমার চাইতে বেশি বুঝি আমি। আমার দুটো মেয়ে আছে, ওদের বিয়ে দিতে হবে। তুমি আছো। আমি চাই না আমার এই ছোট পরিবারে কারো নজর লাগুক। আর তুমি রাজনীতির মাঠে নেমেছ এতো ভয় পেলে চলবে কেন? ওরা যদি তোমাকে বশ করতে চায় তাহলে তুমি থেমে থাকবে কেন? তুমি ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেই না বোঝা যাবে কিছু শিখেছ। এরপরও যদি তুমি না মানো তাহলে আর কিছু করার নেই আমার। তোমাদের নিজেদের হালে ছেড়ে আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেব।”
“মা! আমাদের এতিম করে দেওয়ার কথা তোমার মাথায় এলো কি করে?” রণর হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো জলি। কথাগুলো বলতে তারও যে বুক কেঁপেছে ভীষণ। জলির চোখদুটো জ্বলছে।
“তুমি বুঝলে না দূরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা আর শত্রুকে ঘরে টেনে আনার মধ্যে পার্থক্য কতটা। বেশ, মেনে নিলাম তোমার জেদ। তবে তোমারও একটা কথা মেনে নিতে হবে। এরপর আমি বউয়ের সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবেনা তুমি। কোন ধরনের নাক গলাবে না আমার বিবাহিত জীবনে। যদি কথা দিতে পারো তাহলে যেদিন বলবে বিয়ে করবো।”
জলি কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো-“আমি কথা বলে নিচ্ছি ওদের সাথে। পরশু যাবো ওদের বাড়িতে। ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে সারবো। পরে বড় করে রিসিপশন করা যাবে।”
রণর মুখেচোখে ঘোর আমাবস্যা। সে হেরে যাওয়া মানুষের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-“ওসব নিয়ে যা খুশি করো। আপাতত খেতে এসো। তোমার কারণে কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। দয়া করে খেতে দাও আমাকে।”
“তুই শাওয়ার নিয়ে আয় আমি খাবার রেডি করছি।”
রণ অবসন্ন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না সে। টলতে টলতে মায়ের ঘর ছাড়ে। কোনরকমে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত সে কিনা নিজের ঘরেই হেরে গেলো? এই অনুভূতি তাকে হেরে যাওয়ার চাইতেও বাজে অনুভূতি দিচ্ছে যা তার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক লাগলো। শুভ্রা তার মাকে দখল করে নিলো? এরপর মেয়েটা কিকি করবে ভাবতেই মাথা দুলে উঠছে তার। যতটা স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিল তার সবটাই যেন ধুলোয় মিলিয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে শত্রু বসে থাকলে সে কিভাবে শত্রুর বিনাশ করবে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৬

পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় জলি রণর সামনে এলো না। জীবনে প্রথমবারের মতো এমন হলো যে রণ বাইরে যাচ্ছে আর জলি তাকে বিদায় দিতে আসেনি। রণ সারাটাদিন অফিসে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবল মায়ের কথাগুলো কানে বাজছে। রণর মনটা ভীষণ ভার হয়ে রইলো। মা কেন এরকম অন্যায় জেদ করছে সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মা কি জানে না ওরা কেমন? কতটা নির্দয় হতে পারে। ভেবে ভেবে মনটা অশান্ত হয়ে গেলো রণর। ওর সহকারী রাজিবকে ডেকে পাঠালো।
“ভাই, ডেকেছেন?”
রাজিব এসে দাঁড়ায়। রণকে ভীষণ গম্ভীর দেখা গেলো-“গতকাল মায়ের সাথে দেখা করতে বাসায় কেউ এসেছিল?”
রাজিব অবাক হলো-“হ্যা এসেছিল একজন মহিলা বোরকা পরে।”
“চেহারা দেখেছিস?”
“নাহ ভাই। মুখে নেকাব ছিল। আম্মা বলে রাখছিল, কোন মহিলা আসলে যেন তাকে বাসায় পাঠায় দেই।”
রণ চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো-“কখন এসেছিল?”
রাজীব ভীত গলায় জানতে চাইলো-“দুপুরের দিকে। কেন ভাই কোন সমস্যা হইছে?”
রণ বিরবির করলো-“সমস্যা মানে বিরাট সমস্যা হইছে।”
“ভাই কিছু বলতেছেন?”
রণ চমকে উঠলো-“নাহ কিছু না। শোন, আমি এখন উঠবো। সন্ধ্যার পর কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল ওটা মানা করে দে। বলবি আমি অসুস্থ।”
রাজীব বিস্মিত হয়ে বললো-“আচ্ছা। কিন্তু হইছে কি?”
“পরে বলবো। এখন চল আগে বাসায় যাই।”
রাজীব ঘাড় হেলিয়ে বেরিয়ে গেলো।

বাসায় ফিরে সেই সুনসান নিরবতা। রণ মায়ের ঘরের সামনে এসে কয়েকবার মাকে ডাকলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না। বাধ্য হয়ে বোনদের রুমে এলো। হইচই করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখা হাসিখুশিও আজ নিরব। রণ মনখারাপ করে এসে ওদের বিছানায় বসলো। দুইবোন চুপচাপ পড়ার টেবিলের সামনে বসে ছিলো। ভাইকে দেখে বললো-“ভাইয়া, মা আজ সারাদিন খায়নি। রুম থেকেও বেরোয়নি। এরকম করলে তো মা অসুস্থ হয়ে যাবে।”
রণ চমকে গেলো-“সারাদিন খায়নি?”
“উহু। অনেকবার ডেকেছি বলেছে খাবে না।”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না। তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনেহচ্ছে। কিন্তু মায়ের অন্যায় আবদার মেনে নেওয়াও অসম্ভব তার পক্ষে। সে চুপ করে বসে রইলো। হাসিখুশি উসখুস করছে ভাইকে কিছু বলবে বলে। রণ সেটা বুঝে তাকায় ওদের দিকে-“কিছু বলবি তোরা?”
দু’জনই মাথা দুলায়-“কাল একটা মেয়ে এসেছিল বাসায়। মায়ের সাথে চুপিচুপি কি সব আলাপ করলো। মেয়েটা যাওয়ার পর থেকেই মা গম্ভীর।”
রণ কি মনে করে হুট করে নিজের মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করে দেখালো-“এই মেয়েটা নাকি দেখতো?”
দুই বোন মন দিয়ে ছবিটা দেখলো। তারপর চেচিয়ে উঠে বললো-“হ্যা ভাইয়া, উনিই এসেছিল। কে বলো তো?”
“তোরা চিনবি না।” রণ ভীষণ চিন্তিত হলো।
“ভাইয়া, মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী। তাই না হাসি?”
রণ অন্যমনস্ত হয়ে বোনদের দেখলো। তার মাথায় তখন শুভ্রার চিন্তা। এই মেয়ে কি উদ্দেশ্য নিয়ে মায়ের কাছে এসেছিল? মাকে পটিয়ে কোনভাবে তার বউ হতে? তারপর তাকে ব্যবহার করে ভাইকে জেল থেকে মুক্ত করা? পুরো চাল নিশ্চয়ই ইব্রাহিম সালিমের মাথা থেকে এসেছে? এই লোক এতেটাই নিচু মনের যে নিজের স্বার্থে মেয়েকে ব্যবহার করতে কুন্ঠিত হবে না। রণর চোয়াল শক্ত হলো, হাত মুষ্টিবদ্ধ। শুভ্রা কতোটা ঘাড়ত্যাড়া সেটা তার মা জানে না। দু’টো মাস রণকে জ্বালানোর হেন চেষ্টা নাই করেনি। শুধু মেয়েটার জেদের কারণে রণকে তার সাথে অভদ্রতা করতে হয়েছে। জেনেবুঝে এই মেয়েকে বিয়ে করা মানে নিজের মৃত্যুসনদে সাক্ষ্য দেওয়া। মা কেন বুঝতে পারছে না এসব ওদের চাল? রণ ছটফটিয়ে উঠলো। যে কোন ভাবে মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। মাকে বোঝাতে হবে এসব কথা। রণ পুনরায় মায়ের ঘরের সামনে এলো। নরম গলায় মাকে ডাকলো-“মা, বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো তোমার সাথে। দরজাটা খুলবে? মা প্লিজ দরজাটা খোল।”
পাঁচ মিনিট পরে খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো।
“ভেতরে এসো রণ।”
রণর বুকটা হুহু করে উঠলো। মা কাল থেকে তাকে তুমি সম্বোধন করেই যাচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য মা তাকে কত দূরের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মায়ের বিছানায় এসে বসলো রণ। জলি একটু দূরত্বে বসেছে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের মুখ ঘুরিয়ে রাখা টের পেয়ে খারাপ লাগা বাড়লো রণর। সে বলেই ফেললো-“মা, আমি কি এতই খারাপ যে আমার মুখ দেখতে চাও না এখন?”
জলি জবাব দিলো না। রণ অপেক্ষা করলো এবার হয়তো মা তাকাবে তার দিকে।
“মা, তুমি সারাদিন খাওনি কেন? শরীর খারাপ করবে তো?”
জলি এবার মেজাজ দেখিয়ে বললো-“সে চিন্তা কি তোমার আছে? মাকে নিয়ে কতটা ভাবো তা দেখা হয়েছে আমার।”
“মা! এভাবে বলতে পারলে? আমি কবে তোমার চাওয়ার বিপরীতে কাজ করেছি মা?” রণ আর্তনাদ করে উঠলো।
“চাওয়া!” জলি তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলো-“তুমি আমার ভাবনার অনেক বাইরে কাজ করেছ। যদি একটাবার মায়ের কথা ভাবতে তাহলে কোনদিন এমন কিছু করতে না যাতে তোমার মায়ের মাথা হেট হয়। কেউ তার দিকে আঙুল তুলতে পারে। কেউ এটা বলার সাহস পেতো না যে আমার ছেলের কারণে তার জীবন নষ্ট হয়েছে। ”
রণর হাসফাস লাগে। মাকে আর কতবার বুঝিয়ে বললে মা বুঝবে? সে অসহায় চাহুনি দিয়ে বললো-“তুমি কি একটুও বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন করেছি?”
জলি এবার ছেলের দিকে তাকালো-“তুমি কি বুঝতে পারছ না আমি কেন এমন বলছি?তুমি ভাবছো আমি খুব শখ করে তোমাকে এই কাজ করতে বলছি? আমি শুধু ওই মেয়েটার জায়গায় নিজের সন্তানকে দেখছি। আর তোমাকে কিছুতেই মাফ করতে পারছি না। আমি জীবনে কোনদিন ভাবিনি আমার রণর দিকে কেউ আঙুল তুলবে। কেউ বলবে, এই ছেলেটা মেয়েদের সন্মান করে না।”
“তুমি অন্যায় জেদ করছো মা। ওই মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনলে আমাদের সবার জীবন নরক হয়ে যাবে। ও যেনতেন কোন মেয়ে নয় মা। প্লিজ তুমি তোমার জেদ থেকে সরে এসো। চলো খেতে যাই।”
রণ উঠে জলির হাত ধরতে গেলে সে ঝাঁটকা দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো-“আমাকে বুঝ দিতে হবে না রণ। আমি কোন বাচ্চা মেয়ে নই। সব বুঝে ভেবে ডিসিশন নিয়েছি। তুমি হয় আমার সিদ্ধান্ত মানো নয়তো আমাকে আমার হালে ছেড়ে দাও। যা হওয়ার হোক।”
রণ এবার মেজাজ হারালো-“মা তুমি কেন বুঝতে পারছো না এটা ইব্রাহিম সালিমের চাল। ওর ছেলেকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সেইজন্য আমার পেছনে লেগেছে। এখন ওনার সাথে আত্মীয়তা করা মানে নিজের ক্যারিয়ারে কুড়াল মারা। দলের প্রান্তিক শ্রেনী, এলাকার লোকজন সবাই আমাকে বিশ্বাস করে মা। ওদের বিশ্বাসের খেলাপ করা হবে। ওরা আর ভরসা করবে না আমাকে। তাছাড়া ফুপি কি বলবে?”
জলির ভ্রু কুঁচকে এলো-“ফুপি! ফুপি কি বলবে? তার বলা না বলায় কি এসে যায়। তোমার বাবা এতো গুলো বছর হয় নিখোঁজ সে কি কোন খবর বের করতে পেরেছে? নাকি আমাদের দু’বেলা ভাত খাইয়েছে? আর রইলো এলাকার লোকের কথা। আমি তোমাকে ইব্রাহিম সালিমের পা চাটা গোলাম হতে বলিনি। মেয়ে জামাই হওয়ার পর ওরাই বরং তোমার কাছে ঠেকে থাকবে মেয়ের সুখের কথা ভেবে।”
রণ হাসলো-“এরকম কিছুই হবে না। না তুমি ইব্রাহিম সালিমকে চিনেছ না ওর মেয়েকে। ওরা বরং আমাকে গোলাম হতে বাধ্য করবে।”
“আমার আর চেনার দরকার নেই। শোন রণ, আমার চুলগুলো এমনি এমনি পাকেনি। অবশ্যই তোমার চাইতে বেশি বুঝি আমি। আমার দুটো মেয়ে আছে, ওদের বিয়ে দিতে হবে। তুমি আছো। আমি চাই না আমার এই ছোট পরিবারে কারো নজর লাগুক। আর তুমি রাজনীতির মাঠে নেমেছ এতো ভয় পেলে চলবে কেন? ওরা যদি তোমাকে বশ করতে চায় তাহলে তুমি থেমে থাকবে কেন? তুমি ওদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলেই না বোঝা যাবে কিছু শিখেছ। এরপরও যদি তুমি না মানো তাহলে আর কিছু করার নেই আমার। তোমাদের নিজেদের হালে ছেড়ে আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সপে দেব।”
“মা! আমাদের এতিম করে দেওয়ার কথা তোমার মাথায় এলো কি করে?” রণর হুঙ্কার শুনে কেঁপে উঠলো জলি। কথাগুলো বলতে তারও যে বুক কেঁপেছে ভীষণ। জলির চোখদুটো জ্বলছে।
“তুমি বুঝলে না দূরের শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা আর শত্রুকে ঘরে টেনে আনার মধ্যে পার্থক্য কতটা। বেশ, মেনে নিলাম তোমার জেদ। তবে তোমারও একটা কথা মেনে নিতে হবে। এরপর আমি বউয়ের সাথে কিভাবে জীবন কাটাবো সে বিষয়ে কিছু বলতে পারবেনা তুমি। কোন ধরনের নাক গলাবে না আমার বিবাহিত জীবনে। যদি কথা দিতে পারো তাহলে যেদিন বলবে বিয়ে করবো।”
জলি কিছু বলতে যেয়েও নিজেকে সামলে নিলো-“আমি কথা বলে নিচ্ছি ওদের সাথে। পরশু যাবো ওদের বাড়িতে। ছোটখাটো আয়োজনে বিয়ে সারবো। পরে বড় করে রিসিপশন করা যাবে।”
রণর মুখেচোখে ঘোর আমাবস্যা। সে হেরে যাওয়া মানুষের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো-“ওসব নিয়ে যা খুশি করো। আপাতত খেতে এসো। তোমার কারণে কাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি আমার। দয়া করে খেতে দাও আমাকে।”
“তুই শাওয়ার নিয়ে আয় আমি খাবার রেডি করছি।”
রণ অবসন্ন ভাবে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে কোন জোর পাচ্ছে না সে। টলতে টলতে মায়ের ঘর ছাড়ে। কোনরকমে নিজের ঘরে ফিরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। এতকিছু করে শেষ পর্যন্ত সে কিনা নিজের ঘরেই হেরে গেলো? এই অনুভূতি তাকে হেরে যাওয়ার চাইতেও বাজে অনুভূতি দিচ্ছে যা তার কাছে ভীষণ পীড়াদায়ক লাগলো। শুভ্রা তার মাকে দখল করে নিলো? এরপর মেয়েটা কিকি করবে ভাবতেই মাথা দুলে উঠছে তার। যতটা স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছিল তার সবটাই যেন ধুলোয় মিলিয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে শত্রু বসে থাকলে সে কিভাবে শত্রুর বিনাশ করবে?

চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন

#দর্পহরন
#পর্ব-১৮

রাত নয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে তিনবার কবুল বলে রণ আর শুভ্রা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। মুরুব্বিদের সালাম করার নিয়মে যেয়েই বিপাক বাঁধলো। শুভ্রা তার শশুরবাড়ির লোকদের সালাম করলেও রণ দাঁড়িয়ে রইলো। সে মুখে সালাম জানালো হাতের ইশারায়। ইব্রাহিম সালিম হাসলো-“বেয়াইন, আপনার ছেলেরে দেখি আদব শেখান নাই? মানলাম সে প্রতিমন্ত্রী কিন্তু আমি তো তার শশুর লাগি এখন। আর বিয়ের পর মুরুব্বিদের দোয়া নিতে হয় এটা কি তাকে বলে দিতে হবে?”
রণ কিছু বলতে চাইছিল জলি তাকে চোখের ইশারায় শান্ত থাকতে বলে মৃদুস্বরে জবাব দিলো-“ভাইসাহেব, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার ব্যাপারে ধর্মে নিষেধ আছে। আমার ছেলেকে এভাবেই শিখিয়েছি। আর শুধু সালামে কি আদব বোঝা যায়? দেখতে হবে আচরণ কেমন? আমার ছেলে আলহামদুলিল্লাহ আদবের দিক দিয়ে সেরা। মানুষ হিসেবে অসাধারণ আর ছেলে হিসেবে লাখে একটা। এতটুকু বলতে পারি অন্যায় ব্যাতীত সে আপনাদের কখনো অসম্মান করবে না।”
সালিম সাহেব আরও কিছু হয়তো বলতেন কিন্তু মোর্শেদ থামালো। জলি হাসলো-“আরেকটা কথা ভাইসাহেব। বলেছিলাম স্বল্প পরিসরে আয়োজন করতে। আপনি এলাহি কান্ড করেছেন। এমনটা না করলেও পারতেন। আমরা চেয়েছিলাম ক’দিন পরে সবাইকে জানাবো। এতো তাড়াহুড়োর কিছু ছিলো না। যাইহোক যা করেছেন ভালো করেছেন।”
সালিম চতুর হাসি দিলো-“কি বলেন বেয়াইন! একমাত্র মেয়ের বিয়ে আর আমি আয়োজন করবোনা? আপনি কি জানেন না মেয়ের বিয়ে লুকিয়ে দিতে হয় না।”
জলি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়ে-“আমরা তাহলে বিদায় নেই। ওখানে যেয়ে অনেক আনুষ্ঠানিকতা করতে হবে।”
এ কথা শোনা মাত্র রিমা এগিয়ে এসে জলির হাত ধরলো-“আপা, আমার বড় আদরের মেয়ে শারমিন। একটু জেদি হইলেও মনটা পরিস্কার। আপনি ওকে দেখে রাইখেন আপা।”
জলি স্বান্তনা দিলো-“আপনি ভাববেন না আপা। আমার দুই মেয়ের সাথে ও আরেকটা মেয়ে হয়ে থাকবে। আমরা অন্তত মেয়ে আর বউয়ের মধ্যে তফাৎ করি না।”
সালিম হাত মুঠি করলো। জলির প্রতিটা কথা তার কানে সীসা ঢালছে যেন। এই মহিলা এতো কথা জানে আগে কোনদিন বোঝেনি। এখন বুঝতে পারছে ছেলেটা এতো বুদ্ধি কোত্থেকে পায়।

বিদায় বেলায় শুভ্রা কাঁদলো না খুব একটা। মায়ের হাউমাউ কান্না শুনে কেবল তার চোখের কোল ভিজেছিল। এই পুরো দৃশ্য দূর থেকে দেখেছে তুলতুল। রিমার কান্না দেখে তার খুব নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে। ভালো মতো বিয়ে হলে তার মাও নিশ্চয়ই এভাবে কেঁদে কেটে বিদায় দিতো তাকে? তুলতুলের ভীষণ মনখারাপ হলো। শুভ্রার বিয়েতে তাকে কোথাও দেখা যায়নি। না তার বাড়ির লোকেরা নিমন্ত্রিত ছিলো। সালিম সাহেবের নিষেধ ছিলো তুলতুল যেন কারো সামনে না আসে। শুভ্রার জন্য খারাপ লাগে তুলতুলের। একসাথে থাকতে থাকতে মেয়েটার উপর মায়া পড়ে গেছিল। সাদা মনের মেয়ে, কোন প্যাচ নেই। বাপ ভাইয়ের মতো কুটিল নয় একদমই। মেয়েটা মনেহয় জানেইনা ওর বাপভাই কতটা খারাপ। এই যে তুলতুলকে তুলে এনে বিয়ে করা হয়েছে এটা কি শুভ্রা জানে?

★★★

হাসিখুশি দুই বোন তাদের একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে যায়নি। এটাও রণর ইচ্ছে। বোনদের ওই লোকের সংস্পর্শে নিতে দেবে না কিছুতেই। বলা যায় তাদের মনে কি আছে। বোনদের নিয়ে রিস্ক নেবে না। হাসিখুশির মন খারাপ হয়েছে কিন্তু ভাইয়ের জেদের কারণে হাড় মেনেছে। ওরা বাড়িতে তৈরি হয়ে বসে ছিলো ভাবিকে বরন করে নিতে। গাড়ি এসে থামা মাত্রই দুই বোন আর বাকী কাজিনরা হুড়মুড় করে নিচে নেমে এলো। রণ এমনিতেই বিরক্ত হয়ে ছিলো। পুরোটা রাস্তা সে একটা কথাও বলেনি। চুপ করে বসে ছিলো। মেজাজ দেখানোর উপায় নেই বলে শরীর জুড়ে রক্তকনিকাগুলোর অবাধ্য ছোটাছুটি চলছে। রণ নিশ্চুপ নেমে গেলো গাড়ি থেকে।

এ বাড়ির দোতলাটা নিজের কাজের জন্য ব্যবহার করছে রণ। ও সোজা দোতলায় এলো। গায়ের শেরওয়ানি খুলে নরমাল পোশাক পরে নিলো। আজ এখানে মিহির আর রাজীব দু’জনই আছে। এই মুহূর্তে রণর দু’জনকেই দরকার বলে মিহিরকে ফিরতে দেয়নি এলাকায়। রণকে দেখে মিহির আর রাজীব দু’জনই একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। বুঝতে পারছে রণর মেজাজ ভীষণ খারাপ। মিহির রণর কানে ফিসফিস করলো-“ভাই, নিচে অনেক সাংবাদিক আছে। বিয়ের খবর কভার করতে চায়। কি করবো?”
রণ ভ্রু কুঁচকে ছিলো। খবর শুনে দু’জনকে দেখলো পালা করে-“একটা কাগজে সংক্ষিপ্ত আকারে বিবৃতি লিখে ওদের হাতে দিয়ে দে। আর চা মিষ্টি খাইয়ে বিদায় কর। বিয়ে নিয়ে কোন হইচই যেন না হয় এটা কড়া ভাবে মানা করে দিবি। পরে সবাইকে বলা হবে এটাও জানিয়ে দিস।”
দু’জন মাথা দুলায়। রাজিব বেরিয়ে গেলো।
“দিলশাদ ফোন দিয়েছে? ওদিকে কি খবর?”
মিহিরকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“ওরা আজকে জামিনের কোন চেষ্টাই করে নাই। দিলশাদ বললো এবার পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন মঞ্জুর করেছে।”
রণ হাসলো-“বুঝিসনি কেন চুপ করে বসে আছে? ভেবেছে আমাকে দিয়ে কাজ সারবে। ওদের কি প্ল্যান হতে পারে বলতো? আমার তো মাথা জট পাকিয়ে যাচ্ছে।”
মিহির মাথা চুলকালো। এরকম পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি কাজেই কোন আইডিয়া নেই আসলে। সে মিনমিন করলো-“ভাই, কি করবেন জানি না। তবে এইবার পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। সোহেলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এরইমধ্যে নান্টু গায়েব হয়ে গেছে। সবাই ভাববে আপনি সালিমের দলে ভিরে গেছেন।”
রণ গম্ভীর হয়ে রইলো। কিছুক্ষণ ভেবে বললো-“একটা কাজ করতে পারবি? আচ্ছা থাক। দেখি দিলশাদের সাথে কথা বলি। আর শোন, একটা কাজ দেই তোকে। আমার শশুরের সব বৈধ অবৈধ কাজের তথ্য একত্রে করে আমাকে দিবি। আর ওই যে অভিযোগ বক্সে অভিযোগ জমা হইছিল ওইগুলার বর্তমানে স্ট্যাটাস আমাকে আপডেট দে। আগামী সপ্তাহে আমি এলাকায় যাব। এর একটা আউটপুট দেখাতে চাই এলাকার লোকজনকে। বুঝতে পেরেছিস?”
বলেই মুচকি হাসলো রণ। মিহির অদ্ভুত দৃষ্টিতে রণকে দেখছে। আসলে বুঝতে চাইছে রণ কি করতে চাইছে। মিহির কিছু বলবে তার আগেই রাজিব এসে খবর দিলো, রণকে জলি ডেকে পাঠিয়েছে।

★★★

“বিয়ে করে বউ এনেছ। এতো রাতে দোতলায় কি কাজ রণ? এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে?”
জলির কথায় রণ ভীষণ বিরক্ত-“মা, তোমাকে আগেই বলেছিলাম বিয়ের পর আমার জীবন নিয়ে মাথা ঘামাবে না তুমি।”
রণর খালা মলি গম্ভীর হলো-“দেখ রণ, যা হয়েছে তা হয়েছে। এসব নিয়ে সিনক্রিয়েট না করাই ভালো। তুই চাসনি বলে যেনতেন ভাবে বিয়েটা হলো। ছেলেমেয়েরা সবাই খুব মন খারাপ করেছে। এখন তোকে মনে রাখতে হবে তুই কোন হেলাফেলার মানুষ না। এমন কোন কাজ করা উচিত হবে না যাতে লোকের হাসির পাত্র হতে হয়।
লোকে এসব জানলে নিউজ হবে। জবরদস্তির বিয়ে কিংবা বউয়ের সাথে তোর ঝামেলা চলছে এসব ঘরের মধ্যে থাকুক। লোকে জানলে তোর ইমেজে ইফেক্ট হবে বাবা।”
রণর মামা ব্যরিস্টার খোকন ভাগ্নের কাঁধে হাত রাখলো-“মায়ের উপর রেগে থাকিস না রণ। মা তোর ভালো চেয়েছে বলেই এমন একটা কাজ করেছে। আর বিয়ে যেহেতু হয়ে গেছে সেহেতু মানিয়ে চলার চেষ্টা কর। তুই আমাদের পরিবারের সন্তানদের কাছে আদর্শ মানুষ। তুই এমন কিছু করিস না যাতে ছোট ভাই বোনদের নজরে ছোট হতে হয়। বাকী তুই বুঝদার বাচ্চা, কি বলবো তোকে?”
রণ চুপচাপ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। সবার এক্সপেকটেশন পূরণ করতে করতে তার নিজের চাওয়া পাওয়া ভুলে গেছে সে। ভালো হওয়াটা কি দোষের? মা কেন তার উপর সব চাপিয়ে দিচ্ছে?
রণ ভীষন মন খারাপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতর থেকে হাসাহাসির আওয়াজ আসছে। রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। এই মেয়ের সাথে সবার এতো কিসের হাসাহাসি সে ভেবে পেলো না। এতো অল্প সময়ে সবার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে কি করে? ভাবনা আঁটকে রেখে রণ দরজার আওয়াজ দেওয়া মাত্রই সবার হাসি থেমে গেলো। হাসি এসে দরজা খুললো। ওকে দেখে ঢোক গিললো। ভেতরে তাকিয়ে বললো-“ভাইয়া এসেছে। চল আমরা এখন যাই।”
সেকেন্ডের মধ্যে রুম খালি হয়ে গেলো। খালাতো মামাতো বোনেরা কেউ কেউ একবার তাকিয়ে রণকে দেখে মুখ টিপে হাসলো। রণ সেই হাসির কারণ খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হলো। ঘরে ঢুকেই দেখলো শুভ্রা ভদ্র মেয়েটি সেজে লম্বা ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার কি করনীয় সেটা ভেবে পেলো না রণ। এই মেয়ের সাথে কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পেলো না। অনেকটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো বোকার মতো। তারপর সোফায় যেয়ে বসলো।

শুভ্রা ঘোমটার আড়ালে চুপচাপ বসে থেকে রণর কীর্তি দেখছে। তার চোখেমুখে দুষ্ট হাসির রেখা। সে ইচ্ছে করে একটু কাশলো-“উহুম উহুম।”
রণ চমকে উঠলো। শুভ্রা নাকি কন্ঠে বললো-“নতুন বউকে দেখবেন না মন্ত্রীমশাই?”
রণর কুঞ্চিত ভ্রু যুগল আরও খানিকটা কুঁচকে গেলো। কি করতে চাইছে মেয়েটা? নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে। রণ সন্দিহান নজরে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রা আবারও কথা বলে উঠলো-“আরেহ! ওভাবে বসে আছেন কেন? নতুন বউয়ের মুখ দেখার রীতি পূরন করে আমাকে মুক্তি দিন। আর কতোক্ষণ বসে থাকবো?”
রণ কড়া গলায় বললো-“কে বসে থাকতে বলেছে আপনাকে? ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে? কোন মুখ দেখাদেখি হবে না। আপনার যা ইচ্ছে হয় করুন।”
শুভ্রা ভারী লেহেঙ্গা নিয়ে অনেক কষ্টে নেমে এসে রণর মুখোমুখি দাঁড়াল। ওর চেহারার উপর এখনো ওড়না ঝুলছে। সে গলায় আহলাদ ঢেলে বললো-
“প্লিজ ঘোমটাটা তুলুন। বাসর রাতে বউয়ের মুখ না দেখলে স্বামীর অমঙ্গল হয়। আমি কি করে আপনার অমঙ্গল চাইবো বলুনতো? শত্রু হলেও আপনিই আমার স্বামী, আমার প্রাননাথ।”
রণ হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই মেয়েটা তাকে বোকা বানাতে বন্ধ পরিকর বোঝা যাচ্ছে। ওড়নায় উপর দিয়ে শুভ্রার বঁধু সাজে সজ্জিত চাঁদ মুখখানা ঘরের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে। রণ সেদিকে তাকিয়ে হেসে দেয়-“খুব স্বামীর চিন্তা আপনার, তাই না?”
শুভ্রা মাথা দুলায়। রণ হাসতে হাসতে বললো-“এককাজ করুন। আপনি সোফায় বসে থাকুন আমি একটু ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে না হয় আপনার মুখ দেখবো কিনা সিদ্ধান্ত নেব।”
শুভ্রার চেহারা থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। মন খারাপ করে দরজার দিকে এগুলো। রণ জিজ্ঞেস করলো-“কোথায় যাচ্ছেন?”
“আপনার মায়ের কাছে।”
“কেন?”
“তাকে যেয়ে বলি যে তার ছেলে বাসর রাতে বউয়ের মুখ দেখতে চাইছে না।”
রণ রেগে গেলো-“মিস শুভ্রা, যথেষ্ট নাচিয়েছেন আমার মাকে। আগে কিছু বলিনি বলে ভাববেন না এখনও সব মেনে নেব। আমাদের মধ্যকার ব্যাপারে তাকে দূরে রাখবেন এটাই মঙ্গল হবে আপনার জন্য।”
শুভ্রা ঘুরে দাঁড়িয়ে রণর দিকে তাকিয়ে বললো-“প্রথমত আমি এখন মিস না মিসেস। দ্বিতীয়ত, আপনার মা আপনার মতো খারাপ মানুষ না। ভালো মন্দ জ্ঞান আছে তার। তাই তাকে কোন ব্যাপারেই দূরে রাখবো না।”
রণ রাগী দৃষ্টি নিয়ে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে রইলো। শান্ত গলায় বললো-“আপনার সমস্যা কি বলবেন? আপনার মতো সুন্দরীকে পাত্তা দেইনা এটা গায়ে জ্বালা ধরায় তাই না?”
শুভ্রা অনড়ভাবে বললো-“এতো কথা শুনতে চাই না। আপনি আমার মুখ দেখবেন নাকি শাশুড়ী মায়ের কাছে যাব?”
রণর মনটা বিদ্রোহ করতে চাইছে। মা এ কিসের মধ্যে ফাঁসালো তাকে? সে ক্লান্ত গলায় বললো-“আপনি দয়া করে নিজ হাতে ঘোমটা তুলুন আমি আপনার মুখ দর্শন করি। প্লিজ আর আর্গু করবেন না। যদি এতেও রাজি না থাকেন তাহলে আপনি মায়ের কাছে যেতে পারেন।”
শুভ্রা কিছু সময় চুপচাপ রইলো। তারপর দু’হাতে ওড়না তুলে মাথায় রাখলো। রণ দিকে তাকিয়ে আছে সে। তার চেহারায় নতুন বউয়ের মতো স্বাভাবিক লজ্জার লেশমাত্র নেই। তীক্ষ্ণ নজরে রণকে বিদ্ধ করতে চাইছে। রণ তাকিয়ে থেকে বললো-“দেখলাম। এবার খুশি? প্লিজ এবার আমাকে ঘুমাতে দিন। কাল একটা জরুরি মিটিং আছে সকালে।”
শুভ্রা মাথা দুলিয়ে মিষ্টি হাসলো-“ঘুমান তবে তার আগে আমার গিফটটা দিন।”
“গিফট!” রণ চেচিয়ে উঠলো। শুভ্রা দুষ্ট হাসি দিলো-“নতুন বউয়ের মুখ দেখে গিফট দিতে হয়।”
“এনাফ! যথেষ্ট ফান করেছেন। এবার দয়া করে থামুন। তাছাড়া আপনার মুখ আমি দেখতে চাইনি আপনি জোর করে দেখিয়েছেন। এখন আবার জোর করে গিফটও দাবী করছেন। আপনি তো দেখছি আজব ধরনের বেহায়া মেয়ে? শুনুন কোন গিফট টিফট দিতে পারবোনা। মানুষ বউ দেখে গিফট তখনই দেয় যখন তার মন প্রশান্ত হয়। আপনাকে দেখে তো আমার মনের শান্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। কিসের গিফট দেব আপনাকে?”
বলতে বলতে রণ বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শুভ্রা ওকে দেখতে দেখতে দাঁত কিড়মিড় করে বিরবির করলো-“গিফট তো আপনাকে দিতেই হবে মিস্টার রণ। দেখি কিভাবে গিফট না দিয়ে থাকেন আপনি।”

চলবে—
©Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে