দখিনের জানলা পর্ব-১৬

0
530

#দখিনের_জানলা (পর্ব-১৬)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৩২.
বৃষ্টি হওয়ার পর পরিবেশটা একটু ঠান্ডা লাগছে। এক ঘন্টা আগেও অসহনীয় পর্যায়ের গরম পড়ছিল এখন তা আর নেই। বাতাসেও ভেজা ভাব। বালু উড়ছেনা, আকাশও পরিষ্কার লাগছে। সবমিলিয়ে পরিবেশটা বেশ আরামদায়ক লাগছে। যদিও এখন জ্যামে আ’ট’কা পড়ে আছে তারপরও ভালোই লাগছে। দীর্ঘদিন পর চেনা ঢাকা শহরটা দেখতে পেরেই আনন্দ লাগছে চমচমের। রহমত উদ্দিন একটু পর পরই বলছে,

-‘আম্মা! কিছু খাইবেন? জ্যাম তো সহজে ছুডব না মনৃ হয়। চা কপি কিছু খাইবেন?’

-‘চা পাওয়া যাবে?’

রহমত উদ্দিন হেসে বলে,

-‘পাওন যাইব না মানে? পাশেই একটা দোকান আছে। ওয়ান টাইম কাপে কইরা দেয় চা। নিয়া আসি? খাইয়া দেখবেন প্রাণ জুড়াইছে।’

-‘আচ্ছা আনেন তবে।’

রহমত উদ্দিন চা আনতে চলে গেলেন। চমচম বাহিরে তাকিয়ে দেখল জ্যামটা খুব বা’জে ভাবেই লেগেছে। এক ঘন্টাতেও বোধ হয় ছাড়বেনা। সিটে হেলান দিয়ে সে চোখটা বন্ধ করল। আজকে সকালের ফ্লাইটে চট্টগ্রাম থেকে এসেছিল সে। অনার্স কমপ্লিট করার পরেই একটা কোম্পানীতে চাকরি পায় সে। যদিও সেসময় চাকরিটা পেতে বড় মামার সুপারিশ ছিল কিন্তু তার কাজ দেখে ধীরে ধীরে সবাই তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়। সেই সুবাদে গত সপ্তাহে প্রোমোশন হয়েছে। ঢাকা হেড অফিসে এখন থেকে কাজ করতে হবে তাকে। তাদের কোম্পানিটার সাত বিভাগেই শাখা রয়েছে। বেশ বড় নাম করা কোম্পানি। ঢাকাতে হলো মূল ভবন। আজকে এখানে এসে কিছু দরকারি কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে তাকে। চমচম প্রথমে আসতে চায়নি ঢাকায়। কিন্তু আর কত? পরিবার ছেড়েই বা আর কত দূরে থাকা যায়? অনেক গুলো বছর তো চলে গেল মাঝে। জীবনেও সে এগিয়ে গেছে অনেক। এখন আর ওইসব তু’চ্ছ ঘটনা মনে রেখে পরিবারের লোকদের ক’ষ্ট দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। চমচম নিজেকে আগের থেকেও শ’ক্ত করেছে। চঞ্চল, ডানপিটে স্বভাব থেকেও সে বেরিয়ে এসেছে বহু বছর আগে। এখন সে শান্ত হয়েছে, নম্র হয়েছে, গম্ভীর হয়েছে। কথাও বলে মেপে মেপে। পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে চিনির মতো করে।

আজই হয়তো চমচম আসত না। কিন্তু চিনির বিয়ে দুইদিন পর। না এসে উপায় নেই। তাছাড়া একটা মাত্র বোনের বিয়েতে তার আরো আগেই আসা উচিত ছিল। এমন নয় যে চমচম ঢাকায় বহু বছর পর এসেছে। চমচম আগেও আসত। বন্ধে এসে ছুটিয়ে কা’টিয়ে চলে যেত। কিন্তু তখন তো এখনকার মতো পরিস্থিতি নেই। শুনেছে আব্রাহাম এসেছে। দুই মাস হয়েও গেছে তার দেশে আসার। আব্রাহামের আসার খবর শোনার পরই চমচমের মুখটা তেঁতো হয়ে গিয়েছিল। তবে ওতটা মাথা ঘামায়নি। কারণ তখনও তো সে জানত না যে নীড়ে ফিরতে হবে তাকে। হুট করেই সব হয়ে গেল। বসের কল, প্রোমোশন, ট্রান্সফার, চিনির বিয়ে! চমচম এতসবে হাঁ’পিয়ে গেছে। বহুদিন একা একা থাকার ফলে সে অনেক বেশি ইনট্রোভার্ট হয়ে গেছে। করোনা পজিটিভ হলো যে বছর সেই বছরও তাকে একাই সবটা সামাল দিতে হয়েছিল। লকডাউন থাকাতে কেউ দেখা করতে পারেনি পর্যন্ত। সেই সময়ের কথা মনে পড়লে চমচমের কেন যেন হাসিও পায়। সময়টা অদ্ভুত ছিল। এখন করোনার দুই বছর পার হয়েছে। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে গেছে। বলা যায় আগের চেয়েও বেশি উন্নত হয়েছে সবকিছু। এই যেমন অনলাইন ক্লাসটা আগে ছিল স্বপ্নের মতো আর এখন অহরহ। জুম মিটিং, অনলাইন বিজনেস এসবও দুই বছর আগে তেমন একটা প্রচলিত ছিল না। অথচ এখন ঘরে ঘরে সবাই এসবে আবিষ্ট হয়ে আছে।

রহমত উদ্দিন চা নিয়ে এসেছে। চমচম কাপ হাতে নিয়ে বলল,

-‘আপনার চা আনেন নাই চাচা?’

-‘আমি খাইয়া আপনার জন্য নিয়া আসছি। জ্যাম ছাড়ন শুরু করছে। আমি গাড়ি চালাইতে গেলে তো আর খাইতে পারুম না। তাই আগেই খাইয়া লাইছি। আপনে খান আম্মা।’

চমচম আলতো হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিল। বেশ ভালো খেতে হয়েছে চা টা। জ্যামটা দেখে একটু আগেও মনে হয়েছিল এক ঘন্টা পর ছাড়বে অথচ পনেরো মিনিটেই জ্যাম ছাড়ল। সেই সাথে পথে আর একবারও জ্যাম পড়েনি। গাড়ি আপন গতিতে চলতে লাগল।

৩৩.
আব্রাহাম অফিস থেকে ফিরছিল। বাড়ির সামনের রাস্তায় লাইটিং এর কাজ চলছে। চিনির বিয়ে উপলক্ষ্যে সাজানো হচ্ছে। আয়মান একটা মাঝারি সাইজের বক্স আব্রাহামের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-‘ভাই! আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি তুমি বক্সটা নিয়ে মাকে দিয়ে আসো। মা চিনিদের বাসায়।

-‘আমি টায়ার্ড আয়মান। তুই যা!’

-‘না ভাই। পারব না। আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে। আর্জেন্ট!’

আব্রাহামকে চমচমদের বিল্ডিং এর সামনে নামিয়ে দিয়ে আয়মান চলে গেল। আব্রাহাম বক্সটা হাতে নিয়ে লিফটে ওঠে। চমচমদের ফ্লোরে গিয়েই তার টায়ার্ডনেস আরো বেড়ে গেল। এত মানুষের ভীড় তার সহ্য হচ্ছিল না। সে তার মাকে বক্সটা দিয়েই চলে আসছিল। নিগার খানম হাত ধরে আটকায় তাকে। বলেন,

-‘দাঁড়া। আমিও যাব এখন।’

নিগার খানম দুই মিনিট সময় লাগিয়ে বের হলেন বাসা থেকে। তিনি একা নয় চিনি আর চিনির মাও সাথে ছিল। আব্রাহাম ফাতেমা বেগমকে সালাম দিয়ে চিনির সাথে একটু কথা বলল। সবাই লিফটে উঠল। আব্রাহাম ভেবেছে চিনি আর চিনির মা তাদের বাসায় যাচ্ছে। কিন্তু নিচে নেমে দেখে তারা সবাই গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আব্রাহাম ভ্রু কুঁচকে বলল,

-‘দাঁড়িয়ে পড়লে যে?’

নিগার খানম হেসে বললেন,

-‘চমচম আসছে। মোড়ে ঢুকেছে আরো আগে। এখনই চলে আসবে।’

চিনি চেঁ’চি’য়ে উঠে বলল,

-‘ওই তো গাড়ি আসছে!’

আব্রাহামের হাত পা জমে গেল চমচমের আসার খবর শুনে। তার হার্টবিটের গতি বেড়ে গেল মুহূর্তেই। গাড়িটা এসে একেবারে তার সামনে দাঁড়ালো। সেকেন্ডের মাঝেই গাড়ি থেকে এক জন শাড়ি পরিহিতা নারী বেরিয়ে এলো। আব্রাহাম অবাক হয়ে দেখল সেই পূর্ণ যৌবনা চমচমকে। শেষবার চমচমকে অষ্টাদশী কন্যা হিসেবে দেখেছিল বোধ হয়। অথচ আজ সে ছাব্বিশে পা দেওয়া এক পরিপূর্ণ যুবতী। আব্রাহাম বুঝতে পারল ভূ’তে ধরার অসুখটা শেষ হয়নি বরং আগের চেয়ে এখন, এই মুহূর্তে তা আরো বহু গুণ বেড়ে গেছে। তার বত্রিশ বছর বয়সে সে দ্বিতীয়বারের মতো চমচমের প্রেমে পড়েছে। উহু! এই বয়সে নিশ্চয়ই প্রেমে পড়ে না। এই বয়সে যা হয় তা ভালোবাসা। আশ্চর্য! আব্রাহাম এই প্রথম মন থেকে স্বীকার করল সে চমচমকে ভালোবেসে ফেলেছে। চমচমের জন্য তার বিশেষ অনুভূতি আছে। অথচ দুই দিন আগেও সে এসব অনুভূতিকে পাত্তা দেয়নি। চমচমকে নিয়ে এসব ভাবলেও তার ল’জ্জা, অ’স্ব’স্তি হতো। আর আজ, এখন সে নিজের অনুভূতি নিয়ে ল’জ্জিত নয়। বরং আত্মবিশ্বাসী। নিয়তি বোধ হয় তাকে নতুন করে সুযোগ দিল। এবার ভালোবাসাটা কি তবে আদায় করে নেওয়া দরকার?

চমচমকে প্রথমেই চিনি জড়িয়ে ধরল। এরপর তার মা আর তারপর নিগার খানম। সবার শেষে চমচমের চোখ পড়ল আব্রাহামের উপর। এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সে আব্রাহামকে। ফর্মাল গেটাপে দাঁড়িয়ে থাকা আব্রাহামকে দেখে তার বুকটা ধ্ব’ক করে উঠল। তার চিরচেনা হাম ভাইয়া ভীষণ বদলে গেছে। শরীর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে, লম্বাও লাগছে অনেক। তার চেয়ে বড় কথা আব্রাহামকে ক্লিন শেইভে দেখতে অন্যরকম লাগছে। চমচম দেখল আব্রাহাম মিটিমিটি হাসছে। চমচমের ভীষণ ল’জ্জা লাগছিল। আব্রাহামকে অন্যরকম লাগছে। এক নতুন পুরুষ মনে হচ্ছে তাকে। চমচম চোখ সরিয়ে নেয়। ফাতেমা বেগম বললেন,

-‘কিরে ওকে চিনতে পারছিস না? ও আব্রাহাম। তোর হাম ভাইয়া।’

চমচম বহু ক’ষ্টে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,

-‘ওহ!’

তারপর আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘ভালো আছেন ভাইয়া?’

আব্রাহামের মুখের হাসি মুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেল। চমচম কি মাত্র তাকে আপনি করে বলেছে?

#চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে